তামারা ইয়াসমীন তমা
তৌহিদুল ইসলাম রাসো
চার থেকে একশ: পার্বত্য চট্টগ্রাম সংঘাতে অপতথ্যের রাজনীতি
তামারা ইয়াসমীন তমা
তৌহিদুল ইসলাম রাসো
গত ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে চুরির অভিযোগে গণপিটুনিতে এক যুবকের মৃত্যু হয়। পরের দিন জেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে অন্তত ৮৬টি দোকানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়, যার বেশিরভাগই ছিল আদিবাসীদের। এরপরই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে আরেক পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে। মাত্র দুই দিনের মধ্যে পৃথক ঘটনায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের চারজন নিহত এবং কমপক্ষে ৮০ জন আহত হন। এর মধ্যে খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে দুজনের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) পরে দাবি করে যে, সশস্ত্র গোষ্ঠীর আক্রমণের শিকার হলে টহলরত সৈন্যরা আত্মরক্ষার্থে গুলি ছোঁড়ে এবং তাতেই এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (এনএইচআরসি) এই সংঘাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। একটি যৌথ বিবৃতিতে, সিএইচটি কমিশন এবং ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কগ্রুপ ফর ইন্ডিজেনাস অ্যাফেয়ার্স (আইডব্লিউজিআইএ) আদিবাসীদের উপর সহিংস হামলার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।
সংখ্যালঘু পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে, মৃত্যুর সংখ্যা সম্পর্কে ভুল তথ্য সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত ডালপালা ছড়ায়। এক্স (সাবেক টুইটার), ফেসবুক এবং ইউটিউবের বিভিন্ন পোস্টে মৃতের সংখ্যা ৩২, ৬৭ এমনকি ১০০-র বেশি বলেও দাবি করা হয়। সামাজিক মাধ্যম থেকে এই অপতথ্য জায়গা করে নেয় বিভিন্ন সংগঠন ও ভারতীয় রাজনীতিবিদদের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে, ছাত্রদের বিক্ষোভ সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে এবং এক পর্যায়ে দেশটির মূলধারার গণমাধ্যমের খবরে। একপর্যায়ে সীমান্তের দুই পাশেই এটি রাজনৈতিক প্রচারণার অংশ হয়ে ওঠে।
কোথাও কোথাও একে বাংলাদেশে অবস্থানরত বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের সুসংগঠিত পরিকল্পনা হিসেবে তুলে ধরা হয়। কোথাও সেনাবাহিনী, পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থানরত বাঙালি ও বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে গণহত্যা বা জাতিগত নিধনের অভিযোগ আনা হয় এবং এর জন্য দায়ী করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রত্যাহারেরও দাবি তোলা হয়।
এই বিশ্লেষণে ডিসমিসল্যাব খতিয়ে দেখেছে, পাহাড়ে সংঘর্ষের ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা চার জন থেকে কিভাবে অতিরঞ্জনে একশ জন হল; অপতথ্যটি কারা, কিভাবে এবং কতটা ছড়াল; অনলাইন থেকে একটি মিথ্যা তথ্য কিভাবে অফলাইন বা বাস্তব জগতেরও একটি ভাষ্য হয়ে উঠল এবং এখানে রাজনৈতিক প্রভাব কি ভূমিকা রাখল।
চার থেকে একশ: যেভাবে মৃত্যুর ভুল সংখ্যা ছড়াল
মৃত্যুর অতিরঞ্জিত সংখ্যাগুলো সামনে আসতে থাকে মূলত ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভর এলাকায় গুলিবর্ষণের ঘটনার পর থেকে। রাত সাড়ে দশটায় সংঘর্ষটি শুরু হয় এবং রাত ১২টা ৫৪ মিনিটে জুম্ম নামের একটি ফেসবুক পেজে, ইংরেজিতে লেখা একটি পোস্টে বলা হয়, “এরই মধ্যে ৩২ জন মারা গেছে। সবার নজর খাগড়াছড়িতে।” মৃত্যুর মিথ্যা তথ্য নিয়ে ডিসমিসল্যাব যত পাবলিক পোস্ট পেয়েছে তার মধ্যে এটিই ছিল প্রথম।
পেজটি খোলা হয়েছে ১৮ সেপ্টেম্বর, গোলাগুলির ঘটনার মাত্র এক দিন আগে। সেদিন পেজটিতে যে প্রোফাইল ছবি যুক্ত করা হয়, তাতে ভারতের ত্রিপুরা থেকে পরিচালিত অনলাইন পোর্টাল দ্য জুম্ম টাইমসের লোগো ছিল। ২০ তারিখ মধ্যরাতে বিভিন্ন প্রোফাইল ও পেজ থেকে (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮) হুবহু একই দাবি পোস্ট করা হয়।
জুম্মর ৩২ জনের মৃৃত্যুর দাবি করার এক ঘন্টার মধ্যেই মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়ে যায় ৩৫ জন। এই দফার ফেসবুক পোস্টগুলোতে দাবি করা হয় (১, ২, ৩), “খাগড়াছড়িতে গুলি চালিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৪ — ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাতে ৩৫ জন আদিবাসী নিহত হয়েছে।” এই পোস্টগুলোতে গুলি চালানোর ভিডিও এবং কিছু আহত ব্যক্তিদের ছবি যুক্ত ছিল কিন্তু কোনো মৃতদেহ আছে- এমন প্রমাণ দেখা যায়নি। এই দাবি সংক্রান্ত সবচেয়ে পুরোনো পাবলিক পোস্টগুলো যেখান থেকে দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে একটি ছিল “আরসি’স ওয়ার্ল্ড (RC’s World)” নামের একটি ফেসবুক পেজ। পেজ ট্রান্সপারেন্সির তথ্য অনুযায়ী, ফ্রান্সে বসবাসরত কেউ পেজটি পরিচালনা করে।
রাত তিনটা নাগাদ, নিহতের কথিত সংখ্যা ৩৫ থেকে বেড়ে ৩৬ জনে দাঁড়ায়। এই দাবির ভাষা ছিল এমন: “৫ই আগষ্টের আগের সকল হত্যার দায় যদি আওয়ামী লীগ সরকারের হয়, তাহলে ৫ই আগষ্টের পরের সকল হত্যার দায় কেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কের হবে না ??? কেন তাদেরকে এখনও গ্রেফতার করা হবে না ??পাহাড়ে কান্নার রোল পরেছে ৩৬ জন নিহত সেই সাথে ২০০ বাড়িঘর আগুনে পুড়ে ছাই।” দাবিটি ব্যাপকভাবে (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯) ছড়াতে থাকে।
এই দাবি প্রথম পাওয়া যায়, মোহাম্মদ জাকারিয়া ইসলাম নামের এক ব্যক্তির প্রোফাইলে। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক এবং সদ্য ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে ফেসবুকে নিজের পরিচয় দিয়েছেন। শুরুর দিকে অন্য যারা ভুল তথ্যটি পোস্ট করেছেন তাদের অনেকেই (১, ২, ৩) আওয়ামী লীগ বা এর ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে প্রোফাইল পরিচিতি দিয়েছেন।
২০ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয় ত্রিপুরা ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম দ্য জুম্ম টাইমসের ফেসবুক পেজে। তাতে আগুনে পোড়া একটি ধ্বংসস্তূপের দৃশ্য দেখিয়ে বলা হয়, সেনাবাহিনীর গুলি ও বাঙালি সেটেলারদের দেওয়া আগুনে ৩৩ জন চাকমা নিহত হয়েছেন। তবে এখানে গুলির ঘটনার স্থানকে খাগড়াছড়ি শহরের বদলে দীঘিনালার বলে দাবি করা হয়।
নিহতদের সংখ্যা এরপর আরো বাড়তে থাকে এবং এক সময় ৬৭ ও পরে ৭৯ জনে গিয়ে পৌঁছে। অতুল চাকমা নামের একটি প্রোফাইল থেকে ৬৭ জনের নিহত হওয়ার সবচেয়ে পুরোনো দাবিটি মেলে। তিনি লেখেন, “মানুষ বলছে ১৫০ জনের বেশি সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে। ৬৭ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে এবং আহতের সংখ্যা অনেক।” অতুল চাকমার একটি পেজও আছে। সেখানে বলা হয়েছে, তার অবস্থান ভারতে।
২০ সেপ্টেম্বর বেলা তিনটা নাগাদ, ইংরেজিতে একটি দীর্ঘ পোস্ট ছড়ানো (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭) শুরু হয় যেখানে চলমান সংঘাতের প্রেক্ষিত ও পাহাড়িদের ওপর হামলার বিবরণ তুলে ধরে বলা হয় “এই বার্তা লেখার সময় পর্যন্ত ৬৭ জন মারা গেছেন।” পোস্টগুলোতে এই ঘটনাকে ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করা হয়। বাঙালির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে প্রত্যেক পোস্টের নিচে লেখা হয়: “নোট: বাঙালি অর্থ বাঙালি মুসলিম সেটলার।” এই পোস্টে হিরা, ঢাকা ট্রিবিউন, চাকমা ব্যান্ড মিউজিক কমিউনিটির মতো বিভিন্ন তথ্যসূত্রের উল্লেখ করা হলেও এসব গণমাধ্যম বা ফেসবুক পেজে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে এরকম কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
সুনির্দিষ্ট এই দাবিটি যারা ছড়িয়েছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন সেই অতুল চাকমা যিনি এক সময় অল অরুনাচল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের নেতা ছিলেন; অ্যাডভোকেট সুমন্ত চাকমা যিনি কট্টরপন্থী দল রাস্ট্রীয় সেবক সংঘের কর্মী বলে পরিচয় দেন এবং চাকমা বাবু যিনি জুম্ম টাইমসে নিয়মিত লেখেন বলে তার ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে জানিয়েছেন।
এরই মধ্যে, রুপম দ্য এক্সপ্লোরার নামের ভারতীয় একজন ইনফ্লুয়েন্সার ‘বাংলাদেশি মুসলিমদের নির্মম হামলায় ১০০ জনের বেশি নিহত, বাংলাদেশ পরবর্তী আফগানিস্তান’ শিরোনামে একটি ইউটিউব ভিডিও আপলোড করেন। এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত ভিডিওটি ৩০ হাজার বার দেখা হয়েছে। তাতে সাড়ে তিনশর বেশি ব্যক্তি মন্তব্য করেছেন এবং বেশিরভাগই ভিডিওটির তথ্য বিশ্বাস করেছেন। একাধিক মন্তব্যে বলা হয়েছে, “এমনটা হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টানদের সঙ্গেও হচ্ছে।”
মৃত্যু থেকে গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের অভিযোগ
পাহাড়ে সংঘাতে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে যে মিথ্যা দাবিটি সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে, তাতে বলা হয়: খাগড়াছড়িতে ৬৭ জন এবং দীঘিনালায় ১২ জন, মোট ৭৯ জন নিহত হয়েছে। দাবিটি প্রথম দেখা যায় হিল ব্লাড নামের এক পেজে। পেজ পরিচালকের অবস্থান, বাংলাদেশে।
২০ তারিখ সকাল সোয়া ১০টায়, হিউম্যান রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশি মাইনোরিটিজ (এইচআরসিবিএম) নামের একটি সংগঠনও এটি প্রচার করে। সংগঠনটি আরও দাবি করে, আদিবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে তাদের সরিয়ে দিতে পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা ক্যাম্পেইন চালানো হচ্ছে এবং তারা জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানায়।
এইচআরসিবিএমকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করে, ৭৯ জন মৃত্যু এবং গণহত্যার আক্রমণের দাবি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে (১, ২, ৩, ৪)।
জেনেভায় জাতিসংঘের অফিসে স্বীকৃত এনজিওগুলোর তালিকায় এইচআরসিবিএমের উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু এর আগেও সংস্থাটি তাদের ফেসবুক পেজে বাংলাদেশে জোরপূর্বক দুই হিন্দু তরুণীকে ধর্মান্তরিতকরণের দাবিতে একটি ভিডিও শেয়ার করে যা ভারতীয় তথ্য যাচাই সংস্থা অল্ট নিউজের ফ্যাক্টচেকে ভুয়া প্রমাণিত হয়। পেজ ট্রান্সপারেন্সির তথ্য অনুযায়ী, বিদেশী এই মানবাধিকার সংগঠনটির ফেসবুক পেজের অ্যাডমিনদের মধ্যে ৪ জন যুক্তরাষ্ট্র ও একজন ভারতে থাকেন।
এইচআরসিবিএম তাদের এক্স একাউন্টেও একই প্রচারণা চালায় এবং সেখানে ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্ক গ্রুপ ফর ইনডিজিনাস অ্যাফেয়ার্স (আইডব্লিউজিআইএ), দ্য বর্ডারলেন্স, রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালাইসিস গ্রুপকে তথ্যের সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে। যদিও সূত্রগুলোর নিজস্ব সাইট বা পেজে নিহতদের সংখ্যা সম্পর্কিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালাইসিস গ্রুপের পরিচালক সুহাস চাকমা গণমাধ্যমের কাছে দেওয়া বক্তব্যে ৯ জন পাহাড়ির মৃত্যুর দাবি করেন। তিনি অন্যান্য ভারতীয় চাকমা নেতাদের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে আদিবাসীদের হত্যার কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস করার আহ্বান জানান। দ্য বর্ডারলেন্স, সেই চিঠির উদ্ধৃতি দিয়ে দাবি করে “৯ জন আদিবাসীর মৃত্যু হয়েছে” এবং জানা গেছে খাগড়াছড়ি হাসপাতালে পাঁচটি অজ্ঞাত মৃতদেহ রয়েছে। যদিও দাবিটির পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই সেখানে। তবে আইডব্লিউজিআইএ সিএইচটি কমিশনের সঙ্গে এক যৌথ বিবৃতিতে শুধুমাত্র চারটি মৃত্যুর ঘটনা উল্লেখ করেছে।
জাতিগত সহিসংসতা ছাড়াও ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে বাংলাদেশি হিন্দু ও বৌদ্ধরা হত্যার শিকার বলে ছড়াতে থাকে আরেকটি দল। বাবা বেনারাস নামে এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে – যেখানে আগেও হিন্দুদের উপর নির্যাতন ও সহিংসতার একাধিক ভুয়া তথ্য (১, ২, ৩) ছড়ানো হয়েছিল – দাবি করা হয় রাঙামাটির বনরূপায় ইসলামপন্থীরা কয়েক ডজনখানেক হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীকে হত্যা করেছে। ভয়েজ অব বাংলাদেশি হিন্দুজ এক্স হ্যান্ডেলও খাগড়াছড়িতে ৬৭ জন ও দীঘিনালায় ১২ জনের মারা যাওয়ার দাবিতে ভুয়া তথ্য প্রকাশ করে।
অনলাইন থেকে অফলাইন হয়ে সংবাদে
২০ সেপ্টেম্বর রাত থেকে ভারতের একাধিক রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বেশ কয়েকটি সংগঠন বিক্ষোভ কর্মসূচিরও আয়োজন করে এবং সেখানে নিহতদের বিভ্রান্তিকর সংখ্যা তুলে ধরে।
ত্রিপুরার শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী ও বিজেপি সদস্য সান্তনা চাকমা নরেন্দ্র মোদির কাছে লেখা এক চিঠিতে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ‘সংগঠিত আক্রমণ ও হত্যাযজ্ঞে’ ৪০ জনের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেন। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনেও বিষয়টি উঠে আসে।
ভারতের আন্দোলনকারী ও নেতাকর্মীদের বরাতে নিহতদের অতিরঞ্জিত সংখ্যাগুলো জায়গা করে নেয় মূলধারার গণমাধ্যমে। এর মধ্যে আছে ত্রিপুরা চাকমা স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (টিসিএসএ) প্রেস ব্রিফিং, যেখানে ২০ সেপ্টেম্বর তারা ৬৭ জন পাহাড়ির মৃত্যু সংবাদে নিন্দা জানানোর পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতে অন্তর্ভুক্তকরণের দাবিও জানায়।
২১ সেপ্টেম্বর টিসিএসএসহ টিপরা মথা পার্টির (টিএমপি) ছাত্র সংগঠনের মতো কিছু সংগঠন বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। চাকমা গোষ্ঠীর নেতা অমিতাভ চাকমা গণমাধ্যমকে জানান, “গত কয়েক সপ্তাহে মুসলিম ও তাদের সন্ত্রাসীদের হাতে ৭৯ জনের বেশি নিহত হয় যাদের বেশিরভাগই চাকমা জনগোষ্ঠীর।” দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সহ বেশ কিছু সংবাদ মাধ্যম (১, ২, ৩, ৪, ৫) তাদের সংবাদ প্রতিবেদনে বিক্ষোভকারীদের দাবি অনুযায়ী ৬৭ থেকে ৭০ জনের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে।
সংবাদ মাধ্যম বলে দাবি করা কিছু এক্স হ্যান্ডেলেও নিহতদের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন তথ্য ছড়াতে দেখা যায়: যেমন, ভারতের মেঘ আপডেটস ও অর্গানাইজার উইকলি এবং মিয়ানমারের আরাকান বে নিউজ।
মিথ্যা তথ্য থেকে রাজনৈতিক প্রচারণা
বিষয়টি রাজনৈতিক প্রচারের অংশ হয়ে ওঠে দুটি দিক থেকে: প্রথমটি ভারতের আদিবাসী নেতাসহ বিজেপি সমর্থক ও নেতাদের এবং দ্বিতীয়টি সদ্য ক্ষমতাচ্যুত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থকদের। এই পর্যায়ে বিভিন্ন পেজ বা এক্স হ্যান্ডেল থেকে করা অধিকাংশ পোস্টে পুরো বিষয়টিকে গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূল অভিযান বলে অভিহিত করা হয় এবং জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়।
বেশ কিছু পোস্টে (১, ২, ৩) এসব হত্যার জন্য ড. ইউনূসকে দায়ী করা হয়। ড. ইউনূসের নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারের প্রথম আহ্বান এবং বাংলাদেশে জাতিগত নিধনের প্রাথমিক অভিযোগ আসে ভারতের চাকমা ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা এবং দিল্লিভিত্তিক রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালাইসিস গ্রুপের ডিরেক্টর সুহাস চাকমার কাছ থেকে। তিনি দাবি করেন যে বাংলাদেশে ‘টার্গেটেড জাতিগত প্রোফাইলিং, টার্গেটেড কিলিং এবং পরোক্ষ উপায়ে জাতিগত নিধনের’ ঘটনা ঘটছে, যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ঘটেনি।
বিজেপি মিজোরামের সিএডিসি কমিটি এবং ত্রিপুরা রাজ্য স্তরের চাকমা যুব সংস্থা (টিআরসিজিজে), প্রধানমন্ত্রী মোদীর কাছে পৃথক চিঠি এবং স্মারকলিপিতে নয়জন আদিবাসীর মৃত্যুর উল্লেখ করে এবং ভারতের হস্তক্ষেপ দাবি করে।
ত্রিপুরা চাকমা স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (টিসিএসএ) তাদের প্রেস ব্রিফিংয়ে ৬৭ জন পাহাড়ির মৃত্যুর দাবির সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতে অন্তর্ভুক্তকরণের দাবি জানায়। ত্রিপুরায় এক বিক্ষোভে ড. ইউনূসের উদ্দেশ্যে বলতে শোনা যায়, “যতক্ষণ অবধি পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ কিংবা ভারতের অন্তর্ভুক্ত না হচ্ছে ততক্ষণ অবধি সেখানে সেনা মোতায়েন ও গণহত্যা বন্ধ করতে হবে, এবং সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করতে হবে।”
ড. ইউনূস ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণায় নিহতের মিথ্যা সংখ্যা ব্যবহার করতে দেখা যায় সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থকদেরও। সাপোর্টারস অব বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গ্রুপে একদম শুরুর দিকের ৩২ জন নিহতের প্রচারণা দেখা যায়। পরবর্তীতে দলটির একাধিক সমর্থককেও ৩৬ জন নিহতের দাবি প্রচারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সমন্বয়করা কেন এই হত্যার দায় নেবে না সেই প্রশ্ন রাখা হয়। একটি পোস্টে ড. ইউনূসকে অং সান সুচির সঙ্গে তুলনা করে দাবি করা হয়, তার মতো, “ড. ইউনূস ক্ষমতা দখল করে, পাহাড়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে, আদিবাসীদের হত্যা শুরু করেছে। গত রাতেই সেনাবাহিনীর হাতে ৬৭ জন নিহত হয়েছে।” এক্সে প্রচারিত এই পোস্টগুলোতে #স্টেপডাউনইউনূস হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় ২২ সেপ্টেম্বর নাগাদ, ড. ইউনূসের নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রত্যাহারের পিটিশন ক্যাম্পেইন শুরু হয়। রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে সাম্প্রতিক হামলার প্রসঙ্গে পিটিশনে বলা হয়: “তার (ড. ইউনূসের) সরকারের অধীনে প্রতিটি জেলা জুড়ে অসংখ্য হিন্দু এবং খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি অঞ্চলের আদিবাসীদের হত্যা ও বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. ইউনূস নীরব থাকতে পারেন না, যখন তার সেনাবাহিনী গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও এই অন্যায় উপেক্ষা করা উচিত হচ্ছে না।”
পিটিশনটি সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে এবং তার তথ্য ও যোগাযোগ-প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। অবশ্য চেঞ্জ ডট অর্গের মূল লিংকে গিয়ে এখন আর পিটিশনটি পাওয়া যায় না। লিংকে গেলে দেখা যায়: ”পিটিশনটি নেই। হয় ইউআরএলটি ভুল, এটি আমাদের কমিউনিটি নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে, অথবা যিনি এটি শুরু করেছিলেন তিনি সরিয়ে নিয়েছেন৷”
পার্বত্য চট্টগ্রামের সংঘাতে আসলে কতজন মারা গেছে?
প্রথম আলো, সমকাল, ডয়চে ভেলে, ডেইলি স্টার, ও নিউ এইজ সহ দেশের অনেক গণমাধ্যমে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে তিনটি আলাদা ঘটনায় মোট ৪ জন মারা গেছে বলে খবর বেরিয়েছে। এদের মধ্যে রাঙামাটিতে এবং খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় আঘাতের কারণে মারা যান দুই জন। আর বাকি দুজন নিহত হন খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভর এলাকায়, গুলিবিদ্ধ হয়ে।
বাংলাদেশে আদিবাসীদের মানবাধিকার নিয়ে অনেক দিন ধরে কাজ করে আসা সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে নিহতের সংখ্যা নিয়ে একই ধরনের বিবরণ পাওয়া যায়। তারা আরো জানায় সেই রাতে স্বনির্ভর এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে ৯ জন আহত হয়। পরবর্তীতে আইএসপিআর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দল ইউনাইটেড পিপল’স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর সদস্যরা গুলি চালালে সেনা বাহিনীর টহল দল পাল্টা গুলি ছোড়ে এবং এতেই হতাহতের ঘটনা ঘটে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান সংঘাতে কতজন মৃত্যুবরণ করেছেন সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির স্থানীয় একাধিক গণমাধ্যমকর্মী, প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীসহ অন্তত ৮ জনের সঙ্গে কথা বলেছে ডিসমিসল্যাব। এদের প্রত্যেকে আলাদাভাবে নিশ্চিত করেছেন, গত মঙ্গলবার পর্যন্ত খাগড়াছড়িতে ৩ জন ও রাঙামাটিতে একজন মিলিয়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মোট ৪ জন মারা গেছেন।
খাগড়াছড়িতে মারা যাওয়া ৩ ব্যক্তি হলেন – সদর উপজেলার জামতুলি পাড়া গ্রামের জুনান চাকমা, একই উপজেলার পল্টন জয় পাড়া গ্রামের রুবেল ত্রিপুরা, এবং দিঘীনালা উপজেলার উদালবাগান গ্রামের ধন রঞ্জন চাকমা। আর রাঙামাটিতে মারা গেছেন একজন কলেজ শিক্ষার্থী। অনিক কুমার চাকমা নামের এই শিক্ষার্থী রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার ২নং মগবান ইউনিয়নের নোয়াদাম গ্রামের বাসিন্দা।
ইনডিপেনডেন্ট টিভির সাংবাদিক হিমেল চাকমা চার জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, “রাঙামাটিতে আহতের সংখ্যা ৭০-৮০ জনের মতো, যার মধ্যে আনুমানিক ১৯ জন এখনো বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।” আদিবাসীরা পরিচালনা করেন এমন একটি অনলাইন পোর্টালের সাংবাদিককে প্রশ্ন করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, “আনুমানিক ২০০ জনেরও বেশি লোক আহত হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৫০ জন হাসপাতালে ভর্তি আছেন।” সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত ৩২ থেকে ১০০ জনের মৃতের সংখ্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি সেগুলোকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, “এই ভুল তথ্য ছড়ানোর পেছনে স্বার্থান্বেষী বিভিন্ন পক্ষ রয়েছে।”
আদিবাসীদের গণমাধ্যম আইপিনিউজবিডির পাহাড় বিষয়ক সংবাদের সহ-সম্পাদক সতেজ চাকমা এবং সমকালের খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি প্রদীপ চৌধুরী মৃত্যুর এই সংখ্যাগুলোকে ভুল তথ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
রাঙামাটি জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জনাব শাহনেওয়াজ রাজু বলেন, “মৃত্যুর এই সংখ্যাগুলো অযৌক্তিক। পাহাড়ের পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার জন্যই এমনটি করা হচ্ছে।“ পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) কেন্দ্রীয় সভাপতি অঙ্কন চাকমার সঙ্গেও কথা হয় ডিসমিসল্যাবের। মৃত্যুর এসব সংখ্যাকে তিনিও “একেবারেই ভুয়া” বলে অভিহিত করেন। তাঁর মতে, “পাহাড়ে আতঙ্ক তৈরির জন্যে এমনটি করা হচ্ছে।”