তৌহিদুল ইসলাম রাসো

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
ভিডিওগুলো তিব্বতের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের নয়

ভিডিওগুলো তিব্বতের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের নয়

তৌহিদুল ইসলাম রাসো

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

৭ জানুয়ারি সকালে তিব্বতে শক্তিশালী এক ভূমিকম্পের আঘাতে অঞ্চলটির অনেক ঘরবাড়ি ও স্থাপনা ধ্বসে পড়ে, মারা যায় শতাধিক মানুষ। এর প্রেক্ষিতে তিব্বতের ভূমিকম্প দাবিতে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে দুটি আলাদা ভিডিও ভাইরাল হতে দেখা যায়। ফুটেজ ভিন্ন হলেও ভিডিও দুটি শেয়ার করে বলা হচ্ছে, সেগুলো তিব্বতে আঘাত হানা সাম্প্রতিক শক্তিশালী ভূমিকম্পের। তবে ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা গেছে, দাবিটি ভুয়া। ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলো আসলে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে জাপানে আঘাত হানা ভূমিকম্পের। দেশটির হোনশু দ্বীপের নোটো প্রদেশে গত বছরের পহেলা জানুয়ারির ভূমিকম্পের সময় ধারণ করা একটি ভিডিও কেটে দুটি আলাদা ভিডিও বানিয়ে সেগুলো তিব্বতের সাম্প্রতিক এই ভূমিকম্পের দৃশ্য দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে।

১ম ভিডিও যাচাই

ফেসবুকের বেশ কিছু পোস্টে (, , , , , ) ও ইউটিউবে শেয়ার করা ভিডিওতে (, , ) এক মিনিটের ভিডিও শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে ভিডিওগুলো তিব্বতের। শেয়ার করা ভিডিওগুলোর বিবরণীতে সেগুলো তিব্বতে বা চীনের তিব্বতে আঘাত হানা ভূমিকম্পের বলা হচ্ছে।

ভাইরাল এই ভিডিওটির সত্যতা যাচাইয়ে কিফ্রেম ধরে অনলাইনে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে ডিসমিসল্যাব। উক্ত সার্চে জাপানের একাধিক জাতীয় দৈনিকে এই ভিডিও নিয়ে প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। জাপানের নিপ্পন টেলিভিশন (এনটিভি) ২০২৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তাদের অনলাইন পোর্টালে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে চ্যানেলটির একটি ইউটিউব ভিডিও সংযুক্ত থাকতে দেখা যায়।

জাপানিজ ভাষায় লেখা সেই প্রতিবেদনকে গুগলের মাধ্যমে অনুবাদ করলে তার অর্থ দাঁড়ায় – ‘নোটো পেনিনসুলা ভূমিকম্পের এক মাস পেরিয়ে গেছে, এবং সেখানকার বাসিন্দারা আবারও ফিরতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে দুর্যোগ কবলিত এলাকায় ধারণ করা ফুটেজ প্রকাশ হয়েছে যেখানে ভূমিকম্পের শক্তি কেমন ছিল তা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। প্রকাশিত ভিডিওটি মূলত গাড়িতে থাকা ক্যামেরায় রেকর্ড করা হয়েছে যখন সেটি ভূমিকম্পের সময়ে রাস্তায় চলছিল।’ এছাড়া এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ভিডিও প্রতিবেদন দেখতে বলা হয়।

এনটিভির ৫ মিনিট ১৭ সেকেন্ডের ভিডিও প্রতিবেদনের সঙ্গে সম্প্রতি তিব্বতে ভূমিকম্পের দৃশ্য দাবিতে ভাইরাল হওয়া ভিডিওটির হুবহু মিল পাওয়া যায়। মৃলত সেই ভিডিও প্রতিবেদনটির শুরুর ৩১ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট ২৫ সেকেন্ড পর্যন্ত অংশ কেটে নিয়ে তা তিব্বতের ভূমিকম্পের দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত হচ্ছে। 

এছাড়া ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাপানের আরেকটি গণমাধ্যমও একই ঘটনার উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে যুক্ত ভিডিওর সঙ্গেও তিব্বতের দৃশ্য দাবিতে ভাইরাল হওয়া ভিডিও ফুটেজের হুবহু মিল পাওয়া যায়। ‘দ্য মাইনিচি’ নামের জাপানের সেই জাতীয় দৈনিকের ইংরেজি প্রতিবেদনে বলা হয়– ইশিকাওয়া প্রদেশের সুজুতে বয়স্কদের জন্য একটি নার্সিং হোম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ‘চৌজুকাই’ এর মালিকানাধীন গাড়ির সামনের ক্যামেরায় (ড্যাশক্যাম) পহেলা জানুয়ারির নোটো পেনিনসুলা ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির একটি স্পষ্ট চিত্র ধারণ করা হয়েছে। সামাজিক কল্যাণ সংস্থা ‘চৌজুকাই’ ফুটেজটিকে ভবিষ্যতের দুর্যোগ প্রতিরোধে প্রস্তুতির জন্য ব্যবহার করার আহ্বান জানাচ্ছে। 

এ সম্পর্কে আরও জানতে কিওয়ার্ড সার্চে বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদন খুঁজে পায় ডিসমিসল্যাব। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের প্রথম দিনে অর্থাৎ, ১ জানুয়ারিতে জাপানের হোনশু দ্বীপের নোটো প্রদেশে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। শক্তিশালী এই ভূমিকম্পে ৪৮ জন মানুষ মারা গেছে বলে জানানো হয় এবং বলা হয় মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

তাই বলা যায়, ১ বছর আগের পুরোনো ঘটনাকে ভুয়া দাবিতে সাম্প্রতিক তিব্বতের বলে ছড়াচ্ছে।

২য় ভিডিও যাচাই

তিব্বতের ভূমিকম্পের দৃশ্য দাবিতে আরও একটি ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে ফেসবুক (, , , , , ) ও ইউটিউবে (, , )।  ফেসবুকে ‘কাশ্মীর টাইমস’ নামের একটি প্রোফাইল থেকে ২২ সেকেন্ডের সেই ভিডিওটি লাইভ আকারে প্রচার করা হয়েছে। ২ ঘন্টার বেশি সময়ের ওই ভিডিওটি এখন পর্যন্ত দেখেছেন প্রায় এক লাখ ২০ হাজার ব্যবহারকারী এবং শেয়ার হয়েছে প্রায় দুই হাজার বার। বিবরণীতে লেখা, “#আপডেট: শহরের ডিংরি কাউন্টিতে ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্পের পর মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ৫৩ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে, এবং আরও ৬২ জন আহত হয়েছে…”।

এই ভিডিওটি তিব্বতের ডিংরি অঞ্চলের কি না তা জানতে আগের ভিডিও যাচাইয়ের মতো কিফ্রেম ধরে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে ডিসমিসল্যাব। উক্ত সার্চে জাপানের দুটি সংবাদ প্রতিবেদনের (, ) সঙ্গে ভাইরাল ভিডিওটির ফুটেজের মিল পাওয়া যায়। ‘দ্য জাপান নিউজ’ এর অনলাইন প্রতিবেদনে যে ছবি ব্যবহার করে তার সঙ্গে ভাইরাল ভিডিওটির হুবহু মিল পাওয়া যায়। সেই প্রতিবেদনের বিস্তারিত অংশে নোটো পেনিনসুলা ভূমিকম্পের বিবরণ পাওয়া যায়। 

অপর প্রতিবেদনে যুক্ত ভিডিওর সঙ্গেও ভাইরাল ফুটেজের মিল পাওয়া যায়। জাপানের সংবাদমাধ্যম ‘দ্য মাইনিচি’ তাদের প্রতিবেদনের সঙ্গে যে ভিডিও যুক্ত করেছে তার ১৯ থেকে ৪১ সেকেন্ড পর্যন্ত অংশ কেটে নিয়ে তা ভুয়া দাবিতে তিব্বতের বলে ছড়ানো হয়েছে। কিন্তু সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এটি জাপানের ভূমিকম্পের ঘটনা।

অর্থাৎ এক বছর আগের অন্য দেশের ভূমিকম্পের একই ঘটনা সাম্প্রতিক তিব্বতের ভূমিকম্পের বলে ছড়ানো হচ্ছে। ভাইরাল ভিডিও দুটি জাপানের একই সময়ের ভূমিকম্পের হলেও তা তিব্বতের বলে ছড়ানো হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, গত ৭ জানুয়ারি তিব্বতে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানলে হাজারেরও বেশি বাড়িঘর ও স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই দুর্যোগে এখন পর্যন্ত ১২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানায় , তিব্বতের স্থানীয় সময় সকাল নয়টার দিকে শিগেৎসে শহরে বড় আকারের ওই ভূমিকম্প হয়, রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল সাত দশমিক এক।

এর আগেও একাধিক দেশে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটলে সেটিকে কেন্দ্র করে পুরোনো ছবি-ভিডিও বা ভিন্ন দেশের ছবি-ভিডিও ব্যবহার করে ভুল তথ্য ছড়াতে দেখা যায়। এ নিয়ে একাধিক ফ্যাক্টচেক (, , ) প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ডিসমিসল্যাব।

আরো কিছু লেখা