তাসনিম তাবাস্সুম মুনমুন

মসজিদকে নৃত্যশালা বানানোর দাবিতে তাজিকিস্তানের খুজান্দ দুর্গে নওরোজ উদযাপনের ভিডিও প্রচার
তাসনিম তাবাস্সুম মুনমুন
তাজিকিস্তানে মসজিদকে নৃত্যশালা বানানো হয়েছে দাবিতে একাধিক সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। এর আগে ভিডিওটিসহ একই দাবির এক্স (সাবেক টুইটার) পোস্টকে সূত্র ধরে একাধিক পাকিস্তানি গণমাধ্যমও প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ডিসমিসল্যাবের ফ্যাক্টচেকে দেখা যায়, মসজিদ হিসেবে দাবি করা স্থাপনাটি তাজিকিস্তানের খুজান্দ দুর্গের ভেতরের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক কমপ্লেক্স। ইরানি নববর্ষ নওরোজ উদযাপন উপলক্ষ্যে খুজান্দ দুর্গে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ভিডিও এটি।
একটি স্থাপনার সামনে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পড়ে নারীদের নৃত্য পরিবেশনের একটি ভিডিও শেয়ার করে ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, “তাজিকিস্তান ৯৭%মুসলিমের বসবাস করে।। হিজাব নিষিদ্ধ করে মসজিদকে নৃত্যশালা বানিয়েছে।।” মন্তব্যের ঘরে কেউ বলেছেন, “মুসলিম নামে মোনাফেক দেশ এটা”। একজন লিখেছেন, “যদি তাই হয় তবে কেয়ামত বেশী দুরে নয় মনে হয়”। ৩১ অক্টোবরের এই পোস্ট এখন পর্যন্ত ৭০ হাজার ফেসবুক ব্যবহারকারী দেখেছেন।

একই দাবিতে একাধিক পাকিস্তানি গণমাধ্যমেও প্রতিবেদন (১, ২) প্রকাশিত হয়। এক্স-এর একটি পোস্টকে সূত্র ধরে এসব প্রতিবেদন করা হয়। তার ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, “৯৭% মুসলমানের দেশ তাজিকিস্তান ইতিমধ্যেই বোরকা ও হিজাব নিষিদ্ধ করেছে। এখন উগ্রবাদ দমন করতে মসজিদগুলোকে নৃত্যশালায় পরিণত করছে। এই বুদ্ধি কেমন লাগছে?” ২৮ সেপ্টেম্বরের এই পোস্টটি এখন পর্যন্ত ৫ হাজার বার শেয়ার হয়েছে এবং দেখেছেন ২৩ লাখ এক্স ব্যবহারকারী।
রিভার্স ইমেজ সার্চে ৩০ মার্চ ও ১ এপ্রিল ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে (১, ২) ব্রিটিশ গণমাধ্যম ইন্ডিপেন্ডেন্ট-এর পার্সিয়ান সংস্করণে প্রকাশিত ভিডিও প্রতিবেদন খুঁজে পায় ডিসমিসল্যাব। ভিডিও-এর ক্যাপশনে লেখা, “তাজিক ফ্যাশন ডিজাইনার খুরশেদ সাত্তারোভ নওরোজ নৃত্য এবং বাদ্যযন্ত্র পরিবেশনার ভিডিও শেয়ার করেছেন। সিজদাহ বেদার-এর প্রাক্কালে দুশানবেতে তাজিকিস্তানের গ্র্যান্ড মসজিদের এই আয়োজন করা হয়েছে।”
ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্সিয়ান-এর সূত্র ধরে ফ্যাশন ডিজাইনার খুরশেদ সাত্তারোভের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে গেলে ৩১ মার্চ ও ১ এপ্রিল এই আয়োজনের বিভিন্ন ভিডিও ডিসমিসল্যাবের সামনে আসে। এর একটি ভিডিও যাচাই করা ভিডিও-এর সাথে হুবহু মিলে যায়। তিনি পোস্ট করে লিখেছেন, “ঐতিহাসিক খুজান্দ শহরে ‘তাজিকিস্তানের আন্তর্জাতিক নওরোজ’ প্রকল্পের জন্য আমাদের মডেল, কোরিওগ্রাফার ও ভিডিওগ্রাফারদের অবিশ্বাস্য অবদানের জন্য তাদের কাছে কতটা কৃতজ্ঞ, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।” তিনি হ্যাশট্যাগ তাজিকিস্তান, খুজান্দ, নওরোজ ব্যবহার করেন। অর্থাৎ, একাধিক সূত্র যাচাই-এ নিশ্চিত হওয়া যায় যে এই আয়োজন নওরোজ ও সিজদাহ বেদার উপলক্ষ্যে। উল্লেখ্য, এ বছর সিজদাহ বেদার ২ এপ্রিল আয়োজিত হয়েছে।

তবে ভিডিওতে দৃশ্যমান অনুষ্ঠান আয়োজনের স্থান ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্সিয়ান অনুযায়ী দুশানবেতে তাজিকিস্তানের গ্র্যান্ড মসজিদ, নাকি খুরশেদ সাত্তারোভের তথ্যমতে খুজান্দে- এ নিয়ে বিপরীতধর্মী তথ্য মিলে। দুশানবে তাজিকিস্তানের রাজধানী ও রাজনৈতিক কেন্দ্র, যেখানে প্রেসিডেন্টের দপ্তর ও গ্র্যান্ড মসজিদসহ দেশের প্রধান সরকারি স্থাপনাগুলো অবস্থিত। অন্যদিকে খুজান্দ দেশটির উত্তরে সুগ্ধ অঞ্চলে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক শহর, যা প্রাচীন খুজান্দ দুর্গের জন্য পরিচিত। দুশানবে ও খুজান্দের মধ্যবর্তী দূরত্ব ২০০ কিলোমিটারেরও বেশি।
কি-ওয়ার্ড সার্চে দেখা যায়, তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবের গ্র্যান্ড মসজিদের সঙ্গে যাচাই করা ভিডিও-এর স্থাপনার মিল নেই। অন্যদিকে ভিডিও-এর কি-ফ্রেম নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চে সেই স্থাপনাকে খুঁজে পাওয়া যায় খুজান্দ শহরের “খুজান্দ দুর্গ” নামক ঐতিহাসিক নিদর্শনে। তাজিকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা খোভার একে খুজান্দ দুর্গের “সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক কমপ্লেক্স” বলে উল্লেখ করেছে। ২৩ এপ্রিলের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, “সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক কমপ্লেক্সটি স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। সম্প্রতি দেশটির জাতির নেতা ইমোমালি রাহমনের উপস্থিতিতে ঐতিহাসিক এই দুর্গটি উদ্বোধন করা হয়। প্রায় তিন হাজার বছরের পুরনো এই দুর্গটি সুগ্ধ অঞ্চলের প্রশাসনের অর্থায়নে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।”

এর আগে তাজিকিস্তানের ৩৩ তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে ২০২৪ এর ৩ মার্চ এক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। তাজিকিস্তানের জাতীয় জাদুঘরের সেই ওয়েবসাইটেও এই স্থাপনাকে “ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স, খুজান্দ দুর্গ” বলা হয়েছে।
উজবেকিস্তান ভিত্তিক একাধিক গণমাধ্যম (১, ২) ও সরকারি ওয়েবসাইটের (১, ২) সূত্র মতে, ৩১ মার্চ খুজান্দে অনুষ্ঠিত সামিটে উজবেকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরজিয়োয়েভ, তাজিকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইমোমালি রাহমন ও কিরগিজস্তানের প্রেসিডেন্ট সাদির জাপারভ যোগ দেন। এ সময় তারা সামিটের সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে খুজান্দ দুর্গ পরিদর্শনে যান।
অর্থাৎ, জায়গাটি খুজান্দ দুর্গের ভেতরে সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক কমপ্লেক্স-এর সামনে, দুশানবেতে তাজিকিস্তানের গ্র্যান্ড মসজিদ নয়। নওরোজ উদযাপনের সেই নৃত্য খুজান্দ দুর্গের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক কমপ্লেক্স- এর সামনে অনুষ্ঠিত হয়েছে, কোনো মসজিদে নয়। তাই মসজিদকে নৃত্যশালা বানানোর দাবিটি বিভ্রান্তিকর।
প্রসঙ্গত, ইউরোনিউজ-এর ২০২৪ সালের ২৪ জুনে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, তাজিক সরকার ধর্মসংক্রান্ত ৩৫টি বিস্তৃত আইনের ধারাবাহিকতায় হিজাব নিষিদ্ধ করে একটি নতুন আইন পাশ করেছে। সরকার একে “জাতীয় সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ রক্ষা” এবং “অন্ধবিশ্বাস ও উগ্রবাদ প্রতিরোধের” পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
২০২৪ সালের ২০ জুন সংসদের উচ্চকক্ষ “মাজলিসি মিল্লি” এই আইন অনুমোদন করে। এতে বলা হয়েছে, “বিদেশি পোশাক” ব্যবহার নিষিদ্ধ — এর মধ্যে মুসলিম নারীদের পরিধেয় হিজাবও অন্তর্ভুক্ত। এর পরিবর্তে নাগরিকদের তাজিক ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরতে উৎসাহিত করা হয়েছে। এর আগে ২০০৯ সালে দেশটির সরকার প্রথমে সরকারি অফিস, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে হিজাব পরা নিষিদ্ধ করে।