ডিসমিসল্যাব

অফিসিয়াল ডেস্ক
অনলাইনে ভুল তথ্য থেকে বাঁচার ৫টি বিশেষজ্ঞ পরামর্শ
This article is more than 1 year old

অনলাইনে ভুল তথ্য থেকে বাঁচার ৫টি বিশেষজ্ঞ পরামর্শ

ডিসমিসল্যাব
অফিসিয়াল ডেস্ক

সমাজে ভুল তথ্য ছড়াতে শুরু করলে তা জনস্বাস্থ্য থেকে শুরু করে গণতন্ত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ সব ক্ষেত্রেও মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

তবে অনলাইনে ভুল তথ্য সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবিলা করার কাজটি দুরূহ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তদারকি কোনো সহজ বিষয় নয়। দেখা যায়, এক ধরনের ভুল তথ্য যাচাই করতে করতেই অন্য কোনো ভুয়া তথ্য তার জায়গা নিয়ে নেয়। তাছাড়া সরকার ও করপোরেশনগুলো কীভাবে এ ধরনের সমস্যা ও সেন্সরশিপের বিপদ সামাল দেবে– তা নিয়েও আছে উদ্বেগ। 

বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য

আমরা বুঝতে চেয়েছিলাম যে, কীভাবে মানুষ অনলাইনে ভুল তথ্যের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। এজন্য সোশ্যাল সায়েন্সেস অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ রিসার্চ কাউন্সিল (এসএসএইচআরসি)-র অর্থায়নে পরিচালিত একটি প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা একটা পডকাস্ট তৈরি করেছি, যেখানে আমরা উত্তর আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যের একদল গবেষকের সাক্ষাৎকার নিয়েছি।  

তাদের কাছ থেকে পাওয়া উত্তরগুলোকে আমরা মোটাদাগে ৫টি বিষয়ে ভাগ করেছি। 

১। শেয়ার করার বিষয়ে সচেতন হোন এবং তথ্যসূত্র যাচাইয়ে আরও সময় দিন। টরন্টো মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির সোশ্যাল মিডিয়া ল্যাবের ফিলিপ মাই যেমনটি বলেছেন,

“কোনো পোস্ট রিটুইট বা শেয়ার করার জন্য উদগ্রীব না হয়ে আগে সূত্র সম্পর্কে জানুন। কোনো কিছু আপনাকে আবেগতাড়িত করলে শেয়ার করার আগে দেখে নিন এটি কে শেয়ার করেছে। শুধু কে শেয়ার করছে তা-ই নয়, কীভাবে তারা এই তথ্য পেল, সেটিও যাচাই করে নিন”।

সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় পড়ার মাধ্যমেও আপনি তথ্যের মান যাচাই করতে পারেন। সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় পড়া বলতে বোঝানো হয়েছে, যে জিনিসটি আপনি শেয়ার করছেন তার বিকল্প উৎসগুলো দেখে নেওয়া। এতে পোস্টটি আসলেই কতটূকু বিশ্বাসযোগ্য সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। কগনিটিভ সাইকোলজির অধ্যাপক স্টিফেন লিউয়ান্ডাউস্কির মতে,

“অন্যান্য ওয়েবসাইটে এ সম্পর্কে কী তথ্য মিলে– তা দেখুন। যেমন, উইকিপিডিয়ার কোনো আর্টিকেল সামনে আসতে পারে, যেখানে বলা হচ্ছে সেই ওয়েবসাইটটি জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত বা… অজ্ঞাত কোনো সূত্র থেকে এর তহবিল জোগান দেওয়া হয় বা এ ধরনের কিছু। এবং এটি জানামাত্রই আপনি সেই সূত্রটিকে বাতিলের খাতায় ফেলতে পারেন, ধরে নিতে পারেন সেটি কম বিশ্বাসযোগ্য”।

২। বিভিন্ন সংবাদ সূত্র যাচাই করুন এবং সুপরিচিত সংবাদমাধ্যমগুলোর গ্রাহক হোন প্রয়োজনের সময় সঠিক খবর পাওয়া নিশ্চিত করতে সম্ভব হলে স্বনামধন্য নিউজ সাইটগুলো সাবস্ক্রাইব করুন। আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্যবিষয়ক আইন ও নীতিমালার রিসার্চ চেয়ার টিমোথি কাউলফিল্ডের মতে,

“বিভিন্ন মতাদর্শের সংবাদ ও মতামত পড়ুন। বিস্তৃত চিন্তাধারার পত্রপত্রিকার গ্রাহক হোন। এর ফলে আপনি একই ধরনের আলোচনার পুনরাবৃত্তি না দেখে বিভিন্ন ধারার মত সম্পর্কে জানতে পারবেন।”

ভুল ও বিভ্রান্তিকর হাজারো তথ্যের মাঝে বিশ্বস্ত সংবাদ সূত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন হতে পারে। তবে অনেক টুল আছে যেগুলো আমাদের সাহায্য করতে পারে। দ্য মিসইনফরমেশন এজ বইয়ের সহলেখক ও ফিলোসফি স্কলার কেলিন ও’কনরের মতে,

প্রপ ওয়াচের মতো কিছু ওয়েবসাইট রাজনীতিবিদ বা মিডিয়া কর্মীদের  প্রোপাগান্ডা কৌশল সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে। এসব জায়গা থেকে মানুষ প্রশিক্ষণ নিতে পারে”।

প্রপ ওয়াচ মূলত অলাভজনক শিক্ষামূলক একটি ওয়েবসাইট। এখানে বিভিন্ন ধরনের প্রোপাগান্ডার ক্যাটালগ আছে, যেগুলো আপনি সার্চ করতে পারবেন। এর মাধ্যমে আপনি এসব প্রোপাগান্ডার ধরন বুঝতে পারবেন এবং অনলাইনে সেগুলো আরও ভালোভাবে সনাক্ত করতে পারবেন। 

৩। জানুন এবং সামনে থাকা তথ্যগুলোকে প্রশ্ন করতে শিখুন। সতর্ক দৃষ্টিতে সন্দেহের চোখে যেকোনো বিষয়কে দেখতে শুরু করলে আপনি এমন অনেক ভুল তথ্য থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন, যেগুলো হয়তো অন্য সময় আপনি সহজেই গ্রহণ করতেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্কম্যান ক্লেইন সেন্টার ফর ইন্টারনেট অ্যান্ড সোসাইটি ফ্যাকাল্টি কো-ডিরেক্টর ইয়োচাই বেঙ্কলারের পরামর্শ: 

“যা শুনছেন তার সবই যদি সন্দেহজনক দৃষ্টিতে দেখতে শিখে যান, তাহলেই ফাঁদে পড়া থেকে বাঁচতে পারবেন। এমনটা না যে সবাই মিথ্যা বলবে, কিন্তু ভুল সবারই হতে পারে। তাই সূত্র যাই হোক না কেন সংশয় ধরে রাখুন”।

“সংশয়বাদী হওয়ার ভালো একটি উপায় হলো প্রতিটি ঘটনায় ক্ষমতা সম্পর্কের বিষয়টি অনুসন্ধান করা। স্পিন ডক্টরস বইয়ের লেখক ও সাংবাদিক নোরা লোরেটো বলেন, “ক্ষমতা কার হাতে? কার কাছে ক্ষমতা নেই? ক্ষমতাধরকে কে চ্যালেঞ্জ করছে? এই ক্ষমতা আসল কোথা থেকে? এই ক্ষমতা কীভাবে টিকে আছে?– এইসব প্রশ্ন করুন”।

৪। নিজের সঙ্গে এবং আপনার কমিউনিটির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলুন, যেন চারপাশের জগত সম্পর্কে আরও ভালো তথ্য পেতে পারেন। বর্তমান অ্যাটেনশন ইকোনমির যুগে, আমরা প্রতিনিয়ত নানা ধরনের তথ্যপ্রবাহের মধ্যে ডুবে আছি। 

শিক্ষা ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ শ্যান্ডেল হোল্ডেন বলেন, “অ্যাটেনশন ইকোনমি সত্যিই এক বিচ্ছিন্নকরণের অর্থনীতি, এবং এটি আমাদের সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে”। তিনি আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর প্রতি এবং বিভিন্ন বিষয় আমাদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে– সেগুলোর দিকে আরও ভালোমতো নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইন পরিসর আমাদের বাস্তব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে। কিন্তু নিজেদের সমাজ-সম্প্রদায়ের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে আমরা অন্যদের সঙ্গে মুখোমুখি তর্ক-বিতর্কের সুযোগ পাই। এই বিষয়টি ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী জিও তাকাচ বলেন, “মানুষের সঙ্গে মিশুন। তাদের সঙ্গে আপনার দ্বিমত থাকলেও তাদের কথা শুনুন এবং মূল্যবোধ অনুযায়ী মিলগুলো খুঁজে দেখুন”।

৫। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাঠামোগত পরিবর্তন আনার চেষ্টা করুন। যেমন, এমন রাজনীতিবিদদের নির্বাচিত করুন, যারা ভুল তথ্য মোকাবিলা, এবং তথ্যের নির্ভরযোগ্য উৎসগুলোকে সহায়তা করতে চান। ভুল তথ্য আসলে একটি বৃহৎ কাঠামোগত ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি থাকার লক্ষণ। সামাজিক বৈষম্য থেকে শুরু করে যথাযথ আইনি অবকাঠামো না থাকার মতো গুরুতর সব কারণে ভুল তথ্য ছড়িয়ে থাকে। ও’কনরের মতে, 

“আমার মতে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এমন রাজনীতিবিদদের নির্বাচন করা যারা এসব বিষয়ে মাথা ঘামান। ব্যক্তিপর্যায়ে আপনি যাই করুন না কেন, কাঠামোগত ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ”।

সুস্থ তথ্যপ্রবাহের পরিবেশ ধারণ করতে পারে– এমন একটি কাঠামোগত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে ব্যক্তিপর্যায়ে ভুল তথ্য ছড়ানোও কমে আসবে। সার্বিকভাবে, ভুল তথ্য মোকাবিলায় ব্যক্তি, প্রাতিষ্ঠানিক ও সমাজ কাঠামোর প্রতিটি স্তর থেকেই উদ্যোগ নিতে হবে। তবে নিজেদের অবস্থান থেকে আমরা সকলেই ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সমর্থ্য হব, যার প্রভাব পুরো তথ্য ব্যবস্থাপনাতেই পরিলক্ষিত হবে।


জাইগ্রিস হডসনআন্দ্রেয়া গ্যালিজ্জিয়া-র এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল দ্য কনভারসেশন-এ। ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে লেখাটি পুনরায় এখানে প্রকাশ করা হলো। বাংলায় অনুবাদ করেছেন তামারা ইয়াসমীন তমা।

আরো কিছু লেখা