তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
ক্যান্সার নিয়ে ভুয়া প্রচারণা 
This article is more than 2 years old

ক্যান্সার নিয়ে ভুয়া প্রচারণা 

তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ‘ক্যান্সার আদৌ কোনো রোগ নয়’ শিরোনামে একটি পোস্ট (, , , ) ছড়িয়েছে। ড. বিকাশ গুপ্তের নামে ছড়ানো এই পোস্টটিতে চিনি খাওয়া বাদ দেওয়া এবং গরম পানিতে লেবুর শরবত খাওয়ার মাধ্যমে ক্যান্সার নিরাময় সম্ভব বলে দাবি করা হয়েছে।

এছাড়া পোস্টটিতে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে আরও ২০টি পরামর্শ দেওয়া হলেও বিভিন্ন ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা এসব দাবিকেও ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছে।

বাংলা ভাষায় ছড়িয়ে পড়া সাম্প্রতিক পোস্টে বলা হয়, “ডাঃ বিকাশ গুপ্ত বলেছেন, কেউই ক্যান্সারে মারা যাবেনা যদি তিনি নিম্নলিখিত কতিপয় সহজ পদক্ষেপ নেন।”

এরপর সেই পদক্ষেপগুলো কী তা একে একে লেখা হয়েছে:

“১:-চিনি খাওয়া বন্ধ করতে হবে। তাহলে ক্যান্সার এর জীবাণু এমনিতেই মারা যাবে।

২:-গরম পানিতে লেবুর সরবত ১-৩ মাস নিয়মিত পান করলে ক্যান্সার নিরাময়/প্রতিরোধ সম্ভব হয়। এটা কেমোথেরাপির চেয়ে ১০০০ গুন ভালো।এছাড়াও বলেছেন, অজ্ঞতা কোনো অজুহাত হতে পারেনা।ক্যান্সার প্রতিরোধে সহজ পদক্ষেপগুলো সবাইকে জানতে হবে। তিনি নিজেই এই কথাগুলো গত ০৫ বছর জাবৎ প্রচার করে চলেছেন।”

ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা গেছে, ২০১৯ সাল থেকে একই ধরনের ফেসবুক পোস্ট (, , ) ও পোস্টারের ছবি (, , ) ফেসবুকে প্রচারিত হয়ে আসছে। ২০২০, ২০২১২০২২ সালের বিভিন্ন সময়েও একই পোস্ট ভাইরাল হয়।

একই সময় রাশিয়ার ওএসএইচ স্টেট মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি মস্কোর ড. গুরুপ্রসাদ রেড্ডি (বি ভি)’র নামে ২০১৯, ২০২০, ২০২১২০২২ সালে চিনি খাওয়া ছেড়ে দেওয়া, গরম পানিতে লেবুর শরবত খাওয়ার পাশাপাশি প্রতিদিন অর্গানিক নারকেল তেল খাওয়ার মাধ্যমে ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে প্রচারিত হয়। তবে এই পোস্টের সঙ্গে ২০টি পরামর্শের বাকিগুলো যুক্ত ছিল না।

ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা গেছে, এসব দাবি ২০১৯ সালে ফেসবুকে ইংরেজি ভাষার একটি কনটেন্ট ভাইরাল হওয়ার পর থেকে বাংলায় ছড়াতে শুরু করে। 

তবে ফেসবুকে এ সংক্রান্ত সবচেয়ে পুরোনো পোস্টটি খুঁজে পাওয়া যায় ২০১৫ সালে। এখানে ড. বিকাশ গুপ্ত ও ড. গুরুপ্রসাদ রেড্ডি দুজনের নামই পাওয়া যায়। এই পোস্টে আলোচ্য দাবিটিকে মেরিল্যান্ড কলেজ অব মেডিসিন কর্তৃক করা একটি গবেষণার ফল হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তবে মেরিল্যান্ড কলেজ অব মেডিসিন বলে বাস্তবে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। 

বাংলায় পোস্টটি ড. গুপ্ত এবং ড. গুরুপ্রসাদ রেড্ডি নামের দুজন চিকিৎসকের নামে দুটি ফরম্যাটে ছড়ায়। ইংরেজি কনটেন্টটিতে ড. গুপ্তের কোনো পরিচয় না থাকলেও বাংলায় ড. গুপ্তকে যুক্তরাষ্ট্রের কমপ্রিহেনসিভ ক্যান্সার সেন্টার অফ নেভাডার ডা. বিকাশ গুপ্ত হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়। এছাড়া মেরিল্যান্ড কলেজ অব মেডিসিন বদলে দ্য ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড স্কুল অব মেডিসিনের উল্লেখ করা হয়, যা সুপরিচিত একটি প্রতিষ্ঠান। 

অর্থাৎ, মূল সূত্রে ভুয়া ডাক্তার ও প্রতিষ্ঠানের রেফারেন্স দেওয়া হলেও বাংলায় পোস্টটি পরিবর্তন করে কাছাকাছি একজন সত্যিকারের চিকিৎসকের নাম ও বাস্তব একটি প্রতিষ্ঠানের নাম যুক্ত করা হয়। এমনকি বিকাশ গুপ্তের পোস্টগুলো থেকে অস্তিত্বহীন ওশ স্টেট মেডিকেলের ডা. গুরুপ্রসাদ রেড্ডির নামও অপসারণ করা হয়। কিন্তু এই সময় আরেকটি পোস্টে শুধু গুরুপ্রসাদ রেড্ডির তিনটি পরামর্শ ছড়াতে শুরু করে, যেখানে মূল কনটেন্টের সবগুলো স্বাস্থ্য নির্দেশনা নেই। 

সম্প্রতি ভাইরাল পোস্টের দাবি অনুসারে, দ্য ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড স্কুল অব মেডিসিনের চিকিৎসকগণ দীর্ঘ গবেষণায় এ কথা প্রমাণ করেছেন। তবে পলিটিফ্যাক্টভেরা ফাইলস যাচাই করে জানিয়েছে যে, ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড স্কুল অব মেডিসিনের এমন কোনো গবেষণা প্রকাশের প্রমাণ তারা পায়নি। 

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কমপ্রিহেনসিভ ক্যান্সার সেন্টার অফ নেভাডার ডা. বিকাশ গুপ্তের কথা উল্লেখ করা হলেও এই বক্তব্যগুলো তাঁর, এমন কোনো প্রমাণও মেলেনি। প্রতিষ্ঠানটির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে বিকাশ গুপ্তের প্রোফাইল পাওয়া যায়। তবে পোস্টের বক্তব্যগুলো আসলেই তার কি না, এ বিষয়ে জানতে ডা. বিকাশ গুপ্তের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

গুরুপ্রসাদ রেড্ডি নামের কোনো চিকিৎসক নেই বলেও উল্লেখ করা হয়েছে আফ্রিকা চেক ও এএফপি-র প্রতিবেদনে। এছাড়া মস্কোতে ওশ স্টেট মেডিকেল ইউনিভার্সিটির সন্ধানও মিলেনি। ওশ স্টেট ইউনিভার্সিটি নামে কিরগিজস্তানে একটি প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেলেও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুপ্রসাদ রেড্ডি নামে কারও কার্যক্রমের সন্ধান মিলেনি বলে জানায় ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা দুটি।

২০১৯ সালে ইংরেজিতে ভাইরাল পোস্টের ফ্যাক্টচেক করে আফ্রিকা চেক। ২০২০ সালে পলিটিফ্যাক্টভেরা ফাইলসও পোস্টগুলো ফ্যাক্টচেক করে। ২০২২ সালে এএফপি বাংলায় গুরুপ্রসাদ রেড্ডির নামে প্রচারিত পোস্টগুলোর দাবি খণ্ডন করে।

চিনি না খেলে কি ক্যান্সার সারে?

স্বাস্থ্যকর ডায়েটের অংশ হিসেবে চিনিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা বা কম খাওয়া ভালো হলেও সব ধরনের চিনি খাওয়া বাদ দিলে ক্যান্সার প্রতিরোধ বা ক্যান্সার নিরাময় সম্ভব– এমন ধারণা ভিত্তিহীন বলে চিহ্নিত করেছে আফ্রিকা চেক।

২০২০ সালে যুক্তরাজ্যের ক্যান্সার রিসার্চের একটি আর্টিকেলে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে লেখা হয়েছে, “ক্যান্সার কোষগুলি সাধারণত দ্রুত বৃদ্ধি পায় আর বাড়ে দ্রুত হারে, যার জন্য প্রচুর শক্তি লাগে। এর মানে তাদের প্রচুর গ্লুকোজ প্রয়োজন। ক্যান্সার কোষগুলিরও প্রচুর অন্যান্য পুষ্টির প্রয়োজন হয়, যেমন অ্যামিনো অ্যাসিড এবং চর্বি; তারা শুধু চিনিই চায় এমনটি নয়।”

আর্টিকেলে আরও বলা হয়, “স্বাস্থ্যকর কোষের জন্যও গ্লুকোজের প্রয়োজন পড়ে। তবে শরীর ভালো কোষ ও ক্যান্সার কোষকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে গ্লুকোজ পাঠাতে পারে না”। 

এছাড়া, চিনিমুক্ত খাদ্যাভাসে কান্সারের ঝুঁকি কমে বা ক্যান্সার নিরাময়ের ‘সম্ভাবনা বাড়ে’ এমন কোনো ‘প্রমাণ’ নেই বলেও উল্লেখ করা হয়।

লেবুতে ক্যান্সার সারে না

পোস্টের দাবি অনুসারে, ‘গরম পানিতে লেবুর শরবত’ বানিয়ে খেলে ‘এক থেকে তিন মাসে’র মধ্যে ক্যান্সার নিরাময় সম্ভব বলে দাবি করে বলা হয়, এটি ‘কেমোথেরাপির চেয়ে এক হাজার গুণ বেশি ভালো’।

ফ্যাক্ট-চেকিং সাইট হোক্সস্লেয়ার এবং স্নোপস বিষয়টি যাচাই করে এটি ভুয়া বলে চিহ্নিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর হেলথ কেয়ারও বিষয়টি ভুয়া প্রমাণিত করেছে।

২০১৭ সালের একটি গবেষণা, “অ্যান্টি-ক্যান্সার পটেনশিয়াল অব সাইট্রাস জুসেস অ্যান্ড দেয়ার এক্সট্রাক্টস”-এর গবেষণা অনুসারে, লেবু যে ক্যান্সার প্রতিরোধ করে, তা নিয়ে ক্লিনিকাল স্টাডিজের যথেষ্ট ডেটা নেই।

ক্যান্সার রিসার্চ ইউকের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, সাইট্রাস ফল যেমন লেবু, কমলাতে ক্যান্সার প্রতিরোধী উপাদান থাকলেও তা ক্যান্সার নিরাময় করতে পারে, এমন কোনো প্রমাণ নেই।

ইউনিভার্সিটি অব আরকানসাস ফর মেডিকেল সায়েন্সের একটি প্রতিবেদনের যুক্তিটি খণ্ডন করা হয়। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, “লেবু ও লেবুর রসের ক্যান্সার রেমেডি হিসেবে সম্ভাব্য কার্যকারিতার বিষয়কে অতিরঞ্জিত করে বেড়ে ওঠেছে এই মিথ’।

“সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় লেবুর রসের উপকারী উপাদান নিয়ে সম্ভাবনা দেখা গেলেও, খাবারে যে মাত্রায় তা পাওয়া যায় তাতে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শরীরের সক্ষমতা বাড়াতে কিছুটা সাহায্য করবে। তবে শেষ পর্যন্ত রেডিয়েশন থেরাপি বা কেমোথেরাপির বিকল্প হিসেবে একে ব্যবহারের কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নাই।”

দাবিগুলো গবেষণায় প্রমাণিত নয়

এর আগে ২০১৯ সালে ইংরেজিতে একই পরামর্শ সম্বলিত ফেসবুক পোস্ট ইংরেজিতে ছড়ালে এগুলো প্রমাণিত নয় বলে তখন আফ্রিকা চেক’কে জানান ন্যাশনাল ক্যান্সার ইন্সটিটিউট অব কেনিয়ার সিইও ড. আলফ্রেড কারাগু। তবে ইংরেজিতে ছড়িয়ে পড়া পোষ্টগুলোতে ডা. গুপ্ত’র পাশাপাশি ওএসএইচ স্টেট মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি মস্কোর ড. গুরুপ্রসাদ রেড্ডি বি ভি’র নাম উল্লেখ করা হয়েছে। 

ড. কারাগু আফ্রিকা চেককে বলেন, “পোস্টটিতে সংযুক্ত বিভিন্ন দাবি কোনো গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো- এখন পর্যন্ত জানা দুইশ’র বেশি ক্যান্সার রয়েছে যেগুলো একাধিক কারণে হয়ে থাকে।”

“আর তাই কোনো কিছু খাওয়া বা খাওয়া থেকে বিরত থাকলে ক্যান্সার প্রতিরোধ বা নিরাময় সম্ভব এমন দাবি তাই অসত্য”।

একই প্রতিবেদনে নাইরোবির দ্য টেক্সাস ক্যান্সার সেন্টারের ডিরেক্টর ড. ক্যাথারিন নিয়নগেসা বিষয়টির সঙ্গে একমত পোষণ করেন। দাবিগুলো দেখে তিনি এগুলো ‘মিথ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং বলেন এগুলোর কোনোটিই প্রমাণ করার মতো পর্যাপ্ত তথ্য এখনো নেই।এভ্রিথিং কজেস ক্যান্সার? বিলিফস অ্যান্ড অ্যাটিটিউডস টুয়ার্ডস ক্যান্সার প্রিভেনশন অ্যামং অ্যান্টি-ভ্যাক্সারস, ফ্ল্যাট আর্থারস, অ্যান্ড রেপ্টাইলিয়ান কন্সপিরেসিস্টস: অনলাইন ক্রস সেকশনাল সার্ভে নামের গত বছরের এক গবেষণা অনুসারে, ক্যান্সারের কারণ হিসেবে যে বিষয়গুলোর উল্লেখ করা হয় তার মধ্যে সবচেয়ে ভিত্তিহীন দাবিগুলো হলো চিনিযুক্ত বা মিষ্টি খাবার খাওয়া, স্ট্রেস বা চাপে থাকা এবং জেনেটিকালি মডিফাইড বা জিনগত পরিবর্তন সাধিত খাদ্য গ্রহণ করা।

আরো কিছু লেখা