তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
ফেসবুকে জুয়ার বিজ্ঞাপনে ড. ইউনূসের ডিপফেক ভিডিও-অডিও

নীতি আছে, প্রয়োগ নেই

ফেসবুকে জুয়ার বিজ্ঞাপনে ড. ইউনূসের ডিপফেক ভিডিও-অডিও

তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

বাংলাদেশি ব্যবহারকারীদের লক্ষ্য করে সামাজিক মাধ্যমে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার নতুন নয়। কিন্তু এই প্রচারণা দিনে দিনে হয়ে উঠছে অভিনব। ইদানিং এসব জুয়ার বিজ্ঞাপনে যুক্ত হয়েছে ডিপফেক ভিডিও ও অডিও। বিজ্ঞাপনকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার টুল দিয়ে বানানো হচ্ছে মিথ্যা টিভি সংবাদ ও আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ভুয়া বক্তব্য।

ডিসমিসল্যাব গত সেপ্টেম্বর থেকে এমন ৯টি আলাদা ডিপফেক ভিডিও খুঁজে পেয়েছে, যা শুধু মাত্র ফেসবুকে শতাধিক বার বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রচারিত হয়েছে। এসব বিজ্ঞাপনের আধেয়তে বিভিন্ন জুয়া ও বেটিং অ্যাপে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বিনিয়োগ ও পৃষ্ঠপোষকতার মিথ্যা দাবি করা হয়েছে। বিজ্ঞাপনের মুখ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে, যেখানে তাকে জুয়া খেলার জন্য আহ্বান জানাতে দেখা যাচ্ছে। 

এই ফেসবুক বিজ্ঞাপনগুলো নানা কারণে সমস্যাজনক: প্রথমত, মেটার নিজস্ব নীতিমালা অনুযায়ী যেসব দেশে জুয়ার বিজ্ঞাপন দেখানো যায় সেই তালিকায় বাংলাদেশ নেই; দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে অনলাইনে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে; তৃতীয়ত, বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা বক্তব্যগুলো মিথ্যা, বিকৃত এবং এআই টুল দিয়ে তৈরি। আর এভাবে আদালতের নির্দেশ এবং মেটার একাধিক নীতিমালা ভঙ্গ করে প্লাটফর্মটিতে জুয়ার প্রচারণা চলছে এবং তাদের বিজ্ঞাপন পর্যালোচনা ব্যবস্থা এসব বিজ্ঞাপনকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। 

এদের মধ্যে বেশিরভাগ ভিডিওই মেটা প্ল্যাটফর্মে প্রচারিত হয়েছে অরাজনৈতিক বিজ্ঞাপন হিসেবে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে বিজ্ঞাপন রাজনৈতিক ক্যাটেগরিতে সংরক্ষণ করা, প্লাটফর্মটির স্বচ্ছতা নীতিমালার একটি অংশ। জুয়ার বিজ্ঞাপনদাতারা সফলভাবে এটিকে পাশ কাটাচ্ছে এবং এর ফলে বিজ্ঞাপনগুলো প্রচারের পরপরই হারিয়ে যাচ্ছে। এতে করে বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত মিথ্যা তথ্য যাচাইয়ের সুযোগ কমছে এবং ব্যবহারকারীদের জন্য প্রতারণা বা বিভ্রান্তির শিকার হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।

ডিপফেক প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি বিজ্ঞাপনগুলো মেটার গ্যাম্বলিং ও গেমিং নীতিমালা এবং একাধিক কমিউনিটি মানদণ্ড ভঙ্গ করছে। কিন্তু এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ফেসবুকে এমন বিজ্ঞাপন চলতে দেখা গেছে এবং মেটার স্বয়ংক্রিয় পর্যালোচনা ব্যবস্থা এগুলোকে সনাক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। 

জুয়ার বিজ্ঞাপনে রাজনীতি

বাংলাদেশের ব্যবহারকারীদের লক্ষ্য করে মেটার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচারের ঘটনা নতুন নয়। তবে সম্প্রতি ড. ইউনূসের ডিপফেক ভিডিও দিয়ে বানানো বিজ্ঞাপনগুলোতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও বন্যার মতো দুর্যোগকে হাতিয়ার বানানো হয়েছে। 

আগস্টের শুরুতে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের জের ধরে ক্ষমতাচ্যুত হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার এবং ড. ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। জুয়ার বিজ্ঞাপনগুলোতে এসব রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। একটি ভিডিওতে বলা হয়েছে, “শেখ হাসিনা ক্যাসিনোর জয়ের পরিমাণ কমিয়ে দেখানোর জন্য অতিরিক্ত কারাদণ্ড পাবেন। তিনি বাংলাদেশে ক্যাসিনোগুলোকে তাদের জয় কমাতে বাধ্য করেছিলেন, যাতে মানুষ শুধু কম বেতনের চাকরি থেকে অর্থ উপার্জন করতে পারেন। মুহাম্মদ ইউনূস এই আইনটি বাতিল করেছেন।” 

আরেক ভিডিওতে বলা হয়েছে, “মুহাম্মদ ইউনূস এখন অনলাইন ক্যাসিনোগুলি বৈধ করেছেন এবং জয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছেন।” যাচাইয়ে দেখা যায়, আরটিভির সংবাদ উপস্থাপক সৈয়দা সাদিয়া বেনজিরের ফুটেজ কেটে তার উপর সময় টিভির লোগো বসিয়ে বিজ্ঞাপনটি তৈরি করা হয়েছে। 

এসব ভিডিওর কোনোটিতে ড. ইউনূসকে বলতে শোনা যায় যে, তিনি বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও বেকারত্বের সমস্যা সমাধানে একটি গেমিং অ্যাপ তৈরি করেছেন, যা ব্যবহারে মাসে লক্ষাধিক টাকা আয় করা সম্ভব। কোনো কোনো বিজ্ঞাপনে ছাত্র আন্দোলন ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করতে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলেও দাবি করা হয়। সংবাদ বুলেটিনের আদলে তৈরি এসব বিজ্ঞাপনে ‘সময় টিভি’ ও ‘চ্যানেল ২৪’ এর লোগো জুড়ে দেওয়া হয়।

একটি বিজ্ঞাপনে চ্যানেল ২৪ এর একজন সংবাদ উপস্থাপককে বলতে শোনা যায়, “বাংলাদেশে ব্যাপক বন্যা। মুহাম্মদ ইউনূস ফাউন্ডেশন এবং ব্যাঙ্গার সোশ্যাল ক্যাসিনো নিহতদের সাহায্য করার জন্য পাঁচ মিলিয়ন টাকা বরাদ্দ করেছে। যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাদের সহায়তা প্রদান করা হবে।” এ বিষয়ে চ্যানেল ২৪ এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায় ভিডিওটি উপস্থাপক তানভীর আহমেদের সম্পাদিত ভিডিও। তানভীর আহমেদ নিজেও তার ডিপফেক ভিডিও ব্যবহারের বিষয়টি ডিসমিসল্যাবকে নিশ্চিত করেন।

প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এসব ভিডিওর প্রতিটিকে ভুয়া বলে জানান। তিনি বলেন, “আমরা এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে মেটার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছি।”

এর আগে বাংলাদেশের তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, মাশরাফি বিন মুর্তজা, মোস্তাফিজুর রহমানের ছবি-ভিডিও সম্পাদনা করে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ডিসমিসল্যাব। গত বছরও সংবাদ মাধ্যমের লোগো ব্যবহার করে অনলাইন জুয়ার প্রচারণা দেখা গেছে।

বিজ্ঞাপনে বিকৃতি এবং ডিপফেক ভিডিও-অডিও ব্যবহার

ডিপফেক হলো ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা ভিডিও বা অডিও ক্লিপ যা বাস্তব বলে মনে হয়। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রায় নিখুঁতভাবে মানুষের চেহারা, কণ্ঠস্বর এবং শরীরের অঙ্গভঙ্গি নকল করা যায়, যা মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে।

জুয়ার এই বিজ্ঞাপনগুলোতে ডিপফেক ভিডিও ও অডিও ব্যবহার করা হয়েছে। এতে শুধু ড. ইউনূসের পুরোনো ভিডিওকেই বিকৃত করা হয়নি বরং তার কণ্ঠস্বর প্রায় অবিকল অনুকরণের মাধ্যমে ডিপফেক অডিও-ও তৈরি করা হয়েছে। একটি বিজ্ঞাপনে তাকে বলতে শোনা যায়, “আমরা এখানে সাহায্য করতে এসেছি। শুধু ব্যাঙ্গার ক্যাসিনোতে একটি অ্যাকাউন্ট করুন এবং আমরা আপনাকে এক লক্ষ টাকার পরিমাণে ক্ষতিপূরণ পাঠানোর গ্যারান্টি।” যাচাইয়ে দেখা যায় গত ৭ আগস্ট কালের কণ্ঠকে দেওয়া ড. ইউনূসের এক বিশেষ সাক্ষাৎকারের ভিডিও সম্পাদনার মাধ্যমে বিকৃত করে বিজ্ঞাপনটি বানানো হয়। 

আরেক ভিডিওতে ড. ইউনূস বলেন, “হ্যালো বন্ধুরা, আমরা নাহিদ ইসলামের সহযোগিতায় একটি অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করেছি যা বেকারত্ব ও অন্যান্য সমস্যাগুলির সঙ্গে জড়িতদের সাহায্য করবে প্রতিদিন দুই থেকে তিন ঘণ্টা খেলার জন্য। আমি মাসে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা আয় করা নিশ্চিত করি।” যাচাই অনুসারে, মূল ভিডিওটি গত ৭ আগস্টের। ড. ইউনূস দেশে ফেরার পর গণমাধ্যমে যে বক্তব্য রাখেন, সেটিকে ব্যবহার করে ডিপফেকটি তৈরি করা হয়েছে।

একটি ভিডিওতে ড. ইউনূসকে বলতে শোনা যায়, ”বাংলাদেশে আন্দোলনের কারণে কাজ না থাকায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের জন্য ক্রেজি টাইম নামের একটি অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। এই অ্যাপে এক হাজার শতাংশ বোনাস দেওয়া হবে।” মূলত গত ৮ আগস্ট জাতির উদ্দেশ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেওয়া বার্তা সম্পাদনা করে ডিপফেক এই ভিডিও প্রচারিত হয়। 

আরেক বিজ্ঞাপনে সরকারের তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের বক্তব্যও বিকৃত করে প্রচার করা হয়েছে। সেখানে তাকে বলতে শোনা যায়, “আমরা এই অ্যাপ্লিকেশনটির জন্য অনেককাল ধরে অপেক্ষা করেছি। এখন সব শিক্ষার্থীরা মুহাম্মদ ইউনূসের অ্যাপ্লিকেশনে খেলে আয় করছেন।” তবে যাচাইয়ে দেখা যায়, মূল ভিডিওটি পুরনো। নাহিদের ভিন্ন একটি বক্তব্য সম্পাদনা করে পুরোপুরি আলাদা ভাষ্য জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

কিছু কিছু বিজ্ঞাপনে শুধুমাত্র ড. ইউনূসকেই কথা বলতে শোনা যায়। এরকম চারটি বিজ্ঞাপন পাওয়া গেছে যেখানে ড. ইউনূসের ভিন্ন ভিন্ন ভিডিও ব্যবহার করা হলেও সেগুলোর ভাষা বা স্ক্রিপ্ট একই ছিল। শুধুমাত্র একটি ভিডিওতে কিছুটা শুদ্ধ বাংলা পাওয়া যায়। বাকি সব কটিতে ভাষা ছিল অস্পষ্ট, বাক্যগঠন ছিল দুর্বল, যেমনটা ট্রান্সলেটর টুল ব্যবহার করে অন্যভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করলে দেখা যায়।

ডিপফেক ভিডিও শনাক্তের ক্ষেত্রে ফ্রেম-বাই-ফ্রেম বিশ্লেষণে সাধারণত কিছু অসঙ্গতি ধরা পড়ে। এখানেও তাই দেখা যায়। যেমন, বিজ্ঞাপনগুলোর কিছু ফ্রেমে কথার সঙ্গে ঠোঁট পুরোপুরি মেলে না। অনেক ফ্রেমে চোখের পলক ফেলার সঙ্গে মাথা নাড়ানো ও স্বাভাবিক কথাবলার অঙ্গভঙ্গির মধ্যেও অসামঞ্জস্য দেখা যায়। ড. ইউনূসের কথা বলার সময় তার মুখের যে অংশগুলো নড়ছিল সেগুলোও ছিল অস্পষ্ট। 

কোনো অডিও ডিপফেক কিংবা এআই ব্যবহার করে বানানো হয়েছে কি না, তা বুঝতে কন্ঠস্বরে বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেয় পয়েন্টার ইনস্টিটিউট। অডিওতে অস্বাভাবিক কোনো বিরতি অথবা স্বরের ওঠানামায় কোনো পরিবর্তন হচ্ছে কি না, তা-ও ডিপফেক কন্ঠ যাচাইয়ের অন্যতম উপায়

বিজ্ঞাপনগুলোর অডিও বক্তব্যেও এমন অসঙ্গতি পাওয়া যায়। আসল ভিডিওতে বক্তারা যেধরনের সাবলীল বাংলা বলে থাকেন, এখানে তা ছিল না। কণ্ঠস্বর খুব কাছাকাছি হলেও কিছু শব্দ ও বাক্যের উচ্চারণ ছিল অস্পষ্ট। যেমন একটি ভিডিওতে উপস্থাপক ‘বন্যা’ শব্দটি ‘বনযা’ উচ্চারণ করেন। এছাড়া কিছুক্ষেত্রে একেকটি বাক্য শেষ হলে যে সময়টুকু থামা দরকার, সে সময় দেওয়া হয়নি। কোথাও কোথাও বাংলা শোনাচ্ছে হিন্দি ভাষার টানে। 

মেটার বিজ্ঞাপন পর্যালোচনা ব্যবস্থায় দূর্বলতা

অনলাইন জুয়া বা গেমের বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য মেটার আলাদা নীতিমালা আছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বের মাত্র ৩৪টি দেশে এ ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার করা যেতে পারে এবং তার জন্য আগাম অনুমোদন নিতে হয়। এই তালিকায় বাংলাদেশ নেই। কিন্তু ডিসমিসল্যাব এই গবেষণায় জুয়ার যত বিজ্ঞাপন পেয়েছে তার প্রতিটিই বাংলাদেশের ব্যবহারকারীদের লক্ষ্য করে প্রচার করা হয়েছে।

মেটায় সাধারণ কন্টেন্টের জন্য যে কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড বা মানদণ্ড মেনে চলতে হয়, বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও সেটি প্রযোজ্য। মেটার ম্যানিপুলেটেড মিডিয়া মানদণ্ড অনুযায়ী, ব্যবহারকারীদের মাঝে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে এধরনের ডিজিটালি সম্পাদিত কন্টেন্ট লেবেলিং বা চিহ্নিত করা হয় অথবা বিজ্ঞাপন হিসেবে বাতিল করা হয়। ড. ইউনূস, নাহিদ ইসলাম ও সংবাদ পাঠকদের যেসব ভিডিও জুয়ার বিজ্ঞাপনে ব্যবহার হয়েছে সেগুলো ম্যানিপুলেটেড বা বিকৃত। কিন্তু এই প্রতিবেদন লেখার সময়েও এধরনের বিজ্ঞাপন কোনো চিহ্নিতকরণ ছাড়াই চলতে দেখা গেছে।

তৃতীয়-পক্ষীয় ফ্যাক্টচেকার প্রতিষ্ঠান যদি কোনো আধেয়কে মিথ্যা বা অপতথ্য হিসেবে চিহ্নিত করে, সেটি মেটায় বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রচার নিষিদ্ধ। যেসব বিজ্ঞাপনদাতা ঘনঘন মিথ্যা তথ্য প্রচার করেন, তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। কিন্তু জুয়ার বিজ্ঞাপনের বেলায় এই নীতিও কাজ করেনি। যেমন: গত আগস্টে ড. ইউনূসের ভিডিও সম্পাদনার মাধ্যমে জুয়ার প্রচারণা নিয়ে একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে ফ্যাক্টওয়াচ। কিন্তু সম্প্রতি একই ভিডিও ফের বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রচারিত হতে দেখা গেছে।

মেটা প্লাটফর্ম, অর্থাৎ ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে, দেখানোর আগে প্রতিটি বিজ্ঞাপনকে একটি রিভিউ সিস্টেম বা পর্যালোচনা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কোনো বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানটির অ্যাডভার্টাইজিং স্ট্যান্ডার্ড মানছে কিনা সেটি এই ব্যবস্থার মাধ্যমে যাচাই করা হয়। প্রক্রিয়াটি মূলত স্বয়ংক্রিয়, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা মানুষের মাধ্যমেও পর্যালোচনা করা হয়। এই ব্যবস্থা থাকার পরেও ডিপফেক বিজ্ঞাপনগুলো নজরদারি এড়িয়ে প্ল্যাটফর্মটিতে প্রচারিত হচ্ছে।

রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন বনাম সাধারণ বিজ্ঞাপন 

মেটার নীতিমালা অনুযায়ী নির্বাচন বা রাজনীতি সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনের জন্য আগাম অনুমোদন লাগে এবং যদি বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তুতে কোনো রাজনীতিবিদ, প্রার্থী বা রাজনৈতিক দলের পক্ষে সমর্থন এবং ছবি বা শিরোনামে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিবিদ বা প্রার্থীর নাম (যেমন “গভর্নর”, “এমপি” বা “মন্ত্রী”) বা উল্লেখ থাকে, তাহলে বিজ্ঞাপনতাদাকে “পেইড ফর বাই” (খরচ করেছে কে) ডিসক্লেইমার দিতে হয়। তবে তাদের নীতিমালায় এমনটাও বলা আছে, বিজ্ঞাপনের প্রাথমিক লক্ষ্য যদি হয় কোনো পণ্য বিক্রি বা সেবার প্রচার তাহলে সেই বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে ডিসক্লেইমার প্রযোজ্য না-ও হতে পারে। কিন্তু জুয়ার এসব বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ প্লাটফর্মটি কোন নীতি প্রয়োগ করেছে তা স্পষ্ট নয়। 

যেমন: যে বিজ্ঞাপনে দাবি করা হচ্ছে শেখ হাসিনা ক্যাসিনো থেকে জয়ের পরিমান কমিয়ে দিয়েছেন এবং মুহাম্মদ ইউনূস মানুষের আয় বাড়াতে এই আইনটি বাতিল করেছেন – সেটিকে মেটা রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন হিসেবে শনাক্ত করেছে। এই ভিডিওতে শেখ হাসিনার ছবি ছিল। আপাতদৃষ্টিতে, মেটার পর্যালোচনা ব্যবস্থা শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সনাক্ত করেছে, কিন্তু ড. ইউনূসকে করেনি। কারণ, বাকি আটটি ভিডিও, যেখানে শুধু ড. ইউনূসের ছবি বা ভিডিও রয়েছে সেগুলোকে অ্যাড লাইব্রেরিতে সাধারণ বিজ্ঞাপন হিসেবেই দেখানো হয়েছে। যেমন: Nazaré Natividade নামের পেজ থেকে চালানো একটি জুয়ার বিজ্ঞাপন (ড. ইউনূসের মিথ্যা বক্তব্যসহ) প্রায় দুই মাস ধরে চলার পরও রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন হিসেবে শনাক্ত হয়নি।

স্বচ্ছতা নীতির অংশ হিসেবে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন মেটার অ্যাড লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত হয় এবং বিজ্ঞাপনটি কোথায় দেখানো হয়েছে, এর পেছনে কত অর্থ খরচ করা হয়েছে– এসব তথ্য সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে। আর সাধারণ বিজ্ঞাপনগুলো সচল না থাকলে, সেগুলো অ্যাড লাইব্রেরি থেকে সরিয়ে ফেলা হয়।

রাজনৈতিক হিসেবে শনাক্ত হওয়া একমাত্র ভিডিওটি গত ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত ৪৫টি পেজ থেকে ১৩২ বার বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রচারিত হয়েছে। প্রতিটি ভিডিও পেয়েছে গড়ে অন্তত ৪০ হাজার ইম্প্রেশন। ৬২% ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনগুলোর অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে মার্কিন ডলারে। বাকি ৩৮% বিজ্ঞাপনের অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের মুদ্রায়, যার মধ্যে পেরু (১১%), ইউরোপিয় ইউনিয়ন (৮%), ব্রাজিল (৮%), তাইওয়ান (৩%) ও থাইল্যান্ড (৩%) রয়েছে। যে ৪৫টি পেজ এসব বিজ্ঞাপন দিয়েছে, তাদের অ্যাডমিন বা পরিচালকদের বেশিরভাগের অবস্থান ভিয়েতনাম ও ইউক্রেনে।

মেটার কমিউনিটি মানদণ্ডের স্বচ্ছতার আরেকটি বড় দিক হল, রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনে তৃতীয় পক্ষের এআই প্রযুক্তি ব্যবহার হলে, তার উল্লেখ করতে হয়। কিন্তু রাজনৈতিক হিসেবে শনাক্ত না হওয়ায়, এই জুয়ার বিজ্ঞাপনদাতারা এআই বা ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও পার পেয়ে গেছেন।

ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সিনিয়র লেকচারার মো. পিজুয়ার হোসেইন মনে করেন, ডিপফেক ব্যবহার করে বেটিং অ্যাপ বা আর্থিক স্ক্যামের প্রচারণা মানুষের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। তিনি বলেন, “ড. ইউনূস দীর্ঘদিন ধরে ক্ষুদ্রঋণ প্রচারণার প্রতীক হিসেবে আছেন। তাঁর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারে তার ভূমিকা মানুষের কাছে তাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। ফলে, এই ধরনের ডিপফেক ভিডিওকে মানুষ সহজেই সত্য মনে করতে পারে। বিশেষত বাংলাদেশের ডিজিটাল স্বাক্ষরতার অভাব এবং মোবাইল ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতির কারণে মানুষ আর্থিক প্রতারণার ঝুঁকিতে পড়তে পারে।”

গবেষণা পদ্ধতি

এই গবেষণার জন্য ২০ অক্টোবর থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে মেটা অ্যাড লাইব্রেরিতে “ইউনূস” কীওয়ার্ড ব্যবহার করে অনুসন্ধান চালানো হয়। এই সময়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কেন্দ্র করে ৯টি পৃথক ডিপফেক জুয়ার বিজ্ঞাপন এবং প্রচারণা চিহ্নিত করা হয়। এই ভিডিওগুলোর স্ক্রিপ্ট এবং বিবরণ বিশ্লেষণ করা হয়, এবং সম্পাদিত ভিডিওগুলোর মূল ভিডিওসহ অনুসন্ধান করে যাচাই করা হয়। মেটা ড. ইউনূসকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় বেশিরভাগ বিজ্ঞাপন অরাজনৈতিক ছিল। এগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ায় মেটা অ্যাড লাইব্রেরি থেকে সরিয়ে ফেলা হয়।

সাম্প্রতিক মাসগুলিতে ডিপফেক জুয়ার বিজ্ঞাপন এবং প্রচারণার পরিধি বোঝার জন্য, ২০ আগস্ট থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক হিসেবে চিহ্নিত বিজ্ঞাপনের জন্য “ইউনূস” কীওয়ার্ড ব্যবহার করে আরও অনুসন্ধান চালানো হয়।

এই সময়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একটি ডিপফেক জুয়ার বিজ্ঞাপন চিহ্নিত হয়, যেটি মেটা রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন হিসেবে শনাক্ত করে। এই বিজ্ঞাপনটি ২০ আগস্ট থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত ৪৫টি স্বতন্ত্র ফেসবুক পেজ থেকে মোট ১৩২ বার প্রচারিত হয়। রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন হিসেবে ফ্ল্যাগ করা হলেও বিজ্ঞাপনটিতে কোনো ডিসক্লেমার ছিল না। বিজ্ঞাপনগুলো আরও বিশ্লেষণ করে দেখা হয় এগুলো কোন কোন অঞ্চল থেকে প্রচারিত হচ্ছে এবং কোন মুদ্রায় বিজ্ঞাপনের অর্থ প্রদান করা হয়েছে। পাশাপাশি, বিজ্ঞাপন পেজগুলোর অ্যাডমিনদের অবস্থান কোন কোন দেশে ছিল তাও চিহ্নিত করা হয়। সবচেয়ে পুরোনো বিজ্ঞাপনটি ৫ সেপ্টেম্বর এবং সর্বশেষ বিজ্ঞাপনটি ১৬ নভেম্বর পাওয়া যায়।

আরো কিছু লেখা