কদরুদ্দীন শিশির

অতিথি লেখক
আইএমএফ নিয়ে ভুল তথ্য ও ভুল সূত্রের খবর যখন প্রথম আলোয় 
This article is more than 1 year old

আইএমএফ নিয়ে ভুল তথ্য ও ভুল সূত্রের খবর যখন প্রথম আলোয় 

কদরুদ্দীন শিশির
অতিথি লেখক

গতকাল রোববার (১৫ জানুয়ারি) প্রথম আলো তাদের অনলাইনে “সংকটের সীমানায় অর্থনীতি: আইএমএফ” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। একই শিরোনামে প্রতিবেদনটি তাদের ছাপা সংস্করণেও প্রকাশিত হয়েছে।

পত্রিকাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রথম দুটি অনুচ্ছেদ নিচে তুলে ধরা হলো:

“বাণিজ্য-ঘাটতি, ক্রমবর্ধমান জ্বালানি খরচ ও মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় সংকটের সীমানায় রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। অথচ বৈশ্বিক মহামারি এবং মহামারি-পরবর্তী সময়ে বিশ্বে অর্থনৈতিক যে মন্দা দেখা দিয়েছে, তার আগে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিই ছিল।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) উপব্যবস্থাপনা পরিচালক বা ডিএমডি অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহর ঢাকা সফর উপলক্ষে আইএমএফের ‘ফরেন ব্রিফ’ অংশে গতকাল শনিবার এসব কথা বলা হয়েছে। আইএমএফের ডিএমডি গতকাল দুপুরে বাংলাদেশে এসেছেন। পাঁচ দিনের সফর শেষ করে ১৮ জানুয়ারি ঢাকা ছাড়বেন তিনি।”

প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী ওপরের তথ্যগুলো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল “আইএমএফের ‘ফরেন ব্রিফ’ অংশে” প্রকাশিত হয়েছে।

কিন্তু আইএমএফ এর ওয়েবসাইটে (www.imf.org) ‘ফরেন ব্রিফ’ বলে কোন ট্যাব বা সেকশন নেই। গুগলে সার্চ করে foreignbrief.com নামে একটি ওয়েবসাইট পাওয়া যায়। সেখানে একটি প্রতিবেদন রয়েছে, যার বক্তব্যের সঙ্গে প্রথম আলোর প্রতিবেদনের বক্তব্য মিলে যায়।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনের প্রথম অনুচ্ছেদে যে বক্তব্যটি আইএমএফের বলে তুলে ধরা হয়েছে সেই বক্তব্য ‘ফরেন ব্রিফ’ ওয়েবসাইটের প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে এভাবে:

“The Bangladesh economy was one of the fastest growing in the world before the pandemic and subsequent global economic downturn. Now, its economy is bordering on crisis as trade deficits, rising fuel costs, growing inflation, and shrinking foreign currency reserves.”

ফরেন ব্রিফের প্রতিবেদেনে, কোথাও এই অংশকে আইএমএফের বক্তব্য বা পর্যালোচনা বলে দাবি করা হয়নি। সেখানে বরং এই বিশ্লেষণকে উপস্থাপন করা হয়েছে আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের সফরের পটভূমি হিসেবে, রয়টার্স এবং তাদের নিজেদের একটি পুরনো খবরের বরাতে, যা সেই প্রতিবেদনেও হাইপারলিংক করা রয়েছে।

১৬ জানুয়ারি, আইএমএফ তাদের ওয়েবসাইটে অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ-এর একটি সংবাদ বিবৃতি প্রকাশ করে। এর বাইরে, তাঁর বর্তমান বাংলাদেশ সফর নিয়ে আইএমএফের ওয়েবসাইটে আর কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি।

প্রথম আলোর শিরোনামটি করা হয়েছে ‘ফরেন ব্রিফ’ এর প্রতিবেদনের “Now, its economy is bordering on crisis…” অংশ থেকে। এটিকে প্রথম আলো আইএমএফের বক্তব্য হিসেবে তুলে ধরেছে। কিন্তু বাস্তবে এটি ফরেন ব্রিফের প্রতিবেদনের ভাষা, আইএমএফের নয়। আর ফরেন ব্রিফ খবরটি ছেপেছে তাদের প্রাত্যহিক ব্রিফের অংশ হিসেবে, যার শিরোনাম ছিল “IMF Official visits Bangladesh”। সেটি লিখেছেন ওয়েসকট ইয়াও, যিনি ফরেন ব্রিফের একজন কপি-এডিটর ও বিশ্লেষক হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছেন।

ওয়েবসাইটটি ‘অ্যাবাউট’ সেকশনে নিজেদের আইএমএফের ‘অংশ’ বলেও দাবি করেনি। বরং ‘ফরেন ব্রিফ’ লিখেছে যে এটি ভূ-রাজনৈতিক তথ্যের একটি ওপেন সোর্স উৎস এবং তাদের মনোযোগ মূলত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে ঘিরে। 

তাদের ওয়েবসাইটে পাওয়া বিবরণ নিচে হুবহু তুলে ধরা হলো: “Foreign Brief is an industry-leading source of open source geopolitical intelligence focused first on the Indo-Pacific. We help our customers make sense of the world. Like a translator, our mission is to decipher complex global events in a coherent and contextualized way.”

তারা আরও লিখেছে: “ফরেন ব্রিফের পণ্যগুলো বিস্তৃত পরিসরের সময়ক্রম কাভার করে, যার মধ্যে ডেইলি ব্রিফ, সাপ্তাহিক ঘটনাবলীর সারসংক্ষেপ রাডার সুইপ, দীর্ঘমেয়াদী ইনসাইট রিপোর্টস এবং বিষয়ভিত্তিক ডিপ ডাইভস রয়েছে।” 

সাইটে দেওয়া “টার্মস অব ইউজ” পেইজ থেকে জানা যায়, ওয়েবসাইটটি মূলত “Foreign Brief Pty Ltd” নামের একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের। তাদের টুইটার অ্যাকাউন্ট চালু হয় ২০১৫ সালে এবং তাতে ফলোয়ার সংখ্যা দেড় হাজারের কিছু বেশি। একই বছর ওয়েবসাইটটিও আত্মপ্রকাশ করে। 

আইএমএফের ওয়েবসাইটে এবং গুগলে কীওয়ার্ড সার্চ করেও ওয়েবসাইটটির সঙ্গে আইএমএফের কোন সম্পর্ক থাকার প্রমাণ মেলেনি।

প্রথম আলোর এই প্রতিবেদনে ভুল তথ্য হচ্ছে, আইএমএফ যা বলেনি সেই বক্তব্যকে সংস্থাটির নামে প্রকাশ করা এবং একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসায়িক ওয়েবসাইটের প্রতিবেদনকে ‘আইএমএফের অংশ’ হিসেবে তুলে ধরা।

অনলাইন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যকে যথাযথভাবে যাচাই না করে ভুল খবর প্রকাশের ঘটনা, বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে। গত ফুটবল বিশ্বকাপের সময়ও এমন অনেক ভুয়া খবর ছড়িয়েছে। বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মূলত অনলাইনে পাওয়া তথ্যের মূল সূত্রকে ঠিক মতো যাচাই না করার কারণে এই ভুয়া খবরগুলো সংবাদমাধ্যমের পাতায় উঠে এসেছে।

কদরুদ্দীন শিশির

বাংলাদেশের একজন প্রতিষ্ঠিত ফ্যাক্টচেকার। বর্তমানে তিনি এএফপি ফ্যাক্টচেকের বাংলাদেশ সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন।

আরো কিছু লেখা