ফাতেমা তাবাসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব
ফেসবুকের নীতিমালা ভেঙে চলছে দুই উপদেষ্টার ভুয়া অ্যাকাউন্ট; ছড়াচ্ছে ভুল তথ্য
This article is more than 1 month old

ফেসবুকের নীতিমালা ভেঙে চলছে দুই উপদেষ্টার ভুয়া অ্যাকাউন্ট; ছড়াচ্ছে ভুল তথ্য

ফাতেমা তাবাসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বাংলাদেশে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে, তার অন্যতম দুই উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও নাহিদ ইসলাম। কোটা সংস্কার আন্দোলনের এই দু্ই সমন্বয়ক নিয়েছেন একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। এরপর থেকে ফেসবুকে তাদের দুজনের নামে দেখা যাচ্ছে একাধিক ভুয়া অ্যাকাউন্ট। 

ডিসমিসল্যাব ফেসবুকে এই দুই উপদেষ্টার নামে পরিচালিত ১১১টি ভুয়া প্রোফাইল ও পেজ খুঁজে পেয়েছিল, যেগুলোতে ৫ হাজারের বেশি লাইক বা ফলোয়ার আছে। এর মধ্যে আসিফ মাহমুদের নামে পরিচালিত হতে দেখা গেছে ৯২টি ভুয়া অ্যাকাউন্ট যার মধ্যে ৬৮টি পেজ এবং ২৪ টি প্রোফাইল। অন্যদিকে নাহিদ ইসলামের নামে চলতে দেখা গেছে ৮টি প্রোফাইল ও ১১টি পেজ। এগুলোর মধ্যে অনেকগুলো বন্ধ হয়ে গেলেও ১ অক্টোবর অর্থাৎ এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত সক্রিয় আছে ৬৫টি পেজ-প্রোফাইল। এসবের বেশিরভাগই নতুন করে খোলা হয়েছে বা নাম পরিবর্তন করা হয়েছে ৫ আগস্টের পর। 

ভুয়া এসব প্রোফাইল বা পেজের কোনোটিতেই স্পষ্টভাবে প্যারোডি বা সমর্থনকারী হিসেবে উল্লেখ নেই, যেটি ফেসবুকের ইমপার্সোনেশন পলিসির সরাসরি লঙ্ঘন। ১৫ আগস্ট থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ভুয়া প্রোফাইল ও পেজগুলোর পোস্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায় সেগুলো থেকে শতাধিক ভুয়া বা বিভ্রান্তিকর তথ্য, ছবি-ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে। ফেসবুকে এই দুই উপদেষ্টার আসল অ্যাকাউন্টগুলোতে (আসিফ, নাহিদ) বর্তমানে ভেরিফায়েড নীল ব্যাজ দেখতে পাওয়া যায়।

ভুয়া উদ্ধৃতি

আসিফ ও নাহিদের নামে পরিচালিত এসব ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ছড়াতে দেখা গেছে বেশ কিছু ভুয়া উদ্ধৃতি। যেমন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বরাত দিয়ে বলা হয়েছিল যে, ইমাম, মুয়াজ্জিনের বেতন নিয়ে আলোচনা চলছে; বেকার ভাতা চালু হচ্ছে বা কোরআনের মাহফিল করতে কোন প্রশাসন বা কারো অনুমতির প্রয়োজন নেই। নাহিদ ইসলামের নামে তৈরি একটি অ্যাকাউন্ট থেকে বলা হয়েছিল,‍‍‌‌‌‌ “এখন থেকে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হতে হলে মাস্টার্স পাস হতে হবে।” যদিও ড. ইউনূস বা নাহিদ এ ধরনের কোনো বক্তব্যই দেননি।

আসিফের নামে আলেমদের সমর্থনে একাধিক ভুয়া উদ্ধৃতিও প্রচারিত হতে দেখা গেছে এসব অ্যাকাউন্ট থেকে। যেমন বলা হয়েছে, “আমার বাবা আলেম। আমি আলেমদের ভালোবাসি” বা আলেমদের পরামর্শ ছাড়া দেশ চলবেনা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলমের নামে একটি ভুয়া উদ্ধৃতি ছড়াতে দেখা গিয়েছিল সমকামীদের নিয়ে। যেখানে দাবি করা হয়েছিল যে, সারজিস বলেছেন, “এবার আমার র*ক্তচক্ষুর চাহনি, সম*কামীদের জন্য। কোথায় পালিয়ে যাস,দেখবো”। এই ভুয়া উদ্ধৃতিটি আসিফের নামে খোলা একটি অ্যাকাউন্ট থেকেও প্রচারিত হতে দেখা গেছে। 

এছাড়াও ইসলামী বক্তা মিজানুর রহমান আজহারী, ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামেও কিছু ভুয়া উদ্ধৃতি প্রকাশিত হতে দেখা গিয়েছিল উপদেষ্টাদের নামে খোলা এসব ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে। তবে সেসব পেজ/প্রোফাইল এখন আর দেখা যাচ্ছে না। 

মণিপুরের সহিংসতা নিয়ে ভুয়া তথ্য

গত সেপ্টেম্বরে, ভারতের মণিপুরে সংঘর্ষ-সহিংসতার সময় এ বিষয়ে ভুল তথ্য ছড়াতে দেখা গেছে উপদেষ্টাদের নামে পরিচালিত ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে। যেমন, কিছু পোস্টে (, , ) বলা হয়েছিল, “ভারতের পতাকা নামিয়ে সেভেনসিস্টার এর পতাকা উত্তোলন করছে ছাত্র জনতা”। যদিও রিউমার স্ক্যানার তাদের যাচাই প্রতিবেদনে জানায়, জাতীয় পতাকা নয়, ভারতের মণিপুরের শিক্ষার্থীরা সালাই টারেট পতাকা খুলে নিয়েছিল যা মণিপুরের মেইতেই জাতির সাতটি গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে।

আরও কিছু পোস্টে (, , ) দাবি করা হয়েছিল যে, চীন ভারতের ৬০ কিলোমিটার এলাকার দখল নিয়েছে। যদিও বিষয়টি সত্য নয় বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল গণমাধ্যমে। আরেকটি ভিডিও শেয়ার করে বলা হয়েছিল, “মণিপুরের স্বাধীনতাকামীরা ভারতীয় হেলিকপ্টার ভূপাতিত করেছে।” যদিও ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা যায়, ভিডিওটি আসলে ছিল মিয়ানমারের। 

বন্যা নিয়ে ভুল তথ্য

গত আগস্টে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে বন্যার সময় বেশ কিছু ভুয়া তথ্য ছড়াতে দেখা যায় এই দুই উপদেষ্টার নামে পরিচালিত ফেসবুক অ্যাকাউন্টগুলো থেকে। সেসময় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) টুল দিয়ে তৈরি বেশ কিছু ছবি ছড়াতে দেখা গিয়েছিল সামাজিক মাধ্যমে। সেগুলো শেয়ার করা হয়েছিল উপদেষ্টাদের নামে তৈরি অ্যাকাউন্টগুলো থেকেও। যেমন, আসিফ মাহমুদের নামে পরিচালিত অ্যাকাউন্ট থেকে এমন একটি ছবি পোস্ট করে বলা হয়েছিল, “এটা কোন মুভির দৃশ্য না, বাস্তব দৃশ্য..”। এমন আরও অন্তত ৫টি এআই নির্মিত ছবি-ভিডিও (, , , , ) সেসময় ছড়াতে দেখা গেছে এসব ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে। 

এছাড়াও এগুলো থেকে ছড়িয়েছে বন্যা-কেন্দ্রিক আরও বেশ কিছু পুরোনো বা অপ্রাসঙ্গিক ছবি-ভিডিও (, , , , , )। আর এসব নিয়ে সে সময়ে ডিসমিসল্যাবসহ (, , ) অন্যান্য ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকাশ করেছে একাধিক ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন (, , )।

ছড়ানো হয়েছে বিদ্বেষও

ভুয়া তথ্য ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে বিদ্বেষমূলক নানা পোস্টও দিতে দেখা গেছে এসব অ্যাকাউন্ট থেকে। যার মধ্যে ভারত বিরোধীতা ছিল অন্যতম। ভারত বিদ্বেষ মানেই দেশপ্রেমী, ভারত বিদ্বেষ দেশপ্রেমের সমানুপাতিক, আপনার সন্তানকে ভারত বিদ্বেষী বানান– এ ধরনের বক্তব্য দেখা গেছে বেশ কিছু পোস্টে (, , , )। কোনো কোনো পোস্টে (, , , ) ভারতকে ঘোষণা করা হয়েছে চির শত্রু বা প্রকাশ্য শত্রু হিসেবে। বাংলাদেশের পোশাক খাতে ভারতের কুনজর পড়েছে– এমন মন্তব্য করে সতর্ক হওয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছে কিছু পোস্টে (, )।

বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সম্প্রতি মাজারে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা দেখা গেছে। মাজার সংস্কৃতির বিরোধীতা করেও পোস্ট করা হয়েছে দুই উপদেষ্টার নামে তৈরি করা অ্যাকাউন্টগুলো থেকে। একটি পোস্টে বলা হয়েছে, মাজারগুলো “মদ গাজা আর শির্কের আস্তানা” আরেকটি পোস্টে একটি মাজার ভাঙার ভিডিও পোস্ট করে বলা হয়েছে, “ভন্ডের মাজার এই দেশে থাকবে না।” একই সময়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও উপদেষ্টা আসিফের নামে মাজার নিয়ে ভুয়া উদ্ধৃতি প্রচার করতে দেখা যায়। আসিফ মাহমুদের নামে পরিচালিত একটি পেজ থেকেও ইউনূসের নামে প্রচারিত এই ভুয়া দাবিটিও শেয়ার করা হয়। যদিও পরবর্তীতে পেজটি সরিয়ে ফেলা হয়। এ ঘটনা দুটিকে কেন্দ্র করে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনও (, ) প্রকাশ করে রিউমার স্ক্যানার। 

“দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাজার ভাঙ্গার ঘটনাগুলো কেন ঘটছে? কারা ঘটাচ্ছে?” শীর্ষক বিবিসির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থানে মাজার ভাঙার ঘটনা ঘটছে। বিবিসি জানায়, এসব ঘটনায় হামলা, অগ্নিসংযোগ এবং আহত হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।

রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার

ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী এবং এর ছাত্র সংগঠন, ছাত্রশিবিরের সমর্থনে বেশ কিছু পোস্ট (, , , , , ) দিতে দেখা গেছে আসিফের নামে খোলা অন্তত দুইটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে। যেগুলোর কোথাও বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল গুলোর উচিৎ জামাত ইসলামি থেকে রাজনৈতিক শিষ্টাচার শিক্ষা নেয়া।” বা “ছাত্রশিবির নামক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আপনার ছেলেকে ভর্তি করে দিন! সে নামাজী,বিনয়ী,ভদ্র নেশামুক্ত ও জাতীয় সম্পদ হবে।” একটি পোস্টে বলা হয়েছে, “ক্ষমতা লাগবে না যতদিন বেঁচে থাকবো জামায়েত ইসলামী করবো ইনশাআল্লাহ।”

ফেসবুকের নীতিমালা লঙ্ঘন

দুই উপদেষ্টার নামে তৈরি এসব ভুয়া অ্যাকাউন্ট পরিচালিত হচ্ছে ফেসবুকের নীতিমালা লঙ্ঘন করে। প্ল্যাটফর্মটির অনুকরণ সংক্রান্ত নীতিমালায় বলা হয়েছে, “প্রোফাইলে আপনি এমন কারো নাম ও ছবি ব্যবহার করতে পারবেন না, যা দেখে অন্যরা বিশ্বাস করে বিভ্রান্ত হয় যে, সেটি সত্যিই কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির প্রতিনিধিত্ব করে।” 

আসিফ ও নাহিদের নামে পরিচালিত ভুয়া অ্যাকাউন্টগুলো আসলেও অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারীকে বিভ্রান্ত করছে। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া পোস্টগুলো সত্যিই দুই উপদেষ্টার কাছ থেকে আসছে বলে বিভ্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। পোস্টের কমেন্টে অনেকে উপদেষ্টাদের কাছে নানাবিধ দাবিদাওয়া তুলে ধরেছেন, ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বা সাধুবাদ জানিয়েছেন।

পেজগুলো কী উদ্দেশ্যে চালানো হচ্ছে– তা জানতে কয়েকটি পেজের সঙ্গে থাকা ফোন নম্বরে কল দিয়ে যোগাযোগ করা হয়েছে ডিসমিসল্যাবের পক্ষ থেকে। এমন একজন জানিয়েছেন যে, পেজটি তিনি তার এক বন্ধুকে দিয়ে দিয়েছিলেন। পরে ফলোয়ার বাড়ানোর জন্যই হয়তো নাম বদল করা হয়েছে। দেখা যায়, ২০২১ সালে পেজটি তৈরি করার পর ১১বার নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। পেজটির নাম আসিফ মাহমুদ হয়েছিল গত ১১ আগস্ট। এমন আরেকটি পেজের সঙ্গে থাকা ফোন নম্বরে কল দেওয়া হলে, তিনিও জানান যে, পেজের রিচ বা ফলোয়ার বাড়ানোর জন্যই এভাবে নাম পরিবর্তন করা হতে পারে। 

আরো কিছু লেখা