পার্থ প্রতীম দাস

এনগেজমেন্ট এডিটর, ডিসমিসল্যাব

তৌহিদুল ইসলাম রাসো

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
২০২৪ সালে বাংলাদেশে ভুল তথ্যের প্রবণতা ও ভাষ্য
This article is more than 6 months old

২০২৪ সালে বাংলাদেশে ভুল তথ্যের প্রবণতা ও ভাষ্য

পার্থ প্রতীম দাস

এনগেজমেন্ট এডিটর, ডিসমিসল্যাব

তৌহিদুল ইসলাম রাসো

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

২০২৪ সাল ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি ঘটনাবহুল বছর; একই সঙ্গে ভুল বা অপতথ্য ছড়ানোরও বছর। নির্বাচনী প্রচারণা ও উত্তেজনার কারণে এমনিতেই ২০২৩ সালে অপতথ্যের ছড়াছড়ি ছিল। কিন্তু বিগত বছরটি তাকেও ছাড়িয়ে গেছে। ডিসমিসল্যাবের ফ্যাক্টচেক ডেটাবেসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করা ফ্যাক্টচেকারেরা ২০২৩ সালের তুলনায় ৫৮ শতাংশ বেশি ভুয়া তথ্য যাচাই করেছেন।

ডিসমিসল্যাব প্রতি প্রান্তিকে অপতথ্যের প্রবণতা নিয়ে বিশ্লেষণ তৈরি করে থাকে। নতুন বছরের শুরুতে এসে, এই লেখায় আমরা তুলে ধরছি গোটা বছরের চিত্র। এখানে আমরা ফিরে দেখেছি, ২০২৪ সালে সামগ্রিকভাবে ভুয়া বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর ধরন কেমন ছিল, কোন কোন ঘটনা মিথ্যার জোয়ারকে প্রভাবিত করেছে, কোন ধরনের ভাষ্য বেশি ছড়িয়েছে, এবং কাদের নিয়ে।

গত বছর, স্বভাবতই, সবচেয়ে বেশি পরিমাণ অপতথ্য ছিল রাজনৈতিক। এর কারণ, শুরুতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, মাঝামাঝিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং শেষ দিকে ধর্মীয় সংঘাত। ভুল তথ্যের বিষয় হিসেবে রাজনীতির পরেই ছিল ধর্ম। বছরের শেষ দিকে, অর্থাৎ, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরের মাসগুলোতে ধর্ম সংশ্লিষ্ট ভুল তথ্য বেশি ছড়িয়েছে। সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের অন্যতম সংগঠন, ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট’-এর মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার ও তার বিচারের ঘটনাগুলো এতে সবচেয়ে বড় প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছে। আর আন্তর্জাতিক বিষয় সংক্রান্ত ভুল তথ্যের একটি বড় অংশ ছড়িয়েছে ইসরায়েল-ইরান এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতকে কেন্দ্র করে। 

আমরা দেখার চেষ্টা করেছি, ভুল তথ্যের বিষয়বস্তু হিসেবে সবচেয়ে আলোচিত কারা ছিলেন। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও দেশ, এই তিনভাগে ভাগ করে দেখা গেছে ব্যক্তি হিসেবে শীর্ষে ছিলেন, স্বাভাবিকভাবেই, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছিল আওয়ামী লীগ, সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও বিএনপি নিয়ে। আর বাংলাদেশের বাইরে কোন কোন দেশ ভুল তথ্যের বিষয়বস্তু হিসেবে সবচেয়ে ওপরে ছিল? অবশ্যই ভারত এবং তারপরে ফিলিস্তিন, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র। এই হিসেবটি করা হয়েছে, যাচাই প্রতিবেদন থেকে সংকলন করা শিরোনামে কী-ওয়ার্ড বা মূল শব্দের গণনার ভিত্তিতে (বিস্তারিত দেখুন গবেষণা পদ্ধতি অংশে)।

২০২৩ সালের মতো ২০২৪ সালেও বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি (৩৯%) ভুল তথ্য ছড়িয়েছে শুধু ভিডিওর মাধ্যমে। এরপরেই ছিল ছবি (২৮%) ও গ্রাফিক কার্ডের (১৪%) ব্যবহার।

যত বড় ঘটনা তত বেশি ভুল তথ্য

গত বছর ঠিক কত ভুল বা অপতথ্য ছড়িয়েছে সেটি বলা মুশকিল। পদ্ধতিগত কারণেই অনলাইনে ছড়ানো অপপ্রচারের নেহাতই সামান্য অংশ যাচাই করা যায়। যাচাইয়ের জন্য আধেয়টিতে এমন তথ্য থাকতে হয় যা যাচাই-যোগ্য। যাচাইকারীরা সেটির গুরুত্ব এবং বিস্তারও বিবেচনা করেন। তাই অনেক সময় অনেক ধরনের ভুল তথ্য ফ্যাক্টচেকিংয়ের আওতায় পড়ে না। ডিসমিসল্যাবের ফ্যাক্টচেকিং ডেটাবেস অনুযায়ী, বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করা আটটি ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা, ২০২৪ সালে সাড়ে চার হাজারের বেশি ভুয়া তথ্য যাচাই করেছে। অনেক সময় একাধিক সংস্থা একই বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন করেছে। সেখান থেকে একটিকে ইউনিক বা স্বতন্ত্র উপাত্ত হিসেবে ধরে দেখা যায়, ২০২৪ সালে তারা বাংলাদেশে ছড়ানো তিন হাজারের বেশি স্বতন্ত্র ভুয়া বা বিভ্রান্তিকর তথ্য সনাক্ত ও যাচাই করেছেন, যা আগের বছরের তুলনায় অনেক বেশি।

রাজনীতি ও ধর্ম বছরজুড়ে কম বেশি অপতথ্যের বিষয় ছিল। ওপরের প্রথম চিত্রে দেখা যাবে মোট ভুল তথ্যের তিন ভাগের এক ভাগই (৩৩%) ছিল রাজনীতি সংক্রান্ত। এরপরেই রয়েছে ধর্ম (১৩%) ও খেলাধুলা (৮%)। কিন্তু নিচে ভুল তথ্যের মাসওয়ারী হিসেবের চিত্রটিতে দেখা যাবে, একেক মাসে একেকটি ঘটনা বা ঘটনাপ্রবাহ অপতথ্য ছড়ানোর `ট্রিগার’ হিসেবে কাজ করেছে। যেমন: জুলাইয়ের শেষে এবং আগস্টের প্রথম ভাগে ভুল তথ্যের সংখ্যায় বড় একটি লাফ দেখা যাচ্ছে। এটি হয়েছে মূলত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সময়ে রাজনৈতিক ভুল তথ্যের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে। কোথাও পুরোনো বা অপ্রাসঙ্গিক ছবি-ভিডিও দিয়ে আন্দোলনের তীব্রতা প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে, কোথাও আবার সাম্প্রতিক ছবি-ভিডিওকে পুরোনো দাবি করে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাওয়ার ভাষ্য প্রচার করা হয়েছে। প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করার জন্য ছড়ানো হয়েছে ভুয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তি। বৈদেশিক হস্তক্ষেপ বা সমর্থনের দাবিতেও প্রচারিত হতে দেখা গেছে নানা ভুল তথ্য। নিহতের সংখ্যা নিয়ে নানা ভুল দাবিও ভীতি ছড়িয়েছে আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে। (এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন ডিসমিসল্যাবের এই বিশ্লেষণ)

একইভাবে, গত বছরের জানুয়ারিতে যে লাফটি দেখা যাচ্ছে, তা মূলত নির্বাচনের কারণে। এই মাসে মোট অপতথ্যের ৪৮ শতাংশই ছিল রাজনৈতিক। ২০২৪ সালের শুরুতেই, ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে সফল দেখানো বা কারচুপি প্রমাণের চেষ্টা, নির্বাচনের প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন অথবা সমালোচনা – একেক পক্ষ একেক ধরনের ভাষ্য তুলে ধরতে গিয়ে ভুল তথ্য ছড়িয়েছে। এসময় অন্তত দুইটি ক্ষেত্রে ডিপফেক ভিডিও ছড়িয়ে প্রার্থীতা প্রত্যাহারের ভুয়া তথ্যও ছড়াতে দেখা গেছে। আর এই প্রার্থীদের দুজনই নারী।

গত বছর ধর্মীয় অপতথ্যের একটি বড় অংশে দাবি করা হয়, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন বেড়েছে, বা ইসলামী চরমপন্থার উত্থান হয়েছে। কোথাও পুরোনো বা অপ্রাসঙ্গিক ছবি-ভিডিও দিয়ে হিন্দুদের ওপর হামলার ভুল দাবি করা হয়েছে, কোথাও মুসলিম ব্যক্তি বা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার দৃশ্যকে উপস্থাপন করা হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হিসেবে। কোথাও আবার ভুলভাবে বলা হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হিন্দুদের দেশ ছাড়ার আল্টিমেটাম দিয়েছেন, গণহত্যার আহ্বান জানিয়েছেন, বা বাংলাদেশে ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে মিছিল করে হিন্দুদের জবাই করার হুমকি দিয়েছেন। জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিত ধর্ম বিষয়ক ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে ডিসমিসল্যাব দেখেছিল, আগস্টের পর থেকে ধর্মীয় অপতথ্য কীভাবে ক্রমেই বিদ্বেষমূলক হয়ে উঠেছে, বিভাজন বাড়িয়েছে।

আগস্ট থেকে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অপতথ্য বেড়ে যাবার যে প্রবণতা দেখা গিয়েছিল, তাতে নতুন মাত্রা যোগ হয় নভেম্বরে। গত ৫ নভেম্বর চট্টগ্রামে ইসকন-বিরোধী ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে সংঘর্ষে সেনাবাহিনীর ৫ ও পুলিশের ৭ সদস্য আহত হন। পরবর্তীতে গ্রেপ্তার করা হয় সংঘর্ষে জড়িত ৪৯ জনকে। এরপর ২৬ নভেম্বর একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট’-এর মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে। চট্টগ্রামের আদালতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন নামঞ্জুর হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় তার অনুসারীরা। এসময় আদালত প্রাঙ্গনে খুন হন আইনজীবী সাইফুল আলম। পরবর্তীতে ভুলভাবে দাবি করা হয় যে, সাইফুল আলম চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী ছিলেন। 

নভেম্বরে এসব ঘটনা ঘিরে ছড়াতে দেখা গেছে নানা ভুল তথ্য। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বিভিন্ন ভুয়া উদ্ধৃতি প্রচারিত হয়েছে গণমাধ্যমের ফটোকার্ড নকল করে। তিনি আগে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ বা ইসকনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ইসকনকে নিয়েও ছড়িয়েছে কিছু ভুয়া তথ্য। যেমন কোথাও বলা হয়েছে সিলেটের ইসকন মন্দির থেকে অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে, বা বাংলাদেশের একটি সুপারশপ ও একটি অন্যতম আন্তঃজেলা পরিবহন সংস্থা, শ্যামলী পরিবহন ইসকনকে অর্থপ্রদান করেছে। বাংলাদেশের একটি সংবাদমাধ্যম ইসকনকে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে বা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল, বিএনপি ইসকনকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে– এমন ভুয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তিও প্রচারিত হতে দেখা গেছে। এসব ঘটনার প্রভাবে ডিসেম্বর মাসে ধর্ম বিষয়ে প্রকাশিত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনের সংখ্যা বাড়তে দেখা গেছে উল্লেখযোগ্য হারে। এই মাসে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট ফ্যাক্টচেকিং সংস্থাগুলো যত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, তার ২৯ শতাংশই ছিল ধর্ম সংশ্লিষ্ট।

গত বছর এপ্রিলেও ধর্ম সংক্রান্ত অপতথ্য বেড়েছিল। এই মাসে ভারতে লোকসভা নির্বাচন শুরু হয় এবং ভারত ও বাংলাদেশে ধর্মীয় বিদ্বেষ ও নিপীড়নের পাল্টাপাল্টি ভুল অভিযোগ সামাজিক মাধ্যমে ছড়াতে থাকে। এপ্রিল ছিল রমজান ও ঈদুল ফিতরের মাস, তাই সেসময় ধর্মের অলৌকিকতা, ধর্মীয় ইতিহাস ও ঈদের দিনক্ষণ নিয়েও ভুল তথ্য ছড়ায়।

রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিচারে তুলনামূলক নিস্তেজ মাস ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও জুনে সার্বিকভাবে ভুল তথ্যের পরিমাণ কম ছিল। আর এই সময়ে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়ায় খেলাধুলা নিয়ে। এর সঙ্গেও রয়েছে ঘটনা ও ঘটনাপ্রবাহ। ফেব্রুয়ারিতে মোট যাচাই প্রতিবেদনের ১৬ শতাংশই ছিল খেলাধুলা নিয়ে যা মার্চে আরো বেড়ে ২৫ শতাংশে দাঁড়ায়। এসময় ভুল তথ্যের মূল বিষয়বস্তু ছিল ক্রিকেট ও ক্রিকেট তারকারা। জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে শুরু হয়ে গোটা ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ চলেছে। মার্চ থেকে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ বা আইপিএল। কোন খেলোয়াড় কোন দলে খেলছেন, কে কাকে নিয়ে কি বললেন – এসব নিয়ে অনেক ভুল তথ্য প্রচারিত হয়েছে এই দুই মাসে। এমনকি এই সময় খেলোয়াড়দের ছবি ও ভুল বক্তব্য ব্যবহার করে জুয়ার প্রচারণাও চলতে দেখা যায়। একইভাবে জুনে খেলা বিষয়ক ভুল তথ্য বেশি ছিল। কারণ, এই সময় অনুষ্ঠিত হয়েছিল ক্রিকেটের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। 

আগস্টে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংক্রান্ত ভুল তথ্য অন্যান্য মাসের তুলনায় তিন থেকে চারগুণ বেড়ে যায়, কারণ এই মাসের শেষে বাংলাদেশে বন্যা দেখা দেয়। এসময় ভারত, পাকিস্তান বা মেক্সিকোর বন্যার দৃশ্যকে প্রচার করা হয়েছে বাংলাদেশের বলে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি বেশ কয়েকটি ছবিও (, ) প্রচারিত হয়েছে বাংলাদেশের বন্যার দৃশ্য দাবিতে।

ভুল তথ্যের লাইমলাইটে যেসব ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও দেশ

বছরজুড়ে কাদের ঘিরে বেশি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে– তা বিশ্লেষণের জন্য ২০২৪ সালে প্রকাশিত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনগুলোর শিরোনামে কোন ব্যক্তিদের নাম সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে– তা পর্যালোচনা করেছে ডিসমিসল্যাব। দেখা গেছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম এসেছে সবচেয়ে বেশিবার। এরপরই আছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ভুল তথ্যে এসব ব্যক্তিদের উপস্থাপন ছিল কখনো ইতিবাচক, কখনো নেতিবাচক। শেখ হাসিনা গোটা বছরই মিথ্যাতথ্যের বিষয়বস্তু ছিলেন, আর ড. ইউনূসকে নিয়ে অপপ্রচার শুরু হয় মূলত আগস্টে, তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পরে। (বিস্তারিত এই বিশ্লেষণে)

These are the most talked-about people in false information, reveals yearly misinformation trend and narrative analysis report by Dismislab

তাদের পরে, ভুল তথ্যের সবচেয়ে বড় মুখ ছিলেন বাংলাদেশের দুই তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবাল। বিভিন্ন সময় তাদের নামে নানা ভুয়া উদ্ধৃতি যেমন ছড়িয়েছে, তেমনি তাদের ছবি-ভিডিও সম্পাদনা করে প্রচার করা হয়েছে জুয়ার বিজ্ঞাপনও। সাকিব-তামিমের বিরোধ এই মিথ্যার পালে বড় হাওয়া দিয়েছে। তবে সাকিব আল হাসানের পেশাগত, ব্যক্তিগত ও অর্থনৈতিক – সব বিষয়ই মিথ্যা তথ্যের বিষয়বস্তু হয়েছে। 

৫ আগস্ট বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আলোচনায় এসেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা। উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করা তিন ছাত্রনেতা আসিফ মাহমুদ, নাহিদ ইসলাম ও মাহফুজ আলমকে কেন্দ্র করে ছড়িয়েছে বিভিন্ন অপতথ্য। কোথাও তাদের নামে ভুয়া উদ্ধৃতি (, , ) প্রচার করা হয়েছে, কোথাও আবার তাদের ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের (, , ) সদস্য হিসেবেও প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে। ভুল তথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে আরও দুই আলোচিত ব্যক্তি ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ (, , )। সারজিসের নামে খোলা একটি ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ছড়ানো ভুল তথ্য জায়গা করে নিয়েছিল সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনেও

ভুল তথ্যে আলোচিত যেসব দেশ

দেশের হিসেবে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনের শিরোনামে সবচেয়ে বেশিবার এসেছে ভারতের নাম। ভারত প্রসঙ্গে ছড়ানো ভুল তথ্যের বিষয়বস্তু ছিল বহুমাত্রিক। তবে বছরের সবচেয়ে আলোচিত বা সমালোচিত (, , ) বিষয় ছিল ৫ আগস্ট, বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের অপপ্রচার। কখনো সংখ্যালঘু নির্যাতন ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত নিয়ে ভুল ও অতিরঞ্জিত তথ্য (, , , ), কখনো বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে দেখানোর চেষ্টা – এসময় উত্তেজনা ও বিভাজন ছড়িয়েছে।

৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর সেখানে তার অবস্থানকে কেন্দ্র করেও বিভিন্ন ভুল তথ্য (, , , ) ছড়িয়েছে। কখনো দাবি করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীতে ভারতীয়রা (, ) চাকরি করেন বা বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ভারতীয় নাগরিক। জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ভুলভাবে দাবি করা হয়েছিল যে, বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রবেশ করছে বা ভারতের বিমান বাংলাদেশের বিমানঘাঁটিতে অবস্থান করছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশ ছাড়ছে– এমন দাবিতেও ছড়িয়েছে ভুল তথ্য। এসব অপতথ্য সীমানার এপারে ও ওপারে অবিশ্বাস বাড়িয়েছে।

These are the most talked-about countries in false information, reveals yearly misinformation trend and narrative analysis report by Dismislab

তবে ভারত, আরও নানা কারণে শিরোনামে ছিল। যেমন: দেশটিতে যখন জাতীয় নির্বাচন হয়েছে, তখন সীমানা পেরিয়ে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক ভুল তথ্য প্রতিবেশী বাংলাদেশেও ছড়িয়েছে। অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ নিয়ে উত্তেজনা, এপারেও ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের জন্ম দিয়েছে। এছাড়াও পুরো বছরজুড়ে খেলাধুলা (, , , ) ও বন্যাসহ নানা কারণে যাচাই প্রতিবেদনের শিরোনামে বারবার ভারতের নাম এসেছে। প্রায়ই দেখা গেছে বাংলাদেশের ছবি-ভিডিওকে ভারতের (, , ) দাবি করে বা ভারতের ছবি-ভিডিওকে বাংলাদেশের (, , ) দাবি করে ভুল তথ্য প্রচারিত হয়েছে। আগস্টে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে বন্যার সময় ভারতের বাঁধের দৃশ্য দাবিতে (, , ) নানা ভুল তথ্য ছড়িয়েছে।

দেশ হিসেবে এরপরেই অপতথ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইরান ও ফিলিস্তিন। এসব ভুল তথ্যের অধিকাংশেরই বিষয় ছিল ইসরায়েল-ইরান বা ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে সংঘাত দ্বন্দ্ব। যেমন, প্রতি মাসে গড়ে ২ থেকে ৩ শতাংশ ফ্যাক্টচেক হয়ে থাকে আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী নিয়ে। কিন্তু এপ্রিলে এটি দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে ৮ শতাংশে দাঁড়ায়। কারণ? এই এপ্রিলে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে পাল্টাপল্টি বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। একইভাবে অক্টোবরে দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি মিসাইল হামলার কারণে আন্তর্জাতিক বিষয় সংক্রান্ত ভুল তথ্য বেড়ে যায়। এসময় মূল ভাষ্যগুলো ছিল মূলত ইরানের হামলায় ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতি, এআই দিয়ে তৈরি ইরানী হামলার বানোয়াট ছবি, এমনকি ড. ইউনূসকে ইসরায়েলের বন্ধু প্রমাণ করতে তার বিরোধীরা প্রচার করে যে তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু। উল্লেখ্য, ধর্মীয় আবেগের কারণে ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে ফিলিস্তিন ও ইরানের মতো দেশের প্রতি বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহাসিকভাবেই সহানুভূতিশীল।

বছরজুড়ে অপতথ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নাম এসেছে নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও দেশের রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা নিয়ে। ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে যেসব ভুল তথ্য ছড়িয়েছে– তার একটি বড় অংশজুড়ে ছিল বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের বৈধতা বা ভিসা নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত। ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ার পর বিরোধীদের পক্ষ থেকে ভুলভাবে প্রচার করা হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের ফলাফল বাতিল বা প্রত্যাখ্যান করেছে, অথবা নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ায় বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ভিসা নিষেধাজ্ঞা (, , , , ) দিয়েছে। ৫ আগস্ট, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় এসেছিল সেন্টমার্টিন দ্বীপ ঘিরে। এসময় এমন দাবি ছড়াতে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ হস্তান্তর করেছে বা যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা দ্বীপটির দখল নিয়েছে। এই ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচারের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ এবং তাদের মিত্র রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিভিন্ন মন্তব্য, যেখানে তাঁরা বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের হাতে সেন্টমার্টিন দ্বীপ তুলে দিলে ক্ষমতা পাকাপোক্ত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টমার্টিন দ্বীপ দখল সংক্রান্ত ভুল তথ্যের মাধ্যমে বলতে চাওয়া হয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যুক্তরাষ্ট্রের হাতে এই দ্বীপ তুলে দিয়েই ক্ষমতায় এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মতো পাকিস্তানকে নিয়েও প্রচারিত হয়েছে নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। আগস্টের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার হওয়ার প্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের পর প্রথমবারের মতো সরাসরি পাকিস্তান থেকে পণ্যবাহী জাহাজ আসে বাংলাদেশের বন্দরে। এসময় এমন ভুল তথ্য ছড়িয়েছিল যে, সেই জাহাজে অস্ত্র এসেছে বা সেই জাহাজ তল্লাসি করতে চাওয়ায় দুই কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। কোথাও আবার দাবি করা হয়েছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ দিতে এসেছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাংলাদেশে টহল দিচ্ছে– এমন ভুল দাবি প্রচারিত হতে দেখা গেছে ভারতীয় গণমাধ্যমেও। 

আলোচনার শীর্ষে ছিল যেসব সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান

২০২৪ সালে যেসব প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনকে ঘিরে বেশি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে তার শীর্ষে ছিল আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন। জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছড়িয়েছে এসব ভুল তথ্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। এসময় আন্দোলনকারীদের হামলায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন (, , , ) বলে ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছিল। আন্দোলনকারীদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালানো ছাত্রলীগ বা যুবলীগের নেতাকর্মীকে ছাত্রশিবিরের কর্মী দাবি (, , ) করেও ছড়ানো হয়েছিল ভুল তথ্য। 

৫ আগস্ট, বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের পুরোনো মিছিল-সমাবেশের ছবি-ভিডিওকে (, , , , , ) প্রচার করা হয়েছিল সাম্প্রতিক দাবিতে। আগস্টে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে বন্যার সময় অন্য সংগঠনের বন্যার্তদের সহায়তার ছবি-ভিডিওকে আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের সহায়তা দাবিতেও প্রচারিত হতে দেখা গেছে। অক্টোবরে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার পর এ প্রসঙ্গেও ছড়াতে দেখা গেছে বেশ কিছু ভুল তথ্য, যেগুলোর কোথাও বলা হয়েছে, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার পর মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে, কোথাও আবার বলা হয়েছে হাইকোর্ট এই নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে। আবার নিষিদ্ধ হওয়ার প্রেক্ষিতে নেতাকর্মীদের করণীয় দাবিতে ছাত্রলীগের নামে ছড়ানো হয়েছে ভুয়া বিজ্ঞপ্তি। 

most talked-about organizations in false information, reveals yearly misinformation trend and narrative analysis report by Dismislab

আওয়ামী লীগের পর বেশি আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশের সশস্ত্র ও পুলিশ বাহিনী। জানুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে ছড়ানো কিছু ভুল তথ্যে দাবি করা হয়েছিল যে, সেনাবাহিনীর অধীনে নির্বাচন হবে বা সেনাবাহিনী প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেছে। কোথাও আবার বলা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তবে সশস্ত্র বাহিনী বেশি আলোচনায় এসেছে আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর। এসময় দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ শুরু করে সেনাবাহিনী। এর পরপরই একটি ভুয়া তথ্য ছড়ায়, যেখানে বলা হয় সেনাবাহিনী কিছু নিত্যপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। ১০ আগস্ট, গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সংঘর্ষকে ঘিরেও ছড়িয়েছে ভুল তথ্য। কোথাও বলা হয়েছে সেনাবাহিনীর হামলায় ৬০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছে, কোথাও আবার বলা হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পেটানোর পর সেনাবাহিনীর সদস্যরা উল্লাস করছেন। 

সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার দ্বন্দ্ব চলছে– এমন দাবিতে বেশ কিছু ভুয়া তথ্য ছড়াতে দেখা গিয়েছিল অক্টোবরে। বলা হয়েছিল, সেনাসদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ঘিরে রেখেছে বা সেনাপ্রধানের সঙ্গে বিরোধের জেরে প্রধান উপদেষ্টা দেশ ছেড়েছেন। বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সঙ্গে (, , ) সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ দাবিতেও ছড়িয়েছে ভুল তথ্য। সেনাবাহিনীর চাপে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পদত্যাগ () করেছেন বা সেনাবাহিনী বিভিন্ন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার (, ,) করেছে– এমন দাবিতেও ছড়িয়েছে ভুল তথ্য। 

বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীকে নিয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়াতে দেখা গেছে জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও তার জেরে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন পরবর্তী সময়ে। এসময় পুলিশের হামলায় আন্দোলনকারী নিহতের (, ) ভুল তথ্য যেমন ছড়িয়েছে তেমনি পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার (, ) ভুল তথ্যও ছড়িয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ৪৪ জন পুলিশ সদস্য মারা গিয়েছিলেন বলে জানানো হয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রকাশিত এক তালিকার মাধ্যমে। কিন্তু এই সংখ্যা হাজারেরও বেশি (, ) বলে প্রচারিত হয়েছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে ৫০০ পুলিশ সদস্য হত্যার অভিযোগে মামলা করেছেন বলেও ছড়িয়েছিল ভুল তথ্য।

ভুল তথ্য ছড়ানো সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল অন্যতম। এক্ষেত্রেও বেশি ভুল তথ্য প্রচারিত হতে দেখা গেছে জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের সময়। মিছিল-সমাবেশ, আন্দোলনের পুরোনো বা অন্য জায়গার ছবি-ভিডিওকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক দৃশ্য দাবিতে (, , ) প্রচারিত হয়েছে। সেপ্টেম্বরে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন, ছাত্রশিবির প্রসঙ্গেও আলোচনায় এসেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আওয়ামী লীগ সরকার গত ১ আগস্ট নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল জামায়াতে ইসলামীকে। তবে ২৮ আগস্ট এই নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত বাতিল করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে আসতে দেখা যায় ছাত্রশিবিরের কর্মীদের। এসময় ভুয়া উদ্ধৃতি ছড়াতে দেখা যায় ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নামে।

বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-কে নিয়েও বছরজুড়ে ছড়িয়েছে বিভিন্ন ভুল তথ্য। ৭ জানুয়ারি, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের কয়েক মাসে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে। নির্বাচনের পরপরই তারা জামিনে মুক্তি পেয়েছেন– এমন দাবিতে (, , ) ছড়িয়েছিল ভুল তথ্য। ৫ আগস্ট, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপিকে নিয়ে যত ভুল তথ্য ছড়িয়েছে, তার সিংহভাগই ছিল দলটির নাম ব্যবহার করে ছড়ানো বিভিন্ন ভুয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তি। এ ধরনের প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কোথাও কোনো নেতা-কর্মীকে বহিস্কার (, ) বা শোকজের কথা বলা হয়েছিল, কোথাও আবার কোনো কমিটি বিলুপ্তি ঘোষণা (, , , ) বা নতুন কমিটি (, ) গঠনের ভুল দাবি করা হয়েছিল। আর এসব মূলত ছড়িয়েছিলেন, তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা।

গবেষণা পদ্ধতি

২০২৪ সালে ভুল তথ্যের প্রবণতা ও ভাষ্য বিশ্লেষণের জন্য বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট ৮টি ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন। সাইটগুলো হলো: রিউমর স্ক্যানার, বুমবিডি, নিউজচেকার, ফ্যাক্ট ক্রেসেন্ডো, ফ্যাক্ট ওয়াচ, এএফপি বাংলাদেশ, আজকের পত্রিকা এবং ডিসমিসল্যাব। বিষয়বস্তু অনুযায়ী প্রতিবেদনগুলোকে ভাগ করা হয়েছে ১৭টি বিভাগে। রাজনীতি, খেলাধুলা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ, ধর্ম, প্রকৃতি ও পরিবেশ, বিনোদন, প্রতারণা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, আইনশৃঙ্খলা, শিক্ষা, অর্থনীতি ও উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা, জননীতি, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী, অভিবাসন ও অন্যান্য।

২০২৪ সালে আটটি ওয়েবসাইটে মোট ৪৬৯৯টি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তবে একই ভুল তথ্য নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে একাধিক সাইটে। ফলে বিষয়-ভিত্তিক স্বতন্ত্র বা ইউনিক ভুল তথ্যের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য একই ভুল তথ্য নিয়ে একাধিক ওয়েবসাইটে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে শুধু একটি সাইটের প্রতিবেদনকে বিবেচনা করা হয়েছে স্বতন্ত্র বা ইউনিক হিসেবে। এভাবে ২০২৪ সালে স্বতন্ত্র বিষয়ে প্রকাশিত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন পাওয়া গেছে ৩১৬৭টি। 

ভুল তথ্যে কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা দেশের নাম বেশি এসেছে— তা দেখার জন্য ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনের শিরোনামগুলোর কিওয়ার্ড বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে কোন শব্দগুলো সবচেয়ে বেশিবার এসেছে। এর ভিত্তিতে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও দেশ আলাদা করা হয়েছে।

আরো কিছু লেখা