কদরুদ্দীন শিশির

অতিথি লেখক
বিশ্বকাপ ফুটবল ও অনলাইন ভেরিফিকেশনে বাংলাদেশি মিডিয়ার দুর্বলতা
This article is more than 1 year old

বিশ্বকাপ ফুটবল ও অনলাইন ভেরিফিকেশনে বাংলাদেশি মিডিয়ার দুর্বলতা

কদরুদ্দীন শিশির
অতিথি লেখক

শেষ হয়েছে টানটান উত্তেজনাপূর্ণ এক বিশ্বকাপ। ছোট বলে পরিচিত কিছু দল অর্জনের খাতা খুলেছে। আবার বহু জায়ান্ট আশানুরূপ ফল করতে না পেরে হতাশ হয়েছে। আয়োজকরা সফল টুর্নামেন্ট উপহার দিতে পেরে আনন্দিত। ফুটবল দর্শক হিসেবে বাংলাদেশের আর্জেন্টিনা সমর্থকরাও ৩৬ বছর পর কাপ ঘরে নেওয়ার আনন্দে উল্লসিত। তবে সংবাদভোক্তা হিসেবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের পাঠকদের হতাশ হওয়ার কারণ আছে। ফ্যাক্টচেকারদের মনিটরিং থেকে জানা যাচ্ছে, টুর্নামেন্ট চলাকালে তারা অন্তত ১২টি ভুয়া খবর বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমে চিহ্নিত করেছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হিসেবে সমাদৃত সংবাদমাধ্যমগুলোও অন্তত একবার ভুয়া খবর প্রচারে শামিল হয়েছে! আর কেউ কেউ তা একাধিকবার করেছে।

দেশের শীর্ষ স্থানীয় একটি পত্রিকার একটি প্রতিবেদন দিয়েই উদাহরণ দেয়া যায়। ২৬ নভেম্বর পত্রিকাটি তাদের অনলাইন সংস্করণে একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম করে, “আর্জেন্টিনাকে হারানোয় রোলস রয়েস গাড়ি পাচ্ছেন সৌদি ফুটবলাররা”।

প্রতিবেদনের শুরুতে লেখা হয়েছে: “ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম ডেইলি মেইলের খবরে বলা হয়েছে, সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান আল সৌদ জাতীয় দলের প্রতিটি খেলোয়াড়কে রোলস-রয়েস ফ্যান্টম দিয়ে পুরস্কৃত করার ঘোষণা দিয়েছেন।”

একজন ফ্যাক্টচেকার হিসেবে খবরের মূল সূত্রটি যাচাই করে দেখতে খুঁজে বের করলাম ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইলের খবরটি। দেখা গেল, ডেইলি মেইল খবরটি নিজস্ব সূত্র থেকে পায়নি। প্রতিবেদনে লেখা, তারা খবরটি পেয়েছে ‘মালয় মেইল’ নামের মালয়েশিয়ান আরেকটি সংবাদমাধ্যম থেকে।

এবার মালয় মেইলের প্রতিবেদন খোঁজার পালা। খুঁজে দেখা গেল, এই পত্রিকাটি বলছে তারা খবরটি নিয়েছে আরও দুটি ওয়েবসাইট থেকে যাদের নাম যথাক্রমে মাই উইকএন্ড প্ল্যান এবং হারিয়ান মেট্রো

দুটি ওয়েবসাইটই মালয়েশিয় এবং এদের একটিও নিজেদের ‘সংবাদমাধ্যম’ হিসেবে দাবি করে না। মাই উইকএন্ড প্ল্যান আবার মাই নিউজ জিএইচ নামে ঘানা ভিত্তিক আরেকটি ওয়েবসাইটের বরাতে খবরটি প্রকাশ করেছে।

সর্বশেষ উল্লিখিত তিনটি ওয়েবসাইটের প্রতিবেদনে আলোচ্য খবরের মূল সূত্র হিসেবে সুহেল শেঠ নামে ভারতীয় এক ব্যবসায়ীর এবং আওয়াব আলাভি নামে পাকিস্তানি এক ডেন্টিস্টের টুইটের বরাত দেয়া হয়েছে।

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইলকে খবরের উৎস হিসেবে দেখিয়ে প্রতিবেদন করা হলেও বাস্তবে ডেইলি মেইল উৎস নয়।

এখানে প্রথম বিভ্রান্তিটি হচ্ছে, যে খবরটির দায় ডেইলি মেইল নিজে নিচ্ছে না সেটির দায় তার ওপর চাপানো (বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যম কর্তৃক)। এক্ষেত্রে বাংলা প্রতিবেদনে উল্লেখ করার প্রয়োজন ছিল যে, খবরটির মূল সূত্র হচ্ছে টুইটার; কোন নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম এটিকে নিজেদের স্বাধীন সূত্রের দ্বারা যাচাই করেনি।

এই পর্যায়ে যে প্রশ্নটি ওঠে তা হলো বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো কি অনলাইন ভেরিফিকিশনে একেবারেই অদক্ষ? যদি এই প্রশ্নের উত্তর ‘না’ সূচক হয় তাহলে পরের প্রশ্ন আসবে, তাহলে কি জেনেশুনেই এমন ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর খবর প্রকাশ করা হলো?! ডেইলি মেইল তো চরিত্রগতভাবে একটি ক্লিকবেইট সংবাদমাধ্যম। তারা মূল সূত্র উল্লেখ না করে অথবা সেই মূল সূত্রটি নির্ভরযোগ্য কিনা তা উল্লেখ না করে অন্য আরেক সংবাদমাধ্যমের ওপর দায় চাপিয়ে কিছু ক্লিক অর্জন করা তার চরিত্রের সাথে মাননসই। তাহলে কি বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোও নিজেদেরকে ক্লিকবেইট চরিত্রের ট্যাবলয়েড হিসেবে দেখতে চায়?

আর উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ সূচক হয়ে থাকে তাহলেও তা দুর্ভাগ্যজনক। ইন্টারনেটের যুগে যখন উন্মুক্ত অনেক সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য সংবাদ প্রতিবেদনে ব্যবহারের প্রয়োজন পড়তে পারে। এ কারণে অনলাইন ভেরিফিকেশন একজন সাংবাদিকের মৌলিক দক্ষতাগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। মূলধারার কোনো সংবাদমাধ্যমে এই অতিপ্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব থাকা এবং এর ফলে পাঠকের কাছে ভুয়া তথ্য ‘খবর’ আকারে পৌঁছে দেয়া খুবই পরিতাপের বিষয়।

ওপরে যেমন দেখানো হয়েছে কয়েকটি ক্লিকের বিনিময়ে খবরটির মূল সূত্রে পৌঁছা সম্ভব হয়েছে। এরপর সেই ‘মূল সূত্র’ তথা টুইটগুলো যারা করেছেন তাদের নির্ভরযোগ্যতা, আলোচ্য সংবাদ-সংশ্লিষ্ট তথ্যে তাদের প্রবেশাধিকার থাকা না থাকা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষীয় ব্যক্তিদের বক্তব্য যাচাই করে সেটি যে ভুয়া তথ্য তা প্রকাশের আগেই নিশ্চিত হওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু কিন্তু তা করা হয়নি।

খবরটি ছড়ানোর দুইদিন পর সৌদি টিম, সংবাদ সম্মেলনে এটিকে ভুয়া তথ্য হিসেবে জানায়। কিন্তু তার আগেই ফ্যাক্টচেকাররা খবরটি মূল সূত্রের অনির্ভরযোগ্যতার বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন এবং এটিকে ভুয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

কাতার বিশ্বকাপ চলাকালে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে এমন ভুয়া ফেসবুক পেজ, অনির্ভরযোগ্য টুইটার হ্যান্ডেল, ভুয়া ওয়েবসাইট ইত্যাদির বরাতে অন্তত ১২টি ভুয়া খবর প্রকাশিত হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রকাশিত হয়েছে ভুল ছবি বা ভিডিও।

বাংলাদেশি মিডিয়ায় ভুয়া খবর প্রচারের এই প্রবণতা বেশ অনেক দিন ধরেই দেখা যাচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে এদেশে ফ্যাক্টচেকাররা কাজ করছেন এবং তারা অব্যাহতভাবে মূলধারার মিডিয়ায় ভুয়া খবর চিহ্নিত করে আসছেন। বিশেষ করে করোনা মহামারির শুরুর দিকে ভুয়া তথ্যের রীতিমত মহামারি ছিল সংবাদমাধ্যমে। এর বাইরেও রাজনীতি, বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অনেক বিষয়ে নিয়মিতই ভুয়া তথ্য মিডিয়াতে খবর আকারে প্রকাশিত হয়েছে।

একজন ফ্যাক্টচেকার হিসেবে নিয়মিত মিডিয়া মনিটরিংয়ের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, মূলত অনলাইন ভেরিফিকেশনের দুর্বলতা এবং কোন খবরকে কত দ্রুত প্রকাশ করা যায় তার প্রতিযোগিতা– এই দুইয়ের কারণেই মূলধারার সংবাদমাধ্যমে এত পরিমাণ ভুয়া খবর প্রকাশিত হচ্ছে।

মিডিয়ায় সাধারণ মানুষের আস্থার ঘাটতি যখন চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে তখন সাংবাদিকদের দ্বারা ভুয়া খবর ছড়ানো সেই আস্থাকে আরও সঙ্কটেই ফেলবে এবং পাঠকদের অনির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সূত্র/উৎসের দিকে ঠেলে দেবে; যা দিনশেষে সাংবাদিকতার জন্য অশনিসংকেত।

কদরুদ্দীন শিশির

বাংলাদেশের একজন প্রতিষ্ঠিত ফ্যাক্টচেকার। বর্তমানে তিনি এএফপি ফ্যাক্টচেকের বাংলাদেশ সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন।

আরো কিছু লেখা