ডিসমিসল্যাব
রাজনৈতিক বয়ান বুঝতে ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের সঙ্গে দরকার এখন স্পিন-চেকিং
ডিসমিসল্যাব
আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট-চেকিং দিবস-২০২৪ উপলক্ষে সম্প্রতি মিলিয়ানা রোজাকের মন্তব্য প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে পয়েন্টার। বিশ্বব্যাপী ফ্যাক্ট-চেকারদের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিতে প্রতিবছর ২ এপ্রিল দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। মিলিয়ানা রোজাক সার্বিয়ার বেলগ্রেডের ফ্যাক্ট-চেকিং গ্রুপ ইস্টিনোমারের নির্বাহী সম্পাদক।
চলছে নির্বাচনী কারসাজি। একদিকে পশ্চিম ও অন্যদিকে রাশিয়ার পক্ষ নিয়ে বিভক্ত সমাজ। জনগণ (সার্বিয়ার) অপেক্ষা করছে এমন একজন শক্তিশালী নেতার যিনি “দেশকে সংকট থেকে বেরিয়ে আসায় দৃঢ় হাতে নেতৃত্ব দেবেন”। পক্ষপাতদুষ্ট প্রচারণার ঘূর্ণনে সার্বিয়া, যাকে বলা হচ্ছে ‘রুল অব স্পিন’। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো, সেই সঙ্গে রাজনীতিবিদরাও জনমানুষকে গ্যাসলাইটিং করছে, ছড়াচ্ছে ভুয়া তথ্য। এসবই বর্তমানে সার্বিয়ার ‘স্পিনোক্রেসি’র ছবি।
সার্বিয়ার বহুমুখীন কারসাজি অনেক সময়ই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দুষ্টচক্রের ঘটানো। তবে সিংহভাগ ক্ষেত্রেই এর নেপথ্যে থাকে সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ এবং সরকার সমর্থক মিডিয়া। এগুলো মোকাবেলায় আমরা ফ্যাক্ট চেকাররা নতুন এক কৌশল নিয়েছি, যাকে আমরা বলছি ‘স্পিন-চেকিং’। তার মানে হচ্ছে, একটি তথ্য সত্য না মিথ্যা কেবল এটাই দেখা নয়, আমরা আরও গভীরে যাচ্ছি। আমরা আমাদের রিপোর্টিং দিয়ে জনগণের সঙ্গে করা প্রতারণার ধরনে আলোকপাত করতে চাই, প্রোপাগান্ডার উন্মোচন চাই, মানুষকে আবেগতাড়িত করতে বিশেষ কোনো ভাষার ব্যবহার হচ্ছে কিনা চিহ্নিত করতে চাই তাও; বিশেষ করে রাজনৈতিক নয়ছয়ের কূটকৌশলগুলো আমরা আতশ কাঁচ দিয়ে দেখতে আগ্রহী।
এই নির্বাচনী বছরে পৃথিবীর অনেক দেশের রাজনীতি সরগরম। অপতথ্য ছড়ানোকে জবাবদিহির আওতায় আনার বিতর্কটাকে উপযুক্ত জায়গায় আনার ক্ষেত্রে এটা একটা বড় সুযোগ হতে পারে। দূষিত একটি তথ্যসমাজে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে রাজনীতিবিদদের কী ধরনের ভূমিকা থাকা জরুরি, গণমাধ্যমই বা কীভাবে তাদের দায়বদ্ধ করতে পারে? সাংবাদিকরা এই সময়ে এসে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কারসাজি, প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে অন্যায় আচরণ ও বাইরের দেশের প্রভাব আছে কিনা এ নিয়ে তাদের মনে ভয় কাজ করে। নতুন নতুন ডিজিটাল ফরেনসিক টুল প্রয়োগ করা তাদের শিখতে হয়। সেই সঙ্গে আছে সময়ের নিরন্তর চাপ। এতোসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যে আমরা অনেক সময় ভুলে যেতেই পারি যে সত্যিকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী আসলে কারা।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা এবং রাজনৈতিক যোগাযোগ বিভাগের অধ্যাপক রাসমুস ক্লিস নিয়েলসেন সম্প্রতি ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে এক লেখায় এনেছেন বিষয়টি। তিনি বলেছেন, অনলাইন উৎসগুলো থেকে আসা ভুয়া তথ্যের তুলনায় রাজনীতিবিদদের মাধ্যমে আসা ভুয়া তথ্য সম্ভবত বেশি প্রভাব ফেলতে সক্ষম। একইভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল ট্রাইসম্যান তাঁর “স্পিন ডিকটেটরস: ২১ শতকে স্বৈরতন্ত্রের বদলে যেতে থাকা মুখ” গ্রন্থে দেখিয়েছেন কীভাবে স্বৈরশাসকরা তাদের শাসনতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে প্রায়ই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মূলধারার গণমাধ্যমের অপব্যবহার করেন। ট্রাইসম্যান লিখেন, “স্পিন ডিক্টেটররা প্রায়শই সন্দেহ ছড়িয়ে দিতে ভালোবাসেন, মাত্র একটি সত্য তুলে ধরার বদলে”। তাঁরা গণতন্ত্রের মুখোশে কোনোই আঁচড় পড়তে না দিয়ে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করেন, কোণঠাসা করে দেন প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের।
সার্বিয়ার ফ্যাক্ট-চেকাররা ক্রমশই বাধার বেড়াজালে আটকা পড়ছেন। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আরোপ হয়েছে নতুন সীমারেখা। সাংবাদিকরা হুমকি ও হয়রানির শিকার। এমনকি সহিংসতার ঘটনার বেলায়ও তৈরি হয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। রাজনীতিবিদদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিকেও সত্য হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। তাঁদের দীর্ঘ বক্তব্য থেকে তৈরি করা হচ্ছে বাস্তবতাবর্জিত বিকৃত ছবি। বিভিন্ন সরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে নতুন করে লেখা হচ্ছে ইতিহাস; এবং নির্মাণ করা হচ্ছে ব্যক্তিত্বের অন্ধ আনুগত্য।
তবে এসবের অর্থ এই নয় যে আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও ভুয়া তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইস্তফা দিয়েছি। এসব প্রতিবন্ধকতা বরং আমাদের মিথ্যা খণ্ডনে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে নতুন পথ সন্ধানের প্রেরণা জুগিয়েছে। ফ্যাক্ট-চেকিং, একটি অপতথ্য চাউর হওয়ার আগেই ভুলটি মানুষকে ধরিয়ে দেওয়া এবং জনগণকে গণমাধ্যম সম্পর্কে আরো অবহিত করার চেয়েও বেশিকিছু করতে চাচ্ছি আমরা। তথ্যের সত্যাসত্য যাচাইয়ের বাইরেও আমরা বয়ান, সেই সঙ্গে ভাষা বিশ্লেষণের ওপর মনোযোগ দিয়েছি। এক কথায়, আমাদের কাজকে আরও বহুদূর এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করছে স্পিন-চেকিং।
নতুন এই পদ্ধতিটি খুবই উপকারী বলেও প্রমাণিত হচ্ছে, বিশেষ করে নির্বাচনী নজরদারির ক্ষেত্রে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে স্পিন-চেকিং পাঠকদের সঙ্গে আমাদের এংগেজমেন্ট বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। পাশাপাশি সাহায্য করেছে নানা সামাজিক মাধ্যমে আমাদের অনুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধিতেও । ফ্যাক্ট-চেকিং এর পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক বক্তৃতার সরাসরি কভারেজ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইভ ফ্যাক্ট চেকিং করার মাধ্যমে আমরা স্বতস্ফূর্তভাবে বেশি বেশি স্পিন-চেক শুরু করেছি। সকলে মিলে পুরো স্পিনিং প্রক্রিয়াটাকেই আমরা ঢেলে সাজিয়েছি।
একটা বিষয় জোর দিয়ে বলা জরুরি যে, স্পিন-চেকিং কিছুতেই ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের বিকল্প নয়, বরং এ এর মানোন্নয়ন ঘটানোয় ভূমিকা রাখছে।
তথ্য যাচাই ও অপতথ্য ধরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি আমরা নতুন কিছু কাজ করছি। যেমন জনগণকে প্রতারিত করার কৌশলসমূহ উন্মোচন, রাজনীতিবিদরা প্রপাগান্ডা কৌশলের যে অপপ্রচার চালান তার বিশ্লেষণ, স্পিন তৈরিতে গণমাধ্যমও যে ভূমিকা রাখছে তা ধরিয়ে দেওয়া, মানুষকে অবেগতাড়িত করতে কী ধরনের ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে সেগুলো চিহ্নিতকরণ, দায় এড়াতে বিরোধীপক্ষের ওপর যেসব ভাষা দোষ চাপানো হয় তা বিশ্লেষণ, খবরে ইচ্ছেমতো শিরোনাম বসিয়ে সমস্যা তৈরির পন্থাগুলো গবেষণা করা এবং বেশি প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা কখন দৃশ্যপটে হাজির হচ্ছেন তা নজরে রাখার মতো কাজগুলো আমরা এখন করছি।
এক্ষেত্রে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে যে ফ্যাক্ট চেকিং-এর তুলনায় স্পিন-চেকিং অনেক বেশি সাবজেক্টিভ। এই উদ্বেগও নিরসন করবে বেশি বেশি তথ্য।
স্পিন কী তা বোঝা কঠিন মনে হতে পারে; কখনো কখনো নিতে হতে পারে বেশি সময়। কিন্তু কোনো কিছু মানুষকে গোলকধাঁধায় ফেলে দিলে ফ্যাক্ট চেকারদের তাঁদের গৎবাঁধা দায়িত্ব থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে।
স্পিন-চেকিং মানেই হচ্ছে আমাদের নিরবচ্ছিন্ন দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। যেমন, যদি দৃশ্যত মনেও হয় যে একজন রাজনীতিবিদ সঠিক বক্তব্য দিয়েছেন, যাচাই করতে হবে কোন প্রেক্ষাপটে তিনি কথাটি বলেছেন, কী কী মাধ্যমে এটা ছড়াচ্ছে, কেন ছড়াচ্ছে। আর আমাদের প্রায় ১৫ বছরের অস্তিত্বের সঙ্গে যে লক্ষ্যটি জড়িয়ে আছে তা হচ্ছে জনস্বার্থের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং প্রকাশ্যে যতো শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে সব জবাবদিহির আওতার দাবিটা তোলা।
এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল পয়েন্টার-এ। বাংলায় অনুবাদ করেছেন তামারা ইয়াসমীন তমা।