ডিসমিসল্যাব

অফিসিয়াল ডেস্ক
এগোচ্ছে এআই, সাংবাদিকতাকে বাঁধতে হবে টেকসই নীতিমালায়
This article is more than 4 months old

এগোচ্ছে এআই, সাংবাদিকতাকে বাঁধতে হবে টেকসই নীতিমালায়

ডিসমিসল্যাব

অফিসিয়াল ডেস্ক

২০০১ সালে “নীতি, আত্মবিশ্বাস আর উদ্দেশ্যের সংকটে” ভুগছিল সাংবাদিকতা। টম রোজেনস্টিল ও বিল কোভাচ তাঁদের “দ্য এলিমেন্টস অব জার্নালিজম” গ্রন্থে সাংবাদিকতার পারিপার্শ্বিক পরিবেশের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন কথাটি। প্রজেক্ট ফর এক্সিলেন্স ইন জার্নালিজম নামের একটি উদ্যোগের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে বেশকিছু আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যার ফল ছিল এই গ্রন্থ। প্রকল্পটি শুরুর কাজে আমি  টম ও বিলকে সহায়তা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। 

দুই দশক পরে আমরা আরও এক সংকটের মুখোমুখি, আমি বলব সাংবাদিকতার জন্য এই সংকট আরও বেশি হুমকির। এই হুমকি মোকাবেলায় বিশ্বজুড়ে এখন আমাদেরকে ডিজিটাল ও কৃত্রিম বুদ্ধিমতটার উপযোগী সংবাদক্ষেত্রের জন্য নতুন করে নীতিমালা সাজাতে হবে। সংবাদ প্রতিবেদন তৈরি, পরিবেশন এবং তা গ্রহণে এখন সর্বাত্মকভাবে জড়িয়ে রয়েছে প্রযুক্তি। এখন অধিকাংশ সংবাদই যুক্ত অন্যান্য আরো অসংখ্য কনটেন্টের সঙ্গে; যেমন সোশ্যাল আপডেটস, সেলব্রিটি হট-টেক কিংবা কোনো ভিডিওর আসন্ন মুক্তি পাওয়া। বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে নানাবিধ কনটেন্ট তৈরির সুযোগ তথ্যপ্রযুক্তিকে নিয়ে যাচ্ছে গণমাধ্যম শিল্পের আরো গভীরে (এআই নিউজরুমে অনেক আগে থেকেই ছিল)। 

গণমাধ্যমের জন্য আগামী দিনের ব্যবসায় মডেল অবশ্যই বের করতে হবে, যাতে অন্তর্ভূক্ত থাকবে ডিজিটাল আয়ের নানান সুযোগও। তবে কোনো একটি মডেলকে সফল করতে চাইলে সাংবাদিকদের অবশ্যই এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, এআই এবং এআই নীতিমালার বিকাশ সাংবাদিকতাকেও শক্তিশালী করছে। আর তা যেন এমনভাবে হয় যে অন্য কনটেন্ট থেকে এআই কনটেন্টকে স্পষ্টভাবে আলাদা করা যাবে, আর তা হবে সংবাদ সংগ্রহ ও সাধারণ মানুষের কাছে সংবাদ পরিবেশন এই দুক্ষেত্রেই।

সংবাদ নীতিমালা সম্পর্কে দিন-দিন আলোচনা যখন বাড়ছে, কঠিন হয়ে উঠছে ‘সংবাদ’ আসলে কী তার একটি নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ। এদিকে একই সময়ে সংবাদদাতাদের প্রতি আমাদের বিশ্বাস, গণমাধ্যমের প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এছাড়া সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও বিশ্বব্যাপী আরও হুমকির মধ্যে রয়েছে, এমনকি যে দেশগুলোকে গণতান্ত্রিক বলে মনে করা হয় সেখানেও।

সম্পাদক ও প্রকাশক হোরেস গ্রিলি মতামত থেকে সংবাদকে আলাদা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তেমনি এআই- এরও রয়েছে নানাবিধ ব্যবহার। এআই নিউজ রিপোর্টিংয়ে যেমন সহায়তা করে, তেমনি কখনো কখনো ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে প্রতিবেদন প্রকাশকে করে তুলে কঠিন। এআই এর এই ব্যবহারগুলোকে পরস্পর থেকে পৃথক করে দেখার কাজে যাচাই, সত্যতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের নীতিগুলো কীভাবে প্রয়োগ করা যায় সে চিন্তার দায়িত্ব আজকের সংবাদ নেতাদেরই নিতে হবে। 

একটি বিশ্ব সমাজ হিসেবে আমরা সাংবাদিকতার নীতিমালাগুলোকে ডিজিটাল যুগের প্রয়োজনমতো নবায়ন করিনি। হ্যাঁ, ডিজিটাল সংবাদ কী তা বোঝাতে আমরা কিছু কাজ করেছি, অনলাইন কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ নিয়েছি এবং পাঠক-দর্শকদের সঙ্গে নতুন ধরনের কিছু সংযোগ স্থাপন করেছি।  কিন্তু গণমাধ্যম পৌঁছায় না এমন এলাকা বেড়েই চলেছে,  বাড়ছে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়াও। আগামী দিনের সাংবাদিকতা কেমন হবে সেই লক্ষ্যে নীতিমালা তৈরির জন্য আমরা যখন কথা বলছি, তখন আমাদের সাংবাদিকতার বর্তমান ভূমিকাটিও সত্যিকার অর্থে বিবেচনা করতে হবে। 

তথ্য যাচাই এখন কীভাবে কাজ করে? সাধারণ মানুষের জন্য কোন ধরনের এবং কোন পর্যায়ের সত্যতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ? দায়িত্বশীলতা এবং জনসেবার মনন থেকে রিপোর্টিং করার ক্ষেত্রে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে সাংবাদিকদের জন্য নতুন কী ধরনের স্বচ্ছতার প্রয়োজন রয়েছে?

এআই প্রযুক্তির সহায়তায় ডেটা ইনপুট, যাচাই ও আউটপুট প্রক্রিয়ায় এই প্রশ্নগুলো সামনে আসবে। উত্তর নির্ণয়ে সাংবাদিকদের (আমি বলব বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ের সাংবাদিকদের) নেতার ভূমিকা পালন করা উচিত। এর অর্থ হচ্ছে:

১। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও ঘটনা রিপোর্ট করার কাজে এআই টুলগুলোকে সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগানোর উপায় বের করা এবং কোন কাজে, কীভাবে সেগুলোর ব্যবহার হলো তার সর্বোচ্চ ব্যাখ্যা দেওয়া।

২। সাংবাদিকতার নতুন নীতিমালা কার্যকর করার সময় বিভিন্ন এআই মডেল ও অন্যান্য অ্যালগরিদম যাতে সঠিক কাঠামোয় থাকে তা  নিশ্চিতকরণে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কাজ করা।

৩। সাধারণ মানুষ নানা ধরনের এআই কনটেন্ট পাবে। এই নীতিগুলোর সহায়তা নিয়ে কীভাবে তারা কনটেন্ট বাছাই করবে তা তাদের শেখানো। এটি করা গেলে আস্থা এবং মূল্যমান বৃদ্ধিতেও সাহায্য করবে।

৪। এ ধরনের নীতি কাঠামো কীভাবে তাদেরকে নিরাপত্তা সহায়তা দিতে পারে, বা উল্টো ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে সেই আলোচনায় নেতৃত্ব দিতে হবে।

এখন স্বচ্ছতার একটি ক্ষেত্রে বেশি মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে- প্রামাণ্য (সময়ের সাথে সাথে কনটেন্ট এর পরিবর্তন) এবং উৎস। এ কাজে, উদাহরণস্বরূপ, জলছাপ ব্যবহার করা হয় খারাপ ব্যবহার ঠেকাতে। এই ধরনের টুল গুরুত্বপূর্ণ, তবে যথেষ্ট নয়। 

এআই কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তার উপর একটি কাজের গুরুত্ব অনেকাংশেই নির্ভর করে, প্রযুক্তির উত্তরোত্তর বিকাশের কারণে করবে ভবিষ্যতেও। এটা কি মানুষের কোনো কাজে এসেছে? এর মাধ্যমে কি একটি সংবাদ প্রতিবেদন আরো দ্রুত যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছে, বা আরও নানাবিধ মানুষের মাঝে ছড়াতে ভূমিকা রেখেছে?  গবেষণায় দেখা গেছে, ভুয়া তথ্য চিহ্নিত করার বর্তমান পদ্ধতিগুলোর দুর্বলতা রয়েছে। ভুয়া তথ্যের জন্য একটি সাধারণ লেবেল সেঁটে দেওয়া হলে মানুষ প্রায়ই আসল খবর উপেক্ষা করে। আবার যখন কোনো লেবেল থাকে না তখন সেগুলোকে মনে হতে থাকে সত্যি। গবেষণার এই ফল দাবি করে যে, একটি কনটেন্ট কী পথ ধরে এসেছে, এর শুরুটা কোথায়, তা জানার উপায়গুলো আরো সুস্পষ্ট থাকতে হবে, যাতে ফলাফলটা হয় কার্যকর। বহু মানুষই এখনো কৌশলগুলো সম্পর্কে বেশি কিছু জানে না। 

আমরা যেসব এআই ব্যবহার করি, বিশেষ করে যেগুলো সাধারণ মানুষকে সাহায্য করে, সেসব ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের আরও ব্যাখ্যা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, শিবস্টেড, একটি নরওয়েজিয়ান প্রযুক্তি এবং মিডিয়া কোম্পানি, নরওয়ের জন্য এমন একটি বড় ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল তৈরির দিকে নজর দিচ্ছে যা দেশের অন্যান্য প্রকাশকরাও ব্যবহার করতে পারে। একইভাবে অ্যাইমি রাইনহার্ট তাঁর এ আই স্টাডিজের টাও-নাইট ফেলোশিপের অংশ হিসেবে একটি ইন্টারফেস তৈরি করছেন যা দিয়ে সংবাদ মাধ্যমগুলো সবচেয়ে অত্যাধুনিক লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল ব্যবহার করতে পারবে।

প্রযুক্তি সংস্থাগুলোকেও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সাংবাদিকদের যেসব অনন্য কাজের ক্ষেত্র রয়েছে, সেগুলোকে সম্মান জানিয়ে তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে। মডেল এবং টুলগুলো যাতে স্বচ্ছ হয় নিশ্চিত করতে হবে, যাতে রিপোর্টাররা ফলাফল নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে গ্রাহকদের কাছে সংবাদ পৌঁছে দিতে পারেন এবং টুলগুলোও যেন হয় সকলের ব্যবহার উপযোগী। 

পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো সুবিধাগুলো সর্বাধিক নিশ্চিত করার পাশপাশি সমস্যাগুলো প্রতিরোধে সঠিক সরকারি নীতিমালা থাকা। এই অধিকারটি অর্জনে সাংবাদিক, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের এক হতে হবে। তাদের এমন সমাধানে আসতে হবে যা গণমাধ্যমকে রাখবে স্বাধীন, জনগণের অধিকার করবে সুরক্ষিত,  নিয়মিতভাবে ডেটা ও ট্রেন্ড পর্যালোচনা করা হবে এবং অগ্রসর হবে পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে; আর এই সবই করা হবে সাংবাদিকতার মূল মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। 

আমাদের গ্লোবাল ও ডিজিটাল সংবাদক্ষেত্রগুলো যেসব সমস্যার মধ্যে রয়েছে সেগুলোকে বিবেচনায় রেখে সাংবাদিকতাকে সংজ্ঞায়িত করাই আমাদের প্রতিষ্ঠান “সেন্টার ফর নিউজ, টেকনোলজি অ্যান্ড ইনোভেশনে”-র লক্ষ্য। 

সম্ভাব্য সমস্যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি আমাদেরকে সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ নিয়েও কথা বলতে হবে। আমাদের সাংবাদিকতার এমন একটি ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে, যেখানে প্রযুক্তিগত সকল সুবিধাই পাওয়া যাবে- একই সঙ্গে জনসাধারণের কাছে তা হয়ে উঠবে স্বীকৃতির যোগ্য, নিরাপদ ও মূল্যায়িত।


যুক্তরাষ্ট্রের “সেন্টার ফর নিউজ, টেকনোজলি অ্যান্ড ইনোভেশন”-এর ফাউন্ডিং এক্সিকিউটির ডিরেক্টর এমি মিশেলের এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় পয়েন্টার-এ। ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে পুনরায় ডিসিমসল্যাবে প্রকাশ করা হলো। বাংলায় অনুবাদ করেছেন তামারা ইয়াসমীন তমা।

আরো কিছু লেখা