পার্থ প্রতীম দাস
ধর্মীয় অপতথ্য যেভাবে হয়ে উঠেছে সহিংস, বাংলাদেশ-কেন্দ্রিক এবং বিভাজন সৃষ্টিকারী
পার্থ প্রতীম দাস
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রভাবে বাড়তে দেখা গেছে ধর্মীয় অপতথ্য ছড়ানোর প্রবণতা। পরিবর্তন এসেছে এসব অপতথ্যের ধরনেও। এবছরের প্রথম সাত মাসে যেখানে অলৌকিকতা, ধর্মান্তর বা ধর্মীয় মহিমা প্রচার সংক্রান্ত বিভিন্ন ভুল দাবি বেশি দেখা গেছে, সেখানে আগস্টের পর থেকে ক্রমে বেড়েছে সাম্প্রদায়িক সংঘাত বা ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অপতথ্য। এই সময়ে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সংশ্লিষ্ট ভুল তথ্যের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ এবং বছরের প্রথম সাত মাসের তুলনায় ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অপতথ্য বেড়েছে দ্বিগুণ।
শুধু বিষয়বস্তুর ধরনে নয়, পরিবর্তন দেখা গেছে ভৌগলিক অবস্থার বিবেচনায়ও। আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত, ধর্ম বিষয়ে ফ্যাক্টচেক হওয়া ভুল তথ্যের ৯২% ছিল বাংলাদেশ-কেন্দ্রিক, যেখানে এবছরের প্রথম তিন মাসে আন্তর্জাতিক বা স্থান নিরপেক্ষ ধর্মীয় অপতথ্যের পরিমাণই বেশি দেখা গিয়েছিল। এই পরিবর্তনগুলো তুলে ধরে কীভাবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় ভুল তথ্যের ধরন বদলেছে, যেগুলো সামাজিক বিভাজন তৈরি করছে এবং বিরোধ উসকে দিচ্ছে।
এবছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট আটটি ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ধর্ম বিষয়ক ভুল তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এমন চিত্র। এই সময় আটটি ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা ধর্ম বিষয়ে প্রকাশ করেছে ৩১৩টি স্বতন্ত্র ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন। একই বিষয়ে একাধিক সাইটে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে একটিকে শুধু বিবেচনা করা হয়েছে স্বতন্ত্র হিসেবে। দেখা যায়, এই ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনগুলোর ৫১ শতাংশই প্রকাশিত হয়েছে শেষ চার মাসে, আগস্ট থেকে নভেম্বরে।
এই সময়ে ধর্মীয় ভুল তথ্যের ধরনে দুইটি প্রধান বিষয় লক্ষ্য করা যায়: বাংলাদেশকে উপস্থাপন করা হয়েছে উগ্র ইসলামপন্থী রাষ্ট্র হিসেবে, যেখানে সংখ্যালঘুরা অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। এই ধরনের ভাষ্য প্রচারিত হয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের দিক থেকে। এবং এর পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায় ও সংগঠনের বিরুদ্ধে, যা নভেম্বর মাসে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে।
ধর্মীয় অপতথ্যের ধরনে পরিবর্তন
বাংলাদেশে যেসব ভুল তথ্য ছড়াতে দেখা যায়– তার একটি অন্যতম বিষয় ধর্ম। ডিসমিসল্যাবের এবছরের তৃতীয় প্রান্তিকের প্রবণতা বিশ্লেষণে ধর্মীয় ভুল তথ্যের পরিমাণ বাড়তে দেখা গিয়েছিল। তবে ১১ মাসের ডেটা বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় ধর্ম বিষয়ে ৩১৩টি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনের ৫১ শতাংশই প্রকাশিত হয়েছে গত চার মাসে। আগস্ট থেকে নভেম্বরের মধ্যে।
ধর্মীয় অপতথ্যের ভাষ্যে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে– তা বিশ্লেষণের জন্য ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনগুলোকে ৯টি বিভাগে ভাগ করেছে ডিসমিসল্যাব। অলৌকিকতা, ধর্মীয় মহিমা প্রচার, ধর্মান্তর, ধর্মীয় বিধান, ধর্মীয় সম্প্রীতি, ধর্ম অবজ্ঞা, ধর্মীয় বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও অন্যান্য। এবং এসব অপতথ্যকে ভাগ করা হয়েছে দুইটি সময়পর্বে: প্রাক-গণঅভ্যুত্থানের সময় (জানুয়ারি-জুলাই) এবং গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময় (আগস্ট-নভেম্বর)।
দেখা যায় এবছরের প্রথম সাত মাসে, জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশে যেসব ধর্মীয় অপতথ্য ছড়িয়েছে তার অর্ধেকই ছিল ধর্মীয় মহিমা প্রচার (৩৩%), ধর্মান্তর (৯%), অলৌকিকতা (৬%), সংক্রান্ত বিষয়। যেমন, কাবা শরীফের ছাদে ফেরেশতা দেখা গেছে, আকাশে আল্লাহর নাম ভেসে উঠেছে, বিখ্যাত কোনো ব্যক্তি হিন্দু বা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন ইত্যাদি। ধর্মীয় বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত সংক্রান্ত অপতথ্যের পরিমাণ ছিল ১০%-এর কম।
কিন্তু আগস্টে, ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ধর্মীয় অপতথ্যের ধরন বদলেছে। দেখা যায়, ধর্মীয় মহিমা, ধর্মান্তর বা অলৌকিকতা বিষয়ক ভুল তথ্য নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনের পরিমাণ কমেছে। এবং এই জায়গা দখল করেছে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অপতথ্য। এই সময়পর্বে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অপতথ্যের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩% ও ২১%-এ। সহজ ভাষায়, এবছরের প্রথম সাত মাসের তুলনায় শেষ চার মাসে সাম্প্রদায়িক সংঘাতমূলক অপতথ্যের পরিমাণ বেড়েছে পাঁচগুন। এবং ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অপতথ্যের পরিমাণ বেড়েছে দুইগুন।
যেভাবে ক্রমেই সহিংস হয়েছে ধর্মীয় অপতথ্যের ভাষ্য
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ধর্মীয় ভুল তথ্যের ধরনে দুইটি প্রধান বিষয় লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত, বাংলাদেশকে উপস্থাপন করা হয়েছে উগ্র ইসলামপন্থী রাষ্ট্র হিসেবে, যেখানে সংখ্যালঘুরা অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। এই ধরনের ভাষ্য প্রধানত প্রচারিত হয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের দিক থেকে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া পেজ-প্রোফাইল থেকে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায় ও সংগঠনের বিরুদ্ধে। এই দুই ধরনের ভাষ্য একসঙ্গে মিলে সামাজিক বিভাজন ও উত্তেজনা বাড়িয়েছে।
আগস্টে ভারতীয় কিছু সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের দিক থেকে এমন অনেক ভুয়া দাবি করা হয়েছে যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন বেড়েছে, ইসলামী চরমপন্থার উত্থান হয়েছে। কোথাও এমন দাবি করা হয়েছে পুরোনো বা অপ্রাসঙ্গিক ছবি-ভিডিও দিয়ে, কোথাও মুসলিম ব্যক্তি বা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার দৃশ্যকে উপস্থাপন করা হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হিসেবে। কোথাও আবার দাবি করা হয়েছে, তিন মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাতে ২৭ হাজার হিন্দু নিহত হয়েছে।
বাংলাদেশের ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা রিউমর স্ক্যানার ৫-১৩ আগস্ট পর্যন্ত ছড়ানো এ ধরনের অপতথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছিল, যে ৫০টি এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে এসব অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে, তাদের ৭২ শতাংশই থাকেন ভারতে। এছাড়াও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়া তিন ছাত্রনেতা আগে নিষিদ্ধ ঘোষিত বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সদস্য ছিলেন– এমন মিথ্যা দাবিও (১, ২) উঠতে দেখা গেছে। যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে ইসলামী মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে উপস্থাপনের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়।
আগস্ট থেকে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের এসব মিথ্যা দাবি বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অপতথ্য। কোথাও বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হিন্দুদের দেশ ছাড়ার আল্টিমেটাম দিয়েছেন বা গণহত্যার আহ্বান জানিয়েছেন, কোথাও আবার দাবি করা হয়েছে যে, ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে মিছিল করে হিন্দুদের জবাই করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীতে যোগ না দিলে অপহরণের শিকার হতে হবে, বন্যার ত্রানের বিনিময়ে হিন্দু শিশুর গলা থেকে তাবিজ খুলে নেওয়া হচ্ছে– এ ধরনের অপতথ্য ছড়াতে দেখা গেছে।
অক্টোবরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বড় উৎসব দুর্গাপূজা কেন্দ্র করে আরও বেড়েছে এ ধরনের ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অপতথ্য। কোথাও দাবি করা হয়েছে পূজামণ্ডপে ইসলামি বাণী প্রচার করা হচ্ছে বা মোনাজাত করা হচ্ছে, আবার কোথাও বলা হয়েছে মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা পূজামণ্ডপে গিয়ে গোলমাল করেছেন।
নভেম্বরে এ ধরনের অপতথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে চট্টগ্রামে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আন্তর্জাতিক সংগঠন, ইসকন-বিরোধী একটি ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে সংঘর্ষ এবং ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট’ নামের নতুন একটি সংগঠনের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার সংক্রান্ত ঘটনাবলী। গত ৫ নভেম্বর চট্টগ্রামে ইসকন-বিরোধী ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে সংঘর্ষে সেনাবাহিনীর ৫ সদস্যসহ পুলিশের ১২ সদস্য আহত হন। পরবর্তীতে গ্রেপ্তার করা হয় ফেসবুক পোস্ট দেওয়া সেই ব্যক্তি এবং সংঘর্ষে জড়িত ৪৯ জনকে। ২৬ নভেম্বর একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট’-এর মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে। চট্টগ্রামের আদালতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন নামঞ্জুর করা হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় তার অনুসারীরা।
এসময় এই ঘটনা ঘিরে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক নানা অপতথ্য ছড়াতে দেখা গেছে। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বিভিন্ন ভুয়া উদ্ধৃতি প্রচারিত হয়েছে গণমাধ্যমের ফটোকার্ড নকল করে। তিনি আগে ইসকনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ইসকনকে নিয়েও ছড়িয়েছে কিছু ভুয়া তথ্য। যেমন কোথাও বলা হয়েছে সিলেটের ইসকন মন্দির থেকে অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে, বা বাংলাদেশের একটি সুপারশপ ও একটি অন্যতম আন্তঃজেলা পরিবহন সংস্থা,শ্যামলী পরিবহন ইসকনকে অর্থপ্রদান করেছে। বাংলাদেশের একটি সংবাদমাধ্যম ইসকনকে জঙ্গী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে বা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ইসকনকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে– এমন ভুয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তিও প্রচারিত হতে দেখা গেছে।
বিপরীতে, কিছু ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচারিত ভুল তথ্য এ ঘটনাগুলো নিয়ে আরও বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। যেমন, ভুলভাবে দাবি করা হয়েছে যে, চিন্ময় দাসের আইনজীবীকে হত্যা করা হয়েছে।
বেড়েছে বাংলাদেশ-কেন্দ্রিক অপতথ্য
ধর্মীয় অপতথ্যের ভাষ্যের পাশাপাশি ভৌগলিক অবস্থানের বিবেচনায়ও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এবছরের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) যেসব ধর্মীয় অপতথ্য ছড়িয়েছে– সেখানে আন্তর্জাতিক বা স্থান নিরপেক্ষ বিষয়ের আধিক্য ছিল। কিন্তু বছরের শেষনাগাদ প্রায় সব ধর্মীয় অপতথ্যই ছড়িয়েছে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে।
জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত, বেশিরভাগ ধর্মীয় অপতথ্য ছিল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে। যেমন, জানুয়ারিতে ভারতে রাম মন্দির উদ্বোধনের সময় এ সংক্রান্ত বেশ কিছু অপতথ্য (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬) ছড়িয়েছে। এছাড়াও বছরের শুরুর এই চার মাসে সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কা বা ভারতে আযান দেওয়া, নামাজ পড়া বা রোজা রাখা বিষয়ে বিভিন্ন অপতথ্য (১, ২, ৩, ৪) ছড়াতে দেখা গেছে। সৌদি আরবের আকাশে আল্লাহর নাম ভেসে উঠেছে, কাবা শরীফের ছাদে ফেরেশতা দেখা গেছে– এ ধরনের অলৌকিক দাবি সম্বলিত ভুল তথ্য ছড়ানোর একটি সাধারণ প্রবণতাও লক্ষ্য করা গেছে এই সময়পর্বে।
মে, জুন মাসে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বেশি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও তাদের মধ্যে পার্থক্য খুব বেশি ছিল না। জুলাই মাসে আবার বেশি দেখা যায় আন্তর্জাতিক বা স্থান নিরপেক্ষ বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন। তবে আগস্ট মাস থেকে এই চিত্র পুরোপুরি বদলে যায়। আগস্ট থেকে নভেম্বর, এই চার মাসে ধর্ম বিষয়ে প্রকাশিত অধিকাংশ ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনই ছিল বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট। এসময় বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনের পরিমান ছিল ৯২ শতাংশের বেশি।
গবেষণা পদ্ধতি
এই বিশ্লেষণের জন্য বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট ৮টি ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ধর্ম বিষয়ক ভুল তথ্য নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন। একই বিষয়ে একাধিক সাইটে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে একটিকে শুধু বিবেচনা করা হয়েছে স্বতন্ত্র হিসেবে।
ধর্মীয় অপতথ্যের ধরন ভাগ করা হয়েছে নিম্নোক্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী:
অলৌকিকতা: ঐশ্বরিক শক্তির উপস্থিতি বা ব্যাখ্যাতীত কোনো ঘটনাকে বিবেচনা করা হয়েছে অলৌকিকতা হিসেবে। যেমন, ভেসে থাকা পাথর বা জ্বীন, ফেরেশতার উপস্থিতি।
ধর্মবিশ্বাসকে অবজ্ঞা: কোনো ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা, কটুক্তি, বিদ্রুপ, ধর্মীয় আচার পালনে নিষেধাজ্ঞাকে বিবেচনা করা হয়েছে ধর্ম অবজ্ঞা হিসেবে। যেমন, দেবতার মূর্তির ছবি দিয়ে জুতা তৈরি, কোনো ধর্মকে ভুয়া দাবি করা, নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বী মানুষকে মানসিকভাবে অসুস্থ ও উন্মাদ দাবি করা।
ধর্মান্তর: এক ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়কে ধর্মান্তর বিবেচনা করা হয়েছে। যেমন, ক্রিকেটার মাহমুদুল হাসান বা ডেভিড মিলার হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেছেন।
ধর্মীয় বিধান: ধর্মীয় রীতি-নীতি, আইন-কানুন, পরামর্শ সংক্রান্ত মিথ্যা দাবিকে বিবেচনা করা হয়েছে ধর্মীয় বিধান ক্যাটিগরিতে। যেমন, বোরকা-হিজাব বাধ্যতামূলক করা, পর্দা করা বা দাড়ি রাখার পরামর্শ।
ধর্মীয় বিদ্বেষ: কোনো ধর্ম বা ধর্মাবলম্বী মানুষের প্রতি ঘৃণা বা ভীতি ছড়ায়– এমন আধেয়কে ধর্মীয় বিদ্বেষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। যেমন, হিন্দুদের গণহত্যা, দেশত্যাগ বা মুসলিম নারীদের ধর্ষণের আহ্বান জানানো হয়েছে।
ধর্মীয় মহিমা: ধর্মের মহিমা প্রচার করে বা ইতিবাচকভাবে তুলে ধরে– এমন আধেয়কে ধর্মীয় মহিমা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। যেমন, মন্দির বা মসজিদের সৌন্দর্য্য বা লোকসমাগম, ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ইতিবাচক উদ্যোগ ইত্যাদি।
ধর্মীয় সম্প্রীতি: অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক, সহযোগিতা বা শান্তি বজায় রাখা সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে বিবেচনা করা হয়েছে ধর্মীয় সম্প্রীতি হিসেবে।
সাম্প্রদায়িক সংঘাত: ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, নির্যাতনের ঘটনাকে বিবেচনা করা হয়েছে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হিসেবে।
অপতথ্যের সঙ্গে ভৌগলিক সম্পৃক্ততার বিচারে এগুলোকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে।
স্থানীয়: যেসব অপতথ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টতা আছে– সেগুলোকে ধরা হয়েছে স্থানীয় বিষয় হিসেবে। বিদেশের কোনো ঘটনাতেও যদি বাংলাদেশের বা বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের সংশ্লিষ্টতা থাকে, তাহলে সেটিও বিবেচনা করা হয়েছে স্থানীয় বিষয় হিসেবে। যেমন, কিরগিজস্তানে হিন্দু শিক্ষার্থীদের হামলায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থী মৃত্যুর দাবিকে ধরা হয়েছে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট বিষয় হিসেবে।
আন্তর্জাতিক: বাংলাদেশের সঙ্গে কোনোই সংশ্লিষ্টতা নেই– এমন অপতথ্যকে ধরা হয়েছে আন্তর্জাতিক হিসেবে। যেমন ইসরায়েলের এক নারী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন, বা সৌদি আরবে কাবা শরিফ পরিচালনার জন্য ৪২ আলেমকে বাছাই করা হয়েছে– এমন দাবি।
স্থান নিরপেক্ষ: বিশ্বের যেকোনো জায়গার জন্যই প্রযোজ্য– এ ধরনের অপতথ্যগুলোকে বিবেচনা করা হয়েছে স্থান-নিরপেক্ষ হিসেবে। যেমন, ২০৩০ সালে তিনটি ঈদ অনুষ্ঠিত হবে বা নাসার বিজ্ঞানীরা চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন।
ডেটা সংগ্রহ ও পর্যালোচনার সময় কিছু ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন বাদ পড়তে পারে। একটি প্রতিবেদনে একাধিক ভুল তথ্য ফ্যাক্টচেক করা হলেও সেগুলো ডেটায় পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়নি। এছাড়াও এখানে শুধু সেসব ভুল তথ্যকেই বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, যেগুলো নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ফলে ধর্মীয় ভুল তথ্যের সত্যিকারের সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।