তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চার, ডিসমিসল্যাব

পার্থ প্রতীম দাস

এনগেজমেন্ট এডিটর, ডিসমিসল্যাব
নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অপতথ্য ছড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে
This article is more than 6 months old

নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অপতথ্য ছড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে

তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চার, ডিসমিসল্যাব

পার্থ প্রতীম দাস

এনগেজমেন্ট এডিটর, ডিসমিসল্যাব

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক অপতথ্য প্রচারের প্রবণতা বাড়তে শুরু করেছে। বিভিন্ন ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা রাজনীতি নিয়ে যে পরিমাণ ভুয়া বা বিভ্রান্তকর তথ্য যাচাই করেছে, তা চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে এসে আগের তিন মাসের তুলনায় ৫৬ শতাংশ বেড়েছে। 

ডিসমিসল্যাবের বিশ্লেষণে আরও দেখা যাচ্ছে, ভিসানীতি ও নিষেধাজ্ঞা অপতথ্য ছড়ানোর নতুন বিষয়বস্তু হিসেবে উঠে এসেছে এবং মূলধারার গণমাধ্যমের নামে নকল ফটোকার্ড তৈরি ভুয়া তথ্য ছড়ানোর একটি বড় কৌশল হিসেবে বিস্তৃত হয়েছে। রাজনীতিবিদদের নিয়ে অপতথ্য ছড়ানোর পুরনো প্রবণতা বজায় আছে, তবে ভুয়া তথ্যের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস নতুন চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। 

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৭টি ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ২০৪৯টি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। কোনো বিষয়ে একাধিক ফ্যাক্টচেক হলে, সেখান থেকে একটিকে ইউনিক হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে এবং একক তথ্যযাচাইয়ে পাওয়া বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট বিভ্রান্তিকর তথ্যের ৪৪ শতাংশই ছিল রাজনীতি নিয়ে। 

রাজনৈতিক অপতথ্য যেভাবে বাড়ছে

বাংলাদেশে চারটি বিষয়ে মিথ্যা বা অপতথ্য ছড়ানোর প্রবণতা বেশি দেখা যায়: রাজনীতি, ধর্ম, দুর্যোগ ও খেলাধূলা। ফ্যাক্টচেকারদের যাচাই করা যেসব ভুয়া বা বিভ্রান্তিকর তথ্যের বিষয়বস্তু ছিল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক ইস্যু, নির্বাচন ও গণতন্ত্র, রাজনৈতিক ঘটনা, বা রাজনীতি সংক্রান্ত মন্তব্য- সেগুলোকেই এই বিশ্লেষণে রাজনৈতিক শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিশ্লেষণের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক তথ্যকে আলাদাভাবে শ্রেণীকরণ করা হয়েছে।

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নির্বাচন যত ঘনিয়ে এসেছে প্রতিটি প্রান্তিকে রাজনৈতিক শ্রেণীতে ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য যাচাইয়ের পরিমাণ ততই বেড়েছে। বছরের প্রথম প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ) ‍তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৭৪% বেশি রাজনৈতিক ভুলতথ্য চিহ্নিত হয়েছে এবং দ্বিতীয় প্রান্তিকের তুলনায় তৃতীয় প্রান্তিকে তা আরও ৫৬% বেড়েছে। শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই ফ্যাক্টচেকিং সংস্থাগুলো রাজনীতি নিয়ে ৮৩টি অপতথ্য চিহ্নিত করেছে, যা জানুয়ারিতে ছিল মাত্র ৩১টি। 

রাজনৈতিক অপতথ্যের প্রচারণায় কাদের লক্ষ্য বানানো হচ্ছে– তা বোঝার জন্য যাচাই করা অপতথ্যগুলোকে তিনটি বিভাগে ভাগ করা হয়েছে: আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং অন্যান্য। এই অন্যান্য বিভাগের মধ্যে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত, ড. মোহাম্মদ ইউনুসের মতো ব্যক্তিত্ব এবং জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম, গণ অধিকার পরিষদের মতো সংগঠন, এবং বিভিন্ন সরকারী ও আইনি সংস্থা।

এই বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়: বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে যাচাই হওয়া ৩৭০টি রাজনৈতিক অপতথ্যের মধ্যে ৪০ শতাংশের ক্ষেত্রে লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগ এবং ২৬ শতাংশ ক্ষেত্রে বিএনপি। বাকি ৩৪ শতাংশ পড়েছে অন্যান্য বিভাগে। তবে “আওয়ামী লীগ ও সরকার” এবং “বিএনপি ও রাজনৈতিক বিরোধী” হিসেবে দুইটি আলাদা বিভাগ করা হলে দেখা যায়: এই দুইটি বড় বিভাগের ক্ষেত্রেই কমবেশি একই হারে অপতথ্য প্রচারিত হয়েছে। বেশিরভাগ ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের ভাষ্যই ছিল নেতিবাচক ধরনের। তবে প্রতি বিভাগেই কিছু ভুল তথ্য পাওয়া যায় যেখানে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও তাদের কর্মকাণ্ডের মিথ্যা প্রশংসা করা হয়েছে। 

ভুয়া খবরের ন্যারেটিভ

ওপরের চিত্রটি থেকে রাজনৈতিক অপপ্রচারের প্রধান বিষয়বস্তু ও সাধারণ ভাষ্য সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে। মোটাদাগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, মার্কিন ভিসানীতি ও নিষেধাজ্ঞা, নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পদত্যাগ, নেতাদের মৃত্যু ও সংঘর্ষ – এগুলো নিয়েই ভুয়া খবর বেশি চিহ্নিত হয়েছে।

বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক থেকে ভুয়া খবরের মাঠ সরগরম ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে। এই বিষয়বস্তুতে এসময়ই সবচেয়ে বেশি ভুয়া খবর ছড়িয়েছে। ছড়ানো ভুয়া খবরগুলোতে মূলত দুটি ভাষ্য পাওয়া যায়। প্রথমত, ড. মুহাম্মদ ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হচ্ছেন এবং পিটার হাস বা ডোনাল্ড লু কিংবা বারাক ওবামা ও মার্কিন মন্ত্রীরা এতে সমর্থন দিচ্ছেন। আর দ্বিতীয় ভাষ্যটি হলো: যুক্তরাষ্ট্র বা সেনাবাহিনী বা খোদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এধরনের সরকার ব্যবস্থার “অনুমোদন” দিয়েছেন।  

তৃতীয় প্রান্তিকে এসে অপতথ্যের নতুন ক্ষেত্র হয়ে ওঠে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ও নিষেধাজ্ঞা। বিশেষ করে সেপ্টেম্বরে এই বিষয়ে নানা ধরনের ভুয়া খবর চিহ্নিত হয়েছে। যেমন: ভিসা নিষেধাজ্ঞার নানা রকম তালিকা সামাজিক মাধ্যমে ঘুরে বেড়িয়েছে। এক পক্ষ বলেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও উপদেষ্টা, সরকার সমর্থক শিক্ষক ও পুলিশের কর্মকর্তারা ভিসা নিষেধাজ্ঞায় পড়েছেন। অপর পক্ষ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ভুয়া বক্তব্য প্রচার করে বলেছেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুলও ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছেন। এমনকি ভিসা নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত অপতথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে কখনো সালমান এফ রহমান বা কখনো পুলিশের কোনো কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে বলা হয় তাদের দুবাই বা সিঙ্গাপুরের ভিসাও বাতিল হয়েছে। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া সহ অন্তত আধ ডজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের  অবিশ্বাস্য ও উদ্ভট ভুয়া মৃত্যুর খবর ছড়াতে দেখা গেছে। মৃত্যুর ভুয়া খবরের অন্যান্য শিকারের সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ, সঙ্গীতশিল্পী ও এমপি মমতাজ, খেলাফত মজলিস নেতা মামুনুল হকও রয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিডিও বা শর্টস আকারে সামাজিক মাধ্যমে মৃত্যুর গুজব প্রচারিত হচ্ছে। এর বাইরে কিছু ইউটিউব চ্যানেল নিয়মিত এসব ভিডিও ছড়াচ্ছে এবং এর মূল উদ্দেশ্য ক্লিক থেকে টাকা আয়, যেখানে থাম্বনেইলের সঙ্গে ভেতরের ধারাবর্ণনায় মিল নেই বললেই চলে।

ভুয়া খবরের লক্ষ্য যখন ব্যক্তি

সাতটি ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা যেসব ব্যক্তিদের নিয়ে বেশি ভুয়া খবর যাচাই করেছে– তার অগ্রভাগে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগকে নিয়ে যত ভুয়া খবর পাওয়া গেছে তার বলতে গেলে অর্ধেকই ছিল শেখ হাসিনাকে নিয়ে এবং এতে মূল বিষয় ছিল রাজনৈতিক।

যাচাইকৃত এসব ভুয়া তথ্যের প্রধান বিষয়বস্তু ছিল: জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে অথবা তিনি পদত্যাগ করছেন, বিভিন্ন দেশে সফরের সময় বিএনপির কর্মীরা তাঁকে বাধা দিয়েছে এবং তাঁর ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তিনি মারা গেছেন বলেও একাধিক ভুয়া খবর ভিডিও আকারে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁকে বিশ্বের তৃতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও চিত্রায়িত করা হয়েছে একটি ভুয়া খবরে। 

বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে যেসব ভুল তথ্য যাচাই হয়েছে সেখানে প্রধান বিষয়বস্তু ছিল তাঁর অসুস্থতা ও চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া নিয়ে। একাধিক সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে তাঁর মৃত্যুর অপপ্রচারও চালানো হয়েছে। তবে অন্তত দুটি ক্ষেত্রে ভুয়া খবরের বিষয়বস্তু ছিল খালেদা জিয়ার নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন। 

তাঁর ছেলে তারেক রহমানও ব্যক্তি তালিকায় ওপরের দিকেই রয়েছেন। তাকে ঘিরেও প্রচারিত ভুয়া পোস্টে নেতিবাচক ও প্রশংসাসূচক দুই ধরনের পোস্টই ছিল। যেমন: ছবি বিকৃত করে কোথাও তারেক রহমানকে মদের বোতলের সামনে, আবার কোথাও ঘোড়ার পিঠে নায়কোচিত ভঙ্গিতে বসানো হয়েছে। তাকে গ্রেফতার বা গণধোলাইয়ের ভুয়া খবর হয়েছে, কোথাও বলা হয়েছে তিনিও ভিসা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে পারেন। কিছু ভিডিওতে পাকিস্তানের এক নারীর নাচের ভিডিওকে তারেক রহমানের মেয়ে জাইমার বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সমসাময়িক রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যু কিভাবে ভুয়া তথ্যের নতুন ক্ষেত্র ও লক্ষ্যবস্তু তৈরি করে তার একটি উদাহরণ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে পিটার হাসের নামে বিভিন্ন ভুয়া উক্তি সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো হয়। এবছর ২২ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভিসানীতি প্রয়োগ করার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে দেশটির এই রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে ৬টি ভুয়া তথ্য চিহ্নিত হয় এবং ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রায় এক ডজন ভুয়া খবর বেরোয়।   

যাদের নিয়ে বেশি ভুয়া খবর বেরিয়েছে, এর মধ্যে আছেন যুদ্ধাপরাধের জন্য সাজাপ্রাপ্ত ও প্রয়াত জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেইন সাঈদী, খেলাফত মজলিস নেতা মামুনুল হক, রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট নুরুল হক নুর এবং সোশ্যাল মিডিয়া সেলিব্রিটি হিরো আলম। এদের মধ্যে সাঈদীকে নিয়ে ভুল তথ্য ছড়াতে থাকে তার মৃত্যুর পরে, মূলত তার জানাজা নিয়ে।

ভুয়া তথ্য ছড়ানোর কৌশল

ওপরের চিত্রটি আপনাকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেবে। প্রথমত: সামাজিক মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছে ভিডিওর মাধ্যমে এবং দ্বিতীয়ত ভুয়া খবর ছড়াতে মূলধারার গণমাধ্যমের নকল গ্রাফিক্স কার্ড ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। 

বছরের প্রতিটি প্রান্তিকেই ভিডিও ফরম্যাটে মিথ্যা বা বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে। এরপরেই রয়েছে ছবি। কিন্তু প্রতি প্রান্তিকে ছবির ব্যবহার কমতে দেখা যাচ্ছে এবং এর বদলে বাড়তে শুরু করেছে গ্রাফিক্স কার্ডের ব্যবহার। প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় তৃতীয় প্রান্তিকে এসে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর কৌশল হিসেবে গ্রাফিক্সের ব্যবহার প্রায় ৪২ শতাংশ বেড়েছে।

ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনগুলোর মধ্যে বিশ্বস্ত গণমাধ্যমের সূত্র বিকৃত করে ছড়ানো অপতথ্যের ৮১টি মধ্যে প্রায় ৭০ ভাগই ব্যবহার করা হয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক ভুয়া তথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মূলধারার বিভিন্ন গণমাধ্যমের নাম, লোগো ও  গ্রাফিক্স ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যক্তির ভুয়া উক্তি ছড়ানো হয়েছে। এই ৮১টি অপতথ্যের ৪৩ শতাংশই ছিল রাজনৈতিক ভুয়া উক্তি। 

এই ভুয়া উক্তিগুলো কেমন হয়? যেমন: পিটার হাসের নামে ছড়ানো হয়েছে, তিনি বলছেন, “মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে।” আবার মির্জা ফখরুলের নামে ছড়ানো ভুয়া উক্তিতে বলা হচ্ছে, “বিএনপি ক্ষমতায় গেলে বাইডেন ও ঋষি সুনাকের বিচার করা হবে।” একইভাবে ফটো কার্ডের সাহায্যে ভুয়া খবরও ছড়ানো হচ্ছে। যেমন: একটি গণমাধ্যমের কার্ড নকল করে তাতে বলা হচ্ছে, “প্রশাসনের কাছে আরেকবার সুযোগ চাইলেন শেখ হাসিনা।” অন্যদিকে আরেকটি ভুয়া কার্ডে বলা হচ্ছে, “সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে পরিবারসহ দেশ ছেড়ে পালালেন মির্জা ফখরুল।” 

গবেষণা পদ্ধতি 

এখানে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট সাতটি ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইটের কন্টেন্ট বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই সাইটগুলোতে যে বিষয়গুলো নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে—সেগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে যে, বাংলাদেশে ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের ধারা-প্রবণতা কেমন।

কাজটির জন্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে রিউমরস্ক্যানার, বুমবিডি, নিউজচেকার, ফ্যাক্টক্রিসেন্ডো, ফ্যাক্টওয়াচ, এএফপি বাংলাদেশ এবং ডিসমিসল্যাবের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ৯ মাসের (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনগুলো।

২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই সাতটি তথ্যযাচাইয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ২,০৪৯টি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনকে এখানে নথিবদ্ধ করা হয়েছে। কখনো কখনো ফ্যাক্টচেক সংস্থাগুলো কিছু যাচাই তাদের সামাজিক মাধ্যমে কার্ড হিসেবে প্রকাশ করে, কিন্তু ওয়েবসাইটে প্রতিবেদন হিসেবে প্রকাশ করে না। পদ্ধতিগত স্বচ্ছতার জন্য এখানে শুধু ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। 

একাধিক সাইট একই বিষয়ে ভুল তথ্য খণ্ডন করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিষয়-ভিত্তিক ভুল তথ্যের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য এসব ক্ষেত্রে বিবেচনায় শুধু একটি সাইটের ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনকে একক বা ইউনিক নমুনা হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এভাবে মোট ইউনিক ভুল তথ্যের বিষয় বা প্রসঙ্গ পাওয়া গেছে ১৩৯৫টি প্রতিবেদনে। 

ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের ভৌগলিক প্রাসঙ্গিকতা বোঝার জন্য ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনগুলোকে ভাগ করা হয়েছে তিনটি ভাগে। স্থানীয় বা বাংলাদেশ, আন্তর্জাতিক এবং স্থান-নিরপেক্ষ। ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্যের মধ্যে ৬০ শতাংশই ছিল বাংলাদেশ নিয়ে। 

ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর তথ্যগুলোর বিষয় বা প্রসঙ্গ কী ছিল— তা দেখার জন্য এই ইউনিক ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনকে ভাগ করা হয়েছে ১৫টি বিভাগে- রাজনীতি, খেলাধুলা, স্বাস্থ্য, প্রকৃতি ও পরিবেশ, বিনোদন, জালিয়াতি, দুযোগ, ধর্ম, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, আইনশৃঙ্খলা, শিক্ষা, অর্থনীতি ও উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা, জননীতি ও অন্যান্য। আধেয় বিশ্লেষণ করে অপতথ্যের টার্গেট বা লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ব্যক্তি ও রাজনৈতিক শ্রেণীকে আলাদাভাবে নথিবদ্ধ করা হয়েছে।

সীমাবদ্ধতা: ফ্যাক্টচেকাররা সব ধরনের ভুয়া খবর, গুজব বা অপপ্রচার যাচাই করতে পারেন না। তারা শুধু সেটিই যাচাই করেন, যেখানে যাচাই করার মতো ভুল তথ্য রয়েছে। কাজেই, এই বিশ্লেষণ যে সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো সকল মিথ্যা বা অপতথ্যের প্রতিনিধিত্ব করছে এমন নয়। আবার পদ্ধতিগত কারণে ইন্টারনেটজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সব অপতথ্য যাচাই করাও সম্ভব নয়। 

রাজনৈতিক বা সামাজিক বাস্তবতার কারণেও অনেক সময় ফ্যাক্টচেকারদের পক্ষে সব ধরনের ভুয়া তথ্য যাচাই করা সম্ভব হয় না, যা একটি সীমাবদ্ধতা। এজন্য বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করা প্রতিটি ফ্যাক্টচেকিং সংস্থার প্রত্যেকটি প্রতিবেদন এখানে নমুনা হিসেবে নেওয়া হয়েছে এবং এদের মধ্যে তিনটি সংস্থা বাংলাদেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হয়। 

এই বিশ্লেষণের জন্য ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনগুলোকে বেছে নেওয়ার কারণ হলো, ফ্যাক্টচেকাররা আইএফসিএনের মানদণ্ড বা স্বীকৃত পদ্ধতি মেনে একটি ভুয়া তথ্যকে যাচাই করেন। তাই বিশ্লেষণের জন্য বাছাই করা প্রতিবেদনগুলো নিশ্চিতভাবে ভুল/বিভ্রান্তিকর এবং যাচাইকৃত নমুনা বা উপাত্ত যোগান দেয়। এটি পদ্ধতিগতভাবে নির্ভুল তথ্য সংগ্রহের নিশ্চয়তা দেয়।

আরো কিছু লেখা