স্টিভ সালগ্রা রেমা

ফেলো, ডিসমিসল্যাব
অযোধ্যা মসজিদ নির্মাণে ব্রিটিশ ধনকুবেরের টাকা দানের দাবিটি ভিত্তিহীন
This article is more than 2 months old

অযোধ্যা মসজিদ নির্মাণে ব্রিটিশ ধনকুবেরের টাকা দানের দাবিটি ভিত্তিহীন

স্টিভ সালগ্রা রেমা
ফেলো, ডিসমিসল্যাব

ভারতের উত্তরপ্রদেশে বাবরি মসজিদ মামলার রায় অনুসারে মসজিদ নির্মাণে সহায়তার জন্য ব্রিটিশ ধনকুবের আসিফ আজিজ পাঁচ হাজার কোটি টাকা দান করেছেন, এমন একটি দাবি সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়াতে দেখা গেছে। তবে যাচাইয়ে দেখা যায়, তথ্যটি সঠিক নয়। আসিফ আজিজ পরিচালিত দাতব্য সংস্থার ওয়েবসাইটে এমন কোনো অনুদানের তথ্য পাওয়া যায়নি। মসজিদ নির্মাণের দায়িত্বে থাকা সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যান জুফর আহমদ ফারুকী-ও অনুদানের দাবিটি ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, এক্স (পূর্ববর্তী টুইটার) ও ফেসবুকে সম্প্রতি ভারত সরকারের প্রস্তাবিত অযোধ্যা মসজিদের সম্ভাব্য নকশার সঙ্গে ব্রিটিশ ধনকুবের আসিফ আজিজের ছবি যুক্ত করে বিভিন্ন পোস্ট (, , , , , , , , ) প্রচারিত হতে দেখা যায়। 

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি একটি ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা ফেসবুক রিলে লেখা হয়েছিল: “মাশাল্লাহ ইনি আমাদের ভাই আসিফ আজিজ, তিনি লন্ডনের বাসিন্দা। তিনি অযোধ্যায় মসজিদ নির্মাণের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা দিয়েছেন। মাশাল্লাহ।” এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত ভিডিওটির ভিউ ছিল ৩.৩ মিলিয়ন। ভিডিওটিতে এক লাখ ২১ হাজার লাইকের পাশাপাশি কমেন্ট ছিল ৪০১টি। পোস্টটি শেয়ার করা হয়েছে সাত হাজারের বেশিবার। ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টটি ঘুরে দেখা যায় ভারতীয় অভিনেতা আমির খান এ মসজিদের জন্য ২৫ কোটি এবং ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ৪৫ কোটি অর্থ দান করেছেন দাবি করে যথাক্রমে ২৬ ফেব্রুয়ারি ও ২৪ ফেব্রুয়ারি একই ধরনের আরও দুটি ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে। তবে এ দাবিগুলোর কোনোটিরই সত্যতা পাওয়া যায়নি।

ফেসবুকেও গত ২৭ ফেব্রুয়ারি এক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “আসিফ আজিজ, লন্ডনে সবথেকে বিলাসবহুল রাজকীয় বাড়িটি ২২ হাজার কোটি টাকা দিয়ে ক্রয় করে মাসজিদ এবং ইসলামিক সেন্টারের জন্য দান করে দেন, এবার অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ নির্মাণের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা দান করছেন আলহামদুলিল্লাহ, আশা করা যায় এটা ভারতের সবচেয়ে বড় মসজিদ হবে ইনশাআল্লাহ।”

সামাজিক মাধ্যম এক্স (পূর্ববর্তী টুইটার)-এও এমন তথ্য ছড়িয়েছে। ২২ জানুয়ারি এক ব্যবহারকারী টুইটে লেখেন, “লন্ডনে বসবাসরত আসিফ আজিজ অযোধ্যায় একটি মসজিদ নির্মাণের জন্য ৫০০০ কোটি দান করেছেন। আপনার মহৎ কাজের জন্য আমি আপনাকে সালাম জানাই।”

যাচাইয়ে দেখা যায়, আসিফ আজিজের অযোধ্যা মসজিদে জন্য দান করা নিয়ে সবচেয়ে পুরোনো পোস্টটি দেখা যায় গত ১৭ জানুয়ারির। পোস্টটি পাওয়া যায় অল মুসলিমস ইজ ওয়ান নামের একটি ইন্সটাগ্রাম হ্যান্ডেলে। পোস্টটিতে লেখা ছিল, “সম্প্রতি আসিফ আজিজ অযোধ্যা মসজিদের জন্য ৫,০০০ কোটি রুপি অনুদান দিয়েছেন এবং তিনি প্রত্যেক মসজিদে ইট দান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রতিটি ইটে একটি চিপ ও তার নাম লেখা থাকবে, যেগুলো ২০০ বছর ধরে টিকে থাকার পরেও অবিকৃত থাকবে যাতে অন্য ধর্মের লোকেরা এগুলো জব্দ করতে না পারে। আল্লাহ পাক আসিফ আজিজ ভাইকে সবসময় খুশি রাখুক এবং তার ক্যারিয়ারে মঙ্গল করুন”।

পরবর্তীতে কয়েকটি ভারতীয় ইউটিউব চ্যানেল (, ) ও একটি ফেসবুক পেজ থেকেও এমন দাবি সম্বলিত পোস্ট করা হয়। তবে মূলধারার কোনো গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত খবর প্রচারিত হতে দেখা যায়নি।

কে এই আসিফ আজিজ?

দ্য মুসলিম ৫০০-এর তথ্যানুসারে, আসিফ আজিজ লন্ডনের একজন বিলিয়নিয়ার এবং সমাজসেবী। পূর্ব আফ্রিকার দেশ মালাউই-তে ১৯৬৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ক্রাইটেরিয়ন ক্যাপিটাল-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠান আজিজ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা। ফাউন্ডেশনটি ব্রিটিশ মুসলিমদের উচ্চশিক্ষার বিস্তারে কাজ করে আসছে। ডিসমিসল্যাবের পক্ষ থেকে আজিজ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো উত্তর পাওয়া না গেলেও তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে মসজিদে অনুদান সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

অযোধ্যায় মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ মসজিদ বা অযোধ্যা মসজিদ নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে উত্তর প্রদেশের মুসলিম সুন্নি কেন্দ্রীয় ওয়াকফ বোর্ডকেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিল-এর ওয়েবসাইট থেকে এই বোর্ডের চেয়ারম্যান জুফর আহমদ ফারুকীর ইমেইল সংগ্রহ করে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডিসমিসল্যাবকে জানান, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া আসিফ আজিজের দান সংক্রান্ত দাবিটি মিথ্যা। তিনি বলেন, “এটা একেবারেই মিথ্যা। আসিফ আজিজের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা রেখে বলছি আমরা এখনও কোনো অনুদানের জন্য তার কাছে যাইনি, তাই তার কাছ থেকে কোনো অনুদান পাওয়ার প্রশ্নই আসে না।” তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা ভারতের বাইরে থেকে তহবিল পাওয়ার জন্য এবং সরকারি অনুমতির জন্য আবেদন করার প্রক্রিয়ায় আছি। আবেদন করার পর এবং অনুমতি পাওয়ার পরই কেবল আমরা বিদেশ থেকে অনুদান পেতে পারব।”

তবে ধনকুবের আসিফ আজিজকে নিয়ে ছড়ানো বেঠিক তথ্য এটিই প্রথম নয়। এর আগেও তার নামে লন্ডনে একটি পুরোনো স্থাপনার অংশকে মসজিদে রূপান্তর করার ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। আসিফ আজিজ লন্ডনের ট্রোকাডেরো বিল্ডিংটিকে একটি মসজিদে রূপান্তর করেছেন, এই দাবিটিও সঠিক নয়।

বার্তা ভারতী নামের ভারতীয় একটি সংবাদমাধ্যমও তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, “এখন পর্যন্ত, অযোধ্যা মসজিদে আসিফ আজিজের অনুদানের দাবির সমর্থনে কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই। এই তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত না হওয়া থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, এ সংক্রান্ত দাবিগুলো অনুমান করা হচ্ছে বা সেগুলো ভুল হতে পারে।” 

উল্লেখ্য যে, মোগল সম্রাট বাবরের সেনাপতি মীর বাকি ১৫২৮ সালে অযোধ্যায় একটি মসজিদ তৈরি করেন, যা পরবর্তীতে বাবরি মসজিদ নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৯২ সালে কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের হামলায় মসজিদটি ধ্বংস হলে উপমহাদেশজুড়ে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বিতর্কিত এই জমির মালিকানার রায়ে মন্দিরের জন্য জায়গাটি বরাদ্দ দেয়। একই রায়ে উত্তর প্রদেশের সুন্নি কেন্দ্রীয় ওয়াকফ বোর্ডকে বলা হয়, অযোধ্যায় মসজিদ নির্মাণের জন্য তাদের পাঁচ একর জমি দেওয়া হবে, যেখানে তারা নতুন করে একটি মসজিদ নির্মাণ করতে পারবে। 

গত ২২ জানুয়ারি নবনির্মিত রামমন্দিরটি উদ্বোধন করা হয়। অন্যদিকে সুপ্রীম কোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে অযোধ্যা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে ধান্নিপুর গ্রামে বরাদ্দকৃত স্থানে নির্মিত হতে যাচ্ছে মসজিদ মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ। চলতি বছরের মে মাসে নতুন মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।


তথ্য অনুসন্ধানে সহায়তা করেছেন ডিসমিসল্যাব ফেলো নীতি চাকমা।

আরো কিছু লেখা