তৌহিদুল ইসলাম রাসো

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৫
১৬:৪৮:১৮
যাচাই করা ভুল তথ্য বিজ্ঞাপন আকারে চলছে মেটায়

যাচাই করা ভুল তথ্য বিজ্ঞাপন আকারে চলছে মেটায়

সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৫
১৬:৪৮:১৮

তৌহিদুল ইসলাম রাসো

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

ফেসবুকে ভুয়া দাবিতে শেয়ার করা একটি ভিডিও নিয়ে গত ১১ সেপ্টেম্বর যাচাই প্রতিবেদন প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। পরে একই ভিডিও মিথ্যা দাবিতে ছড়ানো হচ্ছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেশের একাধিক তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান। তবে সপ্তাহখানেক পর সেই একই ভিডিও একই ভুল দাবিতে বিজ্ঞাপন আকারে প্রচারিত হতে দেখা যাচ্ছে মেটায় বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে। প্রতিষ্ঠানটির নীতিমালায় বলা হয়েছে, থার্ড পার্টি ফ্যাক্টচেকারদের দ্বারা কোনো কন্টেন্ট মিথ্যা প্রমাণিত হলে সেটা বিজ্ঞাপন আকারে চলতে পারবে না। তবে এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যাচাই করা ভিডিওটি প্রায় তিন দিন ধরে বিজ্ঞাপন হিসেবে চলছে।

গত ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ভুল দাবির ভিডিওটি বিজ্ঞাপন আকারে প্রচারিত হচ্ছে “হিন্দুজ অব বাংলাদেশ” নামের একটি পেজ থেকে। এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত বিজ্ঞাপনটি সচল ছিল। এর বিবরণে লেখা হয়েছে, “গাজীপুরে বাড়ি ফেরার পথে এক বাবাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে তার মেয়েকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ভুক্তভোগীরা হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য।” এছাড়া #নিউজ ও #অ্যাওয়ারনেস শব্দদুটি হ্যাশট্যাগ হিসেবে যোগ করা হয়েছে। আর ১ মিনিট ১৭ সেকেন্ডের ভিডিওতে সম্পাদনা করে ইংরেজিতে লেখা “বাবাকে বেঁধে রেখে, হিন্দু মেয়েকে গণধর্ষণ।” ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, এক নারী রাস্তায় বসে কান্না করছে। আশেপাশে দাড়ানো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তার নাম, বাবার নাম, বাড়ি কোথায়, ও কার সঙ্গে এসেছেন তা জিজ্ঞেস করছেন।

মেটা অ্যাড লাইব্রেরিতে ভুয়া তথ্য সম্বলিত বিজ্ঞাপন

ভিডিওটি নিয়ে গত ১১ সেপ্টেম্বর ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। যাচাইয়ে দেখা যায়, ঘটনাটি গাজীপুরের নয়, রংপুরের তারাগঞ্জের। এখানে কোনো নারী গণধর্ষণের শিকার হওয়ারও কোনো প্রসঙ্গ ছিল না। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনের বরাতে ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভিডিওটি এক মাস আগে রংপুরের তারাগঞ্জে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার।

ডিসমিসল্যাবের ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন

একই সময়ে দেশের আরও দুটি ফ্যাক্টচেক প্রতিষ্ঠান, রিউমর স্ক্যানারফ্যাক্টওয়াচ ঘটনাটি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এদের মধ্যে ফ্যাক্টওয়াচ হচ্ছে মেটার থার্ড পার্টি ফ্যাক্টচেক পার্টনার, যারা মেটা প্লাটফর্মে ভুয়া দাবিতে ছড়ানো কন্টেন্ট শনাক্ত করে থাকে। এই ঘটনার ক্ষেত্রেও ফেসবুকের কিছু পোস্ট বিভ্রান্তিকর বলে শনাক্ত করেছে তারা।

ফ্যাক্টওয়াচ তাদের প্রতিবেদনে একই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণে জানায়, গাজীপুরে আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যাওয়ার পথে রাস্তায় গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক নারী দাবিতে ছড়ানো পোস্টগুলো “বিভ্রান্তিকর।” গত আগস্ট মাসে রংপুরের তারাগঞ্জে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার ভিডিওকে ভিন্ন দাবিতে ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বরাতে ফ্যাক্টওয়াচ জানায়, চলতি বছরের ৯ আগস্ট রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় ভ্যানচোর সন্দেহে দুই ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। মিঠাপুকুরের শ্যামপুর এলাকার রুপলাল দাসের মেয়ে নুপুর দাসের বিয়ে ঠিক করতে রোববার আত্মীয় প্রদীপ দাস ভ্যানে করে রওনা দেন। পথ না চেনায় তিনি রুপলালকে ফোন করলে দুজনে একসঙ্গে ভ্যানে করে রওনা হন। রাত ৯টার দিকে তারাগঞ্জ-কাজীরহাট সড়কের বটতলায় পৌঁছালে স্থানীয় লোকজন তাদের ভ্যানচোর সন্দেহে আটকায়। এরপর চুরির অভিযোগে বেধড়ক মারধর করে বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে তাদের ফেলে রাখা হয়। পুলিশ উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে রুপলাল দাসকে মৃত ঘোষণা করা হয়। প্রদীপ দাসকে রংপুর মেডিকেলে ভর্তি করলে তিনিও পরদিন ভোরে মারা যান।

অর্থাৎ, ভুক্তভোগীরা হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য হলেও এর সঙ্গে ধর্ষণের কোনো ঘটনা ঘটেনি এবং এটি গাজীপুরেরও কোনো ঘটনা নয়। ভিন্ন ঘটনার ভিডিও ভুয়া দাবিতে ধর্ষণের ঘটনা বলে ছড়ানো হচ্ছে, যা আগেই ফ্যাক্টচেক করা হয়েছে।

ফ্যাক্টচেক হওয়া তথ্য বিজ্ঞাপন হিসেবে মেটায় চলতে পারে কি না তা যাচাইয়ে দেখা যায়, মেটা বলছে বিজ্ঞাপনগুলোকে মিসইনফরমেশনের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলতে হবে। বিস্তারিত অংশে প্রতিষ্ঠানটি জানাচ্ছে, “বিজ্ঞাপনদাতারা এমন বিজ্ঞাপন চালাতে পারবেন না যেটা থার্ড পার্টি ফ্যাক্টচেকাররা ভুল হিসেবে চিহ্নিত করে বা যা আমাদের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড লঙ্ঘন করে।”

ফ্যাক্টচেক হওয়া তথ্য বিজ্ঞাপন হিসেবে চলতে পারে কি না তা নিয়ে মেটার পলিসি

ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং থ্রেডসে ফ্যাক্ট-চেকিং সম্পর্কে মেটা আরও জানায়, “কোনো ফ্যাক্টচেকার যদি কোনো কন্টেন্টকে ভুল (False), বিকৃত (Altered), অথবা আংশিক ভুল (Partly False) হিসেবে রেট করে, তবে সেটির প্রচার মেটা প্লাটফর্মে কমিয়ে দেওয়া হবে। এ ধরনের কন্টেন্ট এবং যেগুলোকে ফ্যাক্টচেকাররা প্রসঙ্গবিহীন (Missing Context) হিসেবে রেট করে, সেগুলোকে সুপারিশকৃত কনটেন্ট থেকে বাদ দেওয়া হবে। ফলে কম মানুষ এগুলো দেখতে পাবে।” এছাড়া ফ্যাক্টচেকারদের রেট করা এ ধরনের কন্টেন্টযুক্ত বিজ্ঞাপন প্রত্যাখ্যান করে বলেও জানায় মেটা। 

এই পলিসিগুলো থাকা সত্বেও তা লঙ্ঘন করে, যাচাইকৃত ভুয়া ভিডিও মেটার চারটি প্ল্যাটফর্মে (ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, অডিয়েন্স নেটওয়ার্ক ও ম্যাসেঞ্জার) প্রচারিত হচ্ছে বিজ্ঞাপন আকারে। বিজ্ঞাপনটি চালানো হয়েছে “হিন্দুজ অব বাংলাদেশ” নামের একটি পেজ থেকে। এটি খোলা হয়েছে চলতি বছরের ২১ জুনে। যোগাযোগের ঠিকানায় ঢাকার একটি জায়গার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তবে পেজটির অ্যাডমিনের অবস্থান কোথায়– তা জানতে গিয়ে দেখা যায়, পেজটি পরিচালনা করছেন ৪ জন ব্যক্তি, যাদের সবার অবস্থান ভারতে।

আরো কিছু লেখা