আহমেদ ইয়াসীর আবরার
বহির্বিশ্বের পুরোনো ভিডিও দুবাইয়ের বন্যার দৃশ্য দাবি করে প্রচার
আহমেদ ইয়াসীর আবরার
পানির তীব্র স্রোতে ভয়ংকরভাবে ভেসে যাচ্ছে শত শত গাড়ি। প্রবল ঝড়ে বহুতল দালানের অংশও উড়ে যাচ্ছে খড়কুটোর মতো। এমনকি অনেক উট আটকা পড়েছে খরস্রোতা পানিতে। এই রকম বেশকিছু ভিডিও দুবাইয়ের সাম্প্রতিক বন্যার দৃশ্য হিসেবে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। ডিসমিসল্যাব এমন বেশ কিছু ভিডিও পেয়েছে যেগুলো দুবাই বন্যার নয়। বিভিন্ন দেশের দুর্যোগের দৃশ্যকে দুবাইয়ের বন্যা হিসেবে দেখিয়ে অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে। এসব ভিডিও ছড়িয়ে দুবাইকে ‘পাপের শহর’ও বলছে কেউ কেউ।
১৬ এপ্রিল ২৪ ঘন্টার অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতে তলিয়ে যায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) বেশকিছু শহর। ৭৫ বছরে এটি বৃষ্টির সর্বোচ্চ রেকর্ড বলে জানাচ্ছে দেশটির গণমাধ্যম। এই দুর্যোগের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বিভিন্ন ভিডিও আসতে শুরু করে। ডিসমিসল্যাব ফেসবুকে কী-ওয়ার্ড সার্চ করে দেখেছে, অপ্রাসঙ্গিক বেশ কিছু ভিডিও দুবাইয়ের দাবি করে ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে।
“পাপের শহর দুবাইকে আল্লাহ বৃষ্টি দিয়ে বন্যায় ভাসায় দিলেন” ক্যাপশনসহ পোস্ট হওয়া একটি ভিডিও যাচাইয়ে দেখা যায় এটি ২০১১ সালে জাপানের ভূমিকম্প-পরবর্তী প্রলয়ঙ্করী সুনামির। গত ২১ এপ্রিলে ফেসবুকে পোস্ট হওয়া ভিডিওটিতে দেখা যায় ঘর, গাড়ি ও অসংখ্য কনটেইনার পানির স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। ভিডিওটি একাধিক ফেসবুক পেজ ও আইডি থেকে পোস্ট হতে দেখা যায় (১, ২, ৩, ৪)। ডিসমিসল্যাব রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে জাপানের গণমাধ্যম টিবিএস নিউজ ডিগের একটি ইউটিউব ভিডিও পায়। ভিডিওটির ১ মিনিট ৪০ সেকেন্ড থেকে যে ক্লিপটি দেখানো হচ্ছে তা দুবাইয়ের বলে চালানো ভিডিওটির সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। মূল ভিডিওর বর্ণনাতে বলা হয়েছে, নয়-মাত্রার ভূমিকম্পের পর তোহোকু এলাকায় যে সুনামি হয়েছিল তাতে ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। চ্যানেলটি বলছে দুর্যোগ নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি, সেই সঙ্গে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্মৃতি ধরে রাখতে তারা এই ফুটেজগুলো সংরক্ষণ করে রাখছে।
ভিডিওটি ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি জাপানে হয়ে যাওয়া সুনামির দৃশ্য- এমন তথ্য ছড়ালে কিছুদিন আগে ফিলিপাইনভিত্তিক ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা ভেরা ফাইলস এ নিয়ে ফ্যাক্টচেক করে। পরে তারা রিপোর্টে জানায়, দাবিটি ভিত্তিহীন।
অন্য একটি ভিডিও পাওয়া যায়, যাতে দুবাইয়ের বন্যার প্রকৃত দৃশ্যের সঙ্গে পুরোনো অন্য ঘটনার ভিডিও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে (১, ২, ৩)। শুরুতে একটি দৃশ্য পাওয়া যায় যা ২০২৩ সালের ২৫ নভেম্বরে পোস্ট হওয়া একটি টিকটক ভিডিওতেও পাওয়া যাচ্ছে। ভিডিওর ১২ সেকেন্ডে বুর্জ খলিফা টাওয়ারে বজ্রপাতের যে দৃশ্য রয়েছে গুগল ইমেজ সার্চের মাধ্যমে দেখা যায় এটি প্রায় দেড় মাস পুরোনো। স্থানীয় চিত্রগ্রাহক জোহাইব আনজুম ৫ মার্চ তাঁর ধারণ করা ভিডিও হিসেবে এটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইনস্টাগ্রামে আপলোড করেছিলেন। একই দিনে আরব আমিরাত ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম দ্য ন্যাশনাল নিউজও টিকটকে ভিডিওটি পোস্ট করে।
একইভাবে ভিডিওর ১৬ সেকেন্ডে ঝড়ে শেকড়সহ গাছ উপড়ানোর দৃশ্যটিকে ২০২৩ সালের ব্রাজিলের বিকাস মিউনিসিপ্যালিটির ঘটনা হিসেবে পেয়েছে ডিসমিসল্যাব। ব্রাজিলভিত্তিক গণমাধ্যম জি১ জানায়, ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি এ ঝড় হয়েছিল।
৩১ সেকেন্ড বরাবর থাকা ঝড়ের দৃশ্যটিকে পাওয়া গেছে ভিডিও বেচাকেনার ওয়েবসাইট শাটারস্টকে। ভিডিওর বর্ণনা মতে, এটি ২০১৮ সালে উত্তর আমেরিকা মহাদেশে হওয়া হারিকেন মাইকেলের দৃশ্য। এছাড়াও, এই দৃশ্যের একটি সম্পাদিত সংস্করণ পাওয়া যায় ইউটিউবে, যা ২০১৯ সালের ১৭ জুলাইয়ে আপলোড করা হয়। ৩৮ সেকেন্ডে দেখা যাওয়া টর্নেডোর দৃশ্যটি রয়েছে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর টিকটক এবং ইউটিউবে পোস্ট হওয়া একটি ভিডিওতে। মূল ভিডিওটি এডিটেড বলে ধারণা করা যায়, কারণ টর্নেডোর দৃশ্য বলা হলেও আশেপাশের গাছগুলোর কোনো নড়াচড়া লক্ষ্য করা যায়নি।
বন্যার তোড়ে গাড়ি ভেসে যাওয়ার একটি ফেসবুক রিল যাচাইয়ে দেখা যায়, গত ২ মার্চ ভিডিওটি টিকটকে পোস্ট হয়েছে এবং একে সৌদি আরবের বন্যার বলে দাবি করা হচ্ছে। ভিডিওটি আসলেই সৌদি আরবের কিনা তা নিশ্চিত না হওয়া গেলেও তারিখের ভিত্তিতে বলা যায়, এটি দুবাই বা আরব আমিরাতের সাম্প্রতিক বন্যার দৃশ্য নয়। কারণ বন্যা হয়েছে চলতি এপ্রিল মাসের ১৬ তারিখে।
গাড়ির সঙ্গে বহুতল ভবনেরও অংশবিশেষ ঝড়ে কাগজের মতো উড়ে যাচ্ছে এমন একটি ফেসবুক রিলের ক্যাপশনে এবং ভিডিও পোস্টে একে দুবাইয়ের দুর্যোগের বলে ইঙ্গিত দেয়া হয়। যাচাইয়ে দেখা যায়, ভিডিওটি গত ২ মার্চ টিকটকে পোস্ট হয়েছে ডিজাস্টারস.টুডে নামক একাউন্ট থেকে। এখানেও তারিখের ভিত্তিতে বলা যায়, ভিডিওটি দুবাইয়ের বন্যার দৃশ্য নয়। একই যুক্তিতে নিচের ভিডিওটিকেও দুবাইয়ের বন্যার নয় বলে নাকচ করে দেওয়া যায়।
এই ভিডিওটিও এসেছে একই ফেসবুক আইডি থেকে রিল আকারে, যাতে লেখা ‘দুবাইয়ের এই করুন অবস্তা দেখে মনে হয় কিয়ামত শুরু হয়েছে’। কিছু দৃশ্য রিভার্স ইমেজ সার্চ করে দেখা যায় একই ভিডিও তুরস্কের গণমাধ্যম আয়কুরোর টুইটার একাউন্ট থেকে ২০২৩ সালের ২২ নভেম্বর পোস্ট করা হয়েছিল। পোস্টের ক্যাপশনে লেখা ছিল, “যা দেখবেন তার সবটাই বিশ্বাস করবেন না। সম্প্রতি এই দৃশ্যগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়াতে দেখা যায়, যা অনেকেই সত্য বলে ধরে নেয়, যার সবটাই কম্পিউটারের মাধ্যমে তৈরি।”
এরকইম অন্য একটি ফেসবুক রিলে বন্যার দৃশ্য দেখিয়ে ক্যাপশন করা হয়: “দুবাই বন্যা 🤣🤣🤣।” রিভার্স ইমেজ সার্চ করে দেখা যায় ভিডিওটি ২০২১ সালে তুরস্কের আর্টবিন শহরে হওয়া বন্যার ঘটনার।
এদিকে, বন্যায় আটকা পড়া উটের একটি ভিডিও পোস্ট করতে দেখা যায় বিভিন্ন ফেসবুক ব্যবহাকারীকে (১, ২, ৩, ৪)। পোস্টগুলোতে দাবি করা হয় যে এই দৃশ্যটি দুবাইয়ের বন্যার। ১৯ এপ্রিলে ইন্ডিয়া টুডের প্রকাশ করা একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে ভিডিওটি মূলত ২০১৮ সালের সৌদি আরবের তাবুক শহরের বন্যার একটি দৃশ্য।
যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এ ধরনের অপতথ্য ছড়ানোর নজির অতীতেও দেখা গেছে। ডিসমিসল্যাবের ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়, তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্পের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এমনকি সিনেমার ছবি বা ভিডিও দুর্যোগের দৃশ্য হিসেবে ছড়ানো হচ্ছিল।