তৌহিদুল ইসলাম রাসো
অপতথ্যের ব্যবসা
“সবাইকে কাঁদিয়ে” যেভাবে মুনাফা করছে ইউটিউব ও ইউটিউবারেরা
তৌহিদুল ইসলাম রাসো
ইউটিউবে ভিডিওটির শিরোনাম: “এইমাত্র সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন লিওনেল মেসি! কেঁদে কেঁদে একি বললেন মেসির স্ত্রী”। থাম্বনেইলে দেখা যাচ্ছে ফুটবল তারকার একটি ছবি, তার পেছনে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ঘেরা একটি কবর। প্রথম দেখাতেই স্পষ্ট হবে যে ভিডিওটি সত্য নয়, কিছুক্ষণের জন্য হয়তো দর্শকের মনে হাসির খোরাকও যোগাবে। আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ, এই ভুয়া ভিডিওটি হয়তো আপনি পাশ কাটিয়ে চলে যাবেন, এবং কিছুক্ষণ পর ভুলে যাবেন।
কিন্তু মৃত্যুর সেই ভুয়া ভিডিও যদি হয় এমন কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে যিনি হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থতার সঙ্গে লড়ছেন? তখন সেটি ভুক্তভোগীদের জন্য গভীর মানসিক যন্ত্রণা এবং ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমনটি ঘটেছে বাংলাদেশের তারকা অভিনেতা আলমগীর ও প্রবীর মিত্রের বেলায়। এমন একটি ভুয়া খবর যে পরিবারগুলোর জন্য কতটা পীড়াদায়ক হতে পারে, সেটি এই দুই অভিনেতার পরিবারের সদস্যরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন।
অনলাইনে এমন ভিডিওর সংখ্যা একটি বা দুটি নয়। নিছক ভুল করে, বা ভুলের শিকার হয়ে এমন ভিডিও বানানো হচ্ছে, এমনটা ভাবলেও ভুল করবেন। ডিসমিসল্যাব গত তিন মাস ধরে, “সবাইকে কাঁদিয়ে”, “না ফেরার দেশে” এবং “এইমাত্র মারা গেলেন” কিওয়ার্ড দিয়ে সার্চ করে জনপ্রিয় প্লাটফর্ম ইউটিউবে ১৭টি চ্যানেলে, তারকা-মৃত্যুর ১৫৯টি বানোয়াট ভিডিও পেয়েছে। এই গবেষণায় দেখা গেছে, তারকাদের মৃত্যুর ভুয়া ভিডিও এখন একটি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে, লাখ লাখ মানুষ ভিডিওগুলো দেখছেন এবং চ্যানেলগুলো সাবস্ক্রাইব করছেন।
এভাবে তারকাদের প্রতি মানুষের আবেগকে পুঁজি করে, জীবিত ব্যক্তিকে মৃত বানিয়ে এবং ভুক্তভোগীদের মানসিক যাতনায় ঠেলে দিয়ে ইউটিউব চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপন থেকে আয় করে যাচ্ছে এবং অপতথ্যের এই ব্যবসা থেকে ইউটিউবও আয়ের ভাগ নিচ্ছে।
এই গবেষণার জন্য সাক্ষাৎকার নেওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্ল্যাটফর্মগুলো অ্যাটেনশন ইকোনমি গড়ে তোলার কারণে ইন্টারনেট এমন এক জায়গা হয়ে উঠেছে, যেখানে কন্টেন্টের প্রধান উদ্দেশ্য আর তথ্য জানানো নয়, বরং হয়ে উঠেছে এনগেজমেন্ট। তাঁরা আরও বলছেন, এটি এতো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে যে ব্যবহারকারীরা বুঝতে পারছেন না কোনটা গ্রহণ করবেন আর কোনটা বর্জন করবেন। এবং এগুলো শুধু মানুষকে ভুল তথ্যই জানাচ্ছে না, একইসঙ্গে ভালোমানের তথ্য-নির্ভর কন্টেন্ট নির্মাতাদেরও ক্ষতির মুখে ফেলছে।
কোন তারকা কত বার “চলে গেলেন”
ভুয়া মৃত্যুর এই ভিডিওগুলোর শিকার মূলত বিভিন্ন খাতের তারকা ব্যক্তিত্বরা। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিডিও তৈরি হয় বিনোদন জগত, বিশেষ করে সিনেমা ও নাটকের তারকাদের নিয়ে। এই তালিকায় রাজনীতিবিদ, ক্রীড়াবিদ, এবং এমনকি ধর্মীয় বক্তাও আছেন। এবং ৯৬ শতাংশ ক্ষেত্রেই ভিডিওতে মারা গেছেন বলে দাবি করা এই ব্যক্তিরা জীবিত ছিলেন।
বানোয়াট ভিডিওতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীর। সাতটি আলাদা চ্যানেল মিলিয়ে তাঁর মোট মৃত্যু সংবাদ এসেছে নয় বার। এরপরই আছেন আরেক অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিক; ছয়টি আলাদা চ্যানেল মিলিয়ে বানোয়াট খবরে তিনি মারা গেছেন সাত বার। এক মানুষের এতবার মৃত্যুর খবর এলেও সবগুলো ভিডিওই দেখেছেন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দর্শক।
এছাড়া ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা ছয় বার, রচনা ব্যানার্জি ও শাবনূর আলাদা আলাদা চ্যানেল মিলিয়ে পাঁচ বার, দীপঙ্কর দে চার বার, এবং রানু মন্ডল তিন বার মিথ্যা খবরে মারা গেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, চিত্রতারকা আলমগীর, শাহরুখ খান, দেব, বা শাকিব খান – কেউ তাদের হাত থেকে রেহাই পাননি।
বাংলাদেশের অন্যতম সফল ক্রিকেটার এবং সাবেক জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার মৃত্যু ভিডিও আছে মোট ৬টি। এর মধ্যে বং টকিজ নামের ইউটিউব চ্যানেলটিই তাঁকে নিয়ে ৪ বার মৃত্যুর ভিডিও বানিয়েছে। ভিডিওগুলো পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, থাম্বনেইল ও শিরোনামে মাশরাফির মৃত্যু হয়েছে বা মাশরাফিকে নিয়ে খারাপ খবর আছে বলা হলেও শেষের দিকে বলা হচ্ছে তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি, অথবা খেলতে গিয়ে চোট পেয়েছেন। থাম্বনেইলে মাশরাফি একটি হাসপাতালের বেডে রক্তাক্ত অবস্থায় আছেন এমনটি দেখানো হয়েছে, আবার ক্রিকেটাররা তাঁকে ঘিরে কাঁদছেন বা দাফনের জন্যে নিয়ে যাচ্ছেন এমনটিও থাম্বনেইলে ফুটে উঠেছে।
প্রয়াত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জীবিত থাকা অবস্থাতেই তাঁর মৃত্যু সংবাদের ভিডিও প্রকাশ করা হয়। আরেক প্রয়াত অভিনেতা তাপস পালকে নিয়ে দুই বার মৃত্যু সংবাদ আছে একই চ্যানেলে। তিনি অসুস্থ থাকাকালীন, তাঁর জীবদ্দশাতে ৩০ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে একবার ভিডিও আসে যে “তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন।” তার মৃত্যুদিন ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে আরেকটি ভিডিও প্রকাশ হয় এই চ্যানেল থেকে। মৃত্যুর দিন পোস্ট করা ভিডিওতেও বলা হয়, তিনি অসুস্থ ছিলেন তবে এখন সুস্থ আছেন।
তারকা মৃত্যুর ভুয়া খবর যারা ছড়ায়
ডেটাভিত্তিক এই বিশ্লেষণে দেখা যায়: যে ১৭টি চ্যানেল মৃত্যুর ভিডিওর ব্যবসায় নেমেছে তাদের একেকটির গড় সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা সাড়ে চার লাখের বেশি। অর্থাৎ, ১৭টি চ্যানেলের মোট সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ৭৯ লাখ প্রায়। এদের বেশিরভাগই বিনোদনের খবর বা গসিপ চ্যানেল হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়, এবং ৫টি সংবাদ চ্যানেল হিসেবে কন্টেন্ট প্রকাশ করে থাকে।
গবেষণায় পাওয়া যায় এই বানোয়াট মৃত্যু সংবাদ সবচেয়ে বেশি বানিয়েছে তারকা গল্প নামের একটি ইউটিউব চ্যানেল। সবাইকে কাঁদিয়ে শব্দ ব্যবহার করে তারা মোট ৪০টি ভিডিও বানিয়েছে। ৩ লক্ষ ১৮ হাজারের বেশি সাবস্ক্রাইবারের এই চ্যানেলের ভিডিও দর্শক সংখ্যাও অনেক।
চ্যানেলটির ভিডিওগুলোতে জনপ্রিয় সব বিনোদন তারকা এবং ক্রীড়াবিদদের মারা যাবার বানোয়াট নিউজ ভিডিও আছে।
ভুয়া ভিডিও ভিউয়ের সংখ্যায় সেরা পাঁচের তালিকায় এরপরই আছে বং টকিজ, লাইভ টকিজ, এক্সক্লুসিভ সিনে গসিপ এবং রিপোর্টার নীলাঞ্জনা নামের চ্যানেলগুলো। এদের মধ্যে বং টকিজকে বাংলা ভাষায় এই ভুয়া মৃত্যুর ভিডিওর ধারার প্রবর্তকও বলা যেতে পারে।
বং টকিজ নামের চ্যানেলটিতে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন এমন হেডলাইনের ভিডিও আছে সর্বমোট ৩১টি। চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা সাড়ে সাত লাখেরও বেশি। তারা ২০১৯ সালে প্রথম এধরনের ভিডিও তৈরি করতে শুরু করে। পরে অন্য চ্যানেলগুলো তাদের অনুসরণ করতে থাকে।
মিথ্যা মৃত্যুর মনিটাইজেশন
ইউটিউব থেকে আয় করতে হলে প্রথমে কিছু শর্ত পূরণ করতে হয় ইউটিউবারদের। এই শর্ত পূরণের পর ইউটিউবাররা ইউটিউব পার্টনারশিপ প্রোগ্রামে যুক্ত হয় এবং চ্যানেলকে মনিটাইজ করতে পারে। চ্যানেল মনিটাইজ হয়ে গেলে তারা কয়েকভাবে আয় করতে পারে। তবে মূল আয় হয় গুগল এডসেন্স থেকে। একবার যখন চ্যানেলে এডসেন্স চালু হয়ে যায় তখন ওই চ্যানেলের যেকোনো ভিডিওর মাঝে গুগল থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখানো হয় এবং এর বিনিময়ে সেই চ্যানেলের মালিক আয় করে থাকে।
এই গবেষণা চলাকালে ১৬টি চ্যানেলের তারকা-মৃত্যু সংক্রান্ত বানোয়াট ভিডিওতে বিজ্ঞাপন চলতে দেখা গেছে। অর্থাৎ এই ভিডিওগুলো থেকে চ্যানেলগুলো আয় করেছে। একটি চ্যানেল এই গবেষণা চলাকালীন বন্ধ হয়ে গেছে।
গত মার্চ নাগাদ, তাদের প্রকাশ করা মৃত্যুর ভিডিওগুলো ৪ কোটি ৩৪ লাখ বারের বেশি দেখা হয়েছে। অর্থাৎ, একেকটি ভিডিওর গড় ভিউ পৌনে তিন লাখের মত। সবচেয়ে বেশিবার দেখা হয়েছে মিঠুন চক্রবর্তীকে নিয়ে বানানো একটি ভিডিও; ভিডিওটি দেখেছে ৭৮ লাখেরও বেশি দর্শক। দশ লাখের ওপর ভিউ আছে এমন ভিডিওর সংখ্যা ১৫টি।
চ্যানেলে পাওয়া ভিডিওগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৮৭ শতাংশ ভিডিওতে শিরোনাম ও থাম্বনেইলের সঙ্গে নেপথ্য কণ্ঠে (ভয়েসওভার) দেওয়া তথ্যের মিল নেই। মারা গেছেন বা না ফেরার দেশে চলে গেছেন এমনটি শিরোনাম ও থাম্বনেইলে তুলে ধরলেও ভিডিও কন্টেন্টে বলা হচ্ছে ওই নির্দিষ্ট ব্যক্তি অসুস্থ আছেন, শুটিংয়ের সময় আঘাত পেয়েছেন, অথবা বিনোদন জগৎকে বিদায় জানিয়েছেন।
মাত্র ২০টি ভিডিওতে শিরোনাম ও থাম্বনেইলের সঙ্গে নেপথ্য কন্ঠের (ভয়েসওভার) মিল আছে। এই ২০ টি ভিডিওর মধ্যে মাত্র ৫টি ভিডিও এমন আছে যেখানে কন্টেন্টে মৃত বলা ব্যক্তি প্রকৃত অর্থে মৃত; বাকি ১৫টি ভিডিওতে ব্যক্তি পুরোপুরি মারা গেছেন বলা হলেও তারা আসলে জীবিত আছেন।
এমনও কিছু ভিডিও পাওয়া গেছে যেখানে ভিডিওর শুরুতে বলা হয় কোনো জনপ্রিয় ব্যক্তি মারা গেছেন, এরপর বলা হয় না টেনে পুরো ভিডিও দেখতে; তবে বিস্তারিত অংশে ওই ব্যক্তির জীবনবৃত্তান্ত তুলে ধরা হয়। শেষে বলা হয় ওই ব্যক্তির মারা যাবার তথ্য কোথাও পাওয়া যায়নি এবং এটি একটি গুজব। কিন্তু থাম্বনেইল ও শিরোনামে ওই ব্যক্তি মারা গেছেন এমনটিই তুলে ধরা হয়। ভিডিও যত বেশি সময় ধরে দেখা হয়, সেখান থেকে ভিউ বাবদ আয়ও তত বেশি হয়।
অনলাইন অপতথ্য এবং আর্থিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত অপতথ্য নিয়ে দীর্ঘ দিন গবেষণা করছেন ফরাসী বংশোদ্ভূত গবেষক ভিকতোয়া রিও। তিনি বলেন, অ্যাটেনশন ইকোনমি বাস্তবায়নের একটি বড় জায়গা গুগল কিংবা ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো। এখানে মানুষের অ্যাটেনশন বা মনোযোগের বিনিময়ে গড়ে ওঠে ব্যবসার একটি কাঠামো। আর অপতথ্য ছড়াতে এই অ্যাটেনশন ইকোনমির একটি বড় প্রভাব রয়েছে।
তিনি মনে করেন, এই প্ল্যাটফর্মগুলো এসব কন্টেন্ট থেকে টাকা না পেলে কখনোই এগুলো প্রচার করত না। অপতথ্য প্রচারে সহায়ক এই কাঠামোর মূলে মনিটাইজেশন এবং এভাবে অ্যাটেনশন রূপ নেয় টাকায়।
এখান থেকে ইউটিউব যেভাবে আয় করে
সাধারণত বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের মাধ্যমে ইউটিউব ও কন্টেন্ট ক্রিয়েটরেরা অর্থ পেয়ে থাকে। ওয়াইপিপি প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে ব্যবহারকারীরা কোনো ভিডিও মনিটাইজ করবে তা নিজেদের ইচ্ছামতো নির্ধারণ করতে পারেন। কোনো চ্যানেলে প্রতিটি বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য ইউটিউব সাধারণত বিজ্ঞাপনদাতাদের দেওয়া অর্থের ৪৫ শতাংশ পেয়ে থাকে। অন্যদিকে কন্টেন্ট ক্রিয়েটরেরা পায় বাকি ৫৫ শতাংশ।
ইউটিউবের নীতিমালা অনুসারে বর্তমানে ব্যবহারকারীরা ঐচ্ছিকভাবে ওয়াচ পেজ মনিটাইজেশন এবং শর্ট মনিটাইজেশন এই দুধরনের বিজ্ঞাপন মডিউল বেছে নিতে পারেন। ওয়াচ পেইজ মডিউলে বিজ্ঞাপন প্রচারিত হলে ক্রিয়েটরকে ৫৫ শতাংশ নেট রাজস্ব দিয়ে থাকে ইউটিউব, অন্যদিকে শর্টস মনিটাইজেশনে দেওয়া হয় ৪৫ শতাংশ নেট রেভিনিউ।
রিওর মতে, “ভুয়া বা অপতথ্য ছড়াচ্ছে এমন ক্রিয়েটরদের অর্থায়নের মাধ্যমে ইউটিউব কেবল এধরনের কাজকেই উৎসাহিত করছে না, একইসঙ্গে একটি খাতকেও সমৃদ্ধ করছে যেখানে কন্টেন্ট ক্রিয়েটররা বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে অসাধু কাজে জড়িত হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “এর মূল কারণ দায়সারা ভাব। ইউটিউব এদের নিয়ে ব্যবসা করছে। ইউটিউব তাদের বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে কাদের উপস্থাপন করছে, অর্থাৎ শেষ অবধি কাদের কাছে টাকা পাঠাচ্ছে সে বিষয়ে তাদের জ্ঞান আরও পর্যাপ্ত হওয়া উচিত।”
বিশ্বের বৃহত্তম ডিজিটাল এডভার্টাইজিং ব্যবসা গুগলের হাতে। গুগল বিজ্ঞাপনের অধিকাংশই আসে গুগল সার্চ ও ইউটিউবে বিজ্ঞাপন দেওয়ার মাধ্যমে। “হু ফান্ডস মিসইনফরমেশন? আ সিস্টেমেটিক অ্যানালাইসিস অব দ্য এড-রিলেটেড প্রফিট রুটিনস অব ফেক নিউজ সাইটস”- শীর্ষক গবেষণায় ২,৪০০ জনপ্রিয় নিউজ ওয়েবসাইট এবং শো বিশ্লেষণ করে দেখেছে, ৪০ শতাংশের বেশি ফেক নিউজ ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার সঙ্গে গুগল ও ইনডেক্স এক্সচেঞ্জের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে।
দর্শক হাসেন, ফিরেও আসেন
এই ধরনের কন্টেন্ট যে দর্শক আকৃষ্ট করে সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় ভিডিওগুলোতে দর্শকদের করা মন্তব্য বিশ্লেষণে। ভিডিওগুলো অসত্য এবং বানোয়াট বুঝেও দর্শকেরা একই চ্যানেলে বার বার ফিরে এসেছেন। রণজিৎ মল্লিককে নিয়ে করা এক বানোয়াট ভিডিওতে ranay ranay নামের ইউটিউব ব্যবহারকারী মন্তব্য করেছেন: “মানুষ কয়বার মরে।” আরেক ব্যবহারকারী Azimul Chowdhury মন্তব্য করেন, “আরে ভাই রঞ্জিত মল্লিক কতবার মরবে? আজ থেকে পাঁচ বছর আগে থেকে শুনে আসছি রঞ্জিত মল্লিক মারা গেছে! রঞ্জিত মল্লিক কি প্রতি বছর মারা যায়?”
ভিকতোয়া রিও বলেন, “যারা এই কাজগুলো করছেন তারা জানেন কীভাবে কৌশলে এনগেজমেন্ট বাড়াতে হয়। এটা শুধু কন্টেন্টের ব্যাপার না। এই কন্টেন্ট ক্রিয়েটররা অ্যালগরিদমকেও প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। তারা দিনের পর দিন ফেক ভিডিও ভিউ, ফেক ক্লিকের মতো কার্যকলাপের পাশাপাশি চটকদার কন্টেন্ট ও শিরোনামের মাধ্যমে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে কোন ধরনের কন্টেন্ট জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, সে বিষয়ে অ্যালগরিদমকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে।”
ভারতীয় ক্রিকেটের ঋষভ পন্থ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেও নিউজ স্কোয়াড নামের এক ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিওতে বলা হয়, তিনি মারা গেছেন। তবে দিশা নামের একজন এই ভিডিওতে কমেন্ট করে বলেন “শুধু শুধু লেখা গুলো দিয়ে ভিউ বাড়ানোর ধান্দা, এই জন্যই বিরক্ত লাগে চ্যানেলটা।” আবার প্রয়াত ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর বেঁচে থাকা অবস্থায় ২০১৯ সালে তাঁকে নিয়ে মৃত্যু খবর ছড়ানো হয়। ওই ভিডিওতে Dipankar De নামের একজন মন্তব্য করেন, “ভিডিওটার বিষয়বস্তু ভালো, কিন্তু টাইটেল টা যথেষ্ট মিসলিডিং। এরকম টাইটেল দিয়ে ভিডিও বানাবেন না।”
কিন্তু এমন মন্তব্যের পরও এসব ভিডিও বানানো বন্ধ হয়নি। বানোয়াট এসব ভিডিওতে মানুষের আগ্রহ থাকায় চ্যানেল মালিকরা এই ধরনের ভুয়া নিউজ বানিয়ে, ইউটিউব থেকে আয় করে চলেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. জিনাত হুদা বলেন, “ব্যক্তিগত পর্যায়ে এই ধরনের কন্টেন্টগুলো বড় ধরনের ক্ষতি করছে। মানুষ সামাজিক মূল্যবোধ এবং রুচিবোধের খরার মধ্যে চলে যাচ্ছে। বুঝতেই পারছে না কোনটা গ্রহণ করবে আর কোনটা বর্জন করবে।”
ইউটিউবের নীতিমালা কী বলে
আয়ের জন্যে ইউটিউবারদের যে ধরনের কন্টেন্ট বানিয়ে ইউটিউবে আপলোড করতে হয়, সেটার জন্যে কিছু কমিউনিটি গাইডলাইন আছে। চ্যানেল সচল রেখে ইউটিউব থেকে আয় করতে ইউটিউবের এসব শর্তাবলী মেনে চলা আবশ্যক। শর্তাবলীর লঙ্ঘন হলে চ্যানেলগুলোকে সতর্ক করা থেকে শুরু করে স্ট্রাইক ও বন্ধ করা পর্যন্ত বিভিন্ন শাস্তি দিতে পারে ইউটিউব কর্তৃপক্ষ।
ইউটিউবের কমিউনিটি গাইডলাইনের থাম্বনেইল পলিসি অংশে বলা আছে, এমন থাম্বনেইল ব্যবহার করা যাবেনা যেটি দেখে দর্শক বিভ্রান্ত হয়। অর্থাৎ, যদি এমনটি হয় যে থাম্বনেইলে যা দেখানো হচ্ছে সেটি আসলে ভিডিওতে নেই, বা তথ্য অন্যরকম দেওয়া হচ্ছে তাহলেও ইউটিউব ব্যবস্থা নিতে পারে। এই গবেষণায় ১৩৯টি ভিডিওতে থাম্বনেইল ও কন্টেন্টে মিল পাওয়া যায়নি, কিন্তু চ্যানেল বা ভিডিওগুলো বহাল তবিয়তে ব্যবসা করছে।
নীতিমালায় বলা হয়, এমন থাম্বনেইল ইউটিউবে ব্যবহার করা যাবে না যেখানে গ্রাফিক্স বা অন্যভাবে রক্ত দেখা যাবে। যদি এরকম থাম্বনেইল কেউ ব্যবহার করে তাহলে ইউটিউব স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই থাম্বনেইল সরিয়ে ফেলবে এবং চ্যানেলটি স্ট্রাইকের সম্মুখীন হবে। কিন্তু গবেষণার ভিডিওর থাম্বনেইল পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, মাশরাফির বানোয়াট মৃত্যু সংবাদের থাম্বনেইলে রক্ত দেখা গেলেও সেটি সরেনি।
কমিউনিটি গাইডলাইনে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিলে চ্যানেল কি ধরনের সমস্যায় পড়তে পারে সেটিও ব্যাখ্যা করা আছে। এই গবেষণায় যে ১৭টি চ্যানেল অন্তর্ভুক্ত, তাদের সবকটি ইউটিউবের কমিউনিটি গাইডলাইন কোনো না কোনাভাবে লঙ্ঘন করেছে। এদের মধ্যে ১৬টি সক্রিয়।
কিন্তু ইউটিউব কেন এসব ভিডিও ধরতে পারে না? দ্য ডেইলি স্টারের ডিজিটাল গ্রোথ এডিটর আজাদ বেগ বলেন, “ইউটিউবের এআই বা অ্যালগরিদম কোনো কন্টেন্ট দেখে না, তারা শুধু কোনো ভিডিওতে অন্য কারও কপিরাইট আছে কি না, সেটা দেখে। ওদের বট শুধু কপিরাইট লঙ্ঘনকারী অডিও বা ভিডিও ক্লিপ ডিটেক্ট করতে পারে। কেউ কমপ্লেইন করলে তারা ম্যানুয়ালি পদক্ষেপ নেয়, তা না হলে নেয় না।”
“এই ধরনের কার্যকলাপ আসলেই উদ্বেগজনক। এটা শুধু আমাদের তথ্য-পরিবেশকেই কলুষিত করছে তা নয়, একইসঙ্গে মুক্ত গণমাধ্যমসহ যারা সুস্থধারার কনটেন্ট তৈরি করছে তাদের জন্যও চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এছাড়া মানবসম্পদ, সামাজিক মাধ্যম ও অটোমেশন টুলসের মতো বিষয়গুলো নিয়ে কালোবাজারি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে, যা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারেরও শঙ্কা থাকে।”
ভিকতোয়া রিও, গবেষক
এই ভুয়া ভিডিও থেকে ক্ষতি হয় যাদের
এ ধরনের ইচ্ছাকৃত বিভ্রান্তিকর খবর ছড়ানোর ফলে ইউটিউবার এবং ইউটিউব কর্তৃপক্ষ লাভবান হলেও সাধারণ দর্শকসহ বানোয়াট খবরে মিথ্যা-মৃত্যুর শিকার ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। সাধারণ দর্শকেরা অনেক সময় এটা সত্য বলে ধরে নিয়ে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে দেন। ফলে একটা মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়ে আরও নানান প্লাটফর্মে। আবার বানোয়াট খবরে মারা যাওয়া ব্যক্তিরাও অস্বস্তিতে পড়েন। জনপ্রিয় ব্যক্তিরা মারা গেলে তাদের শুভানুধ্যায়ীরা খোঁজ খবর নেন, যেটা ওই ব্যক্তি ও পরিবারের জন্যে অস্বস্তিজনক।
প্রবীর মিত্রের বানোয়াট মৃত্যু সংবাদ নিয়ে ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হন প্রবীর মিত্র এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা। এ বিষয়ে কোনো গুজব না ছড়ানোর অনুরোধ করেন তাঁরা। সে সময় দৈনিক প্রথম আলোকে প্রবীর মিত্রের ছেলে মিঠুন মিত্র বলেছিলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো বিভ্রান্তিকর তথ্য নিয়ে তাদের বিব্রত হতে হচ্ছে।
নায়ক আলমগীরকে নিয়ে বানোয়াট মৃত্যু সংবাদে শিল্পীর পরিবার ও চলচ্চিত্র অঙ্গনের অনেকে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। অভিনেতা নিজেও প্রচণ্ড মর্মাহত হয়েছেন বলে জানা যায় দৈনিক যুগান্তর থেকে।
মৃত্যুর আগে মেরে ফেলার প্রবণতা কেন? শিরোনামে মানবজমিনের একটি রিপোর্টে মৃত্যুর বানোয়াট খবর প্রকাশের কারণ ও প্রভাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, “এমন খবর মানুষের মনে বিশাল আঘাত করে। ওই ব্যক্তির সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়। যাদের মানসিক কাঠামো দুর্বল তারা অনেক ভেঙে পড়েন। আবার যারা মানসিকভাবে শক্ত থাকেন তারাও অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েন। এর জন্য ওই ব্যক্তির জীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ে।”
সত্যিকারের সঠিক তথ্য বা সংবাদভিত্তিক চ্যানেলগুলো এই ভুয়া ভিডিও বা চ্যানেলের কারণে রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়। এভাবে বাজারে আর্থিকভাবে ডিসইনফর্মেশন আরো শক্তিশালী হয় এবং মানুষ বঞ্চিত হয় সঠিক তথ্য থেকে।
আজাদ বেগ বলেন, “এখন টিভি-প্রিন্ট সব মিডিয়াই অনলাইন গ্রোথের ওপর ফোকাস করছে। কোনো মিডিয়া যত বেশি ফিন্যান্সিয়ালি সলভেন্ট হবে, তারা তত বেশি রেপুটেন্ট হবে। সরকারি বিজ্ঞাপন মানে তাদের কন্ট্রোলের আন্ডারে যাওয়া। কিন্তু এই ডিপেন্ডেন্সি না থাকলে বা মিডিয়ার ডিজিটাল আর্নিং ভালো হলে তাদের কোনো প্রেশারে পড়তে হবে না, স্বাধীনভাবে অপারেট করতে পারবে।”
ভিকতোয়া রিও বলেন, “এই ধরনের কার্যকলাপ আসলেই উদ্বেগজনক। এটা শুধু আমাদের তথ্য-পরিবেশকেই কলুষিত করছে তা নয়, একইসঙ্গে মুক্ত গণমাধ্যমসহ যারা সুস্থধারার কন্টেন্ট তৈরি করছে তাদের জন্যও চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এছাড়া মানবসম্পদ, সামাজিক মাধ্যম ও অটোমেশন টুলসের মতো বিষয়গুলো নিয়ে কালোবাজারি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে, যা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারেরও শঙ্কা থাকে।”
** সোশ্যাল মিডিয়ায় চলমান তথ্যপ্রবাহ নিয়ে ডিসমিসল্যাবের ধারাবাহিক গবেষণার প্রথম কাজ এই প্রতিবেদনটি। সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশনে সহায়তা করেছেন তামারা ইয়াসমীন তমা ও পার্থ প্রতীম দাস।