তৌহিদুল ইসলাম রাসো

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

পার্থ প্রতীম দাস

এনগেজমেন্ট এডিটর, ডিসমিসল্যাব
অক্টোবর ৩০, ২০২৫
১৭:৩৬:৫৩
বেড়েছে রাজনৈতিক ভুল তথ্য: বেশি ছড়িয়েছে মিছিল-সমাবেশ, সংঘর্ষ ও বিবৃতি সংক্রান্ত মিথ্যা দাবি

তৃতীয় প্রান্তিকের প্রবণতা বিশ্লেষণ

বেড়েছে রাজনৈতিক ভুল তথ্য: বেশি ছড়িয়েছে মিছিল-সমাবেশ, সংঘর্ষ ও বিবৃতি সংক্রান্ত মিথ্যা দাবি

অক্টোবর ৩০, ২০২৫
১৭:৩৬:৫৩

পার্থ প্রতীম দাস

এনগেজমেন্ট এডিটর, ডিসমিসল্যাব

তৌহিদুল ইসলাম রাসো

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

বাংলাদেশে যেসব বিষয়ে ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা বেশি দেখা যায়, বরাবরই তার শীর্ষে থাকে রাজনীতি। ২০২৫ সালের প্রথম দুই প্রান্তিকে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট আটটি তথ্যযাচাইয়ের প্রতিষ্ঠান যতগুলো ভুল তথ্য যাচাই করেছিল, তার প্রায় অর্ধেকই (৪৪ ও ৪৫ শতাংশ) ছিল রাজনীতি সংশ্লিষ্ট। তবে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, এই হার তত বাড়ছে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিত মোট ফ্যাক্টচেকের প্রায় দুই তৃতীয়াংশই (৬৩%) ছিল রাজনীতি সম্পর্কিত।

রাজনীতি বিষয়ক ভুল তথ্যগুলোর ভাষ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে অর্ধেকের বেশি (৫২%) ভুল তথ্য ছড়িয়েছে তিনটি বিভাগে: মিছিল/সমাবেশ সংক্রান্ত ভুয়া দাবি, সংঘর্ষ/সহিংসতা সংক্রান্ত ভুয়া দাবি এবং রাজনীতিবিদ বা রাজনীতি সংক্রান্ত ভুয়া বক্তব্য-বিবৃতি। এছাড়াও ১৮ শতাংশ ক্ষেত্রে ছড়াতে দেখা গেছে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নির্যাতন বা হত্যা এবং রাজনীতিবিদ/রাজনৈতিক দলের অপরাধ/দুর্নীতি সংক্রান্ত ভুয়া তথ্য। 

যেসব ঘটনা ঘিরে রাজনীতি বিষয়ক ভুল তথ্য বেশি ছড়াতে দেখা গেছে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল জুলাইয়ে গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সংঘাত, আগস্টে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী এবং সেপ্টেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন।

রাজনীতির বাইরে ভুল তথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রেখেছে আরও দুইটি ঘটনা — গত জুলাইয়ে ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়া এবং সেপ্টেম্বরের শেষে খাগড়াছড়িতে সংঘাত। এক মারমা শিক্ষার্থীকে গণধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাটিতে।

ভুল তথ্য ছড়ানোর মাধ্যম হিসেবে বাড়তে দেখা গেছে ভিডিওর ব্যবহার। তৃতীয় প্রান্তিকে ৬৬% ভুল তথ্য ছড়িয়েছে ভিডিওর মাধ্যমে। গত প্রান্তিকের (এপ্রিল–জুন) তুলনায় কমেছে গ্রাফিক কার্ড, ছবি ও লিখিত পোস্টের ব্যবহার। 

ডিসমিসল্যাবসহ বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট আটটি ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইটে প্রকাশিত যাচাই প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে এমন চিত্র। এবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে এসব ওয়েবসাইটে সবমিলিয়ে প্রকাশিত হয়েছে মোট ১,৩৪৫টি প্রতিবেদন। একই ভুল তথ্য নিয়ে একাধিক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান যাচাই প্রতিবেদন প্রকাশ করলে একটিকে ধরা হয়েছে ইউনিক বা স্বতন্ত্র হিসেবে। এই বিশ্লেষণটি করা হয়েছে এমন স্বতন্ত্র ভুল তথ্যের ভিত্তিতে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওয়েবসাইটগুলোতে প্রকাশিত হয়েছিল এমন ৯৬০টি স্বতন্ত্র ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন, যা গত প্রান্তিকের তুলনায় ৫ শতাংশ কম। এবছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল ১,০১১টি স্বতন্ত্র ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন।

রাজনৈতিক অপতথ্যের ভাষ্য

ছড়িয়ে পড়া রাজনৈতিক অপতথ্যের ভাষ্য কেমন ছিল– তা বিশ্লেষণের জন্য ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনগুলোকে ১২টি বিভাগে ভাগ করেছে ডিসমিসল্যাব। ভুয়া বক্তব্য/বিবৃতি, চরিত্র হনন, মিছিল/সমাবেশ, নির্যাতন/মৃত্যুর অভিযোগ, দুর্নীতি/অপরাধের অভিযোগ, আদালত/কারাগার/গ্রেপ্তার-সংক্রান্ত, সংঘর্ষ/সহিংসতা, বিদেশী প্রভাব বিস্তারের ষড়যন্ত্র, সরকারি কার্যকলাপ, আওয়ামী লীগের বিদেশী কার্যকলাপ, নির্বাচন ও অন্যান্য।

মিছিল/সমাবেশ সংক্রান্ত ভুয়া দাবি: রাজনৈতিক ভুল তথ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে পুরোনো মিছিল/সমাবেশের ছবি-ভিডিও সাম্প্রতিক দাবিতে প্রচার বা এক রাজনৈতিক দলের মিছিল/সমাবেশ অন্য কোনো দলের মিছিল/সমাবেশের দাবিতে প্রচারের প্রবণতা। মোট ছড়ানো ৬০৮টি রাজনৈতিক ভুল তথ্যের ১৯ শতাংশই ছিল এ ধরনের মিছিল/সমাবেশ সংক্রান্ত ভুয়া দাবি। দেখা গেছে ছড়িয়ে পড়া প্রতি ১০ পোস্টের নয়টিতেই দাবি করা হয়েছে যে সেগুলো আওয়ামী লীগের মিছিল বা সমাবেশের দৃশ্য। দলটি গত বছরের আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে এবং তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমও নিষিদ্ধ রয়েছে। এই মিথ্যা দাবির পোস্টগুলো মূলত আওয়ামী লীগ কর্মীদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে তৈরি, যা দিয়ে বোঝানো হয় যে তারা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাস্তায় বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে।

কখনো আওয়ামী লীগ বা এর অঙ্গসংগঠনের পুরোনো মিছিল, সমাবেশের ভিডিও প্রচারিত হয়েছে (, , , ) সাম্প্রতিক দাবিতে, কখনো আবার অন্য কোনো সংগঠন বা গোষ্ঠীর মিছিল বা আন্দোলনের ছবি-ভিডিও প্রচারিত হয়েছে (, , , ) আওয়ামী লীগের মিছিল-সমাবেশের দৃশ্য দাবিতে।

গত জুলাইয়ে গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সংঘাতের পর আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিল। এই হরতালের সমর্থনে (, ) কিংবা ১৫ আগস্টে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে (, ) এমন ভুয়া মিছিল-সমাবেশের দাবি বেশি ছড়াতে দেখা গেছে।

কিছু ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বা এর অঙ্গ সংগঠনের মিছিল দাবিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি ভিডিও-ও (, , , ) ছড়াতে দেখা গেছে। যেমন, ঢাকা বা চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের মিছিল দাবিতে ছড়িয়েছে এআই দিয়ে বানানো ভিডিও। একটি ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সত্যি একটি মিছিলে মানুষের সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে।

এই প্রবণতা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। বেশ কয়েকটি সম্পাদিত ভিডিওতে মিথ্যাভাবে দাবি করা হয়েছিল যে এনসিপি নেতারা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে স্লোগান দিয়েছেন। কিছু ভিডিওতে বলা হয়েছে এনসিপি নেতারা তারেক রহমানের পক্ষে স্লোগান দিচ্ছেন এবং বাংলাদেশে স্বাগত জানাচ্ছেন; যিনি ২০০৮ সাল থেকে লন্ডনে নির্বাসিত আছেন। অন্যদিকে, কিছু ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে এনসিপি নেতারা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অপমানজনক স্লোগান দিয়েছেন। এসব ভিডিওর মূল উদ্দেশ্য ছিল এনসিপির রাজনৈতিক অবস্থান ও বিএনপির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা।

সংঘর্ষ/সহিংসতা: রাজনৈতিক ভুল তথ্যের ক্ষেত্রে আরেকটি প্রধান ভাষ্য ছিল সংঘর্ষ, সহিংসতা সংক্রান্ত ভুয়া দাবি। এমন ভুল তথ্য ছিল মোট রাজনৈতিক ভুল তথ্যের ১৮%। এক্ষেত্রে পুরোনো বা ভিন্ন কোনো সংঘর্ষ-সহিংসতার দৃশ্যকে প্রচার করা হয়েছে সাম্প্রতিক দাবিতে। কোথাও আবার অন্য কোনো দেশের ছবি-ভিডিও-ও ছড়ানো হয়েছে বাংলাদেশে চিত্র দাবিতে।

যেমন, গত জুলাইয়ে ফেসবুকে একটি মারধরের ভিডিও শেয়ার করে বলা হয় সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল দখলকে কেন্দ্র করে শিবির ও ছাত্রদলের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা। কিন্তু যাচাইয়ে দেখা যায় ভিডিওটি ২০১৮ সালের। সেটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আন্দোলনের সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের হামলার দৃশ্য। আবার ফরিদপুরে এনসিপির নেতাকর্মীদের উপর জনগণের আক্রমণের দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত হয়েছিল কেনিয়ার একটি আন্দোলনের ভিডিও। বিএনপি-জামায়াতের সংঘর্ষের দাবিতে প্রচারিত হতে দেখা গেছে ভারতে গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি সভায় দুই দলের সংঘর্ষের ঘটনার ভিডিও

এছাড়াও জুলাই মাসে গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশ চলাকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ ঘটে। এর প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ সারাদেশে হরতালের ডাক দেয়, এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংঘর্ষ ও সহিংসতা নিয়ে ভুল তথ্যের জোয়ার দেখা যায় (, , , )। যেমন, তাইওয়ানের একটি ভিডিও ছড়িয়ে বলা হয় যে গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনী ট্যাংক থেকে গুলি চালাচ্ছে। অন্য কিছু ভুয়া দাবিতে বলা হয় সেনা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে অর্ধশতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে, কিংবা সেখানে গণহত্যা চলছে। তবে একাধিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন (, ) থেকে জানা যায় ওই সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছিল।

দুই মাস পর, সেপ্টেম্বরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু নির্বাচন পরবর্তী সংঘর্ষের অভিযোগে একাধিক ভুল তথ্যও (, , , ) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। নির্বাচনে ছাত্রশিবির বিজয়ী হওয়ার পর ভুয়া দাবিতে ছড়ানো হয় যে ছাত্রদল ভোট বর্জন করেছে, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে লিপ্ত হয়েছে, অথবা পুলিশ বা ছাত্রশিবির কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছে।

বক্তব্য/বিবৃতি: রাজনৈতিক ভুল তথ্যের আরেকটি প্রধান বিষয় ছিল ভুয়া বক্তব্য বা বিবৃতি। এমন ভুল তথ্য ছিল মোট রাজনৈতিক ভুল তথ্যের ১৬%। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টা, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, কিংবা রাজনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের ভুয়া মন্তব্য বা বক্তব্য ছড়াতে দেখা গেছে। এক্ষেত্রেও দেখা গেছে এআই দিয়ে বানানো ভিডিওর ব্যবহার।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস দীর্ঘদিন ধরেই ভুল তথ্য ছড়ানোর অন্যতম লক্ষ্যবস্তু হিসেবে আছেন। এই প্রান্তিকে তার নামে মিথ্যাভাবে প্রচারিত বক্তব্যগুলোর মধ্যে রয়েছে: কোথাও বলা হয়েছে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন আগামী জাতীয় নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে বা সুদের ব্যবসা বিশ্বকে বদলে দিতে পারে। 

প্রসঙ্গত, জামায়াতে ইসলামী ও এর সমমনা সাতটি দল আগামী জাতীয় নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে আয়োজনের জন্য কর্মসূচি পালন করেছে। অন্যদিকে, বিএনপিসহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল পিআর ব্যবস্থার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আর গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থান থেকে উঠে আসা নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি পিআর পদ্ধতির প্রতি আংশিক সমর্থন জানিয়েছে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মোঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর নামেও ছড়িয়েছে বেশ কয়েকটি ভুয়া বক্তব্য-বিবৃতি। যেমন, দাবি করা হয়েছে যে, তিনি বলেছেন দুর্গাপুজা হলো মদ ও গাঁজার সমাবেশের উৎসব। যদিও যাচাইয়ে দেখা যায়, তিনি এমন কোনো বক্তব্য দেননি। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ মানুষের বক্তব্য (, , , ) দাবিতে ছড়াতে দেখা গেছে অন্তত ১০টি এআই দিয়ে তৈরি ভিডিও। কিছু দাবিতে বলা হয়েছে জনগণ আওয়ামী লীগকে পুনরায় ক্ষমতায় দেখতে চায়, কারণ তাদের সময়ে দেশে উন্নতি হয়েছে। আরও দুটি ভিডিওতে দাবি করা হয়, জনসভায় বক্তারা বিএনপি ও জামায়াতের সমালোচনা করছেন এবং ভোটারদের তাঁদের সমর্থন না দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন।

একই ধরনের কিছু ভুয়া বক্তব্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে বানিয়ে পুলিশসেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের নামেও প্রচার করা হয়েছে। এসব ভিডিওতে উভয় পক্ষকেই একে অপরকে দোষারোপ করতে শোনা যায়। গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগ কর্মী, সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষের পর একটি এআই দিয়ে বানানো ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দেখা যায় একজন পুলিশ কর্মকর্তা সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীকে সহিংসতার জন্য দায়ী করছেন। অপর ভিডিওতে সেনাবাহিনীর এক সদস্যের বক্তব্য হিসেবে বলা হয় দেশে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর নয়, পুলিশের।

সরকারি কার্যকলাপ: এই প্রান্তিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা এর উপদেষ্টাদের বিভিন্ন কার্যক্রম ঘিরেও ভুল তথ্য ছড়াতে দেখা গেছে। কিছু দাবিতে বলা হয়েছে সরকার সশস্ত্র বাহিনীর জন্য ছয় মাসের রেশন বন্ধ করে দিয়েছে, বা কয়েকজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করেছেন (, )।

নির্যাতন/মৃত্যুর অভিযোগ: ছড়িয়ে পড়া রাজনৈতিক অপতথ্যের প্রায় প্রতি দশটির মধ্যে একটি ছিল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মৃত্যু বা নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে। কোথাও ভুল দাবিতে বলা হয়েছে আওয়ামী লীগের এক সাবেক সংসদ সদস্য কারাগারে মারা গেছেন, আবার কোথাও বলা হয়েছে আওয়ামী লীগ বা এর অঙ্গসংগঠনের কর্মী হবার কারণে কেউ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

ফেসবুকে রক্তাক্ত অবস্থায় বসে থাকা এক ব্যক্তির ছবি শেয়ার করে বলা হয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় মারধরের শিকার হন তিনি। তবে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে বলা হয় আহত ব্যক্তিটি সড়ক দুর্ঘটনার শিকার। 

আবার গোপালগঞ্জবাসীর হামলায় এনসিপির ২৩ জন নিহত হয়েছেন দাবিতে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট শেয়ার হতে দেখা গেলেও যাচাই প্রতিবেদনে বলা হয় দাবিটি মিথ্যা।

দুর্নীতি/অপরাধের অভিযোগ: রাজনৈতিক দল বা নেতাকর্মীদের জড়িয়ে দুর্নীতি ও অপরাধের ভুয়া দাবিতে ছড়িয়েছে ৮% রাজনৈতিক অপতথ্য। এমন অন্তত চারটি স্বতন্ত্র ভুল তথ্য ফ্যাক্টচেক হয়েছে যেখানে বলা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন চারজন রাজনীতিবিদের বাড়ি থেকে টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। কোথাও বলা হয়েছে বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাড়ি থেকে টাকা উদ্ধার করা হয়েছে আবার কোথাও বলা হয়েছে এনসিপির নেত্রী সামান্তা শারমিন, তাসনিম জারা বা নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর বাসা থেকে টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।

এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াত বা বিএনপির নেতাকর্মীরা ধর্ষণ বা চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত আছেন– এমন দাবিতে প্রচারিত হতে দেখা গেছে বেশ কিছু ভুল তথ্য। যেমন, বলা হয়েছে, জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা কাউকে ধর্ষণ করেছে বা ধর্ষণের অভিযোগে আটক হয়েছে। চাঁদা না দেওয়ায় বিএনপি কর্মীরা হাসপাতালে জোড়া খুন করেছে দাবিতে ছড়ানো হয়েছে ভারতের ভিডিও।

চরিত্র হনন: দুর্নীতি-অপরাধের অভিযোগ ছাড়াও রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবন ও আচরণ সংক্রান্ত ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে চরিত্র হননের চেষ্টাও দেখা গেছে কিছু ভুল তথ্যের মাধ্যমে। যেমন, ভিন্ন কোনো যুগলের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি সম্পাদনা করে দাবি করা হয়েছে সেগুলো কোনো রাজনীতিবিদের ছবি। কোথাও বলা হয়েছে কোনো রাজনীতিবিদ পরকীয়া করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন। এনসিপি নেত্রী ডা. তাসনিম জারার হাফ প্যান্ট পরিহিত ছবি বা অর্ধনগ্ন ছবি ছড়ানো হয়েছে সম্পাদনা করে। 

একটি ভুল তথ্যে সম্পাদিত ছবি শেয়ার করে বলা হয়েছে সেটি এনসিপির দুই নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ ও তাসনিম জারার চুম্বনের দৃশ্যে। তবে ফ্যাক্টচেকে দেখা যায় ভিডিওটি ভারতের।

আদালত/কারাগার/গ্রেপ্তার সংক্রান্ত: এই বিভাগে ছড়ানো অপতথ্যগুলোতে কোথাও বলা হয়েছে কারাগারে থাকা কোনো আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তি পেয়েছেন আবার কোথাও বলা হয়েছে গ্রেপ্তার হয়েছেন। যেমন সামাজিক মাধ্যমের পোস্টে বলা হয় আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি জুনাইদ আহমেদ পলক মুক্তি পেয়েছেন, আবার কোথাও বলা হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে বলা হয় দাবিগুলো ভুয়া। 

বিদেশী প্রভাব বিস্তারের ষড়যন্ত্র: বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে বিদেশী প্রভাব সংক্রান্ত কিছু ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ছড়াতে দেখা গেছে এবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে। যেমন, গত সেপ্টেম্বরে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লাঠিচার্জের পর এক ব্যক্তির ছবি ছড়িয়ে বলা হয়েছিল তিনি ভারতীয় ভারতীয় গোয়েন্দাসংস্থা ‘র’-এর এজেন্ট এবং নুরকে হত্যার মিশন নিয়ে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। যদিও যাচাইয়ে দেখা যায় ছবিটি তৈরি করা হয়েছিল এআই দিয়ে।

পাকিস্তানকে জড়িয়েও অপতথ্য ছড়াতে দেখা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর পাঁচটি অ্যাকাডেমিক ভবনে স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন স্থাপন করেছিল ইসলামী ছাত্রশিবির। সেসময় দাবি করা হয়েছিল এর জন্য সহায়তা করেছে পাকিস্তানের একটি সংগঠন। 

এছাড়াও ভারত, ফিলিপাইন, যুক্তরাষ্ট্র, পেরু, মিশর, আয়ারল্যান্ড বা আর্জেন্টিনার সরকার বা বিভিন্ন মন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের বৈধ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেছেন বা আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বলেছেন– এমন দাবিতে ছড়াতে দেখা গেছে বেশ কিছু ভুয়া তথ্য। এআই দিয়ে বানানো একটি ভিডিওতে আবার দাবি করা হয়েছিল যে, ভারতের সংসদে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তীব্র সমালোচনা করা হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের বিদেশী কার্যকলাপ: ২০২৪ সালের আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতাকর্মী বা সমর্থক বিদেশ থেকে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন– এমন দাবিতেও ছড়াতে দেখা গেছে কিছু ভুল তথ্য। যেমন, পুরোনো একটি ভিডিও শেয়ার করা বলা হয়েছে শেখ হাসিনা দিল্লি থেকে লন্ডন যাচ্ছেনপাকিস্তানের একটি ভিডিও শেয়ার করে দাবি করা হয়েছে আওয়ামী লীগের সাবেক ছয় মন্ত্রীকে বৈঠকের জন্যে এলাহাবাদে নেওয়া হয়েছে।

নির্বাচন: এবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক (এপ্রিল-জুন) থেকে রাজনীতি-বিষয়ক ভুল তথ্যের একটি অন্যতম বিষয় হয়ে উঠেছে নির্বাচন। তৃতীয় প্রান্তিকেও এই প্রবণতা অব্যাহত ছিল। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়াও এই প্রান্তিকে বেশ কিছু ভুল তথ্য ছড়িয়েছে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে। নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি হচ্ছে, নির্বাচনকে অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য অস্ত্র আনা হচ্ছে– এমন দাবিতে ছড়িয়েছে পুরোনো ও অপ্রাসঙ্গিক ভিডিও। নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার আগে ছড়াতে দেখা গেছে বিভিন্ন প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট নিয়ে নানা ভুল তথ্য, পরিসংখ্যান। চূড়ান্ত ফল ঘোষণার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ-সহিংসতা হয়েছে দাবিতেও ছড়িয়েছে ভুল তথ্য।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গেও আলাদাভাবে ছড়াতে দেখা গেছে নানা ভুল তথ্য। বিশেষ করে প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন বা পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের পক্ষে-বিপক্ষে ছড়িয়েছে একাধিক ভুয়া উদ্ধৃতি। যেমন, কোথাও দাবি করা হয়েছে আগামী নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। আবার কোথাও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বরাতে বলা হয়েছে, যাদের নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা নেই, তারাই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। পিআর ইস্যুতে জামায়াত ও আওয়ামী লীগ জোট করতে পারে– এমন ভুয়া দাবি প্রচারিত হয়েছে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের বরাতে। 

নির্বাচন বিষয়ক প্রচার-প্রচারণায় দেখা গেছে এআই দিয়ে তৈরি ভিডিওর ব্যবহারও। দিনাজপুর-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শিবলী সাদিকের পক্ষে প্রচারণায় ব্যবহৃত হয়েছে এমন ভিডিও। জামায়াতে ইসলামীকে ভোট দেওয়া উচিৎ না– এমন বক্তব্য প্রচারিত হয়েছে এআই দিয়ে তৈরি এক ইসলামী বক্তার মাধ্যমে। নির্বাচনে কোন দলের শক্তি কেমন, কার সঙ্গে কার জোট হবে, কোন দল কেমন ভোট পাবে, বা ক্ষমতায় আসলে কী ধরনের ব্যবস্থা নেবে– এমন কিছু ভুল তথ্যও প্রচারিত হয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের ভুয়া উদ্ধৃতির মাধ্যমে। 

বেড়েছে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত ভুল তথ্য

গত প্রান্তিকের তুলনায় এই প্রান্তিকে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা বেড়েছে। এর অন্যতম কারণ সেপ্টেম্বরের শেষে পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়িতে ছড়িয়ে পড়া সংঘাত। গত প্রান্তিকে প্রকাশিত মোট স্বতন্ত্র ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনের ৭% ছিল আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কিত, যা এই প্রান্তিকে এসে দাড়িয়েছে ১১% এ।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি এক কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে ওঠে পার্বত্য চট্টগ্রামের এই জেলা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে অবরোধকারীদের সংঘর্ষে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর তিনজনের মৃত্যু হয়। আর এই সংঘাতকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমে পুরোনো ও ভিন্ন ঘটনার ছবি-ভিডিও বা অন্য দেশের দৃশ্য ছড়িয়ে পড়ে খাগড়াছড়ির সংঘাতের দাবিতে। 

খাগড়াছড়ির মহাজনপাড়ার রাতের দৃশ্য দাবিতে একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে যাচাই প্রতিবেদনে বলা হয় সেটি পুরোনো ও ইন্দোনেশিয়ার সুরাকারতা শহরের একটি জায়গার। আবার উহ্লামে নামে এক কিশোরীর রক্তমাখা ছবি প্রচার করে দাবি করা হয়, সেনাবাহিনীর গুলিতে সে মারা গেছে, তবে যাচাই প্রতিবেদনে বলা হয় সে বেঁচে আছে, এবং মারা যাবার খবরটি ভুয়া। এছাড়া ফেসবুকে এক ব্যক্তির অস্ত্র হাতে ছবি শেয়ার করে দাবি করা হয় প্রকাশ্য দিবালোকে খাগড়াছড়ির মহাজনপাড়া এলাকায় জুম্ম-জনতার উপর প্রকাশ্যে সশস্ত্র হামলা করেছে বাঙালিরা; তবে যাচাই প্রতিবেদনে বলা হয় সেটি খাগড়াছড়ির কোনো ঘটনার ছবি নয়, বরং গত বছরের জুলাই আন্দোলনের।

কমেছে আন্তর্জাতিক ও ধর্ম সংক্রান্ত অপতথ্য

আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী সংক্রান্ত ভুল তথ্য তৃতীয় প্রান্তিকে এসে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে যেখানে মোট ভুল তথ্যের ১৯ ভাগ ছিল আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী সংক্রান্ত, সেটি এ প্রান্তিকে কমে ১ ভাগে এসে দাড়িয়েছে। এবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ভারত-পাকিস্তান সংঘাত কিংবা ইরান-ইসরায়েল সংঘাতসহ একাধিক আন্তর্জাতিক ঘটনার কারণে ভুল তথ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল, তবে তৃতীয় প্রান্তিকে এসে এমন কোনো বড় সংঘাত দেখা যায়নি। ফলে এ সম্পর্কিত ভুল তথ্যও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। এছাড়া এ প্রান্তিকে এসে ধর্মীয় অপতথ্যও কমতে দেখা গেছে। গেল প্রান্তিকে মোট অপতথ্যের ৭% থেকে তৃতীয় প্রান্তিকে ৪% এ থেমেছে ধর্ম সংক্রান্ত ভুল তথ্য।

এই প্রান্তিকে ভিডিওর মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অপতথ্য ছড়াতে দেখা গেছে। গেল প্রান্তিকে ছড়ানো মোট ভুল তথ্যের ৪৮% ছিল ভিডিওর মাধ্যমে তবে এই প্রান্তিকে এসে ভিডিও দিয়ে অপতথ্য ছড়িয়েছ ৬৬%। তবে ভুল তথ্য ছড়ানোর মাধ্যম হিসেবে কমেছে গ্রাফিক কার্ড, ছবি ও লিখিত পোস্টের ব্যবহার। এই প্রান্তিকের প্রতিটি মাসেই এসবের ব্যবহার কমে গিয়ে বেড়েছে ভিডিওর ব্যবহার।

গবেষণা পদ্ধতি

এই বিশ্লেষণটি করা হয়েছে ২০২৫ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আটটি ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইটে (রিউমর স্ক্যানার, বুমবিডি, নিউজচেকার, ফ্যাক্ট ক্রেসেন্ডো, ফ্যাক্ট ওয়াচ, এএফপি বাংলাদেশ, আজকের পত্রিকা এবং ডিসমিসল্যাব) প্রকাশিত প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে। যেখানে একাধিক ওয়েবসাইট একই ভুল তথ্য নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেখানে শুধু একটি প্রতিবেদনকে স্বতন্ত্র নমুনা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। 

বিষয়বস্তু অনুযায়ী প্রতিবেদনগুলোকে ভাগ করা হয়েছে ১৭টি বিভাগে। রাজনীতি, খেলাধুলা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ, ধর্ম, প্রকৃতি ও পরিবেশ, বিনোদন, প্রতারণা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, আইনশৃঙ্খলা, শিক্ষা, অর্থনীতি ও উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা, জননীতি, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী, অভিবাসন ও অন্যান্য।

রাজনৈতিক অপতথ্যের ধরন ভাগ করা হয়েছে নিম্নোক্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী:

বক্তব্য/বিবৃতি: যেকোনো ব্যক্তির নামে প্রচারিত ভুয়া বক্তব্য-বিবৃতিকে এই বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখানে কারও নামে ছড়ানো ভুয়া মন্তব্য বা উক্তি যেমন আছে, তেমনি পুরোনো কোনো সত্য বক্তব্যকে সাম্প্রতিক দাবিতে প্রচারের বিষয়টিও আছে।

চরিত্র হনন: রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের চরিত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে– এমন অপতথ্যগুলোকে চরিত্র হনন বিভাগে রাখা হয়েছে।

মিছিল/সমাবেশ: ভিন্ন রাজনৈতিক দলের মিছিল/সমাবেশের দৃশ্যকে নিজ দলের বলে ব্যবহার কিংবা পুরোনো ও ভিন্ন জায়গার মিছিল/সমাবেশের দৃশ্যকে সাম্প্রতিক দাবিতে প্রচারিত অপতথ্যগুলোকে এই বিভাগের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।

নির্যাতন/মৃত্যুর অভিযোগ: কোনো একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারী বলে নির্যাতন করা হচ্ছে, বা মেরে ফেলা হয়েছে দাবিতে ছড়ানো অপতথ্যগুলো এই বিভাগের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এছাড়া কোনো রাজনৈতিক নেতার ভুয়া মৃত্যুসংবাদও এই বিভাগে রাখা হয়েছে।

দুর্নীতি/অপরাধের অভিযোগ: এই বিভাগের আওতায় এসেছে রাজনৈতিক দল বা দলের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন অপরাধ বা দুর্নীতিতে জড়িত থাকা সংক্রান্ত ভুল তথ্যগুলো।

আদালত/কারাগার/গ্রেপ্তার সংক্রান্ত: বিভিন্ন ব্যক্তিকে জড়িয়ে আটকের ভুয়া দাবি, কিংবা কারাগার থেকে মুক্তির দাবিতে ছড়ানো অপতথ্যগুলো এই বিভাগে বিবেচনা করা হয়েছে।

সংঘর্ষ/সহিংসতা: বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে হামলা/ সংঘাতের পুরোনো দৃশ্য সাম্প্রতিক দাবিতে প্রচার সংক্রান্ত ভুল তথ্যগুলো এই বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া একটি দলের নেতাকর্মীদের সংঘাতের দৃশ্যকে অন্য দলের নামে প্রচারের ভুয়া দাবিও এখানে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। 

বিদেশী প্রভাব বিস্তারের ষড়যন্ত্র: বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান মন্তব্য করেছে বা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে এমন দাবিতে ছড়ানো অপতথ্যগুলো এই বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

সরকারি কার্যকলাপ: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের বিভিন্ন কার্যকলাপ কিংবা পদত্যাগের ভুয়া দাবিকে এই বিভাগে বিবেচনা করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের বিদেশী কার্যকলাপ: ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন কার্যক্রম সংক্রান্ত ভুল তথ্যগুলো এই বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

নির্বাচন: বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের নির্বাচন কিংবা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছড়ানো অপতথ্যকে এই বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। 

অন্যান্য: এইসব বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি এমন অপতথ্যগুলো অন্যান্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। যেমন: জুলাই অভ্যুত্থানকে হেয় করে শিক্ষার্থীদের গ্রাফিতি অঙ্কনের ভিডিও দাবিতে এআই দিয়ে বানানো ভিডিও প্রচার কিংবা শিক্ষার্থীদের হাতে ‘হাসিনাকে চাই’ লেখা প্লেকার্ডের একটি ছবি ছড়াতে দেখা গেলে যাচাই প্রতিবেদনে জানা যায় সেটি এআই জেনারেটেড।

আরো কিছু লেখা