আহমেদ ইয়াসীর আবরার

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

তৌহিদুল ইসলাম রাসো

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
ফেসবুকে ‘লাইক’ বাড়াতে ড. ইউনূসকে ৫ বছর ক্ষমতায় চাওয়ার প্রচারণা

ফেসবুকে ‘লাইক’ বাড়াতে ড. ইউনূসকে ৫ বছর ক্ষমতায় চাওয়ার প্রচারণা

আহমেদ ইয়াসীর আবরার

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

তৌহিদুল ইসলাম রাসো

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে, মূলধারার মিডিয়ায় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা চলছে। ২০২৪ সালে গণআন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি একাধিকবার জানিয়েছেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবুও, তার কার্যকালের ভবিষ্যৎ নিয়ে গুজব ও আলোচনা থেমে থাকেনি। “ড. ইউনূসকে পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় চাই” — স্লোগানটি এমন অবস্থার মধ্যেই অনলাইনে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

তবে এই রাজনৈতিক স্লোগান অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা গেছে বিভিন্ন ফেসবুক বিজ্ঞাপনে—কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নয়, বরং খাবার, প্রসাধনী, পোশাক কিংবা ব্যক্তিগত ভ্লগের প্রচারণাতে। এসব বিজ্ঞাপনে ড. ইউনূসের নাম ও ছবি ব্যবহার করে ‘লাইক’ বা ‘ফলো’ করার আহ্বান জানানো হয়। ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এপ্রিলের শুরু থেকে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত অন্তত ৪৭টি ফেসবুক পেজ এ ধরনের ৫৫টি বিজ্ঞাপন চালিয়েছে।

বাংলা কীওয়ার্ড ব্যবহার করে মেটার অ্যাড লাইব্রেরি থেকে বিজ্ঞাপনগুলো সংগ্রহ করে, এবং প্রতিটি পেজের সর্বশেষ ২০টি পোস্ট পর্যালোচনা করে তাদের নিয়মিত কার্যক্রম বোঝার চেষ্টা করেছে ডিসমিসল্যাব। দেখা যায়, ৯০ শতাংশ পেজ আগে কোনো রাজনৈতিক বিষয়ে পোস্ট করেনি।

মেটার সামাজিক ইস্যু, নির্বাচন ও রাজনীতি সম্পর্কিত নীতিমালা অনুযায়ী, যেকোনো জনমত প্রভাবিতকারী বিজ্ঞাপনে অর্থদাতার পরিচয় উল্লেখ করে একটি ‘ডিসক্লেইমার’ থাকতে হয়। ডিসমিসল্যাবের পর্যালোচনা করা কোনো বিজ্ঞাপনেই এই ধরনের ডিসক্লেইমার ছিল না। কিছু বিজ্ঞাপন মেটা পরবর্তীতে সরিয়ে নিলেও বেশিরভাগই গবেষণা চলাকালীন সক্রিয় ছিল এবং মেটার সনাক্তকরণ ব্যবস্থা তা ধরতে পারেনি।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, যেখানে কিছু দল দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে, আবার কিছু দল আগে সংস্কারের দাবি জানাচ্ছে, সেখানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ বাড়ানোর আহ্বান নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক বলে মনে করেন এক বিশেষজ্ঞ। তাঁর মতে, এসব বিজ্ঞাপন ব্যবসায়িক পেজ থেকে চালানো হলেও, এগুলোর রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে।

খাবার বিক্রি থেকে ভ্লগ— স্লোগান যেভাবে ছড়াল 

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে “ড. ইউনূসকে পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় দেখতে চাই” স্লোগানটি ছড়িয়ে পড়ে। সদ্য গঠিত ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির নেতা সারজিস আলম একটি ফেসবুক পোস্টে স্লোগানটি ব্যবহার করেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে চলমান আলোচনা ও অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে এই দাবি সামনে আসে এবং তাৎক্ষণিকভাবে নানা রাজনৈতিক দলের নেতারা এটিকে অবাস্তব ও অগণতান্ত্রিক বলে সমালোচনা করেন।

বিষয়টি ভাইরাল হওয়ার পর কিছু ফেসবুক পেজ এই জনমতের সুযোগ নিয়ে নিজেদের পেজে এমন বিজ্ঞাপন চালানো শুরু করে।

১৫ থেকে ১৭ মে’র মধ্যে “ইউনূস”, “ইউনূস” (বিকল্প বানান) এবং “৫ বছর”—এই তিনটি বাংলা কীওয়ার্ড দিয়ে মেটার অ্যাড লাইব্রেরিতে খোঁজ চালিয়ে এমন ৫৫টি বিজ্ঞাপন শনাক্ত করা হয়, যেগুলো ৪৭টি আলাদা ফেসবুক পেজ থেকে চালানো হয়েছে।

প্রতিটি পেজের সর্বশেষ ২০টি পোস্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ পেজ এর আগে কখনো কোনো রাজনৈতিক পোস্ট দেয়নি। তাদের নিয়মিত কার্যক্রমে এ ধরনের স্লোগান একেবারেই ব্যতিক্রম।

ঢাকাভিত্তিক রেস্টুরেন্ট পেজ দ্য টেস্টি অ্যাপ্রন ১৩ ও ১৪ মে দুটি বিজ্ঞাপন চালায়। একটি বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল: “আপনি যদি চান ড. ইউনূস পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকুক, তাহলে ডান পাশে লাইক অপশনে ক্লিক করুন।” বিজ্ঞাপনের নিচে ডান পাশে একটি ‘লাইক’ বাটন দেখা যায়। ১৮ মে পর্যন্ত তাদের সর্বশেষ ২০টি পোস্টের কোনোটিতেই রাজনৈতিক বিষয়বস্তু ছিল না।

যেসব পেজ আগে থেকেই কিছু রাজনৈতিক পোস্ট দিয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে মোটিভ ডিজিটালমি. ইসমাইল। ডিসক্লেইমার না থাকায় এই দুটি পেজের বিজ্ঞাপন পরে মেটা সরিয়ে নেয়। মোটিভ ডিজিটাল ৬ মে একটি পোস্টে লেখে: “নেতৃত্বে পরিবর্তন মানেই ভবিষ্যতের পরিবর্তন।” অন্যদিকে মি. ইসমাইল একটি বিজ্ঞাপনে ড. ইউনূসের নামাজরত একটি ছবি দিয়ে লেখে: “উন্নয়ন না নির্বাচন?”

৪৭টি পেজের মধ্যে ৩০টি, অর্থাৎ প্রায় ৬৪ শতাংশ, বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত—যেমন খাবার, প্রসাধনী, পোশাক, স্বাস্থ্যসেবা বা মৌসুমি ফল। আটটি ছিল ব্যক্তিগত বা ভ্লগ ধরনের পেজ, আর দুটি নিজেদের মিডিয়া আউটলেট হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। বাকি পেজগুলো ‘পাবলিক ফিগার’ বা ‘ডিজিটাল মার্কেটিং’ হিসেবে তালিকাভুক্ত।

কিছু ব্যবসায়িক পেজে যে পণ্য প্রচার করা হয়েছে, তার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন ন্যাচারাল হেলথ বিডি একটি ট্যাবলেট বিক্রি করে যার নাম “হেলথ প্লাস ট্যাবলেট”—যা ওজন এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর প্রাকৃতিক উপায় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আমবাজার নামের একটি পেজ ৮ মে খোলা হয়েছে এবং নিয়মিত বিভিন্ন জাতের আম বিক্রির পোস্ট দিচ্ছে। ১৫ মে একটি পোস্টে লেখা ছিল: “দালালের ঝামেলায় পড়ে যাচ্ছেন? খাঁটি আম আমাদের কাছে স্টকে আছে—এখনই অর্ডার করুন!” আরেকটি পেজ মায়ের দোয়া অ্যাগ্রো কোয়েলের ডিম বিক্রি করে এবং মুরগি পালন নিয়ে ভিডিও শেয়ার করে। এসব পেজের আগের পোস্টগুলোতে কোনো রাজনৈতিক বিষয়বস্তু ছিল না।

রাজনৈতিক স্লোগানে লাইকের চাষাবাদ

ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই ৪৭টি ফেসবুক পেজে গড়ে প্রতি পেজে ৩৫ হাজারের বেশি লাইক এবং ৩৭ হাজারের বেশি অনুসারী ছিল। পুরাতন ও নতুন—দুই ধরনের পেজই এই রাজনৈতিক স্লোগান ব্যবহার করেছে নিজেদের লাইক ও জনপ্রিয়তা বাড়ানোর কৌশল হিসেবে।

সবচেয়ে বেশি লাইক দেখা যায় খবর২৪ নামের একটি সংবাদ পেজে, যার ফলোয়ারের সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৪৩ হাজার। পেজটি নিয়মিত ফটো কার্ড পোস্ট করে এবং মন্তব্যের ঘরে বার্তা টাইমস২৪-এর লিংক শেয়ার করে। বিপরীতে সবচেয়ে কম লাইক রয়েছে প্রিমিয়াম বিডি নামের একটি পেজে, যার ফলোয়ার মাত্র ১১ জন। নতুন এই পেজটি ইউটিউবের প্রিমিয়াম সাবস্ক্রিপশন বিক্রি করে।

এদের মধ্যে ২৬টি পেজের অ্যাডমিনদের লোকেশন পাওয়া গেছে। ২৪টি পেজ পরিচালিত হয় বাংলাদেশ থেকে, একটি পরিচালিত হয় ইতালি থেকে এবং একটি পেজ যৌথভাবে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

ডিসমিসল্যাব ছয়জন অ্যাডমিনের সঙ্গে কথা বলেছে, যারা এ ধরনের বিজ্ঞাপন চালিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চারজন বলেন, তারা বিজ্ঞাপনগুলো নিজেরা তৈরি করেননি, বরং বিজ্ঞাপন এজেন্সিকে প্রচারণার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। একজন জানান, তিনি নিজেই বিজ্ঞাপন তৈরি করেছেন লাইক ও ফলোয়ার বাড়ানোর জন্য। আরেকজন বলেন, একটি ডিজিটাল মার্কেটিং প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল এবং বিজ্ঞাপনের পর ফলোয়ার কিছুটা বেড়েছে, তবে বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তু তিনি আগে জানতেন না।

তিনি বলেন, “আমরা শুধু বলেছিলাম, ফলোয়ার বাড়াতে হবে। কেমন বিজ্ঞাপন চলবে, সেটা পুরোপুরি তাদের সিদ্ধান্ত।”

ইয়াতি ডিজিটাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও এ এম ফারুক বলেন, “এ ধরনের বিজ্ঞাপনের মূল লক্ষ্যই হলো ফলোয়ার বাড়ানো। কারণ, এখন পেজের গ্রহণযোগ্যতা বিচার করা হয় ফলোয়ার সংখ্যা দিয়ে।” তিনি বলেন, “ক্লায়েন্ট ফল চান, এটা ঠিক। কিন্তু এজেন্সিগুলোর উচিত বাস্তব পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা—সব কৌশল সবসময় কাজ করে না।”

পুরোনো কৌশল, নতুন মোড়কে

ফেসবুক বিজ্ঞাপনে রাজনৈতিক স্লোগান আর পরিচিত ব্যক্তিত্বদের ছবি ব্যবহার করে মানুষের আগ্রহ বাড়ানোর এই কৌশল নতুন কিছু নয়। ডিসমিসল্যাবের আগের অনুসন্ধানেও এ ধরনের বিজ্ঞাপন চালানোর নজির পাওয়া গেছে—বিশেষত বাংলাদেশ ও অন্য দেশের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের ব্যবহার করে।

যেমন, ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে—জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে—একটি পেজ বিজ্ঞাপন চালায়, যেখানে লেখা হয়: “ভোট চলছে—খালেদা জিয়াকে জিতিয়ে দিতে চাইলে ডান পাশে লাইক দিন👇👇👇👇👇👇।” মেটা এই বিজ্ঞাপনটিকে ‘রাজনৈতিক’ হিসেবে চিহ্নিত করে সরিয়ে দেয়, কারণ সেখানে কোনো ডিসক্লেইমার ছিল না। ওই পেজের পোস্ট বিশ্লেষণে দেখা যায়, তাদের পুরো বছরের পোস্টের মধ্যে রাজনৈতিক কনটেন্ট ছিল কেবল একটি—একজন রিকশাচালকের ভিডিও, যিনি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করেন।

২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে আরেকটি বিজ্ঞাপন চালানো হয়, যেখানে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার পাশাপাশি ছবি দিয়ে লেখা হয়: “খালেদা জিয়াকে জিতিয়ে দিতে চাইলে ডান পাশে লাইক করুন।” যদিও বিজ্ঞাপনটি একটি ব্যবসায়িক পেজ থেকে চালানো হয়েছিল, সেখানে রাজনৈতিক চিত্র ব্যবহার করে মানুষের মনোযোগ কাড়ার চেষ্টা করা হয়।

এর আগেও, ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে মিল্টন সমদ্দার নামের একটি পেজ জামায়াত নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ছবি ব্যবহার করে একটি বিজ্ঞাপন চালায়। সেখানে লেখা ছিল: “আমি সাঈদী সাহেব, আমি আগামী সপ্তাহে মুক্তি পাচ্ছি। আপনার ভোট দরকার। ডান পাশে ভোট দিন।” মেটা সেটিকে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন হিসেবে চিহ্নিত করে এবং সরিয়ে দেয়। বাস্তবে সাঈদী মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত হয়ে ২০২৩ সালে কারাগারে মারা যান।

এই একই পেজ আরও কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ছবি ও ভুয়া উক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন চালিয়েছিল—যেমন বাংলাদেশের মামুনুল হক, পাকিস্তানের ইমরান খান, মিশরের মোহাম্মদ মোরসি, মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ এবং তুরস্কের রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান। ২০২৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে ওই পেজের পরিচালক স্বীকার করেছিলেন যে বিজ্ঞাপনগুলো পেজ প্রমোশনের উদ্দেশ্যে চালানো হয়েছে এবং সবকিছু পরিচালনা করেছে একটি বিজ্ঞাপন এজেন্সি।

এ এম ফারুক বলেন, “এই ধরনের বিজ্ঞাপন তো আগে থেকেই ছিল। এখন যেহেতু ড. ইউনূস জনপ্রিয়, তাই তাকে ব্যবহার করে দ্রুত লাইক বাড়ানো হচ্ছে।”

মেটার রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন নীতিমালা ও নজরদারির ঘাটতি

মেটার নীতিমালা অনুযায়ী, রাজনৈতিক, নির্বাচনসংক্রান্ত বা সামাজিক ইস্যুভিত্তিক বিজ্ঞাপনগুলোতে “পেইড ফর বাই” (paid for by) ডিসক্লেইমার থাকা আবশ্যক, যেখানে বিজ্ঞাপনদাতার পরিচয় এবং তার পরিচয় যাচাই সম্পন্ন হয়েছে—এটি উল্লেখ করতে হয়। এই বিজ্ঞাপনগুলো মেটার অ্যাড লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত থাকে, যেখানে দেখা যায় বিজ্ঞাপনটি কোথায় এবং কার কাছে প্রদর্শিত হয়েছে, কতদিন ধরে চলেছে, এবং কত অর্থ ব্যয় হয়েছে। এই শর্ত পূরণ না করলে বিজ্ঞাপনটি অযোগ্য বিবেচিত হয় এবং সরিয়ে ফেলা হয়।

“ড. ইউনূসকে পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় দেখতে চাই” — এই স্লোগানসহ যে বিজ্ঞাপনগুলো চালানো হয়েছে, সেগুলো মেটার সংজ্ঞা অনুসারে রাজনৈতিক আধেয় হিসেবে গণ্য হওয়ার মতো। কারণ, এতে   রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে নেতৃত্বে আনার প্রত্যক্ষ আহ্বান রয়েছে এবং তার ছবিও ব্যবহার করা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাঈদ আল-জামান বলেন, “যাকে প্রচার করা হচ্ছে এবং যেভাবে প্রচার করা হচ্ছে—দুটোই বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক বিষয়ে পড়ে।”

তবে ডিসমিসল্যাবের পর্যালোচনা করা ৫৫টি বিজ্ঞাপনের একটিতেও মেটার নীতিমালা অনুযায়ী কোনো ডিসক্লেইমার ছিল না—যেটি বাধ্যতামূলক। এসব বিজ্ঞাপনের মধ্যে ৪৩টি পর্যালোচনার সময় পর্যন্ত সক্রিয় ছিল এবং ১২টি বিজ্ঞাপন মেটা সরিয়ে দেয়, কারণ সেগুলোতে রাজনৈতিক বিষয়বস্তু থাকলেও কোনো ডিসক্লেইমার ছিল না। সরানো বিজ্ঞাপনগুলোর মধ্যে সাতটিতেই একই ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল—যেখানে দেখা যায়, ঈদুল ফিতরের নামাজ শেষে ড. ইউনূস সাধারণ মানুষের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন।

মেটা কিছু বিজ্ঞাপন সনাক্ত করে সরাতে পেরেছে, কিছু পারেনি, যা প্লাটফর্মটির সনাক্তকরণ ব্যবস্থায় দুর্বলতা তুলে ধরে। যেমন, জোবাইদা’স ভ্লগ ইউএসএ পেজ থেকে একই ছবির উপর ভিত্তি করে তিনটি আলাদা বিজ্ঞাপন চালানো হয়—যার মধ্যে মেটা দুটি সরালেও একটি বিজ্ঞাপন মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সক্রিয় ছিল।

অনুসন্ধান বলছে, বাংলায় লেখা বিজ্ঞাপন—বিশেষ করে যেগুলো সরাসরি রাজনৈতিক পেজ থেকে নয় বরং ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক পেজ থেকে আসে— সেগুলো সনাক্ত করতে মেটার তদারকি ব্যবস্থায় এখনো বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। ২০২৩ সালে ডিজিটালি রাইট পরিচালিত একটি গবেষণাতেও এ ধরনের ব্যর্থতার উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছিল। সেখানে দেখা যায়, অনেক রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন ডিসক্লেইমার ছাড়াই চালানো হয়েছে এবং তা মেটার নজরদারি এড়িয়ে গেছে, যদিও বিজ্ঞাপনগুলোর রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা ছিল স্পষ্ট।

গবেষণা পদ্ধতি

এই অনুসন্ধানটি ডিসমিসল্যাব পরিচালনা করেছে ২০২৫ সালের ১৫ থেকে ১৮ মে পর্যন্ত। গবেষকেরা মেটার অ্যাড লাইব্রেরি ব্যবহার করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় রাখার আহ্বান জানিয়ে চালানো বাংলাভাষার ফেসবুক বিজ্ঞাপনগুলো চিহ্নিত করেন। এ জন্য তিনটি বাংলা কীওয়ার্ড ব্যবহার করা হয়: “ইউনূস”, “ইউনূস” (ইউনূস নামের বিকল্প বানান), এবং “৫ বছর”। এই অনুসন্ধানে ৫৫টি বিজ্ঞাপন চিহ্নিত হয়, যা ৪৭টি আলাদা ফেসবুক পেজ থেকে চালানো হয়েছিল এপ্রিলের শুরু থেকে মে মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে।

প্রতিটি পেজ চিহ্নিত হওয়ার পর, গবেষকরা তাদের সর্বশেষ ২০টি পাবলিক পোস্ট পর্যালোচনা করেন, যাতে বোঝা যায়—পেজটি পূর্বে কোনো রাজনৈতিক কনটেন্ট শেয়ার করেছে কি না। এরপর প্রতিটি পেজকে তাদের সাম্প্রতিক পোস্ট এবং ‘অ্যাবাউট’ সেকশনের তথ্যের ভিত্তিতে ব্যবসা, গণমাধ্যম, ব্যক্তিগত ভ্লগ বা রাজনৈতিক ব্যক্তি—এই ধরনের শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়।

অ্যাড লাইব্রেরি থেকে প্রাপ্ত মেটাডেটা যেমন বিজ্ঞাপনের অবস্থা (সক্রিয় বা সরানো হয়েছে), বিজ্ঞাপনের ছবি এবং মেটার নীতিমালার ট্যাগ ব্যবহার করে মেটার স্বচ্ছতা নির্দেশিকাগুলোর সঙ্গে এসব বিজ্ঞাপনের সামঞ্জস্য মূল্যায়ন করা হয়। যেখানে পাওয়া গেছে, সেখানে অ্যাডমিন অবস্থান ও পেজ তৈরির তারিখও নথিভুক্ত করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন বিশ্লেষণের পাশাপাশি, ডিসমিসল্যাব ছয়জন পেজ অ্যাডমিনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে জানতে চায় কেন তারা এ ধরনের বিজ্ঞাপন চালিয়েছেন এবং কী ধরনের বিজ্ঞাপন কৌশল ব্যবহার করেছেন। যেসব পেজের নাম বা অ্যাডমিনের বক্তব্য আগে থেকেই প্রচারিত বিজ্ঞাপনের সঙ্গে যুক্ত, শুধুমাত্র সেই তথ্যগুলো প্রকাশ করা হয়েছে; অন্যদের পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে।

সবশেষে, এসব অনুসন্ধানকে মেটার প্রচলিত বিজ্ঞাপন নীতিমালা এবং পূর্ববর্তী গবেষণাগুলোতে আলোচিত নজরদারি প্রবণতার সঙ্গে তুলনা করে প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে।

আরো কিছু লেখা