আহমেদ ইয়াসীর আবরার

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
আইনজীবী রমেন রায়কে নিয়ে দেশে-বিদেশে ভুল তথ্য প্রচার
This article is more than 1 month old

আইনজীবী রমেন রায়কে নিয়ে দেশে-বিদেশে ভুল তথ্য প্রচার

আহমেদ ইয়াসীর আবরার

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও ইসকনের সাবেক নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে ২৫ নভেম্বর শাহবাগে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি হামলার শিকার হন। এই হামলায় গুরুতর আহত হন রমেন্দ্র নাথ রায় তথা রমেন রায় নামের একজন আইনজীবী। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তিনি ঢাকার একটি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ)-তে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তবে রমেন্দ্র নাথ রায়ের উপর হওয়া এই হামলার পর সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের দাবি ছড়াতে দেখা যায়। সামাজিক মাধ্যম ও একাধিক ভারতীয় গণমাধ্যম রমেন্দ্র নাথ রায়কে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী উল্লেখ করে, এবং তার বাড়িতে হামলার দাবি করে। অন্যদিকে, রমেন্দ্র নাথ রায়ের আহত অবস্থার ছবিকে ভারতের বিহারের আইনজীবী রাধা রমণ রায়ের ছবি বলে দাবি করে বাংলাদেশের একটি গণমাধ্যম। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য হাসপাতালে আহত এই আইনজীবীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে ডিসমিসল্যাব। পরিবারের সদস্যরা নিশ্চিত করেছেন যে, রমেন্দ্র নাথকে নিয়ে ছড়ানো দাবিগুলো সঠিক নয়। 

কলকাতা ইসকনের সহ-সভাপতি ও মুখপাত্র রাধারমন দাস তার এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে ২ ডিসেম্বর পোস্ট করেন, “দয়া করে সবাই অ্যাডভোকেট রমেন রায়ের জন্য প্রার্থনা করুন। তার একমাত্র “অপরাধ” ছিল তিনি আদালতে চিন্ময় কৃষ্ণ প্রভুর পক্ষে উকালতি করছিলেন। ইসলামপন্থীরা তার ঘরে হামলা করে এবং তাকেও নৃশংসভাবে আক্রমণ করে, যার ফলে তিনি এখন আইসিউতে ভর্তি, জীবনের সাথে লড়ছেন।”  এই পোস্টে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসারত এক ব্যক্তির ছবিও যুক্ত করেন। রাধারমন দাসের এই পোস্টের পর একই দাবিতে সংবাদ প্রকাশ করতে শুরু বিভিন্ন ভারতীয় গণমাধ্যম।

ইন্ডিয়া টুডের একটি প্রতিবেদনের শিরোনামে বলা হয়, “বাংলাদেশে হিন্দু সন্ন্যাসী পক্ষের উকিলের উপর হামলা: ইসকন”। টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, “বাংলাদেশী হিন্দু সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণ প্রভুর পক্ষের আইনজীবী রমেন রায়ের উপর নৃশংস আক্রমণ হয়েছে বাংলাদেশে, সম্ভবত প্রভুর পক্ষে উকালতি করার কারণে।” এই বক্তব্যের জের ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, লাইভ মিন্ট, দ্য হিন্দু, নিউজ১৮, ডেকান হেরাল্ড, সিয়াসাত এবং ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। এই সকল পোস্টেই আইনজীবীর নাম হিসেবে উল্লেখ করা হয় রমেন রায়। তবে রাধারমন দাস পরেরদিন অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বর তার আগের পোস্টের নিচে আরেকটি পোস্টে লেখেন, “তিনি ২৫ নভেম্বর ২০২৪ সালে ঢাকার একটি র‍্যালিতে আক্রমণের শিকার হন। তখন থেকে তিনি আইসিউতেই আছেন। তিনি চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের একজন সমর্থক আইনজীবী ছিলেন।”

যাচাইয়ের শুরুতে চট্টগ্রাম জেলা বার অ্যাসোসিয়েশন, ঢাকা জেলা বার অ্যাসোসিয়েশন, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য তালিকায় রমেন রায় নামের কোন আইনজীবীর নাম খুঁজে পায়নি ডিসমিসল্যাব। এই কিওয়ার্ড সার্চ করে ফেসবুকে একটি পোস্টে রমেন্দ্র নাথ রায় নামটি সামনে আসে। ঢাকা জেলা বার অ্যাসোশিয়েশন এবং সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনে এই নামের একজন আইনজীবীর খোঁজ পাওয়া যায়। এরপর ডিসমিসল্যাবের নজরে আসে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের একটি বিবৃতি। এই বিবৃতিতেও রমেন্দ্র নাথ রায়ের নামের উল্লেখ দেখা যায়। চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলামের হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে দেয়া এই বিবৃতিতে বলা হয়, “পরিষদ একই সাথে গত পরশু ২৫ নভেম্বর, ২০২৪ প্রভু চিন্ময়কে ঢাকা বিমানবন্দরে আটকের প্রতিবাদে শাহবাগ চত্বরে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে দুষ্কৃতিকারীদের অতর্কিত হামলায় সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্য এ্যাডভোকেট রমেন্দ্র নাথ রায়ের মাথায় গুরুতর জখমের ঘটনারও তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং পরিষদ তার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে। এ্যাডভোকেট রায় বর্তমানে ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন।” এখান থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে আহত উকিলের নাম রমেন্দ্র নাথ রায়। তবে তাকে নিয়ে তার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের দেয়া ফেসবুক পোস্টগুলোতে তাকে রমেন রায় নামে সম্বোধন করতেও দেখা গেছে (, )।

ইসকন কলকাতার সহ-সভাপতি ও মুখপাত্র রাধারমন দাসের পোস্টের দাবির বিষয়ে জানতে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে রমেন্দ্র নাথ রায়ের পরিবারের সঙ্গে। তার স্ত্রী সাগরিকা রায় বলেন দাবিটি সঠিক নয়। রমেন্দ্র নাথ রায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের উকিল ছিলেন না। এই বিষয়ে ইতিমধ্যে প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে বাংলাদেশি গণমাধ্যম দ্য বিজনেস স্যান্ডার্ড। প্রতিবেদনে বলা হয়, সনাতনী জাগরণ জোটের অন্যতম সংগঠক প্রসেনজিৎ কুমার হালদার বলেন যে রায় আহত হয় ২৫ নভেম্বর সন্ধ্যায়, চিন্ময়ের গ্রেপ্তারের কিছুক্ষণ পরেই, যখন কোন আইনি পদক্ষেপ শুরুই হয়নি। তিনি আরও বলেন যে চিন্ময়কে পরেরদিনই হাজির করা হয় চট্টগ্রাম আদালতে, অথচ রায় উকালতি করেন ঢাকায়। রমেন্দ্র নাথ রায়ের স্ত্রীর সঙ্গে প্রসেনজিৎ কুমার হালদারের বক্তব্যের মিল পাওয়া যায়। অর্থাৎ, এটি নিশ্চিত হওয়া যায় যে তিনি চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী ছিলেন না। এছাড়া, রমেন রায়ের বাড়িতেও কোন হামলা হয়নি বলে ডিসমিসল্যাবকে জানান তার স্ত্রী। 

অপরদিকে বাংলাদেশে কিছু ফেসবুক পোস্টে (, ) চ্যানেল টুয়েন্টি ফোর-এর বরাতে বলা হয়, রমেন রায় নামে যে বাংলাদেশী আইনজীবীর কথা বলা হচ্ছে, তিনি বাংলাদেশের নন, ভারতীয় আইনজীবী।

যাচাই করে বাংলাদেশের গণমাধ্যম চ্যানেল টুয়েন্টিফোরের একটি ভিডিও প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল “চিন্ময় দাসের আইনজীবী নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের চরম মিথ্যাচার।” এই প্রতিবেদনের ১ মিনিট ৩৪ সেকেন্ডে বলতে শোনা যায়, “অনলাইন ঘেঁটে দেখা যায় রমেন রায় নামে যে আইনজীবীর ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে তিনি আসলে বাংলাদেশিই নন। ভারতের বিহারের পাটনার আইনজীবী তিনি।” তবে ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা যায় বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ইতিমধ্যে রমেন রায়ের আহত হওয়ার ঘটনাটি উল্লেখ হয়েছে। ঢাকা ট্রিবিউনের ২৫ নভেম্বরের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, “বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ’র মুখপাত্র ও চট্টগ্রামের পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময়কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে শাহবাগে চলা অবস্থান কর্মসূচিতে হামলা করেছে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় রমেন রায় (৫০) নামে এক ব্যক্তি গুরুতর আহত হয়েছেন।” এছাড়া দৈনিক ইনকিলাব এবং ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদনেও রমেন রায়ের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।

এই বিষয়ে অধিকতর যাচাইয়ে ডিসমিসল্যাব কথা বলে রমেন রায়ের স্ত্রীর সঙ্গে। তাকে সামাজিক মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিটি দেখালে তিনি নিশ্চিত করেন যে এটি রমেন রায়েরই ছবি এবং এই আইনজীবী বাংলাদেশের নাগরিক। রমেন রায় ঢাকায় আইন পেশায় যুক্ত রয়েছেন বলেও জানান তার স্ত্রী। অর্থাৎ, রমেন রায় বাংলাদেশি নন, বিহারের পাটনার আইনজীবী, এই দাবিটি সত্য নয়। যদিও চ্যানেল টুয়েন্টিফোরের ফেসবুক পেজে পরে আর প্রতিবেদনটি পাওয়া যায়নি। 

আরো কিছু লেখা