ফাতেমা তাবাসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব
সুমাইয়া ওয়াশাহ গাজার সর্বকনিষ্ঠ সাংবাদিক নন
This article is more than 9 months old

সুমাইয়া ওয়াশাহ গাজার সর্বকনিষ্ঠ সাংবাদিক নন

ফাতেমা তাবাসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে, মাথায় সেফটি হেলমেট, হাতে বুম, আর গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট জড়িয়ে একটি শিশু সাংবাদিকতা করছে। সম্প্রতি কিছু গণমাধ্যম তাদের প্রতিবেদনে (, ) শিশুটিকে গাজার সর্বকনিষ্ঠ সাংবাদিক বলে প্রচার করে। সামাজিক মাধ্যমেও ( , , , , , ) একই তথ্য ছড়াতে দেখা গেছে। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায় ১১ বছর বয়সী সুমাইয়া ওয়াশাহ গাজার সর্বকনিষ্ঠ সাংবাদিক নন।

২৭ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত আল জাজিরার একটি ভিডিও প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেখানে সুমাইয়াকে সর্বকনিষ্ঠ সাংবাদিক বলাই হয়নি। বরং সুমাইয়াকে গাজার “সর্বকনিষ্ঠ সাংবাদিকদের মধ্যে একজন” বলে পরিচয় দেওয়া হয়, যা রয়েছে ভিডিওটির সপ্তম সেকেন্ডে। 

ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, গাজার সবচেয়ে কম বয়সী সাংবাদিক হচ্ছেন লামা আবু জামুস। তার বয়স নয় বছর। অর্থাৎ, লামা বয়সের দিক থেকে সুমাইয়ার থেকেও দু’বছরের ছোট। 

সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল ভিডিওগুলোও মূলত আল জাজিরার প্রতিবেদনটি থেকে নেওয়া। 

গাজায় যুদ্ধের রিপোর্ট করছে ১১ বছর বয়সী উদীয়মান সাংবাদিক” শীর্ষক প্রতিবেদনটি গত ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় আল জাজিরায়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো যাচাই করে দেখা যায়, তারা সংবাদের সূত্র হিসেবে মূলত আল জাজিরার নাম উল্লেখ করেছে। কাতারভিত্তিক এই গণমাধ্যমটির ভিডিও-প্রতিবেদনকে ভিত্তি করে দাবি করা হচ্ছে বুম হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সুমাইয়া নামের মেয়েটিই “গাজার সবচেয়ে ছোট সাংবাদিক”।

সামাজিক মাধ্যম এক্সে (পূর্ববর্তী টুইটার) একই ভিডিও প্রায় ১৮ হাজার মানুষ দেখেছে। এটিকে রিপোস্ট বা পুনরায় বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট হতে শেয়ার করা হয়েছে ৪২৮ বার। ভিডিওটিতে ৬৪১টি লাইক এবং ৬৭টি কমেন্টস এসেছে। অন্যদিকে, ফেসবুকে একই ভুল তথ্য সম্বলিত একটি ভিডিও (রিল) সাড়ে ৪ হাজার বার শেয়ার করা হয়েছে, যেখানে ১ লক্ষ ৫০ হাজার লাইক এবং ৭৫০টি মন্তব্যও রয়েছে। মূলধারার গণমাধ্যম কালবেলার নামে খোলা একটি ফেসবুক পেজেও ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলা শিরোনামসহ ভিডিওটি প্রচার হতে দেখা যায়। 

এদিকে লামা আবু জামুস সম্পর্কে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন (, , ) থেকে জানা যায় যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনে নয় বছর বয়সী শিশুটি স্বাধীন সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছেন।

লামাকে নিয়ে আল জাজিরাতেও “গাজার যুদ্ধ নিয়ে রিপোর্ট করছে এই ৯ বছরের বালিকা” শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত আছে। স্কাই নিউজের ওয়েব সাইটেও রয়েছে “পরিচিত হোন গাজা’র সর্বকনিষ্ঠ সাংবাদিক ৯ বছর বয়সী লামা আবু জামুসের সাথে” শীর্ষক প্রতিবেদন।

এর আগে গত ২২ ফেব্রুয়ারি এক্সের (পূর্ববর্তী টুইটার) একজন ব্যবহারকারী এই ভিডিওর ক্লিপে ইংরেজিতে যোগ করেন “গাজার সর্বকনিষ্ঠ সাংবাদিক”। ভিডিওটির ক্যাপশনে লেখা হয়, “গাজা উপত্যকার এই নিষ্পাপ মেয়েটির মা নরখাদক ইসরায়েলিদের হামলায় শহীদ হয়েছিলেন। এখন তার ছোট মেয়ে তার মায়ের জায়গায় গাজায় রিপোর্ট করছে। পৃথিবী সত্য দেখছে”। তবে সুমাইয়াকে নিয়ে তৈরি আল জাজিরার অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলের প্রতিবেদনে সুমাইয়াকে তার মা-বাবার কথা বলতে শোনা যায়। সংবাদ উপস্থাপকের জিজ্ঞাসায় সুমাইয়া তাকে জানান (০১: ১৮মিনিটে) “যখন আমি বাইরে যাই, আমি আমার মা এবং বাবাকে বলি যে আমি বাইরে যাচ্ছি এবং আমি আল্লাহর উপর ভরসা রাখি।” এ থেকেও স্পষ্ট, সুমাইয়ার মা নিহত হননি।

আল জাজিরার প্রতিবেদনে সুমাইয়ার বক্তব্যের কোথাও উল্লেখ ছিল না যে তার মা একজন সাংবাদিক বা গণমাধ্যমকর্মী। বরং আল জাজিরার ভিডিওটির ৫০ সেকেন্ডের পর থেকে সুমাইয়াকে বলতে শোনা যায়, “আমার আদর্শ শিরিন আবু আকলেহ। আল্লাহ তার উপর রহমত করুন। আমি তার মতো করে বিশ্বের কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম।”

আল জাজিরার খ্যাতিমান সাংবাদিক শিরীন আবু আকলেহ ইসরায়েল অধিকৃত ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর জেনিনে ইসরায়েলি বুলেটে নিহত হন। 

গত ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের হামলার পর থেকে নানা সময়ে গাজা নিয়ে বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমে বেশ কিছু ভুয়া তথ্য ছড়ায়। গাজার ধ্বংসস্তুপ থেকে ৩৭ দিন পরে শিশু উদ্ধারের একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল অন্তত পাঁচটি গণমাধ্যমে। পরে যাচাইয়ে দেখা গেছে, শিশুটি মূলত তিন ঘণ্টা ধ্বংসস্তুপের নিচে ছিল। এছাড়া, ইলন মাস্কের গাজা সমর্থন ও গাজায় রাশিয়ার ত্রান পাঠানোর মতো সংবাদও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর ভুয়া বলে চিহ্নিত হয়। সম্প্রতি কাদামাটিতে কোনো এক তাঁবুর ভেতরে দুটি শিশুর ছবি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। দাবি করা হয়, ছবিটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের গাজা থেকে পাওয়া। কিন্তু যাচাইয়ে দেখা যায়, ছবিগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই টুল ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। এ নিয়ে ডিসমিসল্যাব গত জানুয়ারি মাসে একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। 

ইউনিভার্সিটি অফ হাল এর গোয়েন্দা ও জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগের অধ্যাপক ড. রবার্ট এম. ডোভার দ্য কনভারসেশনের একটি নিবন্ধে ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের চলমান সংঘাতে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর ব্যাপারে সতর্ক করেন। তিনি বলেন, “গাজা এখন বিশ্বব্যাপী তথ্যযুদ্ধের প্রথম সারিতে।” 

একই প্রতিবেদনে তিনি আরও বলেন, “… সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ পেশাদারদের পক্ষেও কোনটি সত্য এবং কোনটি সত্য নয় তা খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়ে।” বারবার এমন ভুল তথ্য ছড়ানো এবং সেসব যাচাই দুরূহ হয়ে যাবার পেছনের মূল কারণ হিসেবে ড. রবার্ট বলছেন, “ঐতিহ্যবাহী গণমাধ্যমগুলোও গাজা সম্পর্কে ভুল তথ্যের ভয়াবহতা নিরীক্ষা এবং তা প্রতিহত করার জন্য এখন লড়াই করছে। যত দ্রুততম সময়ে সাংবাদিকরা একটি ভুল তথ্য যাচাই বা খণ্ডন করার চেষ্টা করছে, এর চেয়ে অনেক দ্রুতগতিতে সেই ভুল তথ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। আর গাজায় বহু সাংবাদিক নিহত হওয়ার কারণে সঠিক খবর সংগ্রহ করার কাজটি আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।” 

কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) এর “ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধে সাংবাদিক হতাহত” শীর্ষক একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ৪ মার্চ, ২০২৪ পর্যন্ত ৩০ হাজার জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে কমপক্ষে ৯৪ জনই ছিলেন সাংবাদিক এবং গণমাধ্যমকর্মী—।”

আরো কিছু লেখা