পার্থ প্রতীম দাস
তৌহিদুল ইসলাম রাসো
তৃতীয় প্রান্তিকের প্রবণতা বিশ্লেষণ
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রভাবে বেড়েছে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ভুল তথ্য
পার্থ প্রতীম দাস
তৌহিদুল ইসলাম রাসো
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে বাড়তে দেখা গেছে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা। ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে প্রকাশিত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র দেখতে পেয়েছে ডিসমিসল্যাব। এই প্রবণতার পেছনে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন, যা শেষপর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অধীনে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
২০২৪ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত— যে সময়টিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা সবচেয়ে বেশি ছিল— আটটি ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা মোট ৯১৭টি স্বতন্ত্র ভুল তথ্য যাচাই করেছে। এসবের মধ্যে রাজনৈতিক ভুল তথ্য ছিল সবচেয়ে বেশি, যা তৃতীয় প্রান্তিকে যাচাই করা মোট স্বতন্ত্র ভুল তথ্যের ৪২%। এটি আগের প্রান্তিকের তুলনায় প্রায় তিনগুণ এবং প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এই সময়ে ধর্মীয় ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রবণতাও বেড়েছে, যা ছিল মোট যাচাইকৃত ভুল তথ্যের ১২%।
এই সময়ে রাজনৈতিক ভুল তথ্য প্রধানত দুটি পক্ষকে লক্ষ্য করে ছড়ানো হয়েছে: ড. ইউনূস এবং তার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, এবং শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। কখনো কখনো এসব ভুল তথ্যের মাধ্যমে তাদের ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে আবার কখনো কখনো নিন্দা প্রচার করা হয়েছে, যা জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও মেরুকরণের দিকে নিয়ে গেছে। উভয়পক্ষকে জড়িয়েই ছড়ানো হয়েছে বিভিন্ন মিথ্যা দাবি, যেগুলো প্রায়ই প্রচারিত হয়েছে মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের অনুকরণ করে তৈরি করা ভুয়া গ্রাফিক কার্ডের মাধ্যমে। অপরদিকে, ধর্মীয় ভুল তথ্যের অন্যতম বিষয় ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন ও হামলার দাবিতে ছড়ানো ভুল তথ্য, যার বেশিরভাগই এসেছে বাংলাদেশের বাইরের উৎস থেকে।
রাজনৈতিক ভুল তথ্যের প্রবণতা এবং লক্ষ্য
জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, বাংলাদেশি ফ্যাক্টচেকাররা বিপুল পরিমাণ ভুল তথ্যের মুখোমুখি হয়েছেন, যার ফলে এ সময়ে রেকর্ড ১,৩৪৫টি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ৯১৭টি ছিল স্বতন্ত্র ঘটনা। সংসদ নির্বাচনের আগের প্রান্তিকের (অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০২৩) তুলনায় এবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে স্বতন্ত্র ভুল তথ্যের পরিমাণ বেড়েছে ৩২%।
উপরের চার্টটি দেখায় যে জুন মাসে বিক্ষোভ বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে ভুল তথ্যে ছড়ানোর হার বাড়তে শুরু করে, এরপরে জুলাইয়ের মাঝামাঝি ইন্টারনেট বন্ধ এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে সাময়িকভাবে কমে যায়। আগস্টে হাসিনা সরকারের পতন ও নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর এটি আবার বাড়তে শুরু করে এবং সেপ্টেম্বর মাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। সামগ্রিকভাবে অপতথ্য বৃদ্ধির প্রধান কারণ রাজনৈতিক ভুল তথ্য, যা তৃতীয় প্রান্তিকে মোট স্বতন্ত্র ফ্যাক্টচেকের ৪২%। আগের প্রান্তিকে যে সংখ্যাটি ছিল ২৫%।
রাজনৈতিক ভুল তথ্য মূলত রাজনৈতিক অঙ্গনের দুটি পক্ষকে লক্ষ্যবস্তু করেছে: শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ, যা মোট অপতথ্যের ৩৬% এবং ড. ইউনূস, তার অন্তর্বর্তী সরকার ও ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের নিয়ে, যা ৩৫%। স্বাভাবিক সময়ে ভুল তথ্যের একটি সাধারণ লক্ষ্য হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি) নিয়ে অপতথ্য ছড়ানোর মাত্রা ৮%-এ নেমে এসেছে, অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী এবং এর ছাত্র সংগঠনকে লক্ষ্য করে ভুল তথ্যের পরিমাণ বেড়ে ১১%-এ পৌঁছেছে, যা রাজনৈতিক ভুল তথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে পরিবর্তন নির্দেশ করে।
আলোচনার কেন্দ্রে ড. ইউনূস ও শেখ হাসিনা
ব্যক্তি হিসেবে, রাজনৈতিক ভুল তথ্যের প্রধান লক্ষ্য ছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস, এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মোট রাজনৈতিক ভুল তথ্যের ১৪% করে ছড়িয়েছে এই দুজনকে লক্ষ্য করে। তবে তাদের লক্ষ্য করে ছড়িয়ে পড়া ভুয়া তথ্যের ধরন একই রকম ছিল না। কিছু ভুল তথ্যে যেমন তাদের নিন্দা করা হয়েছে তেমনি অন্য ক্ষেত্রে মিথ্যাভাবে তাদের প্রশংসাও করা হয়েছে।
এই লক্ষ্যবস্তুর বিষয়টি বিশ্লেষণের জন্য, ডিসমিসল্যাব ভুল তথ্যের ভাষ্যগুলোকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে: ‘নেতিবাচক’ এবং ‘ইতিবাচক বা নিরপেক্ষ।’ এই শ্রেণিবিন্যাসে ব্যক্তিগত পক্ষপাতদুষ্টতা এড়ানোর জন্যে তিনজন আলাদা গবেষক স্বতন্ত্রভাবে এটি পর্যালোচনা করেছেন এবং একটি সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে, এই ব্যক্তিদের কেন্দ্র করে ছড়ানো ভুল তথ্যের ভাষ্যে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে: শেখ হাসিনার সম্পর্কে প্রায় অর্ধেক (৪৯%) ভুল তথ্য ইতিবাচক বা নিরপেক্ষ ছিল, অন্যদিকে ড. ইউনূসের ক্ষেত্রে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (৬৫%) বর্ণনা নেতিবাচক ছিল। এটি দেখায় যে কীভাবে ভুল তথ্য তাদের প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে প্রভাব ফেলতে চেয়েছে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ এই তিন মাসের সময়কালে, শেখ হাসিনাকে ঘিরে ছড়ানো ভুল তথ্যের ভাষ্যগুলো রাজনৈতিক ঘটনাবলী পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। জুলাই মাসে, যখন হাসিনা একটি কঠিন বিক্ষোভের মুখোমুখি হন, তখন ভুল তথ্য প্রধানত তার ক্ষমতার স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। নেতিবাচক ভাষ্যগুলো সামরিক বাহিনী এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার চাপের কথাও উল্লেখ করে। যেমন দাবিগুলো ছিল “নতুন সেনাপ্রধান শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে বলেছেন,” “জাতিসংঘ শেখ হাসিনার সরকারকে কোটা আন্দোলনের কারণে অপসারিত করার হুমকি দিয়েছে,” এবং তিনি “কোটা আন্দোলনের মধ্যে দেশের বাইরে যাচ্ছেন।”
আগস্টে নেতিবাচক ভাষ্যগুলো আরও বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্বাস্থ্য সম্পর্কিত গুজব এবং দেশ ছেড়ে চলে যাবার মিথ্যা পরিকল্পনাগুলো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, যাতে তার ক্ষমতা এবং নির্বাসিত নেত্রী হিসেবে বৈধতার ওপর সন্দেহ তৈরি হয়। যেমন “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হার্ট অ্যাটাক,” তার ছেলে “দাবি করছে শেখ হাসিনা মারা গেছেন” বা “নরেন্দ্র মোদী হাসিনাকে ভারত ছাড়তে বলেছেন”। এ ধরনের ভুল তথ্যগুলোর মাধ্যমে তাকে দুর্বল এবং একাকী হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা দেখা যায়।
সেপ্টেম্বরে এসে বিভিন্ন ভুল তথ্যে তাকে এমন একজন নেতা হিসেবে চিত্রিত করার প্রবণতা দেখা যায় যিনি বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে তিনি ভারতে ছিলেন এবং বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাজ করতে শুরু করেছে। সামাজিক মাধ্যমের পোস্টগুলোতে দাবি করা হয় যে তাকে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি জানানো হয়েছে। ভুয়া দাবিতে বলা হয়, “শেখ হাসিনা বিশ্বের তৃতীয় সৎ সরকারপ্রধান হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন,” “জাতিসংঘ শেখ হাসিনাকে আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দাবি করেছে” বা তিনি “জাতিসংঘে ভাষণ দিতে নিউ ইয়র্কে এসে পৌঁছেছেন,” এমন মিথ্যা দাবিও ছড়িয়েছে যে তার দ্রুত দেশে ফেরার সম্ভাবনা রয়েছে (১, ২), বা তিনি ভারত থেকে ভাষণ ও সাক্ষাৎকার দিয়েছেন (১, ২, ৩)।
জুলাইয়ে অনুপস্থিত থাকলেও, আগস্ট মাস থেকে রাজনৈতিক ভুল তথ্যের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠেন ড. ইউনূস। কিছু ভাষ্যে তাকে সংস্কার ও সততার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করেছে। ভুল তথ্যের মাধ্যমে দাবি করা হয়েছে যে তিনি “প্রবাসীদের লাশ বিনা খরচে দেশে আনবেন,” বা তার ক্ষমতায় আসার পর ঢাকার বিমানবন্দরে “যাদুকরি পরিবর্তন” হয়েছে। কিছু ভুল তথ্যের মাধ্যমে তাকে মিথ্যাভাবে প্রশংসিত করা হয়েছে “বিশ্বের একমাত্র নোবেল বিজয়ী সরকারপ্রধান” হিসেবে এবং এমন ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে তিনি পরবর্তী ছয় বছর ধরে ক্ষমতায় থাকবেন।
একই সময়ে নেতিবাচক দাবিও প্রচারিত হয়েছে। ড. ইউনূসকে জড়ানো হয়েছে আর্থিক ও ব্যবসায়িক বিতর্কের সঙ্গে। যেমন ইসরায়েলের সঙ্গে তার আর্থিক সম্পর্ক রয়েছে কিংবা এমন মিথ্যা দাবি যে “গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের কোনো কিস্তি দিতে হবে না।” এসব দাবি ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তা ছড়াতে পারে। রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি করতে পারে– এমন ভুল ভাষ্যও ছড়ানো হয়েছে তাকে জড়িয়ে। যেমন বলা হয়েছে যে, বিএনপি নেতারা ইউনূসের পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছেন কারণ তিনি বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে বাধা দেবেন, যা তার সম্ভাব্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহকে উস্কে দিয়েছে।
সেপ্টেম্বরে ড. ইউনূসকে নিয়ে অপতথ্যের বিস্তার আরও তীব্র হয়ে ওঠে এবং ভুল তথ্যের ভাষ্যগুলো ক্রমশ মেরুকরণের দিকে চলে যায়। একইসঙ্গে ইউনূসকে বিভিন্ন প্রগতিশীল উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত জনপ্রিয় নেতা এবং রক্ষণশীল মূল্যবোধের ব্যক্তিত্ব হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। যেমন এমন দাবি ছড়ানো হয় যে, তার সরকার পরিকল্পনা করছে “বিনামূল্যে দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হবে,” “প্রতিটি পরিবারের একজন সদস্যের জন্য সরকারি চাকরি নিশ্চিত করা,” এবং “শিক্ষার্থী বা বেকারদের ভাতা দেওয়া হবে”।
অন্যদিকে, কিছু ভাষ্যে তাকে উপস্থাপন করা হয় রক্ষণশীল ধর্মীয় মতাদর্শের সমর্থক হিসেবে। যেমন তিনি “জাতীয় সংগীতের চেয়ে সূরা ফাতিহাকে পছন্দ করেন,” তিনি “আলেমদের ভালোবাসেন এবং তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে চান,”তিনি তার অফিসে কালিমার (ইসলামী ধর্মের বিশ্বাস) একটি ব্যানার টানিয়ে রেখেছেন।” এছাড়া তিনি বিশ্বাস করেন যে “বেকার মহিলাদের কাজ করার পরিবর্তে বিয়ে করা উচিত,” এবং তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন “মসজিদ ও মাদ্রাসার জন্য বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দেবেন।”
ইউনূস পদত্যাগ করছেন বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চাপের মুখে পড়ছেন– এ ধরনের ভাষ্যও ছড়াতে দেখা যায় সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে। যেমন “তিনি দেশে ফিরছেন না,” “পদত্যাগ করেছেন,” “তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তার করা হয়েছে,” “তার জাতিসংঘের ভাষণ বাতিল করা হয়েছে,” এবং “রাশিয়া জাতিসংঘে তার বক্তৃতায় আপত্তি জানিয়েছে”—এইসব দাবি তাকে এমন এক নেতা হিসেবে উপস্থাপন করেছে, যিনি তীব্র চাপের মধ্যে রয়েছেন।
ধর্মীয় ভুল তথ্য বেড়েছে
বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে, রাজনীতির পরে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে ধর্ম বিষয়ে, যা ছিল মোট স্বতন্ত্র ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনের ১২%। ডেটা অনুযায়ী, এবছরের প্রতি প্রান্তিকেই ধর্মীয় ভুল তথ্যের পরিমাণ বেড়েছে। আগস্টের শুরুতে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলার দাবিতে বেশ কিছু ধর্মীয় ভুল তথ্য (১, ২, ৩, ৪) ছড়াতে দেখা গেছে। পুরোনো বা সম্পর্কহীন ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করে ঘটনাগুলো সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে এক্সে (পূর্বের টুইটার)। ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন সূত্রে দেখা যায় যে এই ধরনের ভুল তথ্য শেয়ার করা বেশিরভাগ অ্যাকাউন্ট পরিচালিত হয় ভারত থেকে। ধর্মীয় আঙ্গিকের বিভিন্ন মিথ্যা বক্তব্য-বিবৃতিও প্রচারিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা এবং বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের নামে।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতাদের সম্পত্তির ওপর হামলা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতার খবর পাওয়া যায়। তবে এ সময়ে পুরোনো ছবি ও ভিডিও সাম্প্রতিক ঘটনার মিথ্যা উপস্থাপনায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, যার মধ্যে ৭ আগস্টে এক্সে শেয়ার করা একটি ভিডিও রয়েছে, যেখানে হিন্দু মালিকানাধীন দোকানগুলো আগুনে পুড়ছে বলে দাবি করা হয়েছিল, তবে ফ্যাক্টচেক করে দেখা যায় যে সেটি অন্তত এক মাস পুরোনো; আবার সাতক্ষীরায় একটি রেস্টুরেন্টের আগুনকে মন্দিরে হামলা হিসেবে উপস্থাপন করা হয় এবং চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনাকে জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক হিন্দুদের ওপর হামলা বলে শেয়ার করা হয়।
এছাড়াও দেখা গেছে বিভিন্ন ভুয়া উদ্ধৃতি। যেমন ধর্ম উপদেষ্টার বরাতে হজ এবং ওমরাহর খরচ কমানোর কথা বলা হয়, এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলমের একটি ভুয়া উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে যে তিনি কোরআনকে সংবিধান করে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় আরও মিথ্যা দাবি করা হয়েছিল যে বাংলাদেশ পুলিশের লোগো পরিবর্তন করে নৌকা প্রতীকের জাযগায় আল্লাহর নাম যুক্ত করা হয়েছে। এই বর্ণনাগুলো ধর্মীয় উত্তেজনা কাজে লাগিয়ে সরকার পরিবর্তনের পর সাম্প্রদায়িক বিভেদের চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছে।
ভুল তথ্য ছড়ানোর মাধ্যম
বাংলাদেশে সাধারণত ভুল তথ্য বেশি ছড়াতে দেখা যায় ভিডিও আকারে। এবছরের তৃতীয় প্রান্তিকেও ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রধান বাহক ছিল ভিডিও। মোট স্বতন্ত্র ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনের ৩১% ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এসব ভুল তথ্য ছড়িয়েছে ভিডিওর মাধ্যমে। তবে এই সংখ্যাটি গত দুই প্রান্তিকের তুলনায় অনেকটাই কমে এসেছে। এবছরের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রান্তিকে ভিডিওর মাধ্যমে ছড়িয়েছিল যথাক্রমে ৪৪% ও ৪২% ভুল তথ্য। অন্যদিকে ক্রমেই বাড়তে দেখা গেছে গ্রাফিক কার্ডের মাধ্যমে ছড়ানো অপতথ্যের পরিমাণ। এবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে যেখানে মোট স্বতন্ত্র ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনের ১৩% গ্রাফিক কার্ডের মাধ্যমে ছড়িয়েছিল, সেখানে তৃতীয় প্রান্তিকে সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯%।
গ্রাফিক কার্ডের মাধ্যমে ছড়ানো এসব ভুল তথ্যের ৮১% ক্ষেত্রেই গণমাধ্যমের নাম-লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। সাধারণত গণমাধ্যমগুলো তাদের সামাজিক মাধ্যমের অ্যাকাউন্টে যে ধরনের গ্রাফিক কার্ডের মাধ্যমে সংবাদ প্রচার করে, সেগুলো সম্পাদনা করে ছড়ানো হয়েছে বিভিন্ন ভুয়া তথ্য। এবং এসব ভুয়া তথ্যের প্রায় অর্ধেকই (৪৯%) ছিল রাজনীতি বিষয়ক।
গবেষণা পদ্ধতি
এই বিশ্লেষণটি করা হয়েছে ২০২৪ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট আটটি ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে। সাইটগুলো হলো: রিউমর স্ক্যানার, বুমবিডি, নিউজচেকার, ফ্যাক্ট ক্রেসেন্ডো, ফ্যাক্ট ওয়াচ, এএফপি বাংলাদেশ, আজকের পত্রিকা এবং ডিসমিসল্যাব।
একাধিক সাইট একই বিষয়ে ভুল তথ্য খণ্ডন করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিষয়-ভিত্তিক ভুল তথ্যের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য এসব ক্ষেত্রে শুধু একটি সাইটের ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনকে স্বতন্ত্র বা ইউনিক নমুনা হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর তথ্যগুলোর বিষয় বা প্রসঙ্গ কী ছিল— তা দেখার জন্য এই ইউনিক ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনকে ভাগ করা হয়েছে ১৫টি বিভাগে- রাজনীতি, খেলাধুলা, স্বাস্থ্য, প্রকৃতি ও পরিবেশ, বিনোদন, জালিয়াতি, দুযোগ, ধর্ম, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, আইনশৃঙ্খলা, শিক্ষা, অর্থনীতি ও উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা, জননীতি ও অন্যান্য। আধেয় বিশ্লেষণ করে অপতথ্যের টার্গেট বা লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ব্যক্তি ও রাজনৈতিক শ্রেণীকে আলাদাভাবে নথিবদ্ধ করা হয়েছে।