মিনহাজ আমান
নির্বাচনে ভুয়া তথ্যের বিস্তার ও ধরন যেমন ছিল
মিনহাজ আমান
গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ভুয়া খবর ও অপতথ্য ছড়াতে দেখা গেছে। নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের মিথ্যা ঘোষণা, নির্বাচনকে সফল দেখানো বা নির্বাচনে কারচুপি প্রমাণের চেষ্টা, নির্বাচনের প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন অথবা সমালোচনা – একেক পক্ষ একেক ধরনের ভাষ্য তুলে ধরতে গিয়ে ভুয়া খবর ছড়িয়েছে। নির্বাচন কেন্দ্রিক অপতথ্য নিয়ে ডিসমিসল্যাবের পর্যবেক্ষণে এমন প্রবণতাই দেখা গেছে।
ভুয়া তথ্য ছড়াতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে: কখনো প্রার্থীর নামে ভুয়া ফেসবুক প্রোফাইল খুলে সেই অ্যাকাউন্ট থেকে মিথ্যা পোস্টে জানানো হয়েছে তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন; গ্রাফিক্স কার্ডে বিভিন্ন কূটনৈতিক ব্যক্তিত্বের ভুয়া উদ্বৃতি প্রচার করে বলা হয়েছে যে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে; পুরোনো নির্বাচনের ভিডিওকে নতুন করে পোস্ট করে দাবি করা হয়েছে, এটি এই নির্বাচনের এবং নির্বাচনে ভোট চুরি হয়েছে; ভোট কেন্দ্রের পুরোনো ছবি তুলে দিয়ে দাবি করা হয়েছে, এবার ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের দীর্ঘ সারি ছিল। সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে ভিডিওর ব্যবহার, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই টুল দিয়ে একাধিক প্রার্থীর নামে মিথ্যা বক্তব্য ছড়ানোর ঘটনাও ঘটেছে।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অপতথ্যের বিস্তার নিয়ে গোড়া থেকেই শঙ্কা ছিল। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই রাজনৈতিক অপতথ্যের বাড়তে থাকা প্রবণতা এই উদ্বেগকে আরো বাড়িয়ে তুলেছিল। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের নির্বাচন কেন্দ্রিক অপতথ্যের বিস্তার ও প্রভাবের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
ডিপফেক ভিডিও
বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আলোচনা হয়েছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি অপতথ্য নিয়ে। আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে এটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যা হয়ে উঠতে পারে। তবে নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি অপতথ্যের ব্যাপক প্রভাব দেখা না গেলেও দুইটি ডিপফেক ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। এই অপতথ্যের ভুক্তভোগী দুটি আসনের দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী। এদের দুজনই নারী।
বগুড়া-২ ও গাইবান্ধা-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন বিউটী বেগম ও আব্দুল্লাহ নাহিদ নিগার। দুই প্রার্থীকে নিয়ে ঠিক একই রকমের ডিপফেক ভিডিও ছড়িয়েছে, যেখানে তাদেরকে বলতে শোনা যায় যে, তারা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন এবং প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন।
দুটি ভিডিও তৈরি হয়েছে এআই টুল দিয়ে। দুই প্রার্থীর স্থিরচিত্র নিয়ে সেটিকে ভিডিওতে রূপান্তরিত করা হয়েছে এবং সেই ভিডিওতে কম্পিউটার জেনারেটেড কন্ঠে, মিথ্যা বক্তব্য জুড়ে দেওয়া হয়েছে। দুটি ভিডিওর ভাষাও ছিল প্রায় একই রকমের। একাধিক ফ্যাক্টচেক সংস্থা ভিডিও দুটিকে ডিপফেক বলে সনাক্ত করেছে।
বগুড়া-২ আসনের প্রার্থী বিউটী বেগমের ডিপফেক ভিডিওটি প্রচারিত হয়েছিল বর্ণিল বগুড়া নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে এবং গাইবান্ধা-১ আসনের প্রার্থী নাহিদ নিগারের ডিপফেক ভিডিওটি প্রচারিত হয়েছিল গাইবান্ধা গেজেট নামের পেজ থেকে। মজার ব্যাপার, দুটি ফেসবুক পেজই খোলা হয়েছিল একই দিনে।
ভিডিওগুলোর কমেন্টে “ভালো উদ্যোগ নিয়েছেন”, “ভালো পদক্ষেপ নিয়েছেন”, “ভালো খবর”– এ ধরনের মন্তব্য দেখা যায়। অর্থাৎ অনেকেই সেটিকে সত্য ঘোষণা বলে ধরে নিয়েছেন। উল্লেখ্য, এই দুই আসনে নারী-পুরুষ মিলিয়ে প্রায় ৭ লক্ষ ২০ হাজার ভোটার ছিল।
শেষপর্যন্ত নির্বাচনে গাইবান্ধা-১ আসনের প্রার্থী আব্দুল্লাহ নাহিদ নিগার জয়ী হয়েছেন, তবে হেরে গেছেন বগুড়া-২ আসনের প্রার্থী বিউটী বেগম। দুটি আসনেই ভুক্তভোগী প্রার্থীদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাতীয় পার্টির: গাইবান্ধায় ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী এবং বগুড়ায় শরীফুল ইসলাম জিন্নাহ। এই দুটি আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোনো প্রার্থী দেয়নি।
প্রার্থিতা প্রত্যাহার ও ভুয়া অ্যাকাউন্ট
বগুড়ার আরেকটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ কবির আহম্মেদ মিঠু দাবি করেন, তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে সেখানে তার প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ভুয়া খবর পোষ্ট করা হয়েছে। পরে তিনি থানায় জিডি করেন এবং সংবাদ সম্মেলন ডেকে অভিযোগ তুলে ধরেন।
ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে প্রার্থীর নির্বাচন থেকে সরে দাড়ানোর মিথ্যা ঘোষণা প্রচারের ঘটনা ঘটেছে নওগা-৫ আসনে। সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান ছেকার আহমেদ শিষাণের নামে ছড়ানো ভুয়া কার্ডে দেখা যায়, তিনি নির্বাচন থেকে সরে গিয়ে নৌকার প্রার্থীকে ভোট দিতে বলছেন। সামাজিক মাধ্যমে এমন একাধিক পোস্ট ছিল বলে একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে বলা হয়। এই প্রার্থী তার নিজস্ব পেজে, নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর দাবিটিকে অপপ্রচার বলে অভিযোগ করেন।
একই অভিযোগ করেন বগুড়া ২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী বিউটি বেগমও, যার নামে ডিপফেক ভিডিও ছড়ানো হয়েছিল। তাঁর নামেও ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয় বলে তিনি গণমাধ্যমকে জানান।
চট্টগ্রাম-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুচ ছালামের নামে ভুয়া ফটোকার্ডের মাধ্যমে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের মিথ্যা দাবি পোষ্ট করা হয়। এই ভুয়া খবর ছড়াতে মূলধারার গণমাধ্যম ডিবিসি নিউজের ফটোকার্ড নকল করা হয়।
ভালো ভোট, মন্দ ভোট
নির্বাচনের আগের রাত ও নির্বাচনের দিন সামাজিক মাধ্যমে অপতথ্যের দুটি বিপরীতমুখী ধারা দেখা যায়। একটি ধারায় দাবি করা হয় নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে এবং কেন্দ্রে ভোটারদের দীর্ঘ সারি দেখা যাচ্ছে। আরেকটি পক্ষ বিভিন্ন ছবি দিয়ে দাবি করতে থাকে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়ম হচ্ছে।
এসব মিথ্যা দাবি ছড়াতে পুরোনো ভিডিও এবং ছবির ব্যবহার বেশি দেখা গেছে। যেমন: ভোটের আগের রাতে ফেসবুকে পুরোনো ভিডিও দিয়ে ঢাকায় নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার দাবি করা হয়। কিন্তু দেখা যায় ভিডিওটি অন্তত দেড় মাস পুরোনো।
একইভাবে ভোটের দিন সকালে একটি অনলাইন পোর্টালে একটি ছবি দিয়ে বলা হয় “শীতের সকালেও ভোটারদের দীর্ঘ লাইন” এবং ক্যাপশনে দাবি করা হয়, ছবিটি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের, যদিও ছবিটি ছিল ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনের। অন্তত তিনটি সংবাদ পোর্টালে পুরোনো ছবি দিয়ে সাত জানুয়ারির নির্বাচনে ভোটারদের লম্বা সারি দেখানো হয়।
জালিয়াতি বা অনিয়মের অসংখ্য ভিডিও ভোটের দিন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এদের মধ্যে কিছু ভিডিও সঠিক বা আসল বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে (১, ২) খবর প্রকাশিত হয়। তবে একই সময়ে নির্বাচনে অনিয়মের বেশ কিছু পুরোনো ভিডিও (১, ২, ৩, ৪) নতুন করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো হয় এবং সেগুলো এই নির্বাচনের বলে মিথ্যা দাবি করা হয়।
মিথ্যা উক্তিতে ভোটের প্রশংসা-নিন্দা
বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যেমন আন্তর্জাতিক সংস্থার নীতিনির্ধারক, দূতাবাস, সাংবাদিক এমনকি শিক্ষকদের বরাতেও বিভিন্ন ভুয়া বক্তব্য প্রচার করা হতে দেখা গেছে এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের নামে তিনটি ভুয়া উদ্বৃতি ছড়ানো হয়। এগুলোতে দাবি করা হয়, তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠ হয়েছে বলে জানিয়েছেন। তিনটি ভুয়া খবর ছড়ানো হয়েছে বাংলাদেশের প্রথম সারির গণমাধ্যম যথাক্রমে দ্য ডেইলি স্টার, দৈনিক কালবেলা এবং প্রথম আলোর নকল ফটোকার্ড ব্যবহার করে।
অপরদিকে জাতিসংঘ এবং যুক্তরাষ্ট্রকে জড়িয়ে উল্টো বক্তব্যও প্রচার করা হয়েছে এবং সেগুলোও ছিল ভুয়া। যেমন, তাদের নাম জড়িয়ে বলা হয় তারা নির্বাচন প্রত্যাখান করে পুনরায় আয়োজন করার আহবান জানিয়েছে।
বাংলাদেশের একজন টকশো ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের নামে ভুয়া বক্তব্য দিয়ে বলা হয়, “নির্বাচনে সহিংসতা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। দুই একজন নিহতের জন্যে মায়াকান্না না করে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হোন।” পরে তিনি জানান, এমন কোনো বক্তব্য তিনি দেননি।
বাংলাদেশী সাংবাদিক ও ডয়েচ ভেলের বাংলা বিভাগের প্রধান খালেদ মুহিউদ্দিনের বরাত দিয়ে ছড়ানো আরেক ভুয়া বক্তব্যে দাবি করা হয়, “৭০ উইকেটের বিনিময়ে অর্জন ৪০%, তার মধ্যে ৩৮% জাল, ২% কাস্ট, গত ১৫ বছরে এটাই তাদের অর্জন…! সাংবাদিক হিসেবে আমি লজ্জিত।” কিন্তু তিনি পরে জানান এমন কোনো বক্তব্য তিনি দেননি। নির্বাচনের সময় অনলাইনে ছড়ানো রাজনৈতিক অপতথ্যের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে গোটা বিশ্বেই উদ্বেগ রয়েছে। কারণ, ২০২৪ সালে বিশ্বের ৬৪টি দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে যেখানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এমন অবস্থায় ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ইউনেস্কোর প্রকাশ করা একটি বৈশ্বিক জরিপে বলা হয়, ৮৫ শতাংশ মানুষ অনলাইন অপতথ্যের প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন রয়েছেন।