তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
মাহফুজ আলমের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার মিথ্যা দাবি যেভাবে ছড়ালো

মাহফুজ আলমের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার মিথ্যা দাবি যেভাবে ছড়ালো

তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী, মাহফুজ আলমকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বেশ কিছু দিন ধরে অপপ্রচার চলছে। এই প্রচারণায় তাকে কখনো ধর্মীয় সংগঠন হেযবুত তাওহীদ, কখনো নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীরের নেতা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। কোথাও কোথাও তাকে জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। এসব দাবি এক পর্যায়ে বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে ইসলামী মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে চিত্রায়নের উপকরণ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। তবে মাহফুজ নিজে এসব দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। এছাড়া ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়েও এসব দাবির সত্যতা মেলেনি।

ডিসমিসল্যাব দেখতে চেয়েছে, সূত্রবিহীন দাবিগুলো কীভাবে ছড়ালো, এর পেছনে মূলত কারা ছিল, এখানে অপতথ্য ব্যবহার হয়েছে কিনা এবং কীভাবে তা একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকে শক্তিশালী করে তুলেছে। এজন্য গত আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে, বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত অন্তত ৬০টি আধেয় বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মূলত আগস্টের শুরু থেকে ডালপালা মেলতে শুরু করা এই প্রচারণা বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন রূপ নেয় এবং মাত্র তিন মাসে সামাজিক মাধ্যমের গণ্ডি পেরিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক কিছু থিংকট্যাংকের ওয়েবসাইটেও জায়গা করে নেয়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ভাষ্যটিকে বিশ্বাস করে, সেটিকে আরো ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখেন।    

মাহফুজ কি হেযবুত তাওহীদ নেতার ছেলে?

মাহফুজ আলম (যিনি মাহফুজ আবদুল্লাহ নামেও পরিচিত) প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে নিয়োগ পান ২৮ আগস্ট। এই সময়টিতে তাকে নিয়ে প্রচারণা তীব্র হয়ে ওঠে। এর পরের কয়েকদিনে আওয়ামী লীগের সমর্থক বিভিন্ন প্রোফাইল, পেজ ও গ্রুপে তাকে ধর্মীয় সংগঠন হেযবুত তাওহীদের নেতার বড় ছেলে বলে দাবি করা হয়। প্রতিটি পোস্টের ভাষ্য প্রায় একই রকম: “জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাওহীদ বাংলাদেশের এমাম সাবেক শিবির নেতা মোঃ সেলিম এর বড় ছেলে সমন্বয়ক মাহফুজ ডক্টর ইউনুস এর বিশেষ সহকারী।”

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকগোষ্ঠীর নামে পরিচালিত বিভিন্ন গ্রুপে (, , ) পোস্টগুলো ছড়াতে দেখা যায়। মুজিব আমার চেতনা, ঢাকা জেলা ছাত্রলীগ, বাংলার মুজিব, জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক, নাঙলকোট উপজেলা যুবলীগপ্রবাস ছাত্র লীগ,  বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিবেদিত কর্মি সহ বিভিন্ন পেজও পোস্টটি প্রকাশ করে।

হেযবুত তাওহীদ নিজেদের ধর্মীয় সংগঠন বলে দাবি করে, যদিও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংগঠনটিকে কালো তালিকাভুক্ত করার খবর প্রকাশিত হয়েছিল। তবে সংগঠনটি বরাবরই যেকোনো ধরনের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার দাবি অস্বীকার করে আসছে এবং নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সংগঠনটির প্রধান, হোসাইন মোহাম্মদ সেলিমের বাড়ি নোয়াখালির সোনাইমুড়িতে। অন্যদিকে, মাহফুজের লেখা বইয়ের ফ্ল্যাপে তার জন্মস্থান লক্ষীপুর জেলায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কয়েকটি অনলাইন পত্রিকার (,) সূত্র অনুসারে, মাহফুজ আলমের বাবার নাম আজিজুর রহমান বাচ্চু মোল্লা। 

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে হেযবুত তাওহীদ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নারী সম্পাদক ও হোসেইন মোহাম্মদ সেলিমের স্ত্রী রুফায়দাহ পন্নী ডিসমিসল্যাবকে বলেন, “একটি গোষ্ঠী মাহফুজ আলমকে আমাদের মাননীয় এমামের ছেলে বলে অপপ্রচার করছে। আমি খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, মাননীয় এমামের সঙ্গে মাহফুজ আলমের কোনো সম্পর্ক নেই।” 

হেযবুত তাওহীদ থেকে হিযবুত তাহরীর ও আনসারুল্লাহ বাংলাটিম

একদিন না যেতেই হেযবুত তাওহীদের এমামের ছেলে দাবি করা মাহফুজ সামাজিক মাধ্যমের পোস্টে বনে যান হিযবুত তাহরীরের নেতা। এই সংগঠনটিকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় জঙ্গি সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়। 

২৯ আগস্ট মধ্যরাতে আমরা রুহী ভাইয়ের ভক্ত নামের পেজ থেকে দাবি করা হয়, মাহফুজ আলমের সঙ্গে হিযবুত তাহরীরের সম্পর্ক থাকার অভিযোগ রয়েছে। পেজটি যাচাইয়ে দেখা যায় এটি নেত্রকোণা ১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা মোশ্তাক আহমেদ রুহীর সমর্থকগোষ্ঠীর চালিত পেজ। 

২৯ আগস্ট দুপুরে কিস্তি বাবা নামে আরও একটি পেজ থেকে মাহফুজ আলমের বিশেষ সহকারী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার সংবাদের সঙ্গে দাবি করা হয় “হিজবুত তাহরীর নেতা এই জঙ্গি হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী!” এবার আর অভিযোগ নয়, বরং তাকে সরাসরি ‘জঙ্গি’ বলা হয়। আধেয় যাচাই করে দেখা যায়, এটিও আওয়ামী লীগের সমর্থকদের পেজ। একইদিনে বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষা মঞ্চ নামের একটি পেজ থেকেও দাবি করা হয় মাহফুজ আলম হিযবুত তাহরীরের একজন নেতা। সূত্র হিসেবে বলা হয়, “ঢাকা থেকে নাম প্রকাশে অনাগ্রহী একাধিক সূত্র আমাদের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।” 

৩০ আগস্ট ফজলুল বারী নামের একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লেখেন: “বার বার হরতাল, অসহযোগ আন্দোলন, সরকার পতন এই শব্দগুলো শুনতে শুনতে সাধারণ মানুষের এইগুলোর উপর থেকে বিশ্বাস উঠে গিয়েছিল। সাধারণ জনগণ যখন দেখে হরতালে গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক থাকে, অসহযোগ আন্দোলনে সব অফিস আদালত খোলা থাকে। তাই দেয়া হয়ে নতুন শব্দ।  বলা হয় এসব শব্দ এবং ধারণাগুলো মাহফুজ আলমের ব্রেইন চাইল্ড। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাহরীরের নেতা মাহফুজ আবদুল্লাহ এখন ডক্টর ইউনুসের বিশেষ সহকারী!” পোস্টটি অন্তত ৬৯ বার শেয়ার হয়।

সেদিন সম্পাদক ভাই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে “ইউনূসের বিশেষ সহকারী জঙ্গি নেতা মাহফুজ আলম” শিরোনামে একটি ভিডিও প্রকাশিত হয়। এখানে বলা হয়, “মনে রাখতে হবে, এবারের ছাত্র আন্দোলনে মূল ভূমিকা রেখেছে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলো। বিশেষ করে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাহরির।  আমরা দেখবো, কিভাবে হিজবুত তাহরির এই আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে।” ভিডিওতে ফজলুল বারীর দেওয়া সেই পোস্টের বক্তব্য তুলে ধরা হয়। 

একই দিন অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট ফোরাম (বোয়াফ) এর প্রতিষ্ঠাতা কবীর চৌধুরী তন্ময় তার ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডি থেকে দেওয়া এক পোস্টে লেখেন, “আজ মুহাম্মদ ইউনুসকে ধন্যবাদ দিতে হয়। কারণ, নিষিদ্ধ জ*.ঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের অন্যতম নেতা মাহফুজ আলমকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী করে প্রকাশ্যে উপস্থাপন করেছেন”।  একই দাবি অনেকে তাদের পোস্টে (,, , , , ) শেয়ার করেন। তন্ময় সম্প্রতি বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক তরিকুল ইসলামের একটি ভুয়া সম্পাদিত ভিডিও পোস্ট করেন যা সামাজিক মাধ্যমেও ব্যাপকভাবে ছড়ায়।

সামাজিক মাধ্যম থেকে মূলধারায়

২৯ আগস্ট দ্য ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদনে সাংবাদিক দীপঞ্জন রায় চৌধুরী “ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নে জামায়াতের আগ্রহ প্রশ্নবিদ্ধ” শীর্ষক প্রতিবেদনে হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে মাহফুজ আলমের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে ধরেন।  তিনি লেখেন, “বাংলাদেশে হিযবুত তাহরীরের বাড়তে থাকা নেটওয়ার্ক পর্যবেক্ষণ করছে বৈশ্বিক নিরাপত্তা সংস্থাগুলো। হিযবুত তাহরীরের প্রতি আনুগত্যের অভিযোগ থাকা শিক্ষার্থী মাহফুজ আলম ইউনূসের বিশেষ সহকারী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন”। কিন্তু এই অভিযোগের সমর্থনে তিনি কোনো সূত্রের উল্লেখ করেননি।

প্রসঙ্গত, দীপঞ্জন রায় চৌধুরী এর আগে ২০১২ সালে ইন্ডিয়া টুডেডেইলি মেইলে প্রকাশিত প্রতিবেদনে, ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপিকে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই আর্থিক সহায়তা করেছিল বলে দাবি করেন। আইএসআই-এর সাবেক প্রধান আসাদ দূরানি বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিষয়টিকে মিথ্যা বলে জানান। 

দ্য ইকোনমিক টাইমসে ১১ সেপ্টেম্বর দীপঞ্জন রায় চৌধুরী “নিষিদ্ধ ঘোষিত মৌলবাদী সংগঠন হিযবুত তাহরীর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে চাপ দিচ্ছে” শিরোনামের একটি  প্রতিবেদনে আবারও মাহফুজের সঙ্গে হিযবুত তাহরীরের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে ধরেন। 

দ্য ইকোনমিক টাইমসের সূত্র দিয়ে সাউথ এশিয়া টেরোরিজম পোর্টাল (এসএটিপি) তাদের ওয়েবসাইটে হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে মাহফুজের সম্পৃক্ততার অভিযোগের কথা উল্লেখ করে। ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে দিল্লিভিত্তিক পোর্টালটি দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণের ডেটাবেজ হিসেবে কাজ করে। 

এ পর্যায়ে মাহফুজ আলম ১৪ সেপ্টেম্বর ফেসবুকের একটি দীর্ঘ স্ট্যাটাসে লেখেন, “ইকোনমিক টাইমসের একজন সাংবাদিক হিযবুত তাহরীরের প্রতি আমার ‘কথিত আনুগত্য’ সম্পর্কে লিখেছেন, যা ভারতীয় রাষ্ট্রের বর্ণনার সেবা ও একীভূত করার জন্য সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ইচ্ছাকৃত ফ্রেম করা। আমি হিযবুত তাহরীর এবং অন্য অগণতান্ত্রিক দলের মতাদর্শের বিরুদ্ধে ছিলাম এবং এখনও আছি।”

কিন্তু এতেও প্রচারণা থামেনি। ২৩ সেপ্টেম্বর মিলেনিয়াম পোস্টে এক মতামত কলামে ভারতীয় লেখক শান্তনু মুখার্জী ফের মাহফুজের সঙ্গে হিযবুত তাহরীরের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ সামনে আনেন।

লেখক ও বিশ্লেষকের টুইট যেভাবে খবরের সূত্র হল

২৪ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস তার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আব্দুল্লাহকে সরকার পতনের আন্দোলনের অন্যতম কারিগর হিসেবে উল্লেখ করেন। এরপর সামাজিক মাধ্যমে ফের মাহফুজের সঙ্গে হিযবুত তাহরীর ও জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ ছড়াতে থাকে। 

২৫ সেপ্টেম্বর এক্সে (সাবেক টুইটার) ভারতে নির্বাসিত বাংলাদেশি লেখিকা তসলিমা নাসরিন লেখেন, “হাসিনাকে সরানোর ‘গোটা বিপ্লবের পেছনের ব্রেইন’ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ ইসলামী জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের নেতা মাহফুজ আলমকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ড. ইউনূস।” ভয়েজ অব বাংলাদেশি হিন্দুজও তাদের অফিসিয়াল অ্যাকাউন্ট থেকে একই ভাষ্য টুইট করে।  

২৬ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লির ভূরাজনীতি বিশ্লেষক ও কলাম লেখক ব্রহ্ম চেলানি তার এক্স হ্যান্ডেল থেকে দেওয়া পোস্টে মাহফুজকে হিযবুত তাহরীরের নেতা হিসেবে দাবি করেন। চেলানির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ নিয়ে লেখা প্রতিবেদনে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপনের অভিযোগ রয়েছে, যা উঠে আসে ঢাকা ট্রিবিউনের ‘ফ্যাক্ট অর চেলানি?’ শিরোনামের প্রতিবেদনে।  ভারতীয় সাংবাদিক স্মিতা প্রকাশও হিযবুত তাহরীরের প্রতি মাহফুজের কথিত আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন

এই পর্যায়ে লেখিকা তসলিমা নাসরিন ও বিশ্লেষক ব্রহ্ম চেলানির টুইটকে সূত্র হিসেবে নিয়ে বিভিন্ন ভারতীয় গণমাধ্যম মাহফুজকে হিযবুত তাহরীরের নেতা হিসেবে অভিহিত করে। রাইসিনা হিলস তাদের প্রতিবেদনে চেলানিকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে। আর তসলিমা নাসরিনের পোস্টকে সূত্র হিসেবে নিয়ে ভারতের আনন্দবাজার, হিন্দুস্তান টাইমস বাংলা, আর প্লাস নিউজ, টিভি৯ বাংলা মাহফুজকে হিযবুত তাহরীরের নেতা হিসেবে অভিহিত করে। 

তসলিমা নাসরীন পরবর্তীতে ৬ অক্টোবরের একটি পোস্টে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের ২০১৯ সালের হিযবুত তাহরীরের নেতা মাহফুজ গ্রেপ্তার শিরোনামের একটি সংবাদ শেয়ার করে লেখেন, ‘মাহফুজ আবদুল্লাহ হিযবুতের লোক –মিডিয়া এই তথ্য দিয়েছে বলে তথ্য পেয়েছি। আজও তো দেখলাম পুরোনো একটি খবর।” তবে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সংবাদটি ২০১৯ সালের এবং সেখানে আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ নামের একজন হিযবুত তাহরীর নেতার উল্লেখ পাওয়া যায়।

২০১৯ সালের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম প্রতিবেদন থেকে আব্দুল্লাহ আল মাহফুজের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় মেলে। বাংলা নিউজ ২৪ এর প্রতিবেদন অনুসারে আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ সাতকানিয়া উপজেলার চর খাগরিয়া এলাকার নজরুল ইসলামের ছেলে এবং ২০১৯ সালে তার বয়স ছিল ৩০। আর ড. ইউনূসের বিশেষ সহকারী মাহফুজের জীবন বৃত্তান্ত অনুযায়ী তার জন্ম ১৯৯৫ সালে লক্ষ্মীপুর জেলায়। পরবর্তীতে তসলিমা নাসরিন তার পোস্ট এডিট করে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের লিংকটি সরিয়ে ফেলেন। সম্প্রতি তার শেয়ার করা স্ক্রিনশটটি আবারও প্রচারিত হতে দেখা গেলে, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে দাবিটি মিথ্যা বলে জানানো হয়। 

বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান দেখাতে মাহফুজকে ব্যবহার

অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে প্রথম আলো, মাহফুজ আলমের একটি দুই পর্বের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে যা বেশ আলোচিত হয়। এরপর তাকে জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়ানোর প্রচারণা আরো জোরদার হয়ে ওঠে। বিভিন্ন পেজ ও প্রোফাইল থেকে গ্রাফিক কার্ড শেয়ার করে দাবি করা হয় মাহফুজ আলম হিযবুত তাহরীরের নেতা। কোথাও কোথাও আবার ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকাকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি পোস্ট পাওয়া যায়, ৬ অক্টোবর (, , , , ,, , , )  এবং ১২ অক্টোবর (, , ,, , , ,, , ১০, ১১)।

একই সময় ভারতে বিজেপি সমর্থক ম্যাগাজিন হিসেবে পরিচিত স্বরাজ্য তাদের একটি বিশেষ প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সহায়তায় বাংলাদেশ ইসলামী কট্টরপন্থী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে। প্রতিবেদনটি মাহফুজ আলমের সঙ্গে ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়ান জার্নালিজম ইন আ নিউ এরা’ বইয়ের একটি প্রবন্ধে  স্বরাজ্যকে ডানপন্থী ও বিজেপি সমর্থকদের পরিচালিত একটি পত্রিকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়, যেখানে সাধারণত মোদির পক্ষে প্রচারণা দেখা যায়।

নিউইয়র্কভিত্তিক থিংকট্যাংক গেটস্টোন ইনস্টিটিউটে প্রকাশিত একটি নিবন্ধেও মাহফুজকে হিযবুত তাহরীরের নেতা হিসেবে অভিহিত করা হয়। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল: “বাংলাদেশের তালিবানিকরণ: বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসন ও ‘মানবাধিকার’ গ্রুপগুলো নিরব”। গণমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাইকারী মিডিয়া বায়াস/ ফ্যাক্টচেক অনুসারে, গেটস্টোন প্রপাগান্ডা, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, মিথ্যা ও বিদ্বেষপূর্ণ  তথ্য প্রচার করে থাকে। দ্য ইন্টারসেপ্ট এক প্রতিবেদনে গেটস্টোন ইনস্টিটিউটের চেয়ার জন বল্টনকে ‘ফেক নিউজ’ প্রকাশক উল্লেখ করে ও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মুসলিম বিদ্বেষী অপপ্রচারের অভিযোগ আনে। 

দিল্লির সাংবাদিক চন্দন নন্দী, গত ২ সেপ্টেম্বর, দ্য নর্থইস্ট নিউজের একটি প্রতিবেদনে ভারতীয় ও বাংলাদেশি গোয়েন্দা সূত্রের উল্লেখ করে দাবি করেন মার্কিন ষড়যন্ত্র এবং পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা (আইএসআই) এবং কাতারের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ছাত্রদের একটি দল ২০২৩ সাল থেকেই হাসিনা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করে যাদের মধ্যে মাহফুজ আলমও ছিলেন। তিনি তার প্রতিবেদনে লেখেন, “ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা সন্দেহ করেন যে শিক্ষার্থীদের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের শুরু ‘গুরুবার আড্ডা’ নামের একটি পাঠচক্রের মধ্য দিয়ে, ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসভিত্তিক একটি দল হিসেবে যার যাত্রা শুরু। ইউনূসের কর্মীদের একজন মাহফুজ আলম এই গোপন দলের নেতৃত্ব দিতেন, যেখানে শুধু হিযবুত তাহরীর নয়, জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সদস্যরা ছিল।” প্রতিবেদনটি নিয়ে পরবর্তীতে বেশকিছু পোস্ট (, ,) প্রচারিত হয়।

প্রসঙ্গত প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মাহফুজ আলম নিজেই গুরুবার আড্ডার কথা উল্লেখ করে বলেন, ছাত্রলীগের চক্ষুশূল হওয়ার ভয়ে অনেকটা আড়ালেই এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “গুরুবার, মানে বৃহস্পতিবার আমাদের আড্ডাটা বসত। আমরা নানা প্রশ্ন নিয়ে ভাবতাম—রাষ্ট্র, সমাজ, দর্শন, ইতিহাস আর ধর্মতত্ত্ব, যেটা অনেকে বাদ দিয়ে যান। আমরা কামরুদ্দীন আহমেদের লেখা যেমন পড়েছি, তেমনই লেনিনের বা ইসলামি রাষ্ট্রভাবনার বাস্তবতা নিয়েও আলোচনা করেছি। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, ইকবালকে নিয়ে আলোচনা করেছি।”

আরো কিছু লেখা