পার্থ প্রতীম দাস
প্রথম প্রান্তিকের প্রবণতা বিশ্লেষণ
ভুল তথ্য: রাজনীতিতে কমল, খেলা-ধর্মে বাড়ল
পার্থ প্রতীম দাস
২০২৪ সালের শুরুতেই বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। গত ৭ জানুয়ারির এই নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশে রাজনীতি সংক্রান্ত ভুল ও অপতথ্যের বিস্তার বাড়তে দেখা গিয়েছিল। তবে নির্বাচন শেষ হওয়ার পর রাজনীতির পালে ভাটা নেমেছে, আর জোয়ার এসেছে খেলা ও ধর্মীয় ভুল তথ্যে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিক, অর্থাৎ, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে, বাংলাদেশ সংক্রান্ত আটটি ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
এই সময়ের মধ্যে, ডিসমিসল্যাব উল্লিখিত ওয়েবসাইটগুলো থেকে মোট ১০২৮টি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন নথিভুক্ত করেছে। কোনো বিষয়ে একাধিক যাচাই প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তাদের একটিকে স্বতন্ত্র বা ইউনিক হিসেবে ধরে নিয়ে বিশ্লেষণটি করা হয়েছে। এভাবে স্বতন্ত্র ভুল তথ্যের বিষয় পাওয়া গেছে ৬৫৬টি, যা আগের প্রান্তিক, অর্থাৎ গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসের তুলনায় সামান্য কম।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, যাচাই হওয়া ভুল তথ্যের মধ্যে প্রতি চারটিতে একটিই রাজনীতি সংক্রান্ত। সংখ্যায় অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় বেশি হলেও, ভুল তথ্যের মোট সংখ্যায় রাজনীতির ভাগ আগের প্রান্তিক, অর্থাৎ গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসের তুলনায় অনেক কমেছে। ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে মোট ভুল তথ্যের ৪৫ শতাংশই ছিল রাজনীতি সংক্রান্ত। এবছরের প্রথম প্রান্তিকে সেই সংখ্যাটি নেমে এসেছে ২৫ শতাংশে। আর সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে খেলা ও ধর্ম বিষয়ক ভুল তথ্য, যেখানে বাংলাদেশ ও ভারতের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট লিগ (বিপিএল ও আইপিএল) এবং রাম মন্দির বিতর্ক বড় ভূমিকা রেখেছে।
আগের মতোই, ২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকেও সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে ভিডিওর মাধ্যমে এবং এর পরেই ভুল তথ্য প্রচারের প্রধান মাধ্যম ছিল, ছবি। তবে রাজনৈতিক ভুল তথ্য কমার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাফিক কার্ড ব্যবহার করে ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রবণতাও কমতে দেখা গেছে উল্লেখযোগ্য হারে।
সার্বিক প্রবণতা
চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে যাচাই হওয়া ভুল তথ্যের পরিমাণ আগের বছরের শেষ প্রান্তিকের তুলনায় শতকরা ৫ ভাগ কম ছিল। বলে রাখা ভালো, এই প্রান্তিকে দৈনিক আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনগুলোকে এই ডেটাবেসে যুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ, তথ্যের উৎস বাড়ার পরও যাচাই হওয়া ভুল তথ্যের সংখ্যা গত বছরের শেষ প্রান্তিকের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে কম ছিল।
বিষয়বস্তুর বিচারে গত তিন মাসে রাজনীতি বিষয়ক ভুল তথ্য নিয়ে যাচাই প্রতিবেদনের পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি। স্বতন্ত্র যাচাই প্রতিবেদনের ২৫ ভাগের বিষয় ছিল রাজনীতি। তালিকায় এর পরই আছে খেলাধুলা (১৭%) ও ধর্ম (৯%)। মোট ভুল তথ্যের শতাংশ হিসেবে ধর্ম সংক্রান্ত ভুল তথ্যের পরিমাণ আগের প্রান্তিকের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন হয়েছে।
আগের সময়গুলোতে, রাজনীতির বাইরে দুর্যোগ নিয়ে প্রচুর ভুল তথ্য পাওয়া যেত। বিশেষভাবে বিভ্রান্তিকর ও পুরোনো ছবি-ভিডিওর ব্যবহার হতো সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায়। কিন্তু গত প্রান্তিকের তুলনায় এই প্রান্তিকে এ ধরনের ভুল তথ্য খুব কমই দেখা গেছে।
ভুল তথ্যের জগতে নির্বাচনের প্রভাব
ভুল বা অপতথ্যের বিস্তারে নির্বাচন মৌসুমের ভূমিকা ডেটায় বেশ স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। যেমন, গত বছরের শেষ প্রান্তিকে, অর্থাৎ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে, যত ভুল তথ্য যাচাই হয়েছে তার শতকরা ৪৫ শতাংশই ছিল রাজনীতি নিয়ে, যেটি নির্বাচনের পরের প্রান্তিকে নেমে এসেছে মোটের ২৫ শতাংশে।
আবার, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে যত রাজনীতিবিষয়ক ভুল তথ্য এসেছে তার প্রায় দুই-তৃতীয়াশংই ছিল জানুয়ারি মাসে, অর্থাৎ, ভোটের মাসে। এই প্রবণতা ফেব্রুয়ারি থেকে কমতে শুরু করে। মার্চ মাসে এটি ছিল গত ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম।
জানুয়ারিতে নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের মিথ্যা ঘোষণা, নির্বাচনকে সফল দেখানো বা নির্বাচনে কারচুপি প্রমাণের চেষ্টা, নির্বাচনের প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন অথবা সমালোচনা – একেক পক্ষ একেক ধরনের ভাষ্য তুলে ধরতে গিয়ে ভুয়া খবর ছড়িয়েছে। নির্বাচন-কেন্দ্রিক ভুয়া তথ্যের ধরন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন ডিসমিসল্যাবের এই বিশ্লেষণ।
বেড়েছে খেলাধুলা সংক্রান্ত ভুল তথ্য
২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে রাজনীতির পর সবচেয়ে বেশি ছড়াতে দেখা গেছে খেলাধুলা সংক্রান্ত ভুল তথ্য। এটি ছিল মোট ভুল তথ্যের ১৭ শতাংশ। গত বছরের শেষ প্রান্তিকে যাচাই হওয়া মোট ভুল তথ্যের ১৪ শতাংশ ছিল খেলাধুলা সংক্রান্ত।
গেল প্রান্তিকে প্রতি মাসেই খেলাধুলা সংক্রান্ত ভুল তথ্যের পরিমাণ বেড়েছে। জানুয়ারিতে এমন ভুল তথ্য ছড়িয়েছে ১৭টি। মার্চ মাসে পরিমাণ তার চেয়েও প্রায় চারগুন (৬২) বেড়েছে।
খেলাধুলা সংক্রান্ত এসব ভুল তথ্যের সিংহভাগই ছিল বাংলাদেশ ও ভারতের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট লিগ, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) এবং ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) সংক্রান্ত। বিরাট কোহলি, এইডেন মার্করাম বা ট্রেন্ট বোল্টের মতো তারকা ক্রিকেটারেরা বিপিএলের বিভিন্ন দলের হয়ে খেলতে আসছেন, অথবা বাংলাদেশের ক্রিকেটারেরা আইপিএলের বিভিন্ন দলের হয়ে খেলতে যাচ্ছেন (১, ২, ৩) —এমন দাবিতে ছড়াতে দেখা গেছে বেশ কিছু ভুয়া তথ্য। এছাড়াও, বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্রিকেটারের ছবি-ভিডিও সম্পাদনা করে জুয়ার অ্যাপের প্রচার-প্রচারণা নিয়েও প্রকাশিত হয়েছে বেশ কয়েকটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন (১, ২, ৩)।
অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার ডেভিড ওয়ার্নার, বাংলাদেশের ক্রিকেটার মুস্তাফিজুর রহমানের প্রশংসা করছেন, শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটার লাসিথ মালিঙ্গা বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক বক্তব্য দিচ্ছেন, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রিকেটার অ্যাডাম গিলক্রিস্ট পাকিস্তানের ক্রিকেট দল নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন— এ ধরনের ভুয়া উদ্ধৃতিও খেলাধুলা সংক্রান্ত ভুল তথ্যের অন্যতম বিষয় হিসেবে আসতে দেখা গেছে।
আলোচনায় বাবরি মসজিদ ও রাম মন্দির
২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে রাজনীতি ও খেলাধুলার পর সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে ধর্ম সংক্রান্ত ভুয়া তথ্য, যার অন্যতম বিষয় ছিল ভারতে নব-নির্মিত রাম মন্দির প্রসঙ্গ। মোটের শতাংশ হিসেবে গত বছরের শেষ প্রান্তিকের তুলনায় ধর্মীয় অপতথ্য বা ভুল তথ্য বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
এ বছরের ২২ জানুয়ারি ভারতের অযোধ্যায় এই রাম মন্দির উদ্বোধন করা হয়। একই স্থানে আগে ছিল বাবরি মসজিদের অবস্থান, যেটি ভেঙে ফেলা হয়। এ নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরেই উপমহাদেশে একটি সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব, অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায়।
এ ধরনের ভুল তথ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল অন্য কোনো জায়গার মন্দির বা মসজিদকে রাম মন্দির বা বাবরি মসজিদ হিসেবে প্রচার। যেমন দিল্লির অক্ষরধাম মন্দির বা বৃন্দাবনের প্রেম মন্দিরের ছবি-ভিডিওকে রাম মন্দির হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একইভাবে ভারতের কর্ণাটকের কালাবুরাগি অঞ্চলের একটি মসজিদ বা নয়াদিল্লীর ফিরোজ শাহ কোটলা এলাকার একটি মসজিদের ছবিকে প্রচার করা হয়েছে বাবরি মসজিদ হিসেবে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে অযোধ্যায় যে নতুন একটি মসজিদ নির্মানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটি নির্মানের জন্য ব্রিটিশ ধনকুবের আসিফ আজিজ বা পর্তুগালের তারকা ফুটবলার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো অর্থসাহায্য দিয়েছেন— এমন দাবিতেও ছড়াতে দেখা গেছে কিছু ভুয়া তথ্য।
১২ মার্চ থেকে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র রমজান মাস শুরুর পর থেকে রোজা রাখা বা ইফতার আয়োজন সংক্রান্ত কিছু ভুয়া তথ্যও প্রচারিত হতে দেখা গেছে। যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইফতার আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, ভারতে রোজা রাখা ও তারাবির নামাজ পড়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে, বা ভারতের ক্রিকেটার বিরাট কোহলি ইফতারের জন্য মসজিদে ১০ কোটি টাকা দান করেছেন।
ভিডিওর মাধ্যমে ভুল তথ্য ছড়িয়েছে বেশি
বাংলাদেশে প্রধানত ভিডিও ও ছবির মাধ্যমে ভুয়া তথ্য বেশি ছড়াতে দেখা যায়। এবছরের প্রথম প্রান্তিকেও এই দুই মাধ্যমের আধিক্য ছিল। তবে ভিডিওর মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ভুয়া তথ্য ছড়ালেও গত প্রান্তিকের তুলনায় এবারের প্রান্তিকে ভিডিওর মাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর হার কমেছে ২০ শতাংশ। অন্যদিকে ছবির মাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর হার বেড়েছে ৩০ শতাংশ।
ভিডিওর মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ভুয়া তথ্য ছড়াতে দেখা গেছে ফেসবুকে। ভিডিওর মাধ্যমে ছড়ানো মোট ভুল তথ্যের ৪০ শতাংশই ছিল ফেসবুকে। অন্যদিকে ইউটিউব ও টিকটকে ছড়িয়েছে যথাক্রমে ৩০ ও ২৯ শতাংশ ভুল তথ্য।
এবছরের প্রথম প্রান্তিকে উল্লেখযোগ্য হারে কমতে দেখা গেছে গ্রাফিক কার্ডের মাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর হার। গত প্রান্তিকের তুলনায় গ্রাফিক কার্ডের মাধ্যমে ভুল তথ্য ছড়ানোর হার কমেছে ৪৭ শতাংশ।
সাধারণত রাজনৈতিক ভুল তথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে গ্রাফিক কার্ডের ব্যবহার বেশি দেখা যায়। ২০২৩ সালে গ্রাফিক কার্ডের মাধ্যমে যত ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছিল– তার ৪৮ শতাংশই ছিল রাজনীতি সংশ্লিষ্ট। এবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজনৈতিক ভুল তথ্য কমার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাফিক কার্ডের মাধ্যমেও ভুল তথ্য ছড়ানোর হার কমেছে।