কদরুদ্দীন শিশির
সাফা কবির বিতর্ক: একটি মিথ্যা মিম যেভাবে ‘তথ্য’ ও সংবাদ হয়ে উঠল
কদরুদ্দীন শিশির
গত ৯ জুন বাংলাদেশি বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম ছিলো এরকম: “শাহরিয়ার কবিরের মেয়ে সাফা কবিরের মরদেহ উদ্ধার”। এমন দুটি লিংক এখানে (১, ২) দেওয়া থাকলো।
নামকরা আরও অনেক সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম এমন না হলেও প্রতিবেদনের ভেতরে বলা হয় যে, “ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের মেয়ে সাফা কবিরের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।” এরকম ছয়টি প্রতিবেদনের আর্কাইভ লিংক এখানে পাবেন (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬)।
একই সময়, বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম জানাল (১, ২), শাহরিয়ার কবিরের সদ্যমৃত মেয়ের নাম ‘অর্পিতা শাহরিয়ার মুমু’ বা ‘অর্পিতা কবির মুমু’।
এবং সবশেষে বোঝা গেল, যেসব সংবাদমাধ্যম শাহরিয়ার কবিরের মেয়ে হিসেবে ‘অর্পিতা শাহরিয়ার মুমু’ বা ‘অর্পিতা কবির মুমু’ লিখেছেন তারাই সঠিক। কারণ যারা ‘সাফা কবির’ লিখেছিলেন প্রায় সবাই একে একে প্রতিবেদনগুলো সরিয়ে নিয়েছেন বা সংশোধন করেছেন।
প্রশ্ন হল: মূলধারার গণমাধ্যমে তথ্যের এমন বিভ্রান্তি তৈরি হল কী করে? এর উৎস লুকিয়ে আছে চার বছর আগের একটি সাক্ষাৎকার, একটি মিথ্যা মিম ও অনলাইন তথ্যযুদ্ধে।
মিম যেভাবে ‘তথ্য’ হয়ে গেল
২০১৯ সালের ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে এবিসি রেডিওর একটি লাইভ অনুষ্ঠানে অভিনেত্রী সাফা কবিরকে এক ভক্ত বার্তা পাঠান, “আপু আপনি কি পরকালে বিশ্বাস করেন? করলে আপনার লাইফ স্টাইল …..।”
এই প্রশ্নের উত্তরে সাফা কবির বলেছিলেন যে পরকালে তার বিশ্বাস নেই, কারণ তিনি যা দেখেন না তা বিশ্বাসও করেন না। এরপর অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা অন্য প্রসঙ্গে চলে যান, কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে বিষয়টি রয়ে যায় এবং বড় হতে থাকে।
সেই ইউটিউব ভিডিওর কমেন্ট সেকশনে এবং সামাজিক মাধ্যমে এই মন্তব্যের জন্য আক্রমণের শিকার হতে থাকেন সাফা কবির। দুদিনের মাথায় তিনি নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ক্ষমা চেয়ে পোস্ট করেন সাফা কবির।
সেই বিতর্কের মধ্যেই একটি মিম ভাইরাল হয়। তাতে দেখা যায়: একটি পোস্টারে পাঁচজন ব্যক্তির ছবি এবং যথাক্রমে প্রতিটি ছবির ওপর লেখা: “বাবা শাহরিয়ার কবির, মা খুশি কবির, ছেলে জন কবির, বড় মেয়ে সাবা কবির, ছোট সাফা কবির”।
এরপর সাফা কবির এবিসি রেডিওর সেই অনুষ্ঠানে আবার হাজির হন, সেই বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চান এবং জানান যে তিনি শাহরিয়ার কবির বা খুশি কবিরের মেয়ে নন।
ভাইরাল হওয়া মিমে ৪র্থ ব্যক্তি হিসেবে যার নাম ‘সাবা কবির’ লেখা ছিল সেখানে ছবি ব্যবহার করা হয় অভিনেত্রী সোহানা সাবার। এই অভিনেত্রী ২০১৯ এর ১৬ এপ্রিল নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে মিথ্যা মিমটি পোস্ট করে তার বক্তব্য জানান।
সেখানে তিনি মিমটিকে ‘বিরক্তিকর’ ও ‘হাস্যকর’ হিসেবে অভিহিত করেন এবং বলেন, মিমের অন্যান্য ব্যক্তিদের সাথে তার পারিবারিক কোন সম্পর্ক নেই। তার পোস্ট থেকে এটাও স্পষ্ট হয় যে, অন্য যে চারজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের মধ্যেও পারস্পরিক কোন পারিবারিক সম্পর্ক নেই।
ওইসময় এই মিমটি আরও নানা ধরনের কাউন্টার মিমেরও জন্ম দেয়। যেমন এই ফেসবুক পোস্টে আরেকটি পোস্টার প্রকাশ করা হয় যেটির ক্যাপশনে লেখা হয়: “সাফা কবির যদি শাহরিয়ার কবির, খুশি কবির পরিবারের হয় তবে ‘নুর’ পরিবার বাদ যাবে কেন?”
ওই একই সময়ে মাওলানা শহীদুল ইসলাম সিদ্দিকী নামের একজন ইসলামী বক্তার ওয়াজের ভিডিও ভাইরাল হয় সেখানে তিনি ভাইরাল মিমটিকে ‘সত্য তথ্যের ওপর নির্মিত’ ধরে নিয়ে বক্তব্য দেন। ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি মঞ্চে বসে হাতে কিছু একটা দেখে দেখে ”বাবা শাহরিয়ার কবির, মা খুশি কবির, ছেলে জন কবির, বড় মেয়ে সাবা কবির এবং ছোট মেয়ে সাফা কবির” ইত্যাদি বলছেন। তিনি পহেলা বৈশাখে এবিসি রেডিওতে সাফা কবিরের বক্তব্যেরও সমালোচনা করেন।
মাওলানা শহীদুলের এই ওয়াজ মিমযুদ্ধে নতুন মাত্রা যোগ করে। অনেকেই (দেখুন এখানে ও এখানে) তার বক্তব্যকে ‘ট্রল’ করে ফেসবুকে পোস্ট করেন। সাফা কবিরকে (ও তার কথিত বাবা-মা শাহরিয়ার কবির/খুশি কবির) ‘নাস্তিক’ অভিহিত করে নানান ধরনের নিন্দামূলক পোস্টও (১, ২) একই সঙ্গে চলতে থাকে।
অনলাইন তথ্যযুদ্ধের প্রভাব
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে শাহরিয়ার কবিরের মৃত সন্তানের নাম কীভাবে ‘সাফা কবির’ হয়ে গেল তার আসলে অন্য কোন ব্যাখ্যা নেই এটা ছাড়া যে, অনলাইনে দুটি পক্ষের তথ্যযুদ্ধে ছড়ানো একটি ‘অপতথ্য’ সমাজে এত প্রভাব তৈরি করেছে যে, সেটিই ‘তথ্য’ আকারে অনেকের মাঝে, এবং বিশেষভাবে ‘সাংবাদিকদের মধ্যে’ স্থান করে নিতে পেরেছে! এবং এক পর্যায়ে সেটি সংবাদমাধ্যমের পাতা হয়ে সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে ‘তথ্য’ আকারে।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে অপতথ্য খবর বা তথ্য আকারে প্রকাশিত হওয়ার বিষয়টি মহামারি আকারে রূপ নিয়েছে। এসব অসত্য তথ্যের অনেকগুলো নিয়মিতভাবে বিভিন্ন ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা চিহ্নিত করলেও তাতে সংবাদমাধ্যমের সচেতনতা তৈরি হওয়ার লক্ষণ খুব একটা পরিলক্ষিত হচ্ছে না, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
গণমাধ্যমে ভুল তথ্য পরিবেশনার ফল অনেক ক্ষেত্রে অনেকের জন্য খুবই ভয়াবহ হতে পারে। আলোচ্য ঘটনায় আমরা সেটি দেখতে পাই। গণমাধ্যমে সাফা কবিরের লাশ উদ্ধারের খবর প্রচারিত হওয়ার পর অভিনেত্রী সাফা কবির তার ফেসবুক পোস্টে এসে নিজের জীবিত থাকা বিষয়ে পোস্ট দেন।
এরপরও অনেকে সেটি বিশ্বাস না করেননি। তখন এই অভিনেত্রী ফেসবুক লাইভে এসে জানান এই খবরটির কারণে তার পরিবার কী ধরনের বাজে পরিস্থিতিতে পড়েছে। সাফা সাংবাদিকদের কাছে আরও সচেতনতা কামনা করেন এবং দর্শকদের উদ্দেশ্যে তিনি তার ধর্ম বিশ্বাসের বিষয়ে বারবার আশস্ত করেন! তিনি জানান যে, তিনি নাস্তিক নন এবং তার বিরুদ্ধে আর কেউ যেন এই অভিধাগুলো প্রচার না করেন।
সাফা কবিরের এসব আকুতি থেকে পরিস্কার তিনি কতটা মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন এবং সেই উপলক্ষ্যটি তৈরিতে প্রচলিত সাংবাদিকতারও দায় রয়েছে। এর চেয়ে দু:খজনক বিষয় সংবাদমাধ্যমের জন্য আর কী হতে পারে!