তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
পাকিস্তানের ভিডিও ব্যবহার করে সামাজিক মাধ্যমে বরিশালের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার গুজব
This article is more than 3 months old

পাকিস্তানের ভিডিও ব্যবহার করে সামাজিক মাধ্যমে বরিশালের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার গুজব

তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে সম্প্রতি এক নারীর আহাজারির ভিডিও (, ) পোস্ট করে দাবি করা হয়, ভিডিওটি গত বছর বাংলাদেশের বরিশাল জেলার গৌরনদীতে মুসলমানদের হামলার শিকার একটি হিন্দু পরিবারের। যাচাইয়ে দেখা যায়, মূলত এটি ভারতে ছড়িয়েছে এবং ভিডিওটি পাকিস্তানের। ২০২২ সালে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের কিশোরী খুন হওয়ার পর তার পরিবারের আহাজারির দৃশ্যর ভিডিও এটি। সম্প্রতি বরিশালের নির্বাচনী সহিংসতা নিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলার গুজব ছড়ানোর পর হিন্দি ভাষায় প্রায় একই দাবির সঙ্গে পাকিস্তানের ভিডিওটি ছড়ায়।

গত ২ মে বাংলাদেশের বরিশালের গৌরীনদীতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবারের সদস্যদের বক্তব্যের একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার দিয়ে হিন্দি ভাষার ক্যাপশনে একে সাম্প্রদায়িক হামলা বলে দাবি করা হয়। ঘটনাটি সাম্প্রদায়িক ছিল না এমন তথ্য ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনেও উঠে আসে। এ বিষয়টি যাচাই করতে গিয়ে দেখা যায়, সাম্প্রদায়িক হামলা বলে দাবি করা হিন্দি ভাষার একই ক্যাপশন যুক্ত করে পাকিস্তানের একটি পুরোনো ভিডিও ছড়ানো হয়েছে। এতে দাবি করা হয় যে, গত বছর বরিশালের গৌরনদীতে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক পরিবারের উপর মুসলিমরা হামলা চালায়। ডিসমিসল্যাব যাচাইয়ে দেখেছে, এটি পাকিস্তানের ভিডিও। আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডিসমিসল্যাব পাকিস্তানের এক সাংবাদিক ও একজন ফ্যাক্টচেকারের সঙ্গেও কথা বলেছে। দ্য সেন্টার ফর সোশ্যাল জাস্টিস পাকিস্তান তাদের অনুসন্ধানের পর নিশ্চিত করেছে যে ভিডিওটিতে কিশোরী পুজার পরিবারকে দেখা যাচ্ছে।

বরিশালের নির্বাচনী সহিংসতাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ হিসেবে প্রচার 

বরিশালের নির্বাচনী সহিংসতার ভিডিওটিতে হামলার শিকার ব্যক্তির এক স্বজনকে বলতে শোনা যায়: “উপজেলা নির্বাচন নিয়া সব ঝামেলা। ওরা মারতে পারলে পদ ক্লিয়ার। গেছেবার ইউনিয়ন পরিষদের যে নির্বাচন হইসে তখন অ্যাকসিডেন্ট করছে, মানে গাড়ি দিয়া ওর অ্যাকসিডেন্ট করাইসে।” 

তবে ভিডিওটির সঙ্গে হিন্দিতে যে ক্যাপশন পাওয়া গিয়েছে তাতে এই কথাগুলো নেই। 

হিন্দিতে লেখা ক্যাপশন এই রকম: “এই হৃদয় বিদারক বিলাপ বাংলাদেশের একটি হিন্দু পরিবারের। সেখানে বরিশাল জেলার গৌরীনদীতে একটি হিন্দু পরিবার মুসলমানদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। 

ইসলামি দেশ পাকিস্তানে হিন্দুদের হত্যা করা হচ্ছে। 

ইসলামি দেশ বাংলাদেশে হিন্দুদের হত্যা করা হচ্ছে

ভারতেও হিন্দুদের হত্যা করা হচ্ছে।”

একই দিন একই ধরনের ক্যাপশন ব্যবহার করে বাংলাদেশের বরিশালের ঘটনা দাবি করে সামাজিক মাধ্যমে ভিন্ন একটি ভিডিও (, ) ছড়াতে দেখা যায়। 

এই ভিডিওটির ক্যাপশনে লেখা ছিল: “এই হৃদয় বিদারক বিলাপ বাংলাদেশের একটি হিন্দু পরিবারের। বরিশাল জেলার গৌরনদীতে গত বছর হিন্দু পরিবারের ওপর মুসলিমরা হামলা চালায়। ইসলামের দৃষ্টিতে কাফেরদের ওপর অত্যাচার করা পুণ্যের কাজ। আল্লাহর কাছে নাম্বার পাওয়া যায়। এমনটাই লেখা আছে আর বলা হয়। এর ফলাফল দেখুন।” পাকিস্তান, বাংলাদেশ, এমনকি ভারতেও হিন্দুদের হত্যা করা হচ্ছে এমন মন্তব্য করে আরো লিখা হয়: “এর জন্য কংগ্রেস দায়ী, সেইসব ধার্মিক যারা ধর্মের সহাবস্থান করতে পারে না এমন ধর্মীয় লোকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে; মুসলিমরা আলাদা ভূমির দাবি করে দেশভাগ করেছিল”।

ঠাকুর প্রকাশ সিং সনাতন হিতকারিনি ন্যস নামের যে দুই ফেসবুক আইডি থেকে ভিডিওটি ছড়ানো দুটো প্রোফাইলেই তারা নিজেদের ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) কর্মী হিসেবে উল্লেখ করেছে।  

যাচাইয়ে ২৫ সেকেন্ডের ভিডিওটি খুঁজে পাওয়া যায় ২০২২ সালের মার্চে ভয়েজ অব পাকিস্তান মাইনোরিটি নামের টুইটার হ্যান্ডেলে। ক্যাপশনে লেখা, “অপহরণে বাধা দেওয়ায় পূজা কুমারীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে ওয়াহিদ বক্স লাশারি। অপহরণের পর তাকে জোর করে ধর্মান্তরিত ও বিয়ের পরিকল্পনা ছিল। দেখুন মেয়েটির পরিবারের অবস্থা”। 

ধর্মান্তরিত হতে অস্বীকৃতি জানানোয় পাকিস্তানে হিন্দু মেয়েকে গুলি করে হত্যা” শিরোনামে ভারতীয় গণমাধ্যম মোজো নিউজের প্রতিবেদনেও ভিডিওটি পাওয়া যায়। পাকিস্তান নিউজ নামের একটি চ্যানেলেও একই ভিডিও প্রচারিত হয়। 

বরিশালের গুজবের সঙ্গে পাকিস্তানের ভিডিও 

বাংলাদেশে হিন্দু পরিবারের ওপর নির্যাতনের দাবিতে ছড়াতে থাকা ভিডিওতে থাকা ব্যক্তিরা পূজা কুমারীর পরিবারের সদস্য কিনা জানতে পাকিস্তানি সাংবাদিক লুবনা জেরারের সঙ্গে কথা বলে ডিসমিসল্যাব।

লুবনা জেরার জানান, “ঘটনাটি ২০২২ সালের। ভয়েজ অব পাকিস্তান মাইনোরিটি এই টুইটার হ্যান্ডেলটিও বিশ্বাসযোগ্য। নির্ভরযোগ্য কিছু মানুষ একে অনুসরণ করছে। তবে হ্যান্ডেলটি পাকিস্তান থেকে বা পাকিস্তানিরা চালায় কিনা তা নিশ্চিত নয়”। 

পাকিস্তানি ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান সোচের ফ্যাক্টচেকার সামিন আজিজের সঙ্গেও কথা বলে ডিসমিসল্যাব। তিনি জানান, ২০২২ সালের ঘটনাটি সেসময় বিভিন্ন গণমাধ্যমেও আসে। 

ভিডিওটি আরও যাচাইয়ে ভাইসের একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে পূজা কুমারীর মা রাবিয়া অওদের একটি ছবি প্রকাশিত হয়। ভাইসের প্রকাশিত ছবির সঙ্গে ভিডিওতে আহাজারিরত নারীর পোশাকের মিল পাওয়া যায়। অর্থাৎ, বাংলাদেশের বরিশালের বলে ছড়ানো ভিডিওটি আসলে পাকিস্তানে নিহত হিন্দু কিশোরী পূজা কুমারীর পরিবারের।

পাকিস্তানের ডন পত্রিকার প্রতিবেদনে পূজা কুমারী হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি সম্পর্কে বলা হয়, “পুলিশ জানিয়েছে, সোমবার সুককুরের (পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের একটি শহর) ছুয়াহরা মান্ডি এলাকার কাছে হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৮ বছর বয়সী এক কিশোরীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে”।

স্থানীয় সুক্কুর স্টেশন হাউস অফিসার (এসএইচও) বশির জাগিরানির বরাতে প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, “খুনী হিসেবে ওয়াহিদ বক্স লাশারি নামে একজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। দুই সহযোগীকে নিয়ে পূজা কুমারীর বাড়িতে প্রবেশ করে লাশারি এবং তার উপর গুলি চালায়। কর্মকর্তারা জানান, লাশারি ওই কিশোরীকে বিয়ে করতে চেয়েছিল কিন্তু সে রাজি হয়নি।”

ডন ছাড়াও পাকিস্তানের এক্সপ্রেস ট্রিবিউন এবং আল-জাজিরা বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

অন্য যে ভিডিওটি একই ক্যাপশনে ছড়ানো হয়েছে তা যাচাইয়ে দেখা যায়, গত ৪ মে এটি ভারতের হিন্দু ভয়েজ নামের একটি টুইটার হ্যান্ডেলে পোস্ট করা হয়েছে। এতে লেখা হয়, “#বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। #বরিশাল জেলার গৌরনদীতে উপজেলা নির্বাচন চলাকালে ইসলামপন্থীরা গতকাল এক হিন্দুকে ছুরিকাঘাত ও মারধর করেছে।” তবে ফ্যাক্টচেকিং প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভিডিওটি বাংলাদেশের হলেও এটি কোনো সাম্প্রদায়িক হামলা ছিল না। প্রায় একই হিন্দি ক্যাপশন ব্যবহার করে ভিডিওটি আরো অনেককে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার (, ) করতে দেখা যায়। 

বাংলাদেশের ভিডিওটি যাচাইয়ে দেখা যায়, মূলত বরিশালের গৌরনদী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে মাহিলাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈকত গুহকে কুপিয়ে জখম করে প্রতিপক্ষের লোকজন। এরপর গণমাধ্যমে আসা এই ঘটনার  ভিডিও ক্লিপ ব্যবহার করে একে সাম্প্রদায়িক হামলা হিসেবে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করা হয়।

এর আগেও বাংলাদেশের বিভিন্ন ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়ে ভারতে ভুয়া খবর ছড়ানোর নজির মিলে। সম্প্রতি, বাংলাদেশের মোহাম্মদপুরে তরুণী নির্যাতনের একটি ঘটনাকে বাংলাদেশে হিন্দু তরুণীর উপর মুসলিমরা যৌন নির্যাতন চালিয়েছে দাবি করে ভারতে প্রচারিত হয়। তবে ভারতীয় ফ্যাক্টচেকাররা দাবিটি খণ্ডন করেন।

আরো কিছু লেখা