ফামীম আহমেদ
‘দৈনিক ৮ গ্লাস পানি’ খেলে আয়ু বাড়ার প্রমাণ নেই
ফামীম আহমেদ
একটি গবেষণার বরাত দিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, দৈনিক ৮ গ্লাস পানি খেলে মানুষের আয়ু অন্তত ১৫ বছর পর্যন্ত বৃদ্ধিসহ দূর হতে পারে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা; যেমন- হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক কিংবা ডিমেনশিয়া (স্মৃতিভ্রংশ) ইত্যাদি।
গত ৮ এবং ৯ জানুয়ারি বাংলাদেশের মূলধারার বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে (১, ২, ৩) খবরটি প্রকাশিত হয়।
উল্লিখিত ৩টি সংবাদমাধ্যমের মধ্যে সর্বপ্রথম জাগোনিউজ গত ৮ জানুয়ারি “দৈনিক ৮ গ্লাস পানি পানেই বাড়বে আয়ু, বলছে গবেষণা” শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
পরে দৈনিক মানবকণ্ঠ ও দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ-এ হুবহু একই টেক্সট সম্বলিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
জাগোনিউজ এর প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে: “জানলে অবাক হবেন, দৈনিক ৮ গ্লাস পানি পান করলে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যাসহ হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক কিংবা ডিমনেশিয়ার ঝুঁকি কমবে। একই সঙ্গে আয়ু বাড়তে পারে অন্তত ১৫ বছর পর্যন্ত। এমনটিই জানাচ্ছে সাম্প্রতিক গবেষণা। গবেষকরা বলছেন, দৈনিক ৮ গ্লাস পানি পান করার মাধ্যমে বার্ধক্যকে ধীর করা সম্ভব। ৩০ এর বেশি বয়স্ক মোট ১১ হাজার মানুষের রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা ট্র্যাক করা হয়েছে এই গবেষণায়। এটি ইবিওমেডিসিন (সঠিক উচ্চারণ হবে ‘ই-বায়ো মেডিসিন) জার্নালে প্রকাশিত হয়।”
অর্থাৎ একটি গবেষণার বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলোতে দুটি তথ্য দেয়া হচ্ছে। সেগুলো হলো:
১. দৈনিক ৮ গ্লাস পানি পানে আয়ু বৃদ্ধি করা সম্ভব।
২. ৩০-এর অধিক বয়স এমন প্রায় ১১ হাজার লোকের উপর এই গবেষণাটি করা হয়েছে।
জাগোনিউজ (এবং আলোকিত বাংলাদেশ) তাদের খবরের উৎস হিসেবে ব্রিটেনের ডেইলি মেইলকে উল্লেখ করেছে।
এছাড়া একাধিক ফেসবুক পেজেও খবরটি পোস্ট করা হয়েছে যার মধ্যে আছে হোমিও চিকিৎসা সংক্রান্ত পেজও।
তবে ডিসমিসল্যাবের তথ্য যাচাইয়ে খবরটি বিভ্রান্তিকর হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে।
ডেইলি মেইলের প্রতিবেদন কী বলছে?
২০২৩ এর জানুয়ারি মাসের ২ তারিখ ডেইলি মেইল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যার শিরোনাম: “Secret to anti-aging: Drinking eight glasses of water every day can prolong your life for up to 15 YEARS and slash the risk of heart attacks, strokes and dementia, study suggests”
যার বাংলা অনুবাদ হলো: “বার্ধক্য ঠেকানোর গোপন তথ্য: দৈনিক ৮ গ্লাস পানি পান আপনার আয়ু ১৫ বছর বৃদ্ধি করতে পারে এবং হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমাতে পারে; বলছে গবেষণা”
অর্থাৎ, ডেইলি মেইল তাদের শিরোনামে দৈনিক পানির পরিমাণ ৮ গ্লাস উল্লেখ করেছে গবেষণার বরাতে। কিন্তু প্রতিবেদনের ভেতরে এক জায়গায় বলেছে ভিন্ন কথা।
ডেইলি মেইলের প্রতিবেদনের ভিতরের অংশে উল্লেখ করা হয়েছে: “The study did not specify how much water is needed exactly to slow down the effects of aging. But official US health guidelines say men and women should drink up to three litres of water – the equivalent of eight glasses – per day to stay hydrated.”
অনুবাদ: “বার্ধক্যের প্রভাব দমিয়ে দিতে ঠিক কী পরিমাণ পানি (পান করা) প্রয়োজন তা গবেষণা নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক স্বাস্থাবিধিমালায় বলা হয়েছে, (প্রাপ্তবয়স্ক) নারী-পুরুষদেরকে দৈনিক ৩ লিটার পর্যন্ত পানি পান করা উচিত- যা ৮ গ্লাসের সমতুল্য।”
এতে স্পষ্ট হয় যে, ডেইলি মেইল এর শিরোনামটি বিভ্রান্তিকর। কারণ যে নির্দিষ্ট গবেষণার বরাতে খবরটি প্রকাশ করা হয়েছে সেই গবেষণায় পানির পরিমাণের কথা উল্লেখ না থাকা সত্ত্বেও শিরোনামে তা তুলে ধরা হয়েছে।
ডিসমিসল্যাব-ও ই-বায়ো মেডিসিন জার্নালের গবেষণাপত্রে পানির নির্দিষ্ট কোন পরিমাণের উল্লেখ খুঁজে পায়নি।
এছাড়া গবেষণাপত্রটি নিয়ে আমেরিকার সিএনএন, এনবিসি নিউজ, ইউএসএ টুডে, সায়েন্স ডেইলিসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রতিবেদন হলেও কোথাও দৈনিক ৮ গ্লাস পানি খাবার কথা উল্লেখ করা হয়নি।
৮ গ্লাস পানির মেডিকেল মিথ
আসলে দৈনিক ৮ গ্লাস পানি খাওয়ার ব্যাপারটি একটি ‘মেডিকেল মিথ’। এই পরামর্শের পক্ষে কোনো সরকারি সংস্থার সূত্র বা বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।
এই বিষয়ে মার্কিন ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা স্নোপস, এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস ইতিমধ্যে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
স্নোপসের মতে, পানি পানের এই পর্যাপ্ত পরিমান কেবল ব্যক্তি বা লিঙ্গভেদে নয়, বয়স, কর্মশক্তি এমনকি আবহাওয়ার উপরেও নির্ভর করে।
“৩০ বছর” নিয়ে বিভ্রান্তি
জাগোনিউজ২৪-এর খবরটিতে বলা হয়েছে, “৩০ এর বেশি বয়স্ক মোট ১১ হাজার মানুষের রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা ট্র্যাক করা হয়েছে এই গবেষণায়।”
একই বক্তব্যের উল্লেখ আছে মানবকন্ঠ এবং আলোকিত বাংলাদেশের প্রতিবেদনেও।
অপরদিকে ডেইলি মেইল-ও তাদের প্রতিবেদনে ‘৩০ বছরের বেশি বয়সী’ ১১ হাজারের বেশি অংশগ্রহণকারীর কথা ইংরেজিতে লিখেছে এভাবে: “The study of more than 11,000 over-30s tracked sodium levels in the blood, which increase when you drink less fluid.”
কিন্তু এটি বিভ্রান্তিকর।
মূল গবেষণাপত্রে এবং গবেষণাটি প্রকাশ উপলক্ষ্যে এটির অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান মার্কিন সরকারের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ (NIH) তাদের প্রেস রিলিজে লিখেছে: “Using health data gathered from 11,255 adults over a 30-year period, researchers analyzed links between serum sodium levels” যার বাংলা অনুবাদ হলো: “৩০ বছর সময়কাল ধরে ১১ হাজার ২৫৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যতথ্য সংগ্রহ করে গবেষকরা সেরাম সোডিয়ামের মাত্রার যোগসূত্র বিশ্লেষণ করেছেন”।
অর্থাৎ গবেষণাটির জন্য ৩০ বছর ধরে স্বাস্থ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে যেটি ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে ডেইলি মেইল এবং বাংলা সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে।
৪৫ থেকে ৬৬ বছর বয়সীদের সিরাম সোডিয়ামের (৩০ বছর ধরে সংগৃহীত) উপাত্তের ভিত্তিতে এই গবেষণাটি করা হয়েছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ এর প্রেস রিলিজে জানানো হয়েছে যে, গবেষণাটির কাজ শুরু হয় ১৯৮৭ সালে।
মূল গবেষণাপত্রেও একই তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে: “In order to test the hypothesis that hydration can affect speed of aging, we analyzed data from Atherosclerosis Risk in Communities (ARIC) study: an ongoing population-based prospective cohort study in which 15,792 45-66 year-old black (African American) and white men and women were enrolled from four US communities in 1987–1989 and followed up for more than 25 years.”
সিএনএন-সহ অন্য সংবাদমাধ্যমের এ সংক্রান্ত খবরেও ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে গবেষণা চলার প্রসঙ্গটি এসেছে।
দৈনিক পানি পানের পরিমাণ আসলে কত
আমেরিকার ন্যাশনাল একাডেমিস-এর “ডায়েটারি ইনটেক লেভেলজ ফর ওয়াটার, সল্ট এন্ড পটাসিয়াম টু মেইনটেইন হেলথ এন্ড রিডিউস ক্রনিক ডিজিজ রিস্ক” অনুযায়ী, ১৯ থেকে ৩০ বছর বয়সী পুরুষদের প্রতিদিন ৩.৭ লিটার ও নারীদের ২.৭ লিটার জন্যে পানি পান করা উচিত। বিভিন্ন বয়স সীমা অনুযায়ী নারী, পুরুষ ও শিশুদের দৈনিক পানি পানের পরামর্শও এখানে উল্লেখ করা আছে।
এছাড়াও “ইউরোপিয়ান ফুড সেফটি অথরিটি” জার্নাল অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের দৈনিক ২.৫ লিটার ও নারীদের ২ লিটার পানি পান করা উচিত।
অর্থাৎ দৈনিক ৮ গ্লাস পানি পান সংক্রান্ত ভিত্তিহীন তথ্যকে সাম্প্রতিক একটি গবেষণার সাথে মিলিয়ে খবর প্রচার করা হচ্ছে যা বিভ্রান্তিকর।