ডিসমিসল্যাব

অফিসিয়াল ডেস্ক
সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৫
১৭:৩৮:৪০
খাগড়াছড়িতে সংঘাত নিয়ে ছড়ালো যেসব অপতথ্য
This article is more than 2 months old

খাগড়াছড়িতে সংঘাত নিয়ে ছড়ালো যেসব অপতথ্য

সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৫
১৭:৩৮:৪০

ডিসমিসল্যাব

অফিসিয়াল ডেস্ক

সম্প্রতি খাগড়াছড়ির সংঘাত নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একের পর এক ছবি-ভিডিও ভিন্ন ভিন্ন দাবিতে ছড়িয়ে পড়ছে। এসবের মধ্যে অনেকগুলো সঠিক হলেও ভুয়া দাবিযুক্ত কিছু পোস্টও শেয়ার হতে দেখা গেছে। বেশ কিছু পোস্টে আহত ব্যক্তির নাটক, রাজনৈতিক সহিংসতা, প্রশাসনের ভূমিকা ও সেনা সদস্যকে অপহরণের দাবি করা হয়েছে। তবে ফ্যাক্টচেক করে দেখা গেছে, ছড়িয়ে পড়া পোস্টের এই দাবিগুলো ভুয়া এবং ভিন্ন প্রেক্ষাপটের পুরোনো ছবি-ভিডিও ব্যবহার করে তা খাগড়াছড়ির বলে ছড়ানো হচ্ছে। চলমান এই সংঘাতকে ঘিরে ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোর মধ্যে অন্তত পাঁচটি দাবি ভুয়া বলে নিশ্চিত হয়েছে ডিসমিসল্যাব।

দাবি ১

ফেসবুকে রিল আকারে শেয়ার হওয়া একটি ভিডিওতে দাবি করা হচ্ছে খাগড়াছড়িতে রঙ লাগিয়ে আহত হওয়ার নাটক করছে এক চাকমা। “গণ অধিকার পরিষদ” নামের এক প্রোফাইল থেকে শেয়ার হওয়া সেই রিলের বিবরণে লেখা, “খাগড়াছড়ি উপজাতির আহত চাকমার নাটক। দেখুন রং লাগিয়ে অভিনয় করছে।” ভিডিওতে মাথায় গামছা সদৃশ কাপড় জড়ানো এক ব্যক্তিকে রক্তাক্ত অবস্থায় কথা বলতে দেখা যায়। ১৫ সেকেন্ডের ভিডিওটির শুরুতে কান্নারত অবস্থায় দেখা গেলেও ১৩ সেকেন্ডে তাকে হাসতে দেখা যায়। একই ভিডিও ফেসবুক (, ) ও ইনস্টাগ্রামেও (, ) পোস্ট হতে দেখা গেছে।

ভিডিওটির সূত্র যাচাই করতে কিফ্রেম সার্চ করে ডিসমিসল্যাব। সার্চে দেখা যায় এটি প্রথম পোস্ট হয় চলতি বছরের ১৮ জুলাই “কালসেং সাংমা পেজ” নামের একটি প্রোফাইল থেকে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, এর ক্যাটাগরি হিসেবে “অভিনেতা” দেওয়া। প্রোফাইলের ট্রান্সপারেন্সি যাচাইয়ে এর প্রাথমিক লোকেশন দেখায় ভারতে। একই ব্যক্তির ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলের লোকেশনও ভারতে। প্রোফাইলটি থেকে নিয়মিত বিনোদনমূলক ভিডিও পোস্ট হতে দেখা যায়। একাধিক ছবি ও ভিডিওতে ব্যক্তিটিকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার ব্যানারের সঙ্গে দেখা যায় যেখানে স্থান হিসেবে ভারতের মেঘালয়ের দক্ষিণ পশ্চিম গারো হিলসের নাম উল্লেখ থাকতে দেখা যায় (, , )। চলতি বছরের ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসেও ফেসবুকের ওই প্রোফাইল থেকে ছবিভিডিও পোস্ট করা হয় যেখানে ভিডিওতে থাকা ব্যক্তিকে ভারতের পতাকা বহন ও স্যালুট করতে দেখা যায়।

দাবি ২

ফেসবুকে এক ব্যক্তির অস্ত্র হাতে ছবি শেয়ার করে ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখের উল্লেখ করে দাবি করা হচ্ছে, প্রকাশ্য দিবালোকে মহাজনপাড়া এলাকায় জুম্ম-জনতার উপর প্রকাশ্যে সশস্ত্র হামলা করেছে পাহাড়ি বাঙালিরা (সেটেলার)। আরেকটি প্রোফাইলে আরও দুইটি ছবির সঙ্গে এই ছবি একই দাবিতে শেয়ার করা হয়। এছাড়া, খাগড়াছড়ির ঘটনা দাবি করে ২৮ সেপ্টেম্বরে একটি প্রতিবেদনও ছবিটি প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, “শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদরত রাখাইন শিক্ষার্থীদের ওপর খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারা উপজেলার কর্তৃপক্ষ গুলি চালিয়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে তিন বাঙালি কর্তৃক ১২ বছরের এক রাখাইন স্কুলছাত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ প্রতিবাদের সূত্রপাত হয়”।

তবে ছড়িয়ে পড়া ছবিটির সত্যতা যাচাইয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চে সংবাদমাধ্যম দ্য ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদন সামনে আসে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ছবিটি গত বছরের জুলাই আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামের এনায়েত বাজার এলাকা থেকে তোলা। দৈনিক ইত্তেফাকের এক ভিডিও প্রতিবেদনে অপর ছবিটিরও সন্ধান পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয় ছবির ঘটনাটি গত বছরের আগস্ট মাসে রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনার। 

অর্থাৎ, এক বছরের পুরোনো এই ছবিগুলো বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ফেসবুক ব্যবহারকারীর প্রোফাইল থেকে সাম্প্রতিক দাবিতে ছড়ানো হচ্ছে যার সঙ্গে চলমান খাগড়াছড়ি সংঘাতের কোনো সম্পর্ক নেই।

দাবি ৩

খাগড়াছড়িতে সেনা সদস্যকে পাহাড়িরা ধরে নিয়ে গেছে দাবিতে ফেসবুকে একাধিক প্রোফাইল-পেজ থেকে একটি ভিডিওটি ছড়াতে দেখা যায় (, , , , , , , , )। ক্যাপশনে লেখা হয়, “পাহাড়িরা সেনাবাহিনীকে ধরে নিয়ে গেছিল, প্রায় দু ঘন্টা পর উদ্ধার করা হয়, কিন্তুু উদ্ধার করার পর দেখা যায় অবস্থা খুব ক্রিটিকাল।” একই দাবিতে সামাজিকমাধ্যম এক্সেও ভিডিওটি ছড়াতে দেখা যায়।

দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে ভিডিওটির একাধিক কিফ্রেম নিয়ে সার্চ করলে দৈনিক ইত্তেফাকের অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। চলতি বছরের ২২ জুলাইয়ে প্রচারিত সেই প্রতিবেদনে রিপোর্টারকে বলতে শোনা যায় এটি সেসময়ের সচিবালয়ের একটি ঘটনার। বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২ মিনিটি ৩৬ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যের ভিডিওটির ২৫ থেকে ৩১ সেকেন্ড অংশের সঙ্গে খাগড়াছড়ির দাবিতে ছড়ানো ৬ সেকেন্ডের ভিডিওটির হুবহু মিল রয়েছে। আরেক সংবাদমাধ্যম কালের কণ্ঠেও একই ঘটনা সচিবালয়ের বলে প্রচারিত হয়েছে।

দাবি ৪

সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ৪ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, রাস্তায় সাদা গেঞ্জি পরিহিত এক ব্যক্তি হাতে মোবাইল নিয়ে সামনে আগাচ্ছেন এবং তার সামনে হেলমেট পড়া, বন্দুক হাতে এক ব্যক্তি রয়েছেন। তাদের পিছনে আরো কিছু ব্যক্তিকে দেখা যায় যারা মোবাইল হাতে সামনে আগাচ্ছেন দৌড়াতে দৌড়াতে। পোস্টের ক্যাপশনে লেখা, “১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সেনাবাহিনীর বিজিবির উপর পাহাড়িদের হামলা অস্ত্র লুট করে নিয়ে যাচ্ছে আমরা কোথায় বসে আছি” (বানান অপরিবর্তিত)। ফেসবুকের একাধিক ফেসবুক প্রোফাইল থেকে (, , , , , , ) একই দাবিতে ভিডিওটি শেয়ার করতে দেখা যায়।

ভুয়া দাবিতে ছড়ানো ভিডিও

ঘটনাটি যাচাইয়ের জন্য ভিডিওটির কিফ্রেম ধরে সার্চ করলে ইউটিউবে ১৪ সেকেন্ডের একটি ভিডিও পাওয়া যায়, যার প্রথম ০৪ সেকেন্ড ছড়িয়ে পরা ভিডিওটির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এর বিবরণীতে লেখা, “জেনজি প্রটেস্ট নেপাল কাঠমান্ডু । আন্দোলন লাইভ।” ইউটিউবের ওই ভিডিওর রিভার্স ইমেজ অনুসন্ধানে সেখানে থাকা লাল তোরণের সদৃশ একটি স্ট্রিট ভিউ সাজেশন পাওয়া যায়, যার লোকেশন কাঠমাণ্ডুর রিং রোডের। সাজেশনের সূত্র ধরে পরে দেখা যায় গুগল স্ট্রিট ভিউয়ের কাঠমান্ডুর রিং রোডের গুয়াশালার পুলিশ সার্কেল এর চারদিকের পরিবেশের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দৃশ্যমান এলাকার মিল রয়েছে।

গুগল ম্যাপের স্ট্রিট ভিউতে, ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর ০৩ সেকেন্ডে সবুজ রঙ এর একটি সাইনবোর্ড দেখা যায়। স্ট্রিট ভিউতে একই ধরনের একটি সবুজ সাইনবোর্ড দেখা যায় যার পিছনে সাদা একটি অবকাঠামো। অবকাঠামোটির সামনে লাল ইটের প্রাচীর। গুগল স্ট্রিট ভিউতে, গুয়াশালা পুলিশ সার্কেলে সবুজ সাইনবোর্ড এবং এই অবকাঠামোটি লক্ষ্য করা যায়। 

অর্থাৎ, ভিডিওতে দেখানো স্থানটি খাগড়াছড়ির চলমান সংঘাতের দৃশ্য নয়, বরং নেপালের কাঠমান্ডু শহরের গুয়াশালা এলাকার রিং রোডের পুলিশ সার্কেল নামক একটি জায়গার দৃশ্য।

দাবি ৫

সামাজিক মাধ্যমের একটি পেজ থেকে ১২ সেকেন্ডের একটি ভিডিও শেয়ার করে বলা হচ্ছে, এটি খাগড়াছড়ির মহাজনপাড়ার রাতের দৃশ্য। ভিডিওটিতে দেখা যায়, একটি গাড়ি ও কিছু মোটরসাইকেল রাস্তার একদিক থেকে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। এসময় গাড়ি থেকে একটি বস্তু আকাশের দিকে উৎক্ষেপণ করা হয় এবং আগুনের ফুলকি ও ধোয়া দেখা যায়। রাস্তায় থাকা কয়েকজন মানুষকে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। বিবরণে লেখা, “খাগড়াছড়ি মহাজন পারা রাতের দৃশ্য আরো ভয়াবহ আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন,আমিন।” একই ভিডিও একই দাবিতে আরও একাধিক ফেসবুক পেজ-প্রোফাইল থেকেও ছড়াতে দেখা যায় (, , , , , )।

ভুয়া দাবিতে ছড়ানো ভিডিও

তবে ঘটনাটির সত্যতা যাচাইয়ে ভিডিওটির একাধিক কিফ্রেম ও প্রাসঙ্গিক কিওয়ার্ড সার্চ করে ডিসমিসল্যাব। এতে ভিডিওটির সঙ্গে হুবহু সাদৃশ্যপূর্ণ আরেকটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। মারতাপুরাপেডিয়া নামের একটি ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে গত ৩০ আগস্ট পোস্ট হওয়া দুই মিনিটের একটি ভিডিওর ৫ সেকেন্ড থেকে ১৭ সেকেন্ড অংশের সঙ্গে খাগড়াছড়ির বলে ছড়ানো ভিডিওটির হুবহু মিল আছে। ইন্সটাগ্রামের ওই ভিডিওর বিবরণে লেখা, “যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ হতাহত না হচ্ছে, সোলোতে ডেমো চলবে— শুক্রবার, ২৯ আগস্ট ২০২৫। আশা করি আমার ইন্দোনেশিয়া দ্রুত স্বাভাবিক হবে।”

খাগড়াছড়ির মহাজনপাড়ার রাতের দৃশ্য দাবিতে ইন্দোনেশিয়ার ঘটনা প্রচার
মারতাপুরাপেডিয়া নামের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টের ভিডিও

ভিডিও ধারণের স্থানটির সঠিক অবস্থান যাচাই করতে সেখানে দেখতে পাওয়া কয়েকটি স্থাপনার কিফ্রেম নিয়ে তা রিভার্স ইমেজ সার্চ করে ডিসমিসল্যাব। এতে ভিডিওটিতে থাকা তোরণের মতো হুবহু একটি ছবি খুঁজে পাওয়া যায় শাটারস্টক নামের ছবি বেচাকেনার ওয়েবসাইটে। ছবিটির ক্যাপশনে লেখা, “সোলো, সুরাকারতা, ইন্দোনেশিয়া – ২৯ জুলাই ২০২৫। রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেলে ‘জালান সলামেত রিয়াদি’ সড়কের সংযোগস্থলে অবস্থিত ‘নাগারসোপুরো’ ফটকের পেছন দিক থেকে সোলো শহরের কেন্দ্রস্থলের দৃশ্য।”

পরবর্তীতে স্থানগুলোর নাম গুগল ম্যাপে সার্চ করা হয়। গুগল ম্যাপের স্ট্রিট ভিউ থেকে দেখা যায়, ভিডিওতে দেখানো একাধিক স্থাপনা, নকশা ও দৃশ্যের সঙ্গে নাগারসোপুরো ফটক ও এর আশেপাশের ভবন, স্থাপনা ও শিল্পকর্মের হুবহু মিল রয়েছে।

অর্থাৎ, ভিডিওতে দেখানো স্থানটি খাগড়াছড়ির মহাজন পাড়ার নয়, বরং ইন্দোনেশিয়ার কোটা সুরাকারতা শহরের নাগারসোপুরো নাইট মার্কেট নামক একটি জায়গার।

প্রসঙ্গত, গত ২৩ সেপ্টেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়িতে একজন মারমা কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে জেলা সদর ও গুইমারা উপজেলায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে স্থানীয় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানা যায় চলমান সহিংসতায় এখন পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া উপজেলাটিতে ১৩ সেনাসদস্য ও ৩ পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছে।

আরো কিছু লেখা