পার্থ প্রতীম দাস
তৌহিদুল ইসলাম রাসো
প্রথম প্রান্তিকের প্রবণতা বিশ্লেষণ
শীর্ষে রাজনীতি, বেড়েছে অপরাধ সংক্রান্ত ভুল তথ্য
পার্থ প্রতীম দাস
তৌহিদুল ইসলাম রাসো
২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই বা চাঁদাবাজির মতো অপরাধ বেড়ছে–এমন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমেও। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে “অপারেশন ডেভিল হান্ট” নামে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে এ সংক্রান্ত নানা ভুল তথ্যও বাড়তে দেখা গেছে উল্লেখযোগ্য হারে।
২০২৪ সালের শেষ তিন মাসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সংক্রান্ত ভুল তথ্য ছিল মোট ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনের মাত্র ১%। সেখানে এবছরের প্রথম তিন মাসে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯%-এ। সংখ্যার হিসেবে, গত প্রান্তিকে এ ধরনের ভুল তথ্য ছিল মাত্র ১১টি। সেটি এবছরের প্রথম তিন মাসে ৭ গুন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৭টিতে। ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট আটটি ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পেয়েছে ডিসমিসল্যাব।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে যেসব বিষয়ে ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা বেশি দেখা যায়, বরাবরই তার শীর্ষে থাকে রাজনীতি। ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এসময়ে ডিসমিসল্যাবসহ বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট তথ্যযাচাইয়ের প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায় মোট ভুল তথ্যের প্রায় অর্ধেকই (৪৫%) ছিল রাজনীতি সংশ্লিষ্ট। এর পরে বেশি ছড়াতে দেখা গেছে ধর্ম সংক্রান্ত ভুল তথ্য, যা ছিল মোট ভুল তথ্যের ১৩%।
এবছরের প্রথম প্রান্তিকের ভুল তথ্যের এই প্রবণতা বিশ্লেষণের জন্য ডিসমিসল্যাব বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট আটটি ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়েছে। এসময়ে এই ওয়েবসাইটগুলোতে ১,৩২৬টি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। একই বিষয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তাদের একটিকে স্বতন্ত্র বা ইউনিক হিসেবে ধরে বিশ্লেষণটি করা হয়েছে। এভাবে স্বতন্ত্র ভুল তথ্যের বিষয় পাওয়া গেছে ৮৬৭টি, যা আগের প্রান্তিকের (৮১৬) তুলনায় সামান্য বেশি।
বেড়েছে অপরাধ সংশ্লিষ্ট ভুল তথ্য
বাস্তব জগতে যখন যেসব বিষয় নিয়ে বেশি আলোচনা দেখা যায়, সেগুলোর প্রতিফলন দেখা যায় ভুল তথ্যের ক্ষেত্রেও। এসব ভুয়া তথ্য প্রায়ই সমাজে চলমান ঘটনা, যেমন রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সংকটপূর্ণ মুহূর্তের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। ব্রেক্সিট, জাতীয় নির্বাচন বা কোভিড-১৯ মহামারির মতো অনিশ্চয়তার সময়ে ভুল তথ্যের প্রসার বেড়েছে এবং তা জনমনে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। গবেষণা বলছে, ভুল তথ্য যখন ব্যক্তিগত মনোভাবের সঙ্গে মিল খায়, প্রচলিত সামাজিক নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, নতুন কিছু উপস্থাপন করে অথবা তীব্র আবেগ জাগায়— তখন তা অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে অপরাধ সংক্রান্ত ভুল তথ্যের ক্ষেত্রেই একই রকম চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। এবছরের প্রথম তিন মাসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা বেড়েছে। ছিনতাই, ধর্ষণের মতো অপরাধের প্রবণতা বেড়ে যাওয়া নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সমাজে এ সংক্রান্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে এ সংক্রান্ত ভুল তথ্যও। ২০২৪ সালের প্রতি প্রান্তিকে গড়ে এ ধরনের ভুল তথ্য ছিল মোট ছড়ানো ভুল তথ্যের মাত্র ২ শতাংশ। সেখানে এবছরের প্রথম প্রান্তিকে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত ভুল তথ্যের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ শতাংশে।
সবচেয়ে বেশি ছড়াতে দেখা গেছে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই ও ডাকাতি সংক্রান্ত বিভিন্ন ভুয়া দাবি। অনেক ক্ষেত্রেই অন্য দেশের, বিশেষভাবে ভারতের ঘটনাকে প্রচার করা হয়েছে বাংলাদেশের দাবিতে। যেমন, ইন্দোনেশিয়ার একটি হোটেল থেকে এক ব্যক্তির লাফ দেওয়ার ভিডিওকে বাংলাদেশে ডাকাতি করতে গিয়ে পালানোর দৃশ্য হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। একইভাবে ভারতের পেট্রোল পাম্পে বা গহনার দোকানে ডাকাতির ভিডিওকে বাংলাদেশের বলে দাবি করা হয়েছে। এছাড়াও কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পুরোনো বা অপ্রাসঙ্গিক ঘটনার ভিডিওকে (১, ২) সাম্প্রতিক ছিনতাইয়ের দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত হতে দেখা গেছে।
নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও খুন সংক্রান্ত বিভিন্ন ভুল তথ্যের ক্ষেত্রেও ভারতের ভিডিও প্রচার করে সেটি বাংলাদেশের ঘটনা বলে দাবি করা হয়েছে। বাংলাদেশে ধর্ষণ বা নির্যাতনের পর নারীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে– এমন দাবিতে ছড়ানো অন্তত চারটি ভিডিওর (১, ২, ৩, ৪) ক্ষেত্রে দেখা গেছে সেগুলো আসলে ভারতের ঘটনা। নারীর লাশ উদ্ধার সংক্রান্ত বাংলাদেশের কিছু পুরোনো ঘটনার ভিডিও-ও (১, ২, ৩) প্রচারিত হতে দেখা গেছে সম্প্রতি ধর্ষণ বা হত্যার দাবিতে। ৭৩ ঘন্টায় ১০০ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন– এমন একটি দাবি গত ফেব্রুয়ারিতে প্রচার করা হয়েছিল সংবাদমাধ্যমের ফটোকার্ড সম্পাদনা করে।
তাৎক্ষণিক ভীতি ছড়ানো ছাড়াও অপরাধ-সংক্রান্ত ভুল তথ্যের আরও বিস্তৃত পরিণতি দেখতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, অপরাধ সংক্রান্ত ভুল ধারণা জনসাধারণের মনোভাবকে প্রভাবিত করতে পারে, সামাজিক অস্থিরতা বাড়াতে পারে এবং নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। অপরাধ সংক্রান্ত পরিসংখ্যানে কারসাজির মাধ্যমে প্রায়ই জননিরাপত্তা সংক্রান্ত আলোচনাকে চাঞ্চল্যকর রূপ দেওয়া হয়, শাস্তিমূলক নীতি গ্রহণকে বৈধতা দেওয়া হয় এবং সহিংসতার গভীর কাঠামোগত পদ্ধতিগুলো থেকে দৃষ্টি ভিন্নদিকে সরিয়ে দেওয়া হয় বলে সতর্ক করেছে দ্য লিগাল ডিফেন্স ফান্ড। “অপরাধ সংক্রান্ত প্রবণতাগুলোর পেছনে কোন বিষয়গুলো প্রভাবক হিসেবে কাজ করে– তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে না পারার কারণে আমরা এর সমাধান নির্ধারণ ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের সক্ষমতা হারাই,” বলছে সংগঠনটি। তরুন প্রজন্মের জন্য এই ঝুঁকিটি আরও বেশি। গবেষণায় দেখা যায়, জেন-জি প্রজন্ম তাদের অগ্রজ প্রজন্মের তুলনায় চারপাশের পরিস্থিতি নিয়ে বেশি ঝুঁকির আশঙ্কা করে। তারা অপরাধ সংক্রান্ত ভাষ্যগুলোর ফলে বেশি ভীতিতে থাকে।
রাজনৈতিক ভুল তথ্যের ধরন ও ভাষ্য
বাংলাদেশে বরাবরই বেশি ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা দেখা যায় রাজনীতি বিষয়ে। এবছরের প্রথম প্রান্তিকেও দেখা গেছে একই চিত্র। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইটগুলোতে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তার ৪৫% ছিল রাজনীতি বিষয়ক।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে আওয়ামী লীগ (৩৪.৮%) ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে (২১.৮%) কেন্দ্র করে। তবে ভুল তথ্যের ভাষ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় আওয়ামী লীগকে কেন্দ্র করে প্রচারিত ভুল তথ্যগুলোর অধিকাংশই (৬৮%) ছিল ইতিবাচক। অন্যদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, বিএনপি, জামায়াত-শিবির ও সমন্বয়কদের নিয়ে ছড়ানো অধিকাংশ ভুল তথ্য ছিল নেতিবাচক।
আওয়ামী লীগ, এর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন ও নেতাকর্মীদের ঘিরে এমন ভুল তথ্য বেশি ছড়াতে দেখা গেছে যেগুলো তাদের জন্য ইতিবাচক। এর একটি বড় অংশজুড়ে ছিল বিক্ষোভ, মিছিলের পুরোনো ছবি-ভিডিও, যেগুলো আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক ছবি-ভিডিও বলে দাবি করা হয়েছে। গত ১৮ জানুয়ারি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পদত্যাগসহ আরও কিছু দাবিতে হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল আওয়ামী লীগ। এসময় হরতালের সমর্থনে আওয়ামী লীগের মিছিল দাবিতে প্রচারিত হতে দেখা গেছে বেশ কিছু পুরোনো ও অপ্রাসঙ্গিক ভিডিও (১, ২, ৩, ৪)। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্য সংগঠনের মিছিলকে (১, ২, ৩, ৪) দাবি করা হয়েছে আওয়ামী লীগের মিছিল বলে। এসব ভুল তথ্যের মাধ্যমে এমন বার্তা দেওয়া হয়েছে যে, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে ক্রমেই শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করছে, বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে সমর্থন জানানো হয়েছে, তিনি অনেকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন–এমন দাবিতে নানা ভুল তথ্য ছড়াতে দেখা গেছে বিভিন্ন সময়ে। যেমন, বলা হয়েছিল শেখ হাসিনা দিল্লিতে জাতিসংঘের ও ইউরোপিয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বা তিনি এলাহাবাদে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে দেখা করবেন। এছাড়া শেখ হাসিনা জনসমক্ষে এসেছেন, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বা দেশবাসীর উদ্দেশে বিভিন্ন বার্তা দিয়েছেন–এমন দাবিতেও ছড়িয়েছে বিভিন্ন ভুল তথ্য।
আওয়ামী লীগের প্রতি সমালোচনামূলক ভুল তথ্যগুলোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ছিল সংগঠনটির বিভিন্ন নেতাকর্মী গ্রেফতারের খবর। যেমন, কোথাও দাবি করা হয়েছে শেখ হাসিনাকে ইন্টারপোল গ্রেফতার করেছে, বা আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদের, নিজাম হাজারী ভারতে গ্রেফতার হয়েছেন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং এর বিভিন্ন উপদেষ্টাদের নিয়ে যে ধরনের নেতিবাচক ভুল তথ্য ছড়াতে দেখা গেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বিভিন্ন উপদেষ্টা পদত্যাগ করেছেন (১, ২, ৩), যুক্তরাষ্ট্র বা জাতিসংঘের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পদত্যাগ বা গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে–এমন সব দাবি। কোথাও আবার বলা হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পদত্যাগের জন্য চাপ দিয়েছেন সেনাপ্রধান। উপদেষ্টাদের নামে নানা ভুয়া বক্তব্য-বিবৃতিও ছড়াতে দেখা গেছে বিভিন্ন সময়ে। যেমন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের নামে ছড়ানো একটি ভুয়া বিবৃতির মাধ্যমে দাবি করা হয়েছিল যে, তিনি বলেছেন, সংস্কার হতে তিন বছর সময় লাগবে। তার আগে নির্বাচন হবে না। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নামে ছড়ানো ভুয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, তিনি ডাকাত-ছিনতাইকারী দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়েছেন।
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে ছড়ানো ভুল তথ্যগুলোরও অধিকাংশ ছিল নেতিবাচক। বিভিন্ন জায়গায় ধর্ষণ, হামলা, হত্যা, ছিনতাই, চাঁদাবাজির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী বা এর ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির জড়িত ছিল বলে বেশ কিছু ভুল তথ্য (১, ২, ৩, ৪, ৫) ছড়ানো হয়েছে। বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছেন–এমন দাবিতে প্রচারিত হতে দেখা গেছে কিছু ভুল তথ্য (১, ২, ৩)। দুইটি ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ভারতের বিভিন্ন ঘটনার ভিডিও প্রকাশ করে সেগুলো বিএনপি বা এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের হামলার দৃশ্য দাবিতে প্রচার করা হয়েছে। এছাড়া বিএনপির কয়েকজন নেতার নামে প্রচারিত হয়েছে বিভিন্ন ভুয়া বক্তব্য-বিবৃতি। যেমন, ভুলভাবে দাবি করা হয়েছে যে, বিএনপি নেতা ইসলাম ধর্মের নবীকে নিয়ে কটুক্তি করেছেন। বিএনপির আরেক নেতার একটি ভিডিও সম্পাদনা করে দাবি করা হয়েছে তিনি কর্মীদের চাঁদাবাজি করতে উৎসাহ দিয়েছেন।
বিএনপির পক্ষে ইতিবাচক কিছু ভুল তথ্যও ছড়াতে দেখা গেছে, যেখানে দাবি করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানে বিএনপির নেতারা যোগ দিয়েছেন বা লিওনেল মেসি আগামী নির্বাচনে বিএনপির পক্ষে প্রচারণা চালাবেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিয়ে যেসব ভুল তথ্য ছড়াতে দেখা গেছে তার অধিকাংশই ছিল নেতিবাচক। যেমন দাবি করা হয়েছে যে সমন্বয়কদের গ্রেফতার (১, ২, ৩) করা হয়েছে, তাদের পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে বা তারা গণধোলাইয়ের (১, ২, ৩) শিকার হয়েছেন। সমন্বয়কেরা বিভিন্ন আর্থিক দুর্নীতির (১, ২) সঙ্গে জড়িত দাবিতেও ছড়াতে দেখা গেছে কিছু ভুল তথ্য। অন্তত তিনজন নারী সমন্বয়ককে নগ্ন অবস্থায় উপস্থাপন করা হয়েছে সম্পাদিত ছবি-ভিডিওর (১, ২, ৩) মাধ্যমে।
রাজনৈতিক ভুল তথ্যে ট্রাম্প প্রভাব
২০২৪ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অপতথ্যের জগতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এবছরের প্রথম তিন মাসেও তাকে জড়িয়ে ছড়াতে দেখা গেছে বেশ কিছু রাজনৈতিক অপতথ্য। ২০ জানুয়ারি ট্রাম্পের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর কিছু ভুল তথ্যে দাবি করা হয় যে, এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া।
ট্রাম্প শেখ হাসিনার পক্ষে আছেন এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরোধীতা করছেন—এমন দাবিতে ছড়াতে দেখা গেছে বেশ কিছু ভুল তথ্য। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ট্রাম্প শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়েছেন বা তাকে ১ সপ্তাহের মধ্যে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে চান—এমন দাবিতে প্রচারিত হতে দেখা গেছে ভুল তথ্য। ট্রাম্পের হাতে শেখ হাসিনার ছবি দাবিতে প্রচারিত হতে দেখা গেছে একটি সম্পাদনা করা ছবি। ১৩ মার্চ ট্রাম্প ভারত সফরে যাবেন এবং শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করবেন—এমন ভুল তথ্যও প্রচারিত হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। অন্যদিকে ট্রাম্প ড. ইউনূসের কড়া সমালোচনা করেছেন, তাকে স্বৈরাচার আখ্যা দিয়েছেন বা তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন— এমন দাবিও করা হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন পোস্টে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্যোগে ড. ইউনূসের নোবেল পুরস্কার বাতিল করা হচ্ছে— ট্রাম্পের নামে এমন ভুয়া বিবৃতিও ছড়াতে দেখা গেছে।

ধর্ম বিষয়ক ভুল তথ্য
ধর্ম সংক্রান্ত ভুল তথ্যের সংখ্যা এই প্রান্তিকে এসে কিছুটা কমেছে। গত বছরের শেষ প্রান্তিকে ধর্ম সংক্রান্ত ভুল তথ্যের পরিমাণ ছিল মোট যাচাইকৃত ভুল তথ্যের ১৮%, যা চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে কমে দাড়িয়েছে ১৩%-এ। তবে এর ধরন ছিল একই রকমের–পুরোনো বা সম্পাদিত ছবি-ভিডিও সাম্প্রতিক দাবিতে প্রচার, প্রেক্ষাপট পরিবর্তন করে ভুল তথ্য প্রচার, কিংবা ভারতের ছবি-ভিডিও বাংলাদেশের দাবিতে প্রচার। ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন সংক্রান্ত যেসব ভুয়া দাবি ছড়াতে দেখা গেছে এবছরের প্রথম তিন মাসেও প্রায় একই ধরনের ভুল তথ্য ছড়িয়েছে। যেমন কক্সবাজারের চকরিয়ায় ধর্ষণের শিকার মুসলিম নারীকে হিন্দু দাবিতে প্রচার, বাগেরহাটে মুসলিমদের বাড়িতে আগুনের ঘটনাকে হিন্দুদের বাড়িতে আগুন দাবিতে প্রচার, রাজনৈতিক কারণে মারধরের ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক হামলা দাবিতে প্রচার, কিংবা মাজারে হামলাকে হিন্দুদের বিয়ে বাড়িতে মুসলিম জনতার হামলা দাবিতে প্রচার।
বিপরীতে ভারতে মসজিদ ভাঙা হচ্ছে বা আগুন দেওয়া হচ্ছে, মুসলিমদের ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে– এমন দাবিতেও বাংলাদেশে ছড়াতে দেখা গেছে কিছু ভুল তথ্য। যেমন, ইন্দোনেশিয়ার একটি পার্কের স্থাপনা ভেঙে ফেলার ভিডিওকে ভারতে মসজিদ ভাঙার দৃশ্য দাবিতে প্রচার করা হয়েছে। গুজরাটে অবৈধ স্থাপনা ভাঙার একটি ভিডিও পোস্ট করে ভুলভাবে দাবি করা হয়েছে, গরুর মাংস বিক্রির অপরাধে মুসলিমদের বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে।

এই প্রান্তিকে এসে ধর্ম সংক্রান্ত ভুল তথ্য ছড়ানোর ঘটনায় নতুন কিছু ভাষ্যও যোগ হয়েছে। বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লস অ্যাঞ্জেলসে দাবানলের ঘটনা ঘটে। এসময় ধর্মীয় মহীমা প্রচারের লক্ষ্যে দাবি করা হয় দাবানলে সব কিছু পুড়ে গেলেও এক মুসলিম ব্যক্তির মালিকানাধীন বাড়ি বা একটি মসজিদ অক্ষত আছে। আবার ক্যালিফোর্নিয়ায় আগুন নেভাতে আজান দেওয়ার ঘটনা দাবিতে ছড়ানো হয়েছে পুরোনো ভিডিও।
মার্চে এসে দেখা গেছে ধর্ম সংক্রান্ত ভুল তথ্য ছড়িয়েছে রমজানকে কেন্দ্র করে। যেমন– রমজানের শেষ দশ দিনের বিশেষ আমল সংক্রান্ত কিছু পরামর্শ ভুলভাবে ছড়ানো হয় কাবা শরীফের ইমামের বরাতে, আবার মহাসড়কের জায়গা দখল করে ভবন নির্মাণ করার অভিযোগে দক্ষিণ ভারতের অভিনেতা ও রাজনীতিবিদ থালাপতি বিজয়ের রাজনৈতিক দলের একটি কার্যালয় ভেঙে ফেলার ভিডিও পোস্ট করে ভুলভাবে দাবি করা হয় যে, এই অভিনেতা মুসলিমদের সঙ্গে ইফতার করেছেন বলে তার ছবিযুক্ত একটি ভবন ভেঙে ফেলা হয়েছে।
বেড়েছে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভুল তথ্য
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ভুল তথ্যের পরিমাণ বাড়তে দেখা গেছে এবছরের প্রথম প্রান্তিকে। ২০২৪ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভুল তথ্য নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল ২৭টি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন। সেখানে এবছরের প্রথম তিন মাসে এই সংখ্যা দ্বিগুন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪টিতে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব ভুল তথ্যের বেশিরভাগই (২৪%) ছিল রাজনীতি সংশ্লিষ্ট।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা বা রাজনীতিবিদদের নামে এমন কিছু বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হতে দেখা গেছে, যেগুলো তারা দেননি। যেমন, ৬ ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস–এমন একটি সংবাদ প্রকাশিত হতে দেখা গিয়েছিল গত ফেব্রুয়ারিতে। যদিও তিনি নির্বাচনের এমন কোনো নির্দিষ্ট তারিখের কথা বলেননি। ভুয়া বা অপ্রাসঙ্গিক ফেসবুক প্রোফাইল থেকে করা পোস্টকে সত্য ধরে নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হতে দেখা গেছে। সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীনের নামে খোলা একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টের পোস্টকে তার বক্তব্য ধরে নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল গত মার্চে। একইভাবে আসিফ মাহমুদ নামের এক ব্যক্তির ফেসবুক পোস্টকে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বক্তব্য ধরে নিয়ে সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।

এবছরের প্রথম প্রান্তিকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হতে দেখা গেছে কয়েকটি ভুল তথ্য। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করা হয়েছে, বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হচ্ছে বা পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকার রাস্তায় টহল দিচ্ছে–এমন ভুল দাবিতে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে বিভিন্ন ভারতীয় গণমাধ্যমে। বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটি মৌলিক প্রশিক্ষণের ছবিকে জিহাদের প্রশিক্ষণ দাবিতে প্রচার করা হয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম, আজতক বাংলায়। কোনো প্রতিবেদনে আবার বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সরকারী চাকরিতে হিন্দুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, বা বাংলাদেশে ভারতীয় গরুর সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় ঘোড়ার মাংস খাচ্ছে।
ভুল তথ্য বেশি ছড়িয়েছে ভিডিওর মাধ্যমে
বাংলাদেশে বরাবরই বেশি ভুল তথ্য ছড়াতে দেখা যায় ভিডিওর মাধ্যমে। এবছরের প্রথম প্রান্তিকেও ভিডিওর মাধ্যমে ছড়িয়েছে ৪২% ভুল তথ্য। এরপরেই ছিল ছবি (২৫%) ও গ্রাফিক কার্ডের (১৯%) ব্যবহার।
সোশ্যাল মিডিয়ায় সংবাদ প্রচারের জন্য সংবাদমাধ্যমগুলো যে ধরনের ফটোকার্ড ব্যবহার করে, সেগুলো সম্পাদনা করে ভুল তথ্য ছড়ানোর একটি প্রবণতা দেখা যায় বাংলাদেশে। এবারের প্রান্তিকেও ১২৫টি ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে সংবাদমাধ্যমের সোশ্যাল মিডিয়া ফটোকার্ড সম্পাদনা করে। এসব ভুল তথ্যের অধিকাংশই (৭১%) ছিল রাজনীতি সংশ্লিষ্ট। ভুয়া এসব গ্রাফিক কার্ডে সংবাদমাধ্যমের লোগো যুক্ত থাকায় এসব ভুল তথ্য বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠার ঝুঁকি তৈরি হয়। আবার সংবাদমাধ্যমের সত্য ফটোকার্ডকে নকল বলে প্রচার করার চিত্রও দেখা গেছে। গত ৩০ জানুয়ারি ডিবিসি নিউজের ফেসবুক পেজে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়ার একটি বক্তব্য প্রচারিত হয়েছিল একটি ফটোকার্ডের মাধ্যমে। এই আসল ফটোকার্ডটিকে ভুয়া দাবি করে পোস্ট দেখা গিয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়।

গবেষণা পদ্ধতি
এই বিশ্লেষণটি করা হয়েছে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত আটটি ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইটে (রিউমর স্ক্যানার, বুমবিডি, নিউজচেকার, ফ্যাক্ট ক্রেসেন্ডো, ফ্যাক্ট ওয়াচ, এএফপি বাংলাদেশ, আজকের পত্রিকা এবং ডিসমিসল্যাব) প্রকাশিত প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে। যেখানে একাধিক ওয়েবসাইট একই ভুল তথ্য নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেখানে শুধু একটি প্রতিবেদনকে স্বতন্ত্র নমুনা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
বিষয়বস্তু অনুযায়ী প্রতিবেদনগুলোকে ভাগ করা হয়েছে ১৭টি বিভাগে। রাজনীতি, খেলাধুলা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ, ধর্ম, প্রকৃতি ও পরিবেশ, বিনোদন, প্রতারণা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, আইনশৃঙ্খলা, শিক্ষা, অর্থনীতি ও উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা, জননীতি, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী, অভিবাসন ও অন্যান্য।
রাজনৈতিক ভুল তথ্যের ক্ষেত্রে দেখা হয়েছে, সেখানে কোনো রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী বা তাদের কর্মীদের প্রশংসা নাকি সমালোচনা করা হয়েছে। যদি কোনো ভুল তথ্য কোনো দল, গোষ্ঠী বা তাদের সদস্যদের সম্মানহানি, কটাক্ষ বা অবমূল্যায়ন করে, তবে সেটিকে নেতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। অন্যদিকে, যদি কোনো ভুল তথ্য তাদের প্রভাব বৃদ্ধি বা ভাবমূর্তি উন্নয়নের ইঙ্গিত দেয়, তবে সেটিকে ইতিবাচক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।