ডিসমিসল্যাব

টিএমডি হ্যাশট্যাগে ছড়ানো হচ্ছে ধর্মীয় বিদ্বেষ, সহিংসতার ডাক
ডিসমিসল্যাব
এই প্রতিবেদনের কিছু ছবি ও ভাষা সংবেদনশীল পাঠকদের জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে।
বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমে #টিএমডি হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। সম্প্রতি, বিশেষ করে ফেসবুকে, অসংখ্য ব্যবহারকারী এই হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে পোস্ট দিচ্ছেন। ডিসমিসল্যাব, গত ২২ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে, একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর প্রতি সহিংসতা ও হত্যার উস্কানি ও সরাসরি বিদ্বেষ ছড়ানো অন্তত ৩৯টি পোস্ট পেয়েছে।
এই ৩৯টি পোস্ট সুস্পষ্টভাবে বিদ্বেষমূলক। ডিসমিসল্যাব, এর বাইরে আরও প্রায় ১৭৮টি পোস্ট পেয়েছে যেগুলোতে টিএমডি লেখাসহ সাংকেতিক ভাষায় বা দ্ব্যর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বার্তা ছড়ানো হয়েছে। সংগ্রহ করা প্রতিটি পোস্টই সেই এক সপ্তাহ সময়ের মধ্যে ছড়িয়েছে।
ডিসমিসল্যাবের বিশ্লেষণ করা অনেক পোস্ট ফেসবুকের মালিকানা প্রতিষ্ঠান মেটার কমিউনিটি নীতিমালার পরিপন্থী। বাংলাদেশের সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশেও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো অপরাধ। সেই বিচারে, অন্তত ৩৯টি পোস্ট দেশের আইন এবং প্লাটফর্মের নীতিমালা দুটোই ভঙ্গ করছে। এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত কিছু পোস্ট ও একটি গ্রুপ ফেসবুক থেকে সরানো হয়েছে, তবে বেশিরভাগই এখনো রয়ে গেছে।
বাংলাদেশে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ২০২৪ সালের ২৮ নভেম্বর টিএমডি হ্যশট্যাগে সবচেয়ে পুরোনো পোস্টগুলো পাওয়া যায়। ওই দিনই একজন ব্যবহারকারী “Total ملعون death #TMD” লিখে পোস্ট করেন। এর বাংলা করলে দাঁড়ায় “সম্পূর্ণরূপে মালাউন নিধন”। তখন এই অর্থেই এটি সরাসরি ব্যবহার হতে দেখা যায়।
ملعون বা মালাউন মূলত একটি আরবি শব্দ যার আভিধানিক অর্থ অভিশপ্ত। তবে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে শব্দটি বহুদিন ধরে হিন্দু সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে অবমাননাকর গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
পরের এক বছরে সেটি “টোটাল মিষ্টি ডিস্ট্রিবিউশন” সহ বিভিন্ন রূপ নেয়। কিন্তু অর্থ বা রূপ যেমনই হোক কয়েকটি ফেসবুক পেজ ও গ্রুপে হিন্দু ধর্ম বিদ্বেষী পোস্টের সঙ্গেই টিএমডি হ্যাশট্যাগ বেশি ব্যবহার হতে দেখা যায়।
টিএমডির বিদ্বেষমূলক ব্যবহারের ধারা বাংলাদেশেই প্রথম নয়। এর উৎপত্তি অন্য দেশ থেকে। পশ্চিমা অনলাইন মহলে ‘টোটাল মুসলিম ডেথ’ এবং ভারতে ‘টোটাল মোল্লা ডেথ’ নামে অনুরূপ ব্যবহার দেখা গেছে। গাজায় ইসরায়েলি আক্রমণের সময় ফিলিস্তিনি ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য ব্যবহার হয়েছে টিএমডি (Total Muslim Death) ও টিপিডি (Total Palestinian Death)-এর মতো হ্যাশট্যাগও।

৩৯টি প্রত্যক্ষ বিদ্বেষমূলক পোস্টের ভাষ্য যেমন
গত ২৫ অক্টোবর সকালে “ভিত্তিমূলক মিম পোস্টিং” নামের একটি ফেসবুক প্রোফাইল থেকে একটি রিল বা সংক্ষিপ্ত ভিডিও পোস্ট করা হয়। ভিডিওটিতে একের পর এক কমলা রঙের দাড়িসহ ছবি পোস্ট করা ব্যক্তির ছবি আসছে, এবং তার পটভূমিতে একটি গান বাজছে। গানটির ভাষা হলো, “বাংলার মোল্লা, ফালাও মালুর কল্লা।” এখানে কমলা রঙের দাড়িসহ ব্যক্তিদের “বাংলার মোল্লা” হিসেবে অভিহিত করে তাদের প্রতি কখনো গানে, কখনো ছবি, কখনো সরাসরি লেখায় মালুর (মালাউনের সংক্ষিপ্ত রূপ) কল্লা ফেলার ডাক দেওয়া হচ্ছে।
এই গানের ভাষা সরাসরি একাধিক পোস্টেও ক্যাপশন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাবের বিশ্লেষণে এই ভাষা ব্যবহার করে সহিংসতার উস্কানি দেওয়া পোস্টই সবচেয়ে বেশী পাওয়া গেছে। ৩৯টি পোস্টের ৮টিতেই হুবহু একই ভাষায় সরাসরি “মালুদের” হত্যা করতে বলা হচ্ছে।
চার ব্যবহারকারী (১, ২, ৩, ৪) সরাসরি টিএমডিকে “টোটাল মালাউন ডেথ” অর্থে ব্যবহার করেছেন। এদের একজন “নোয়াখালী ১০ অক্টোবর ১৯৪৬” লিখে পোস্ট করে, নিজেই পোস্টের কমেন্টে টিএমডির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আরেক জন টোটাল মালাউন লিখে তারপর ডেথ বা মৃত্যুর প্রতীক ব্যবহার করেছেন।
সাতটি পোস্টে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ইঙ্গিত করে, তাদের যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই “টিএমডি করে” দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। কেউ কেউ এই দাবির সঙ্গে মালাউন মুক্ত দেশ গড়ার কথা বলেছেন।
একজন সরাসরি বলেছেন, “পাথর নিক্ষেপ করে মারতে হবে মালুদের এটাই শাস্তি”। “ভারতে যদি মুসলমান মাইরা ফেলায়, আমরা এই দেশের হিন্দু মাইরা ফেলামু। একটাও বাঁচতে দিমু না”, টিএমডির সঙ্গে এমন একটি অডিও শেয়ার করেন অনেকে। বাকিরা মালু বা হিন্দু মুক্ত দেশ গড়ার কথা বলছেন অথবা “মালাউন” শব্দ ব্যবহার করে অশ্লীল ভাষায় গালি দিয়েছেন।
আরেকজন ব্যবহারকারী একটি নিউজ ফটোকার্ড শেয়ার করে লিখেছেন, “যারা ইসকন খারাপ হিন্দুর সাধারণ হিন্দুদের ভালো বলে তারা এই কমেন্ট বক্সে দেখলেই বুঝবেন সবগুলো একই শুয়োরের পাল সবগুলোকে একভাবেই ট্রিট করতে হবে। TMD করা ছাড়া উপায় নাই।”
প্রসঙ্গত, ধর্ম, জাতি, বর্ণ বা জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে কাউকে আক্রমণ, অপমান (যেমন মালাউন বলা), হুমকি দেওয়া বা সহিংসতায় উস্কানি দেওয়া অথবা দেশ থেকে বের করে দেওয়ার মতো বর্জনমূলক বক্তব্যকে বিদ্বেষমূলক বলে ধরা হয়।
ঘৃণার বদলে ঘৃণা
গত ২৪ অক্টোবর থেকে টিএমডি হ্যাশট্যাগের সঙ্গে ফেসবুকে লাল–কমলা দাড়ির সঙ্গে ছবি পোস্ট করার একটি নতুন ট্রেন্ড শুরু হয়, যেখানে টিএমডি সমর্থকেরা গর্বের সঙ্গে নিজেদের ‘বাংলার মোল্লা’, ‘কাঙলু’ ইত্যাদি নামে পরিচয় দিতে শুরু করেন।
মাত্র তিন দিনের মধ্যে (২৪ থেকে ২৬ অক্টোবর) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কমপক্ষে ৮৮টি পাবলিক পোস্টে এই নতুন পরিচয়ের প্রতি সমর্থন দেখা যায়। এদের অধিকাংশই এআই প্রম্পট ব্যবহার করে লাল রঙ করা দাড়ি ও চুল রঙ করা ছবি শেয়ার করে ট্রেন্ডে যোগ দেয়। ২৪ অক্টোবর সকালে পাওয়া সবচেয়ে পুরোনো পোস্টটির ক্যাপশন ছিল, “বাংলার মুল্লাহ, ফালাও মালুর করল্লা”।
টিএমডি ট্রেন্ডের প্রেক্ষাপট খুঁজতে গিয়ে ডিসমিসল্যাবের সামনে আসে ভারতীয় সোশ্যাল মিডিয়ার দীর্ঘদিনের বাংলাদেশবিদ্বেষী মিম সংস্কৃতি। ফেসবুক (১, ২, ৩) ইন্সটাগ্রাম (১, ২) রেডিট (১, ২), এক্স (সাবেক টুইটার) (১, ২, ৩)–সহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ‘কাঙলু’ বা ‘মোল্লা’ লিখে অনুসন্ধান করলে পাওয়া যায় অসংখ্য মিম, যেখানে বাংলাদেশি পুরুষদের লাল দাড়ি, লুঙ্গি ও টুপি পরিহিত অবস্থায় দেখিয়ে ব্যঙ্গ করা হয়। এসব মিমে তাদের উপস্থাপন করা হয় অপরিচ্ছন্ন, দরিদ্র ও ধর্মীয়ভাবে পশ্চাৎপদ হিসেবে।
সাম্প্রতিক সময়ে তা আরও ব্যাপকভাবে ফিরে এসেছে, বিশেষত এআই-নির্মিত কনটেন্টের মাধ্যমে। অসংখ্য এআই জেনারেটেড ভিডিওতে বাংলাদেশের পতাকা জড়ানো লাল-কমলা দাড়ির ব্যক্তিকে দেখানো হচ্ছে ব্যঙ্গাত্মকভাবে। ফেসবুক ও এক্সে ছড়িয়ে পড়া এমনই এক ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়- একজন বয়স্ক, কমলা দাড়িওয়ালা মানুষ কাঁদছেন, কারণ ডিএনএ পরীক্ষায় জানা গেছে তার মধ্যে “তুর্কি রক্ত নেই।”
কিন্তু সেই পরিচয়কেই ধারণ করার মাধ্যমে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন টিএমডি প্রচারকেরা। কেউ লিখেছেন, “বাংলার মোল্লা টিএমডির জন্য তৈরি” (Banglar Mollah ready for T M D), আরেকজনের পোস্ট, “টিএমডির জন্য গণ মোল্লাকরণ জরুরী” (Mass mollafying is important for #TMD”)। অন্য একজন লিখেছেন, “হ্যাঁ, আমিই সেই কাংলার মোল্লা।”
টিএমডি সংক্ষিপ্ত রুপটি শুধুমাত্র বাংলাদেশে হিন্দু বিদ্বেষী অর্থেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি ইসলাম-বিদ্বেষী প্রচারেও ব্যবহৃত হচ্ছে। ফেসবুকে ‘টোটাল মোল্লা ডেথ-টিএমডি‘ নামের একটি পেজ খুঁজে পাওয়া যায়। পেজের বিবরণীতে, সেটি ভারত থেকে পরিচালিত বলে দাবি করা হয়েছে। পেজটির বেশিরভাগ পোস্টই ইসলাম-বিদ্বেষী এবং কোনো কোনো পোস্টে সরাসরি গণহত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে।
একটি পোস্টে লেখা হয়েছে, “একমাত্র নির্বিচারে মোল্ল্যা গণহত্যাই পারে সারা পৃথিবীকে নৈরাজ্যমুক্ত ও শান্তিতে রাখতে”। আগে পেজটির নাম ছিল ‘এক্স হিন্দু এথিস্ট’, যা গত আগস্টে বদলে বর্তমান নামে আনা হয়। একইভাবে, টুইটারেও একাধিক ক্ষেত্রে (১, ২) টিএমডি-কে ‘টোটাল মোল্লা ডেথ’ অর্থে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।

বাংলাদেশে টিএমডি ট্রেন্ডের সঙ্গে ১৯৪৬ সালের নোয়াখালী দাঙ্গার প্রসঙ্গ টেনেও বিভিন্ন পোস্ট ছড়িয়েছে। ২৪ অক্টোবর মতিঝিল শাপলা চত্বরের সামনে তোলা আরবি লেখা পতাকায় মুখ ঢাকা একটি ছেলের ছবিতে দুটি পোস্টার দেখা যায়। একটিতে লেখা, “আমাদের দাদাদের জিজ্ঞেস করার সময় এসেছে যে তারা নোয়াখালিতে কী করেছিল— এবং প্রস্তুত হও।” অন্য পোস্টারে লেখা, “সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে টিএমডি করুন (টোটাল মিষ্টি বিতরণ)।” নিচের মন্তব্যগুলো ছিল আরও ইঙ্গিতপূর্ণ। কেউ লিখেছেন, “একটা একটা হিন্দু ধর”, কেউ আবার জবাই করে ফেলে রাখা পশুর রক্তাক্ত ছবি শেয়ার করেছেন।
আরেকটি পোস্টে দেখা যায়, কমলা দাড়ি-সবুজ টুপির এক ব্যক্তি কপালে তিলক দেওয়া আরেক ব্যক্তির গলা চেপে ধরেছেন। মিমটির ক্যাপশন ছিল “নোয়াখালী ১৯৪৬ #টিএমডি”। এই পোস্টে প্রায় দুই হাজার রিয়েকশন এবং এক হাজার ৭০০টি কমেন্ট রয়েছে। উস্কানিমূলক এই পোস্টের কমেন্ট একাধিক ভারতীয় অ্যাকাউন্ট থেকেও বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য দেখা যায়: একজন মন্তব্য করেন, “নোয়াখালীর থেকে ভয়ানক ছিল বিহারের দাঙ্গা। সেটা বোধহয় তোরা ভুলে গেছিস”।
সম্প্রতি নোয়াখালী দাঙ্গার প্রসঙ্গটি আবার আলোচনায় আসে সদ্য মুক্তি পাওয়া ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ নামের একটি হিন্দি চলচ্চিত্রকে ঘিরে। দেশভাগের আগের বছর, ১৯৪৬ সালে কলকাতা ও নোয়াখালীতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই সিনেমাটি মুক্তির পরই বিতর্ক জন্ম দেয়। সমালোচকদের অভিযোগ ছিল, চলচ্চিত্রটি ইতিহাস উপস্থাপনের আড়ালে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা উস্কে দিতে পারে। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকার সিনেমাটির প্রদর্শনীতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
যেভাবে ফিরলো #টিএমডি
সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াতে বাংলাদেশে টিএমডি প্রচারণা প্রথম পাওয়া যায় গতবছর। ২০২৪ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন)-এর বহিষ্কৃত সদস্য ও বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর গ্রেপ্তার ও জামিন নামঞ্জুর হওয়া নিয়ে চট্টগ্রামে এক সংঘর্ষে সাইফুল ইসলাম নামের এক আইনজীবিকে হত্যা করা হয়। এর সঙ্গে ইসকনের সম্পৃক্ততার অভিযোগ এনে তাদের নিষিদ্ধ করার দাবি উঠে।
দুদিন পরই একাধিক ব্যবহারকারী টিএমডিকে ‘টোটাল মালাউন ডেথ’ হিসেবে লিখে পোস্ট করেন এবং এরপরের মাসেই টোটাল মিষ্টি বিতরণ নামের গ্রুপটি তৈরি হয় এবং আরও অনেকে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা শুরু করে।
গতমাসের শেষ দিকে টিএমডি প্রচারণা ফের ছড়াতে শুরু করে। এর পেছনে তিনটি ঘটনা কাজ করেছে: গত ২১ অক্টোবর মধ্যরাতে ধর্ষণের অভিযোগে বুয়েট শিক্ষার্থী শ্রীশান্ত রায়কে ঘিরে শুরু হওয়া আন্দোলন, গাজীপুরে এক মাদ্রাসা ছাত্রীকে ধর্ষণ, এবং গাজীপুরের টঙ্গী থেকে খতিব ও পেশ ইমাম মো. মুহিবুল্লাহ মিয়াজীকে অপহরণের অভিযোগ।
বুয়েটের ঘটনায় একটি প্রোফাইল থেকে ফেসবুকে পোস্ট করা হয়: “বুয়েটের এক মালাউন শুয়োরের বাচ্চা এক মুসলিম মেয়েকে জোরপূর্বক ধ_র্ষণ করে…মালাউনেরা মুসলিম মেয়েদেরকে নিজেদের যৌ’নদাসী মনে করে। আগেও বলছি, প্রমাণ দিছি, এখনও বলতেছি, প্রমাণ তো আপনারা দেখলেন-ই।” এই পোস্টের সঙ্গে টিএমডি হ্যাশট্যাগ ছিল।
পরের দিন, ২২ অক্টোবর, সামাজিক মাধ্যমটিতে টিএমডি-যুক্ত একের পর এক পোস্ট আসতে থাকে। “পাথর নিক্ষেপ করে মারতে হবে মালুদের এটাই শাস্তি #TMD হোক প্রত্যেকটি এলাকায়”, “Kafir can’t be friends বাংলার মোল্লা ফালাও মা-লু-র ক*ল্লা #TMD”, “৪৬ এর মতন করে যদি করেন টোটাল মিস্টি ডিস্ট্রিবিউশন, মালায়ন করবে পলায়ন… #TMD”– এমন সব মন্তব্য ছড়িয়ে পড়ে অল্প সময়ের মধ্যে।
গত ২৪ অক্টোবর, শুক্রবারের জুমার নামাজের পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে মিছিল বের হয়। এসব মিছিলের আয়োজনে ছিল ইন্তিফাদা বাংলাদেশ নামের এক সংগঠন। আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেন, গাজীপুরের ধর্ষণ মামলা ও এক ইমাম অপহরণসহ একাধিক ঘটনার সঙ্গে ইসকন জড়িত। তারা ইসলামফোবিয়া বিরোধী জাতীয় নীতি প্রণয়ন, মুসলিম নারীদের সুরক্ষা, এবং ইসলাম অবমাননাকারীদের শাস্তি দাবিতে স্লোগান দেন। এরপর থেকে ইসকন ব্যান হ্যাশট্যাগের সঙ্গে টিএমডি হ্যাশট্যাগের ব্যবহার আরও ছড়িয়ে পড়ে এবং বিদ্বেষের ভাষাও তীব্রতর হতে থাকে।
প্রচারণায় সাংকেতিক বা ‘কোডেড’ ভাষার ব্যবহার
টিএমডি প্রচারণায় একটি বড় অংশ জুড়ে আছে সাংকেতিক বা কোডেড ভাষার ব্যবহার। এই কৌশলগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো শব্দের প্রতিস্থাপন (যেমন: ‘মালু কতল’-এর পরিবর্তে ‘বালু কতল’ ব্যবহার করা) এবং অ্যাক্রোনিম #টিএমডি-কে বিভিন্ন রূপ দেওয়া। যেমন: টোটাল মিষ্টি ডিস্ট্রিবিউশন (Total Misti Distribution), তবারকের মিষ্টি ডিস্ট্রিবিউশন (Tobaroker Mishti Distribution), তাওহীদ, ম্যানার, দ্বীন (TAWHID,MANNER, DEEN’) টোটাল মুরগি ডেথ (Total Murgi Death), টোটাল মোল্লা ড্রিপ (Total Mollah Drip)।
২০২৪ সালের ৩ ডিসেম্বর, সিফাত হাসান নামের এক ব্যবহারকারী ‘টোটাল মিষ্টি ডিস্ট্রিবিউশন টিএমডি’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ খোলেন। গ্রুপটি দ্রুত মিম ও স্যাটায়ার পোস্টের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। পেজের পোস্টগুলোর অধিকাংশই ছিল ভারত ও হিন্দুত্ববাদবিরোধী এবং কখনো কখনো উসকানিমূলক ও সহিংস। গ্রুপটি এখন আর নেই।
এরই ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক প্রচারণায়ও কয়েকটি মিম পেজ, টিএমডি ট্রেন্ড নিয়ে একাধিক পোস্ট দিয়েছে এবং ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক বার্তা ব্যঙ্গাত্মক কনটেন্টের আকারে প্রচার করেছে। “মোল্লা with his মৌলবাদী memes,” “Islamist MEME League,” “Dawah Meme TMD,” “জাল মিমস,” “MuslimBongo–মুসলিমবঙ্গ,” এবং “MuslimBongo 2.0”–এর মতো পেজগুলো নিয়মিতভাবে টিএমডি নিয়ে প্রচারণা চালিয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুসারী থাকা পেজ হলো ‘মোল্লা with his মৌলবাদী memes’ যার ফলোয়ার সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৪১ হাজার।
এছাড়াও, পোস্টে “নেভার সার্চ দ্য নোয়াখালী রায়টস” (Never search the Noakhali Riots) এর মতো ক্যাপশন ব্যবহার করে জাতিগত নিধনের ইতিহাস খুঁজতে উৎসাহিত করা হয়। এই সাংকেতিক ভাষার সমর্থনে ভিজ্যুয়ালও ব্যবহার করা হয়। যেমন: একটি পোস্টে ১৯৬২ সালের রাজশাহী দাঙ্গার প্রেক্ষাপট বুঝাতে রাজশাহী স্টেশনের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে।

অনলাইনে নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠী বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ ছড়াতে অ্যাক্রোনিম ও সাংকেতিক ভাষার ব্যবহার নতুন নয়। ২০১০-এর দশকের শেষভাগে ফোরচ্যানের মতো ফোরামে এমন শব্দের প্রচলন দেখা যায়। তখন টিএনডি (Total N** Death)* বা টিজেডি (Total Jew Death)–এর মতো সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহার করা হতো, যা পরে মডারেশন এড়ানোর জন্য আপাত নির্দোষ বাক্য যেমন “Totally Nice Day”তে রূপান্তরিত হয়।
নীতিমালার পরিপন্থী
ডিসমিসল্যবের নথিববদ্ধ করা সরাসরি বিদ্বেষমূলক ৩৯ পোস্টে সরাসরি ‘টোটাল মালাওন ডেথ’ বলা হয়েছে অথবা হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতার ডাক দেওয়া হয়েছে। কিছু পোস্টে ঐতিহাসিক নোয়াখালী দাঙ্গার প্রসঙ্গ এনে পুনরায় একই ধরনের দাঙ্গা ও গণহত্যার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া, সহিংসতার ধরণ স্পষ্ট করতে, অনেক ক্ষেত্রে কী অস্ত্র ব্যবহার করা হবে, বা কীভাবে ব্যবহার করা হবে তা দৃশ্যের সাহায্যে বা ভিজ্যুয়ালি উপস্থাপন করা হয়েছে। সরাসরি হত্যার আহ্বান জানানো গানও অডিও কনটেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি অস্ত্র ও রক্তাক্ত ছবি দিয়ে টিএমডি লিখে প্রচার প্রচার করা হয়। যেমন, অস্ত্রধারী এক ব্যক্তির ছবিসহ একজন লিখেছেন, ‘“আমি, আজমল কাসব, প্রতিজ্ঞা করছি যে আমি #TMD-এর তরে ১৬৬ মালাউনকে তাদের নির্ধারিত জায়গায় পাঠাব না।” অপরটিতে, “দাওলার (আইএস) এর কিছু মুনাসির আখিদের #TMD অনুশীলন” ক্যাপশনে একটি ভিডিও প্রকাশিত হয়, যেখানে কয়েকজনকে বিস্ফোরক তৈরির চেষ্টা করতে দেখা যায়।
মেটার হেটফুল কনডাক্ট নীতিমালার আওতায় ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, যৌন অভিমুখিতা, প্রতিবন্ধীত্ব বা গুরুতর রোগের মতো সংরক্ষিত বৈশিষ্ট্যে ভিত্তিতে কাউকে আক্রমণ বা অপমান করা যাবে না। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ সব পোস্ট এই নীতির বিরুদ্ধে যায়।
একইভাবে, ভায়োলেন্স এবং ইনসাইটমেন্ট নীতিমালা অনুযায়ী, এমন কোনো কনটেন্ট পোস্ট করা যাবে না সহিংসতার হুমকি দেয়, সহিংসতা ঘটাতে পারে বা কাউকে আঘাত করার আহ্বান জানায়। এখানে শুধু সরাসরি হুমকি নয়, সাংকেতিক ভাষা (কোড) ব্যবহার করে দেওয়া প্রচ্ছন্ন হুমকিও নিষিদ্ধ। তবে, ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত এই পোস্টগুলোর বেশিরভাগই ফেসবুক থেকে সরেনি এবং সক্রিয় ছিল।
বাংলাদেশ সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫ অনুসারে, যদি কেউ ইচ্ছা করে, জেনে-শুনে, বা ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে নিজের বা অন্য কারো আইডিতে ঢুকে অনলাইনে (সাইবার স্পেসে) এমন কিছু প্রকাশ বা ছড়ান, যা ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ায় বা জাতিগত বিদ্বেষ তৈরি করে এবং সহিংসতা তৈরি বা উদ্বেগ সৃষ্টি করে বা বিশৃঙ্খলা বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের নির্দেশনা করে সেটি একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এই অপরাধ করলে, অপরাধী ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ২ বছর পর্যন্ত জেল বা ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা, বা উভয় শাস্তি দেওয়া হতে পারে।
পদ্ধতি:
সাম্প্রতিক সময়ে টিএমডি ট্রেন্ড নিয়ে যাচাই করতে গিয়ে গত ২১ অক্টোবর প্রথম পোস্টটি পাওয়া যায়। ২২ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত এক সপ্তাহে ফেসবুকে শুধুমাত্র ইংরেজিতে ‘TMD’ লিখে অনুসন্ধান চালিয়ে মোট ১,৩৬০টি পোস্ট পাওয়া যায়, যার মধ্যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে টিএমডি সম্পর্কিত ছিল ২৯৪টি পোস্ট। এই কনটেন্টগুলোকে ৩০ নভেম্বর একটি ডেটা আর্কাইভে সংরক্ষণ করা হয়। বিশ্লেষণের জন্য এই ২৯৪টি পোস্টকে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়, যেখানে ২১৭টি পোস্টই টিএমডি-এর পক্ষে সক্রিয় প্রচারণা হিসেবে চিহ্নিত হয়। এদের মধ্যে ৩৯টিকে এক্সপ্লিসিট বা সরাসরি বিদ্বেষ হিসেবে আলাদা করে আধেয় বিশ্লেষণ করা হয়। পোস্টগুলোকে মেটার ভায়োলেন্স ও ইনসাইটমেন্ট নীতিমালার আলোকে পর্যালোচনা করা হয় এবং দু’টি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়, সাংকেতিক বা প্রচ্ছন্ন আক্রমণ এবং সরাসরি বা এক্সপ্লিসিট হুমকি। প্রতিটি পোস্টের মোট লাইক কমেন্ট শেয়ার মোট এংগেজমেন্ট হিসেবে হিসাব করা হয়। পোস্টগুলোর প্রেক্ষাপট, উদ্দেশ্য এবং রাজনৈতিক ঝোঁক বুঝতে পোস্টদাতার পাবলিক প্রোফাইলগুলোও যাচাই করা হয়। এছাড়া, ২৪ থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত রঙিন দাড়ি ট্রেন্ডের পক্ষে পাওয়া অন্তত ৮৮টি প্রচারণাও শনাক্ত করা হয়।





