পার্থ প্রতীম দাস
মিনহাজ আমান
বাংলাদেশের সরকারি ওয়েবসাইটে হাজার হাজার বেটিং পেজ
পার্থ প্রতীম দাস
মিনহাজ আমান
অজ্ঞাতসারেই অনলাইন বেটিং প্ল্যাটফর্মের প্রচারণা মাধ্যমে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট। ডিসমিসল্যাবের সাম্প্রতিক গবেষণায় ১১টি সরকারি ওয়েবসাইটে ৩ হাজারের বেশি বেটিং ওয়েবপেজের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেখানে সক্রিয়ভাবে চারটি বেটিং প্রতিষ্ঠানের প্রচার চালানো হয়েছে।
‘গভ ডট-বিডি’ ডোমেইনগুলোতে ‘ক্যাসিনো’ ও ‘বেটিং’-এর মতো কীওয়ার্ড ব্যবহার করে প্রাথমিক গুগল সার্চের পাশাপাশি ওয়েবসাইটগুলোর সাইটম্যাপ যাচাই করে, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিরক্ষা সংস্থার অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ৩২৯৫টি বেটিং পেজের সন্ধান পাওয়া গেছে।
‘গভ ডট বিডি’ শীর্ষ মানের একটি ডোমেইন যা বাংলাদেশের সরকারি সংস্থার ওয়েবসাইটের জন্য নির্ধারিত।
যেসব সরকারি ওয়েবসাইটে বেটিং সংশ্লিষ্ট প্রচার দেখা গেছে, তার মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, এবং বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। এছাড়া রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডসহ একাধিক জেলার সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেমন নারায়ণগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ, কিশোরগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের ওয়েবসাইটেও বেটিংয়ের প্রচার দেখা গেছে। সরকারের নিবন্ধিত দুইটি অনলাইন নিউজ পোর্টালেও পাওয়া যায় অনলাইন বেটিংয়ের প্রচারণা।
বিষয়টি প্রশ্ন তুলেছে সরকারি ওয়েবসাইটগুলোর ব্যবস্থাপনা নিয়ে। ডিসমিসল্যাব এ ব্যাপারে অবহিত করেছে বাংলাদেশ ই-গভর্নমেন্ট কম্পিউটার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম (বিডিসিআইআরটি)-কে।
জুয়া ও জুয়ার বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কঠোর অবস্থান সত্ত্বেও, নীতিমালা ভেঙে বাংলাদেশের ব্যবহারকারীদের টার্গেট করে ফেসবুক বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে টেলিভিশন চ্যানেল, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, এমনকি ঢাকার বিলবোর্ডেও অনলাইন বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হচ্ছে।
অনলাইন বেটিংয়ের আক্রমণে বেজা
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) দেশে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে শিল্প, কর্মসংস্থান, উৎপাদন এবং রপ্তানির প্রসার ও বহুমুখীকরণের মাধ্যমে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চালনায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। কিন্তু বেজার অফিসিয়াল ওয়েবসাইট অনলাইন বেটিং প্রচারণার অন্যতম লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। প্রধান ডোমেইন এবং সাতটি সাব ডোমেইন মিলিয়ে বেজার ওয়েবসাইটে পাওয়া যায় মোট ১৪৯৩টি বেটিং পেজ।
এই বেটিং ওয়েব পেজগুলো ‘বেজা ডট গভ বিডি’ সাইটের অধীনে থাকা সাব-ডোমেইনগুলোতে লুকোনো আছে। এর কয়েকটি গুগলে ইনডেক্স হয়েছে এবং সাধারণ কীওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমেই সেগুলো দেখতে পাওয়া যায়। ডিসমিসল্যাব প্রতিটি সাব-ডোমেইনের সাইটম্যাপ পরীক্ষা করে দেখতে পায় এগুলোর মধ্যে ৭টি সাব-ডোমেইনে বেটিং পেজের অস্তিত্ব আছে।
সাইটম্যাপে মূলত একটি ওয়েবসাইটের বিভিন্ন পেজ, ভিডিও ও অন্যান্য ফাইল এবং তাদের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে তথ্য পাওয়া যায়।
বেজার ওয়য়েবসাইটের বেটিং পেজগুলো খুব সাধারণ। ক্লিক করার পর পুরো পৃষ্ঠাতেই একটি বেটিং প্ল্যাটফর্মের প্রচার দেখা যায়, যেখানে ব্যবহারকারীদের টানতে “প্লে নাও”, “জয়েন নাও” বা “সাইন আপ হিয়ার” লেখা বাটন যুক্ত করা হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, বেজা ডোমেইন এবং এর সাব-ডোমেইনের মধ্যে লুকোনো বেটিং প্ল্যাটফর্ম ফ্যান্সিউইন সাইন-আপ করলেই শতভাগ বোনাস অফার করে। এর বিজ্ঞাপনে লেখা, “ফ্যান্সিউইন: বাংলাদেশের প্রিমিয়ার ক্রিকেট এক্সচেঞ্জ বেটিং প্ল্যাটফর্ম; আজই নিবন্ধন এবং লগ ইন করুন!” বেজা ডোমেইনে পাওয়া ১৪৯৩টি বেটিং পেজ জিটাএইস, ফ্যান্সিউইন এবং সিক্সসিক্সএস– এই তিনটি বেটিং প্ল্যাটফর্মের প্রচার করে।
আরও যেসব সরকারি ওয়েবসাইটে
বেজা ছাড়াও অন্যান্য আরও কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট এসব বেটিং প্রচারণার কবলে পড়েছে। সাইটম্যাপ বিশ্লেষণে স্থানীয় সরকার বিভাগের ওয়েবসাইটে ৩৫৮টি, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের ওয়েবসাইটে ৩৫২টি, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাইটে ২৮৮টি, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে ২৮১টি, ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাডেমির সাইটে ১৬৭টি এবং ফেনী জেলা পরিষদের সাইটে ১৪৯টি বেটিং পেজ পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের ওয়েবসাইটের ৩৫২টি পেজে যুক্ত “সাইন আপ হিয়ার” বাটনে ক্লিক করলে তা নিয়ে যায় ‘ভাগ্যবিডি’ নামের বেটিং সাইটের নিবন্ধন পেজে। বাকিগুলোতে ক্লিক করলে বেটিং অ্যাপ জিটাএইস এবং ফ্যান্সিউইন-র নিবন্ধন পেজে নিয়ে যাওয়া হয়, যেমনটি দেখা গিয়েছিল বেজার ওয়েবসাইটের ক্ষেত্রে।
বাংলাদেশের আরও কয়েকটি সরকারি ওয়েবসাইটের ভেতরে বেটিংয়ের পোস্ট খুঁজে পেয়েছে ডিসমিসল্যাব। যার মধ্যে আছে প্রধান বিদ্যুৎ পরিদর্শকের দপ্তর (১), ঔষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর (১, ২), বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (১) এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ওয়েবসাইট (১)। ২৯ মে, প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত সবগুলো পেজই সক্রিয় ছিল।
গুগল সার্চে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এবং প্রতিরক্ষা ক্রয় মহাপরিদপ্তরের ওয়েবসাইটেও (১) এমন বেটিং পেজের সন্ধান পাওয়া যায়, তবে লিংকগুলো এখন আর সক্রিয় অবস্থায় নেই।
আক্রান্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট
দেশের তিনটি সরকারি কলেজ, শিক্ষা বোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটেও বেটিং প্রচারণার পেজ পেয়েছে ডিসমিসল্যাব।
কিশোরগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ, নারায়ণগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ (১, ২, ৩) এবং যশোর সরকারি সিটি কলেজের ওয়েবসাইটে নগদ৮৮ নামে বেটিং ওয়েবসাইটের পোস্ট পাওয়া যায়। তবে যশোর সিটি কলেজের পোস্টগুলো কয়েক বছরের পুরোনো। সর্বশেষ পোস্টটি করা হয়েছিল ২০১৯ সালে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটেও মিলেছে বেটিং পোস্টের খোঁজ। প্রথম বর্ষ স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টি যে ওয়েবসাইট তৈরি করেছে— সেখানে পাওয়া যায় ১৭০টি বেটিং পেজ। পেজগুলোয় যুক্ত লিংক ব্যবহারকারীদের নিয়ে যায় ভাগ্যবিডি (bhaggobd) নামের বেটিং ওয়েবসাইটে। রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটেও (১, ২, ৩) বেটিং ও ক্যাসিনো সংক্রান্ত পোস্ট পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের শিক্ষকদের জন্য তৈরি অনলাইন ওয়েব পোর্টাল প্ল্যাটফর্ম, শিক্ষক বাতায়নের একটি পোস্টের মাধ্যমেও চালানো হয়েছে বেটিং প্রচারণা। ২০২৩ সালের আগস্টে আপলোড করা একটি পোস্টে নগদ৮৮ বেটিং অ্যাপের পরিচিতি এবং ব্যবহারের বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এমপিওভুক্ত স্কুল কলেজের শিক্ষকেরা ইনডেক্স নাম্বার দিয়ে শিক্ষক বাতায়ন ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করার মাধ্যমে বিভিন্ন পোস্ট করতে পারেন। এই ব্যবস্থাটি নিয়ে আগেও বিতর্কের সৃষ্ট হয়েছে। অন্যের ইনডেক্স নাম্বার জালিয়াতি করে বেতন উঠিয়ে নেয়ার ঘটনাও আছে।
বেটিংয়ের প্রচারণা নিবন্ধিত অনলাইন পোর্টালেও
সরকারের তথ্য অধিদপ্তর যেসব নিবন্ধিত অনলাইন পোর্টালের তালিকা প্রকাশ করেছে তার অন্তত দুটিতে বেটিং পোস্টের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। নিবন্ধিত অনলাইন পোর্টাল ডেইলিদিনকাল ডট নেট (www.dailydinkal.net) ও আজকেরবার্তা ডট কম (www.ajkerbarta.com)- এ গেলে দেখতে পাওয়া যায় ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় লেখা বেটিং সংক্রান্ত বিভিন্ন পোস্ট।
অনলাইন আর্কাইভ অনুসন্ধানে দেখা যায় ডেইলিদিনকাল ডট নেট ওয়েবপোর্টালটি একটি সংবাদমাধ্যম হিসেবে সক্রিয় ছিল ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত। তারপর থেকেই এখানে দেখা যায় ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় বেটিং সংক্রান্ত বিভিন্ন পোস্ট। একই চিত্র আজকেরবার্তা ডট কম সাইটটির ক্ষেত্রে। এটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল আকারে চালু ছিল ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত।
সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটগুলোতে বেটিং সংক্রান্তে পেজের অস্তিত্ব প্রসঙ্গে ডিসমিসল্যাব কথা বলে আন্তর্জাতিক সংস্থা এনগেজ মিডিয়ার ডিজিটাল নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আশরাফুল হকের সঙ্গে। তাঁর মতে, ওয়েবসাইটগুলো পরিচালনার সঙ্গে যুক্তদের অগোচরেই সেখানে বিভিন্ন পেজ তৈরি করে বেটিং প্রচারণা চালানো হয়ে থাকতে পারে। তিনি বলেন, “দেখভালের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের ওয়েবসাইট পরিচালনা এবং সার্ভারের নিরাপত্তা সংক্রান্ত অদক্ষতা বা গুরুত্ব না দেওয়ার সুযোগে সাইটগুলো হ্যাকিংয়ের শিকার হতে পারে। এমনকি ওয়েবসাইট তৈরির সঙ্গে যুক্ত থার্ড পার্টি ডেভেলপার কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থার অভাবে এমনটি ঘটতে পারে। এছাড়া এ সকল ওয়েবসাইটের অ্যাডমিন অ্যাক্সেস আছে এমন কারো অসতর্কতার সুযোগে তাদের ইউজারনেম ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে অন্য কেউ এ ধরনের কাজ করে থাকতে পারে।”
৩০ মে, ইমেইলের মাধ্যমে সরকারি ওয়েবসাইটগুলোতে বেটিং পেজ পাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ ই-গভর্নমেন্ট কম্পিউটার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম (বিডিসিআইআরটি)-কে অবহিত করেছে ডিসমিসল্যাব।
সম্প্রতি, প্রযুক্তি সংক্রান্ত গণমাধ্যম টেক ক্রাঞ্চ তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, বিহার, গোয়া, কর্ণাটক, কেরালা, মিজোরাম এবং তেলেঙ্গানার মতো ভারতীয় রাজ্যগুলোর প্রায় চার ডজন “gov.in” ডোমেইনের ভারতীয় সরকারি ওয়েবসাইটে বেটিংয়ের প্রচারণা পাওয়া গেছে।