ফাতেমা তাবাসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব
বাঁধাকপি ‘নকল’ হচ্ছে না, ভিডিওগুলো জাপানের ‘নমুনা-খাদ্য’ তৈরির

বাঁধাকপি ‘নকল’ হচ্ছে না, ভিডিওগুলো জাপানের ‘নমুনা-খাদ্য’ তৈরির

ফাতেমা তাবাসুম
ফেলো, ডিসমিসল্যাব

“নকল বাঁধাকপি” বা “নকল বাঁধাকপি কিভাবে তৈরি করে”- এমন শিরোনামে কিছু ভিডিও এবং পোস্ট সম্প্রতি ফেসবুক (, , , , , , , , ) ও ইউটিউবে (, , , , , , ) দেখা যাচ্ছে। যাচাইয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়, নকল বাঁধাকপি তৈরি নয়, বরং এগুলো জাপানিজ ফুড স্যাম্পল বা খাবারের নমুনা বানানোর ভিডিও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়া এই ভিডিওগুলোর সঙ্গে খাদ্যে ভেজাল বা নকল খাবার বা নকল সবজি বানানোর কোনো সম্পর্ক নেই। জাপানে রেস্তোরাঁ বা খাবারের বড় দোকানগুলোতে প্রদর্শন কিংবা বিজ্ঞাপনী কাজের জন্য সাধারণত এ ধরনের ‘নমুনা খাদ্য’ তৈরি করা হয়ে থাকে। এসব ‘নমুনা খাবার’ ব্যবহার, গ্রহণ, বা রপ্তানিরও কোনো নিয়ম জাপানে নেই। 

একটি ভিডিও শেয়ার দিয়ে এক কন্টেন্ট নির্মাতাকে বলতে শোনা যায়, “আপনারা কি জানেন আমাদেরকে প্রতিনিয়ত কিভাবে ঠকানো হচ্ছে? নকল বাঁধাকপি বানিয়ে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। আর ঐ বাঁধাকপি আমরা বাসায় এসে মচমচা করে ভেজে খাচ্ছি। এই বিষয়টা আগে গোপন থাকলেও তবে কিন্তু এখন ফাঁস হয়ে গিয়েছে। আপনারা সবাই সতর্ক হয়ে যান”।

বাংলায় সম্পাদিত একই ধরনের আরও অনেক ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। অনেক ভিডিওতে এও বলা হয়েছে কী কী রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে বানানো হচ্ছে এই বাঁধাকপি। ভিডিওতে ভয় দেখানো হচ্ছে যে এগুলো খেলে হবে ক্যান্সারের মত মরণব্যাধি। অনেক পোস্টদানকারীকে আবার নকল খাদ্য তৈরির অভিযোগে চীনকে অভিযুক্ত করতে শোনা যায়। 

ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে খোঁজ মিলেছে মূল ভিডিওটির। “মেকিং জাপানিজ ফুড স্যাম্পলস” অর্থাৎ “জাপানি খাবারের নমুনা তৈরি করা” শিরোনামের জাপানি ভিডিওটি ১০ বছরের পুরোনো। এর তিন মিনিট ২৯ সেকেন্ডে খুঁজে পাওয়া যায় ভিডিওর সেই অংশটুকু, ভুয়া তথ্য ছড়ানোর জন্য যেটি ব্যবহার করা হয়েছে। আসল ভিডিওর নিচে বাম পাশে পরিষ্কারভাবে উল্লেখও করা আছে “মেকিং ক্যাবেজ স্যাম্পল” বা “বাঁধাকপির নমুনা তৈরি”। দেখা যায়, এটি আসলে জাপানিজ ফুড স্যাম্পল বা খাবারের নমুনা বানানোর সময় তৈরি। 

‘নমুনা খাবার’ বা মডেল খাবার জাপানি খাদ্য সংস্কৃতিতে বহু বছর ধরে বড় জায়গা নিয়ে আছে। স্থানীয় ভাষায় একে বলা হয়, শকুহিন স্যানপুরু। শকুহিন অর্থ খাবার, আর ইংরেজি ‘স্যামপল’ শব্দটিই জাপানে হয়ে গেছে ‘স্যানপুরু। জানা যায়, জাপানে এই ধরনের খাবারের নমুনা সাধারণত বানানো হয় শুধু রেস্তোরাঁ বা খাবারের বড় দোকানগুলোতে প্রদর্শন বা বিজ্ঞাপন তৈরির জন্য। এগুলোকে খাবার হিসেবে ব্যবহার, গ্রহণ, বা রপ্তানির কোনো সুযোগ নেই। এ ধরনের কোনো তথ্যও পাওয়া যায় না।

বাংলা ভাষায় ভুলভাবে উপস্থাপিত একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, একজন ব্যক্তি কড়াইয়ে পানিতে সাদা ও সবুজ রঙিন তরল ঢালছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে এগুলো জমাট বেঁধে পাতার মতো হয়ে যাচ্ছে। ভাঁজ করলে এটি অনেকটা বাঁধাকপির মতো গোল আকার নেয়। এরপর মাঝখান দিয়ে কাটতেই সেটি দেখতে প্রায় বাঁধাকপির মতোই মনে হয়।

মূল ভিডিওর বিবরণ অংশে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে: জাপানের গুজো শহরে জাপানি রেস্তোরাঁর মেনু প্রদর্শনীর জন্য নমুনা খাবার তৈরির চল শুরু হয়েছিল। ‘আলট্রা-রিয়েলিস্টিক’ তথা প্রায়-বাস্তব এই নমুনা খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা হয় প্লাস্টিক ও মোম; তারপর এগুলোতে রঙ মেশানো হয়। 

এর আগে ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা স্নুপস তাদের একটি প্রতিবেদনে বলে: চীনের ‘সিনথেটিক’ বাঁধাকপি। এই ভিডিওর মাধ্যমে অপ্রাসঙ্গিকভাবে দেখানো হচ্ছ যে চীন অজ্ঞাত ক্রেতাদের মধ্যে মোমের তৈরি নকল শাকসবজি ব্যাপকভাবে বাজারজাত করছে।

স্নুপসের প্রতিবেদনে বলা হয়, আমেরিকার এক ইন্টারনেট টিভি ও রেডিও স্টেশনের ফেসবুক পেজ “দ্য পিপলস ভয়েস” ২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি একটি ভিডিও ছেড়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, চীনে “সিন্থেটিক বা কৃত্রিম ‘বাঁধাকপি’ তৈরি হচ্ছে মাত্র ৪০ সেকেন্ডে…শীঘ্রই আপনার কাছাকাছি মুদি দোকানগুলোতে এগুলো পাওয়া যাবে”। 

স্নুপস তাদের যাচাই প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে যে, আসলে দ্য পিপলস ভয়েস আমেরিকার সাধারণ পাঠক ও দর্শকদের কাছে চীন নিয়ে ভুয়া বা মিথ্যা তথ্য প্রচার করেছে।

২০১৪ সালে কোটাকু নামের একটি গণমাধ্যম’ “নকল জাপানি খাবারের সম্মোহনী জগত” শীর্ষক একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, সামাজিক মাধ্যমগুলোতে প্রায়শই ভুলভাবে ভিডিও উপস্থাপন করে বলা হচ্ছে যে “নকল খাবার” তৈরি হচ্ছে।

ডিম ও চালের মতো খাবার কৃত্রিমভাবে তৈরি করে বাজারে ছাড়া হচ্ছে- এ জাতীয় ভুয়া তথ্য গত এক দশকে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। 

২০১৭ সালে যাচাই– এর একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে বলা হয়, এ দাবিটি অপ্রমাণিত যে “বাংলাদেশের বাজারে চায়না থেকে আমদানি করা হচ্ছে নকল বা প্লাস্টিকের ডিম। যা মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে সাধারণ ডিমের সাথে।”

নিউজচেকার ২০২২ সালে একটি যাচাই প্রতিবেদনের শিরোনাম করে “বাজারে বিক্রি হচ্ছে প্লাস্টিকের তৈরী নকল ডিম? ভাইরাল এই দাবির সত্যতা জানুন”। তাদের যাচাইয়ে বেরিয়ে আসে, প্লাস্টিকের ডিম বা নকল ডিমের দাবিটি ডাহা মিথ্যে।

এর আগের বছর ফ্যাক্টওয়াচ–এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, “সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে নকল ডিম, জেনে রাখুন বিষাক্ত ডিম চিনে নেয়ার ১০টি লক্ষণ” শিরোনামে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া খবরটি ছিল প্রায় ৭ বছরের পুরনো। 

২০২১ সালেই ফ্যাক্টওয়াচ পৃথক এক যাচাই প্রতিবেদনে বলে: “আসল চাল এর বদলে প্লাস্টিকের নকল চাল খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে বলে গুজব শোনা যায় মাঝে মাঝেই। অনেকে নিজেদের রান্না করা অস্বাভাবিক চালকে প্লাস্টিকের তৈরি দাবি করে বিভিন্ন ভিডিও তৈরি করে ফেসবুকে আপলোড করেছেন। তবে এদের কোনোটাই প্লাস্টিকের তৈরি বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি এখন পর্যন্ত।”

আরো কিছু লেখা