যাচাই পদ্ধতি

যাচাই পদ্ধতি

ডিসমিসল্যাব ফ্যাক্টচেক করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট চেকিং নেটওয়ার্ক (আইএফসিএন)-এর নীতিমালা অনুসরণ করে। 

১) তথ্য যাচাইয়ের জন্য দাবি নির্বাচন: আমরা সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের চলমান ঘটনাপ্রবাহ, সংবাদমাধ্যমের খবরাদি এবং সামাজিক মাধ্যমের ভাইরাল হওয়া, বিতর্কের জন্ম দেওয়া এবং গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট মনিটর করি। এসব কন্টেন্টের মধ্যে সন্দেহজনক তথ্য-ছবি-ভিডিওকে আমরা যাচাই করে সেটির ঠিক-বেঠিক পাঠককে জানানোর চেষ্টা করি।

কোন দাবিটি যাচাইয়ের জন্য নির্বাচন করা হবে– সেটি নির্ভর করে কিছু প্রশ্নের উত্তরের ওপর। প্রশ্নগুলো হচ্ছে, ছড়ানো দাবিটি কোনো ইম্প্যাক্ট বা প্রভাব রাখছে কিনা? এটি খুব বেশি মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে কিনা? এটি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠির প্রতি হুমকি তৈরি করছে কিনা? দাবিটি বাস্তব জীবনে মানুষের, বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত দুর্বল জনগোষ্ঠির ক্ষতি করার শঙ্কা আছে কিনা?

এসব প্রশ্নের এক বা একাধিকের উত্তর ‘হ্যাঁ’ বোধক হলে আমরা সেই দাবিটিকে যাচাই করে দেখার জন্য নির্বাচন করি।

২) দাবির মূল উৎস খুঁজে বের করা: একটি দাবিকে যাচাইয়ের জন্য বেছে নেওয়ার পর, আমরা দাবিটির মূল উৎস কোথায় তা খুঁজি। অর্থাৎ, সর্বপ্রথম কে কোথায় কখন এই দাবিটি করেছেন সেটি খুঁজে দেখার চেষ্টা করি। এতে প্রায়শই মূল উৎসের নির্ভরযোগ্যতা একটি দাবির সত্যাসত্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

উদাহরণস্বরূপ, কোনো খবরে উল্লিখিত তথ্য যাচাই করার সময় আমরা ওই সংবাদমাধ্যম যে উৎস থেকে খবরটি নিয়েছে সেটি খুঁজে বের করি এবং সেটির নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করে দেখি।

কোনো ছবি বা ভিডিও যাচাইয়ের ক্ষেত্রে সেটি অনলাইনে কবে প্রথম প্রকাশ করা হয়েছে, কে প্রকাশ করেছে এবং তখন কী তথ্য এটির সাথে যুক্ত ছিল– সেগুলো খুঁজে বের করি। এসব কাজে আমরা বিভিন্ন ওপেন সোর্স টুলের ব্যবহার করে থাকি।

কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে ছড়ানো তথ্যের ক্ষেত্রে আমরা ব্যক্তির নির্ভরযোগ্যতা, তার তথ্য প্রাপ্তির প্রক্রিয়া, তার তথ্যের উৎস, সেই তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের সাথে তার স্বার্থ বা উদ্দেশ্য খুঁজে দেখার চেষ্টা করি।

৩) উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ: দাবির উৎস যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হয়ে থাকে তাহলে আমরা বিস্তারিত জানতে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করি। মূল দাবিটি আসলে কেমন ছিল এবং কোন প্রেক্ষাপটে করা হয়েছে তা জানার জন্য আমরা ভিডিও প্রমাণ বা প্রকাশ্যে উপলব্ধ ট্রান্সক্রিপ্ট জোগাড়ের চেষ্টা করি। রিপোর্ট বা ডেটা পয়েন্টের ক্ষেত্রে, আমরা এমন সংস্থার সাথে যোগাযোগ করি, যারা সেই প্রসঙ্গে কন্টেন্টগুলির সন্ধান দিতে পারে।

৪) দাবির সঠিকতা নির্ধারণে প্রমাণ ও তথ্য সংগ্রহ: মূল উৎস অনুসন্ধান এবং সেটির সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যকে যাচাইয়ের জন্য আমরা স্বাধীন বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রমাণাদি, নথিপত্র, রেকর্ড, ছবি, ভিডিও সংগ্রহ করে থাকি। অনেক ক্ষেত্রে জরিপ, রেকর্ড বা গবেষণালব্ধ তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমরা জরিপ বা গবেষণা পরিচালনাকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা, নিরপেক্ষতা, পেশাদারিত্ব, গবেষণার মেথডোলোজির সঠিকতা, স্বার্থগত দ্বন্দ্ব ইত্যাদি বিষয় আমলে নিই। এসব বিষয়ে ঘাটতি থাকা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের করা জরিপ/গবেষণা/রেকর্ড আমরা প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করি না।

সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণের বিপরীতে আমরা নির্বাচিত দাবিটিকে মিলিয়ে দেখি এবং প্রমাণাদি নিজেই দাবিটিকে ঠিক বা বেঠিক বলে নির্ধারণ করে।

৫) বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও বক্তব্য: দালিলিক প্রমাণের বাইরেও আমরা প্রায়ই কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের জ্ঞানের উপর নির্ভর করি। আমরা অজ্ঞাত সূত্রের বরাতে প্রাপ্ত কোনো তথ্যকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করি না। শুধুমাত্র যারা স্বপরিচয়ে অন দ্য রেকর্ড কথা বলতে ইচ্ছুক তাদের উদ্ধৃত করি। বিশেষজ্ঞ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যক্তির গ্রহণযোগ্যতা, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে তার জ্ঞানের গভীরতা, নিরপেক্ষতা এবং স্বার্থগত দ্বন্দ্বের বিষয়গুলো আমরা বিবেচনায় রাখি।

৬) ফ্যাক্টচেক কন্টেন্ট লেখা: উপরের পর্যায়গুলো অতিক্রম করে আমাদের প্রাপ্ত প্রমাণাদি এবং সেগুলোর ভিত্তিতে একটি সিদ্ধান্ত তুলে ধরতে একটি ফ্যাক্ট চেকিং কন্টেন্ট রচনা করি। আমাদের কন্টেন্টগুলিতে উল্লেখ্য সুত্রের লিংক প্রদান করি। কোনো নথিপত্র থাকলে সেগুলো যুক্ত করি। এবং কোন প্রমাণ আমরা কিভাবে সংগ্রহ করেছি সেটিও কন্টেন্টে উল্লেখ করা থাকে। এতে পাঠকের নিজের পক্ষ থেকেও প্রয়োজনে তথ্যটি যাচাই করে নেয়ার সুযোগ থাকে।

৭) লেবেলিং: আমাদের ফ্যাক্ট চেক কন্টেন্টে যাচাই করা দাবির বিষয়ে চার ধরনের সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকি।

  • বেঠিক: অর্থাৎ, এই দাবিটি ভুল বা অসত্য।
  • বিকৃত: ছবি বা ভিডিওকে যদি সম্পাদনার মাধ্যমে বদলে ফেলা হয় তাহলে আমরা ‘বিকৃত’ বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছাই।
  • বিভ্রান্তিকর: কোনো দাবি পুরোপুরি অসত্য নয় আবার পুরোপুরি সত্যও নয়। বা দাবিটির সাথে আরও কোনো তথ্য যুক্ত না করলে মানুষের বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। অথবা সঠিক তথ্যই ভিন্ন প্রেক্ষিতে ব্যবহারের কারণে মানুষ বিভ্রান্ত হতে পারে- এমন ক্ষেত্রে আমরা ‘বিভ্রান্তিকর’ অভিধাটি ব্যবহার করি।
  • অপ্রমাণিত: প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে অথবা প্রমাণের অভাবে কোনো দাবির ঠিক-বেঠিক নির্ধারণ করা সম্ভব না হলে সেটিকে আমরা ‘অপ্রমাণিত’ হিসেবে পাঠকের সামনে তুলে ধরি।

আমরা কী কী ফ্যাক্টচেক করি না

ডিসমিসল্যাব প্রধানত নিজস্ব মনিটরিং টিম এবং পাঠকের পাঠানো বিভিন্ন জিজ্ঞাসা থেকেই তাদের ফ্যাক্টচেকের বিষয়াদি নির্ধারণ করে থাকে। মূলত দুটি প্রশ্নকে সামনে রেখে আমরা যাবতীয় ফ্যাক্টচেক করে থাকি। 

১- ছড়িয়ে পড়া দাবিটির প্রভাব কেমন।

২- দাবিটি কী পরিমাণ ছড়িয়েছে। 

তবে ফ্যাক্টচেকের কর্মপদ্ধতি এবং সীমাবদ্ধতাকে ধর্তব্যে নিয়ে আমরা অনেক বিষয়ের সঠিকতা যাচাইয়ে বিরত থাকি। আমরা যে সব বিষয় ফ্যাক্টচেক করি না:

১. যত গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেন, আমরা রাজনৈতিক মন্তব্য বা মতামত ফ্যাক্টচেক করি না, যদি না তাতে যাচাইযোগ্য ফ্যাক্ট থাকে। রাজনীতিবিদদের বক্তব্য বা দাবি কেবল তখন যাচাইযোগ্য হবে, যখন তাতে কোনো প্রতিষ্ঠান বা উৎসের বরাতে কোনো তথ্য বা পরিসংখ্যানের উল্লেখ থাকবে।

২. ধর্মীয় বিশ্বাস সংক্রান্ত কোনো বক্তব্য বা দাবি আমরা যাচাই করি না। তবে বক্তব্যে কোনো উৎসের বরাত থাকলে এবং সেটি যাচাইযোগ্য বলে নির্ধারণ হলে আমরা সেটি যাচাই করি।  

৩. ভবিষ্যৎসূচক কোনো বক্তব্য বা তথ্য আমরা যাচাই করি না। ওমুক দিন কিছু একটা ঘটবে বা এর প্রভাবে এরকম কিছু হতে পারে – এধরনের ব্যক্তিমত, কলাম, সামাজিক মাধ্যমের পোস্ট, পূর্বাভাস বা অতিপ্রাকৃত ভবিষ্যদ্বানী (ভুল হলেও) যাচাইযোগ্য নয়। তবে সেসব কলাম বা পোষ্টে অন্য কোনো তথ্য বা উপাত্তের উৎসের বরাত থাকলে সেটি আলাদাভাবে যাচাই করতে পারি। এছাড়া ভবিষ্যৎসূচক তথ্যের ক্ষেত্রে সেটি সঠিক সূত্রসহ ব্যবহৃত বা প্রচারিত হচ্ছে কিনা সেটি আমরা পরখ করতে পারি। 

৪. ফ্যাক্টচেকিং-এর সাথে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কিংবা বিশেষজ্ঞ গবেষণার ফারাকগুলোকে আমরা যৌক্তিক মনে করি। ফলে যেকোনো দাবি বা ক্লেইম যদি ‘ওপেন সোর্স’ অনুসন্ধানের বাইরে সাংবাদিক কর্তৃক দীর্ঘ অনুসন্ধান কিংবা বিশেষজ্ঞদের বিশদ গবেষণার দাবি রাখে, তাহলে সেসব দাবিকে আমরা ফ্যাক্টচেক বা যাচাই করা থেকে বিরত থাকি।

৫. অনেক সময় অনেক তথ্যে সূত্রের উল্লেখ থাকলেও — এবং তা আপাতদৃষ্টিতে ভুল বলে মনে হলেও – তা যাচাই করা হয় না, কারণ স্বাধীনভাবে সেই উৎসের কাছে পৌঁছানো বা তাদের মত জানা সম্ভব হয় না।

৬. কোনো ভুয়া তথ্য বা অপতথ্য দেখামাত্রই আমরা সেটা ফ্যাক্টচেক করি না। যখন সেটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার উপক্রম হয় এবং মানুষের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখনই আমরা সেটি যাচাই করি। কারণ, একটি ভুয়া তথ্য ছড়ানোর আগে ফ্যাক্টচেক করার মাধ্যমে, বরং ভুয়া তথ্যটিকে আরও ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয় বলে আমরা মনে করি। 

৭. এমন ক্ষেত্রে ডিসমিসল্যাবের সম্পাদকীয় সিদ্ধান্ত-ই চূড়ান্ত।