মিনহাজ আমান

রিসার্চ-লিড, ডিসমিসল্যাব
অপ্টিম্যাক্স কেলেঙ্কারি: স্বাস্থ্যপণ্যের আন্তর্জাতিক, সংঘবদ্ধ ও ভুয়া প্রচারণা
This article is more than 2 months old

অপ্টিম্যাক্স কেলেঙ্কারি: স্বাস্থ্যপণ্যের আন্তর্জাতিক, সংঘবদ্ধ ও ভুয়া প্রচারণা

মিনহাজ আমান

রিসার্চ-লিড, ডিসমিসল্যাব

প্রচারণার ধরনটি এমন: সামাজিক মাধ্যমে জাদুকরী একটি ওষুধ বা স্বাস্থ্যপণ্যের প্রচার করার জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে বা বেশ কিছু পেজ খোলা হবে; সেই বিজ্ঞাপনে ক্লিক করলে বা পণ্যটি কেনার আগ্রহের কথা মেসেজ বা কমেন্টের মাধ্যমে জানালে একটি ওয়েবসাইটের লিংক পাওয়া যাবে; এই লিংকে নামী-বেনামী গণমাধ্যমের ওযেবসাইটের আদলে একটি ওয়েবপেজ মিলবে; সেখানে কোন বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী বা চিকিৎসকের একটি সাক্ষাৎকার থাকবে, সেই সাক্ষাৎকার একটি স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে দ্রুত মুক্তির জন্য একটি ওষুধের নাম বলবে এবং শেষে ওষুধটি কেনার জন্য একটি যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকবে।

বাস্তবতা হল, লিংকে যে গণমাধ্যমের পরিচয় ব্যবহার করা হয়েছে সেটি নকল, সাক্ষাৎকারটি ভুয়া, তাতে বিশেষজ্ঞদের বিবরণও প্রতারণাপূর্ণ। ছবিগুলো বিভ্রান্তিকর এবং বার্তাগুলো ভুয়া। 

সম্প্রতি এমন একটি ঘটনা বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এসেছে, যেখানে দেখা গেছে দৈনিক প্রথম আলোর পেজ নকল করে এবং বাংলাদেশের কয়েকজন পেশাজীবীর ভুয়া সাক্ষাৎকার জুড়ে দিয়ে অপ্টিম্যাক্স নামের একটি পণ্যের প্রচারণা চলছে। অপটিম্যাক্স অল্প দিনেই মানুষের চোখের গুরুতর সমস্যা সারিয়ে তোলার দাবি করে। কিন্তু ডিসমিসল্যাবের গবেষণায় দেখা গেছে, একটি কোনো একক ঘটনা নয়, এবং ভুয়া প্রচারণাটি বৈশ্বিক ও বহুবিধ স্বাস্থ্যপণ্যের।

ইতালি, পোল্যান্ড, সার্বিয়া, ফিলিপাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাংলাদেশসহ ইউরোপ ও এশিয়ার অন্তত ১৫টি দেশে এই ভুয়া প্রচারণার প্রমাণ পাওয়া গেছে। গত এক মাসে নতুন করে গতি পাওয়া এই প্রচারণায়, কোথাও চোখের, কোথাও ডায়াবেটিসের এবং কোথাও অস্থিসন্ধিতে ব্যথার নিরাময় করে বলে বিক্রি করা হচ্ছে, যদিও এদের কোনোটিই মেডিকেল ড্রাগ বা চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ নয়। কোনোটি ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট (খাদ্য সম্পূরক) এবং কোনোটি ব্যথা উপশমকারী মলম মাত্র।

এখন পর্যন্ত পাওয়া ফলাফলে এই প্রচারণার প্রথম সূত্র মেলে রাশিয়ায়, ২০২০ সালে। এরপর এটি প্রথমে পূর্ব ইউরোপ ও বলকান এবং তারপরে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়াতে দেখা যায়। ২০২৩ সালে এ নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপভিত্তিক ছয়টি সংস্থার একটি নেটওয়ার্ক সি চেকের একটি যাচাই প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। কিন্তু প্রচারণাটির বৈশ্বিক ধরন কখনোই এভাবে উঠে আসেনি, যেমনটা ডিসমিসল্যাবের তথ্য-প্রমাণে দেখা যাচ্ছে। 

বিভিন্ন কারণে প্রচারণাটি সমস্যাজনক। এতে যে শুধু গণমাধ্যমকে নকল করে ভুল বার্তা দেওয়া হচ্ছে তা নয়, এখানে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভুয়া তথ্য ও ছবি দিয়ে স্বাস্থ্যপণ্যের প্রচার চালানো হচ্ছে এবং কোথাও কোথাও একটি নির্দিষ্ট দেশের ওষুধ আমদানি ও বিপণনের আইনও ভঙ্গ করছে। অন্তত দুটি ক্ষেত্রে, এইসব দেশের কর্তৃপক্ষ এই ধরণের ঔষুধ গ্রহণের বিষয়ে সতর্কতা জারি করেছে। একইসাথে, যেসব বিশেষজ্ঞের নাম বা ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে, তাদের সম্মানহানি তো আছেই। 

বাংলাদেশে অপ্টিম্যাক্সের ভুয়া প্রচারণা

বাংলাদেশে বিষয়টি ধরা পড়ে গত ৩ জুলাই, যখন অনুজীববিজ্ঞানী ড. সেঁজুতি সাহা তার নাম ও ছবি ব্যবহার করে ভুয়া প্রচারণার বিষয়টি সামনে আনেন এবং থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি বা জিডি করেন। তাঁর ছবি ব্যবহার করে ফেসবুকে বেশ কয়েকটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় এবং তাতে দাবি করা হয়, ড. সেঁজুতি সাহা দৃষ্টিশক্তি পুনরুদ্ধারের একটি অভিনব পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন এবং তার আবিষ্কার করা অপ্টিম্যাক্স নামের ওষুধটি “মাত্র ২ সপ্তাহে যে কোনো বয়সে দৃষ্টিশক্তি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে।” বিজ্ঞাপনগুলো ওষুধটির প্রচারণায় দুটি ওয়েবপেজ লিংক ব্যবহার করে, যার একটিতে ক্লিক করলে সেটি দৈনিক প্রথম আলোর একটি নকল ওয়েবপেইজে নিয়ে যায় যেখানে সেঁজুতি সাহার সঙ্গে জনপ্রিয় সাংবাদিক মুন্নি সাহার একটি ভুয়া সাক্ষাৎকার রয়েছে। অপর লিংকটি প্রথম আলোর ১০ বছর পুরোনো একটি সংবাদের। এটি নিয়ে রিউমর স্ক্যানার এবং প্রথম আলো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

কিন্তু বাংলাদেশে অপ্টিম্যাক্স বিক্রির এমন আরো দুটি ওয়েবপেইজের সন্ধান পায় ডিসমিসল্যাব। কৌশল একই: একজন বিশেষজ্ঞ সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন এবং সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে সেই বিশেষজ্ঞ বলছেন তিনি কিভাবে আবিস্কারটি করলেন অথবা কেন অপ্টিম্যাক্স কেনা দরকার। সব শেষে একটি ফর্ম (অথবা বাটন যা আপনাকে ফর্মটিতে নিয়ে যাবে) যেখানে আপনার ফোন নম্বর দিলে, বিক্রেতারা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। এবং দুটিতেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বা বিজ্ঞানীদের ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করা হয়েছে এবং একে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমের ওয়েবসাইট নকল অথবা ভুয়া সংবাদমাধ্যমের ওয়েবপেজ তৈরি করা হয়েছে। মূলত তিনটি ওয়েব ডোমেইন ও সাব-ডোমেইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে এই প্রচারণা চালানো হয়। সেগুলো হল: healthymedproduct.pro, l3-optimax-bd.wowtop.shop, এবং vision-bd.tantanika.com।

এদের মধ্যে প্রথমটি বিবিসির ওয়েবসাইটের নকশা নকল করেছে এবং ডোমেইনটি গুগলে সার্চ করলে ওয়েবসাইটির শিরোনামের সঙ্গে “বিবিসি নিউজ” লেখা দেখা যায়। দ্বিতীয়টিতে প্রথম আলোর লোগোর সঙ্গে “প্রধান সংবাদ” জুড়ে নিয়ে একটি সংবাদ পোর্টালের চেহারা দেওয়া হয়েছে, যদিও সার্চ করে এমন কোনো সংবাদ পোর্টাল পাওয়া যায়নি। তৃতীয়টি নকল করেছে প্রথম আলোকে যা আগেই বলা হয়েছে। মজার বিষয় হল, এমন একাধিক ইউজার বা ব্যবহারকারী পাওয়া গেছে যারা তিনটি আলাদা ডোমেইনে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের নিচে পণ্যটির গুণাগুণ সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। 

সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে পেজ খুলে এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যবহারকারীদের এই লিংকগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়। অপ্টিম্যাক্সের প্রচারণার জন্য ইউটিউব ভিডিও-ও পাওয়া যায়।

প্রচারণা চলছে বহু দেশে, বহু ভাষায়

নকল বিশেষজ্ঞ, নকল সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার সম্পর্কে আরো জানার আগে এই ভুয়া প্রচারণার একটি বিশ্বভ্রমণ করে আসা যাক।

ডিসমিসল্যাবের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলা, ইংরেজি, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান, সার্বিয়ান, বুলগেরিয়ান বসনিয়ান-ক্রোয়াট, তুর্কিসহ কমপক্ষে ১২টি ভাষা ব্যবহার করে এশিয়া ও ইউরোপের অন্তত ১৫টি দেশে প্রচারণাটি পরিচালিত হয়ে আসছে। প্রচারণার ধরন হুবহু এক, তবে একেক এলাকায় একেক ধরনের স্বাস্থ্যপণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। একেক দেশে একেক গণমাধ্যমের ওয়েবসাইট নকল করা হয়েছে।

এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল: ocaps-new.com ডোমেইনটি। এটি ও-ক্যাপস নামের একটি সাপ্লিমেন্ট বিক্রি করছে, যা দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে কাজে আসে বলে দাবি করা হয়। এই ডোমেইনটিতে মোট ১৩টি সাবডোমেইন আছে, যাদের একেকটিতে একেক ভাষায় পণ্য বিক্রির প্রচারণা রয়েছে এবং কোনো কোনো ডোমেইনে প্রবেশ করতে গেলে ব্রাউজার, নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে বলে জানাচ্ছে। এর স্প্যানিশ ভাষার সাবডোমেইনে, বিবিসি নিউজ মুন্ডো বা বিবিসির ল্যাটিন আমেরিকা ওয়েবসাইটকে নকল করা হয়েছে। এখান থেকে ১০টি দেশে (আলবেনিয়া, বসনিয়া, বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, মন্টিনিগ্রো, মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া, স্লোভেনিয়া, তুরস্ক, কসোভো) পণ্যটি বিক্রি করা হয়।

ও-ক্যাপসের একই প্রচারণা পাওয়া যায় সার্বিয়া, স্লোভেনিয়াবসনিয়ার ভাষাতেও। এগুলোর ডোমেইন পুরোপুরি আলাদা, যা স্থানীয় মুদ্রাতে, নির্দিষ্ট এই দেশগুলোর ভোক্তাদের কাছে পণ্য বিক্রি করছে। কোথাও বিশেষজ্ঞের নাম আলাদা কিন্তু ছবি এক, আবার কোথাও বিশেষজ্ঞের ছবি এক নাম আলাদা, কিন্তু ভিন্ন ভাষায়, হুবহু একই সাক্ষাৎকার প্রতিটিতেই দেখা গেছে।

সার্বিয়ার ভাষায় যে প্রচারণা চলছিল তার মূল ডোমেইন হল, ফেয়ার-টুসেল ডটকম (fair-2sale.com)। বিভিন্ন পণ্যের নামে এই সাইটের ১০টির বেশি সাবডোমেইন আছে, যদিও সবগুলোতে প্রবেশ করা যায় না। যেগুলো খোলা যাচ্ছে , তার মধ্যে একটি ইতালীয় ভাষায় এবং অপরটি পোলিশ ভাষায়। তারা একই কায়দায় ইতালিতে বিক্রি করছে ডায়াবেটিসের বড়ি “ডায়াস্টাইন” এবং পোল্যান্ডে বিক্রি করছে অস্থিসন্ধিতে ব্যথার মলম ”ফ্লেক্সিও”। 

দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশের ফ্যাক্টচেকিং সংগঠনের জোট সি-চেক ২০২৩ সালের এপ্রিলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে স্লোভেনিয়াকে লক্ষ্য করে পরিচালিত ও-ক্যাপসের বিজ্ঞাপন যে ভুয়া, সেটি বিশদভাবে তুলে ধরা হয়। কিন্তু তাতেও এই প্রচারণা থামেনি। 

বাংলাদেশে অপ্টিম্যাক্স নামক স্বাস্থ্যপণ্যটির প্রচারণা চালানো একটি ওয়েবসাইটের মূল ডোমেইন ছিল, ওয়াওটপ ডট শপ। এই ডোমেইনের অধীনে দুটি আলাদা ওয়েবসাইট খুঁজে পায় ডিসমিসল্যাব, যা মূলত ইংরেজি ভাষায় ফিলিপাইনসংযুক্ত আরব আমিরাতে ডায়াবেটিসের তথাকথিত রোগনাশক বিক্রি করছে: একটির নাম ডায়াবেটিন এবং অপরটির নাম ডায়াবেক্সটান। দুটিতেই মেডিনিউজ নামের অচেনা এক সংবাদ মাধ্যমে জাপানী এক চিকিৎসকের সাক্ষাৎকার দেওয়া হয়েছে। এখানে বিষয়বস্তুর পরিবেশনা এবং ওয়েবপেজের নকশা আগের উদাহরণগুলোর তুলনায় একটু আলাদা হলেও বিক্রয়-পদ্ধতি একই।

এই প্রচারণার সবচেয়ে পুরোনো সূত্র পাওয়া যায় রাশিয়ায়। দেশটির স্থানীয় সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম ভিকে বা ভি-কন্টাক্টে ২০২০ সালের আগষ্ট মাসে প্রকাশিত একটি পোস্ট পাওয়া যায় যেখানে জাপানের সেই কথিত ১০৫ বছর বয়সী শিক্ষাবিদ আরিথা তানাকার সাক্ষাৎকারটি পোস্ট করা হয়েছিল। 

প্রচারণায় ভুল তথ্য, মিথ্যা পরিচয় ও বিভ্রান্তিকর ছবি

প্রচারণার পেজগুলোতে একজন তথাকথিত বিশেষজ্ঞকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়, যিনি ওষুধটির আবিষ্কর্তা। যেমন, বাংলাদেশে ইতিমধ্যে ভুয়া প্রচারণার জন্যে চিহ্নিত হওয়া সাইটে সেঁজুতি সাহার মিথ্যা সাক্ষাৎকার ছিল। সেখানে আরো দুজন চিকিৎসকের বক্তব্য দেয়া হয়েছিল যারা অপ্টিম্যাক্স নামের কথিত ওষুধের ‍গুণ গাইছেন। এদের একজনের নাম ডাঃ ফাতেমা বেগম। তাকে চক্ষু বিশেষজ্ঞ বলা হলেও তিনি আসলে একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এবং তার কর্মস্থলের তথ্যও ভুল।

একই প্রবণতা দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রচারিত বাকি দুটি ওয়েবসাইটের বেলাতেও। যেমন, বিবিসির আদলে তৈরি ওয়েবসাইটের শুরুতে দাবি করা হয় ওয়াকিল আখতারুজ্জামান নামে মেডিকেল শেষ বর্ষের একজন ছাত্র মানুষের দৃষ্টিশক্তি পুনরুদ্ধার করার ওষুধ আবিস্কার করেছেন। তার একটি ছবিও এখানে যুক্ত করা হয়। কিন্তু যাচাইয়ে দেখা যায়, ছবির এই ব্যক্তির নাম ওয়াকিল বা ভাকিল আখতারুজ্জামান নন, তার নাম মাসুদুর রহমান। তিনি মেডিকেল শেষ বর্ষের ছাত্র নন, বরং গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক। 

একাধিক পেইজে এক ব্যক্তির ছবি, নাম ও বক্তব্য দিয়ে বলা হয় তিনি টমাস মোয়া এবং ৩৫ বছরের অভিজ্ঞ চিকিৎসক। আরেক বিজ্ঞাপনে তাকেই ডেয়ান স্পাসিচ নামে পরিচয় করানো হয়েছে। ইউক্রেনের একাধিক চিকিৎসা সংক্রান্ত ওয়েবসাইটে (,) তার নাম লেখা রয়েছে: ভাবরিশুক আনাতোলি সিমানোভিচ। অনুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতিকে নিয়ে প্রচারিত ভুয়া সাক্ষাৎকারে এরকম ৩৫ বছরের অভিজ্ঞ যে ডাক্তারের ছবি দেওয়া হয়েছে, তিনি আর কেউ নন, স্বনামধন্য অধ্যাপক ও সাহিত্যিক ড. জাফর ইকবাল।

তিনটি আলাদা সাইটে, একই ব্যক্তির নাম লেখা হয়েছে কখনো মার্কো রিভেরা, কখনো জোভান গ্রুজিচ বা কখনো আদনান হোজিচ। আবার বসনিয়ায় প্রচারণার জন্য ব্যবহৃত ছবিতে এই আদনান হোজিচ সম্পূর্ণ আলাদা ব্যক্তি। মিল হল: এরা প্রত্যেকে মেডিকেল ৫ম বর্ষের ছাত্র এবং তারা প্রত্যেকে একেকটি রোগের নিরাময় আবিষ্কার করেছেন। 

বাংলাদেশে প্রধান সংবাদের খবর হিসেবে প্রচারিত বিজ্ঞাপনে এক ব্যক্তিকে নোবেল বিজয়ী ভারতীয় চক্ষু বিশেষজ্ঞ অনন্ত শিকদার বলা হয়। যাচাইয়ে দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে ছবিটি রণদীপ গুলেরিয়া নামের এক চিকিৎসকের এবং তিনি দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেসের ফুসফুস ও অনিদ্রা বিষয়ক অধ্যাপক।

প্রতিবেদনে অনন্ত শিকদারের সঙ্গে আরো একজন ব্যক্তির ছবি ছিল, যা ফিলিপিনে প্রচারিত বিজ্ঞাপনেও ব্যবহার হয়। বলা হয়, তার নাম আরেথা তানাকা এবং তিনি একজন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ও হরমোন বিশেষজ্ঞ। কিন্তু ছবি যাচাইয়ে দেখা যায়, তিনি আসলে জাপানের বিখ্যাত চিকিৎসক ও লেখক শিগিয়াকি হিনোহারা। অপরদিকে আরব আমিরাতে যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, সেখানে অন্য একজন ব্যক্তিকে আরেথা তানাকা বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। 

একই কৌশল ব্যবহার করে পোলিশ ভাষায় একটি ক্রিমের প্রচারণায় একজন অর্থোপেডিক চিকিৎসকের পরিচয়সহ সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হয়। বলা হয় যে সেই ব্যক্তির নাম ম্যাকসিমিলান বালসেরোস্কি এবং তিনি পোল্যান্ডের ক্রাকোর বাসিন্দা। যাচাই করে দেখা যায়, ছবির মানুষটি আসলে ধ্রুপদী ভাষাবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড্যান নেগ্রুসকো; তিনি রোমানিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। 

এভাবে প্রচারণায় অন্তত ১২ জন ব্যক্তির মিথ্যা পরিচয় ব্যবহার করা হয়েছে। কখনো একই ব্যক্তির ছবিকে একাধিক নাম বা কখনো একাধিক ব্যক্তিকে একই নাম দেয়া হয়েছে। 

প্রচারণায় আরো যত মিল

এসব প্রচারণার ক্ষেত্রে যতগুলো ওয়েবসাইট ব্যবহার করা হয়েছে, একটি বাদে বাকি সবগুলোতে নিউজ পোর্টালের আদল নেয়া হয়েছে। মূলধারার নিউজ পোর্টালের মতই তাদের একইরকম মেন্যুবার থাকে। এছাড়া, সবগুলোতে বিশ্বাসযোগ্য গণমাধ্যম অথবা কল্পিত গণমাধ্যমের নাম ব্যবহার করা হয়। 

যে দেশে যে গণমাধ্যমের নাম ব্যবহার করা হয়েছে
বাংলাদেশপ্রথম আলো, বিবিসি, প্রধান সংবাদ
ইতালিরাই নিউজ
পোল্যান্ডজিশে (DZISIAJ)
বুলগেরিয়ানভিনি
ফিলিপাইনমেডলাইফ
আরব আমিরাতমেডলাইফ 
সার্বিয়াবিবিসি
মেসিডোনিয়াবিবিসি
বসনিয়াবিবিসি
স্লোভেনিয়াবিবিসি
সার্বিয়াবিবিসি

প্রচারণায় ব্যবহৃত ওয়েবপেইজগুলোর ডিজাইন কম-বেশি একই রকম। প্রতিটিতেই শেষের দিকে পণ্যের বিবরণ ও ক্রয়ের উপায় বলা থাকে। প্রত্যেকটি দেশের জন্যে সেখানকার মুদ্রায় পণ্যের দাম উল্লেখ থাকে এবং ওয়েবসাইটে পণ্য অর্ডারের জন্যে আলাদা কান্ট্রিকোড সম্বলিত ফর্ম বা একটি বাটন থাকে যার মাধ্যমে বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। ডিসমিসল্যাব দেখতে পেয়েছে, পণ্য, দেশ এবং ডোমেইন আলাদা হওয়ার পরও পেইজগুলোতে যে যোগাযোগের জন্য যে ফর্ম বা বাটন দেওয়া হয়েছে তা একই রকম।

ডিসমিসল্যাব এই ফর্ম ব্যবহার করে ফোন নম্বর দিয়ে অপ্টিম্যাক্স কেনার “আবেদন” করে। এরপর একটি নম্বর থেকে আবেদনকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। টেলিফোনে অর্ডার করার পর “ট্রাস্ট ফার্মেসি” নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে কুরিয়ারের মাধ্যমে অপ্টিম্যাক্সের কৌটা পাঠানো হয়।

ডিসমিসল্যাব অপ্টিম্যাক্সের যে কৌটাটি সংগ্রহ করেছে, তার গায়ে লেখা এটির প্রস্তুতকারক ম্যাক্সহার্ব লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। কৌটাতেই প্রতিষ্ঠানটির দুটি ঠিকানা দেওয়া। একটি জার্মানির এবং অপরটি সিঙ্গাপুরের। দুটি ঠিকানাই শেয়ার্ড অফিস স্পেসের, অর্থ্যাৎ যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান চাইলে ঘন্টা, দিন, সপ্তাহ বা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেখান থেকে জায়গা ভাড়া নিতে পারে।

যেসব স্বাস্থ্যপণ্য বিক্রির জন্য এই প্রচারণা

আলোচ্য ১১টি ওয়েবসাইটে মোট ৬টি আলাদা আলাদা স্বাস্থ্যপণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়েছে। বাংলাদেশে অপ্টিম্যাক্স নামের যে পণ্যটি এভাবে বিক্রি করা হচ্ছে, সেটি মানুষের দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে পারে দাবি করা হয়। অপ্টিম্যাক্স মূলত একটি ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট (খাদ্য-সম্পূরক)। 

ইউরোপে ও-ক্যাপস নামের যে পণ্যটি বিক্রি করা হচ্ছে, সেটিও দৃষ্টিশক্তি বাড়ানোর বলে দাবি করা হয়। এটিও একটি ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট যাতে মূলত বেটা ক্যারোটিন, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই এবং জিঙ্ক রয়েছে বলে বিবরণে লেখা রয়েছে। ২০২৩ সালে স্লোভেনিয়ার পাবলিক এজেন্সি ফর মেডিসিনাল প্রডাক্টস অ্যান্ড মেডিক্যাল ডিভাইস ও-ক্যাপস সম্পর্কে বলেছিল, এটি একটি “প্রচলিত অনলাইন স্ক্যাম” এবং এগুলো না কেনাতেই মঙ্গল। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এন্ড ড্রাগ অথরিটির (এফডিএ) মতে, ওষুধ ও সাপ্লিমেন্ট এক নয়। তবে সাপ্লিমেন্টে অনেক সময় ওষুধের ব্যবহার থাকতে পারে বলে এটি গ্রহণের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার পরামর্শও দেয় এফডিএ।

এছাড়া ফিলিপাইন, আরব আমিরাত এবং ইতালিতে তিনটি আলাদা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের স্বাস্থ্যপণ্যের প্রচারণা চালানো হয়; যেগুলোর নাম যথাক্রমে: ডায়াবেটিন, ডায়াবেক্সটান, এবং ডায়াস্টাইন। এদের মধ্যে, উদাহরণস্বরূপ, ডায়াবেক্সটান নামের পণ্যটি সম্পর্কে ফিলিপাইনের ওষুধ প্রশাসন তাদের গ্রাহকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সতর্ক করেছে এবং এটি না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। 

পোলিশ ভাষার ওয়েবসাইটিতে ফ্লেক্সিও নামের একটি শরীরের অস্থিসন্ধির ব্যথা উপশমকারী মলম বিক্রি করছে। পোলিশ ভাষার প্রচারণা অনুযায়ী, ফ্লেক্সিওতে অন্যান্য বিভিন্ন সহায়ক উপাদানের সঙ্গে থান্ডার গড ভাইন নামক গাছের মূল, গম ঘাসের শিকড়, ক্রিপিং ডাস্টের শিকড়, পুদিনা এবং ভোজ্য তেলের মতো উপাদান রয়েছে। এই তথাকথিত জাদুকরী ওষুধ দাবি করে যে এটি কমপক্ষে দশটি রোগের চিকিৎসা করতে পারে যা প্রাথমিকভাবে শরীরের অস্থিসন্ধি, হাড় এবং শরীরের বিভিন্ন অংশের সংযোগকারী টিস্যুকে প্রভাবিত করে।

প্রচারণায় সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার

এসব পণ্যের বিক্রির প্রচারণায় কেবল ওয়েবসাইট নয়, ব্যবহার করা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমও। বাংলাদেশে অপ্টিম্যাক্স পণ্যের অন্তত ১৭টি ফেসবুক পেজ রয়েছে যার মধ্য থেকে ৫টি (, , , , ) বিজ্ঞাপনও চালাচ্ছে। মেটার  বিজ্ঞাপন নীতিমালা বলছে কোনো বিজ্ঞাপন যা করতে পারে না: 

  • একটি পণ্য বা পরিষেবার সাফল্য সম্পর্কে প্রতারণামূলক বা অতিরঞ্জিত দাবি ব্যবহার করে কাউকে বিভ্রান্ত করে সংবেদনশীল তথ্য ক্রয় বা শেয়ার প্রভাবিত করা
  • বিখ্যাত ব্যক্তি ছবি এবং বিভ্রান্তিকর কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে জনসাধারণকে একটি বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট করে প্ররোচিত করা।

তবে, জুনের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ৩০টি সক্রিয় ফেসবুক বিজ্ঞাপনের বেশিরভাগেই সেঁজুতি সাহার ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে ভুল তথ্যের উপস্থিতি রয়েছে। ২০২৩ এ, স্লোভেনিয়ান স্বাস্থ্য মন্ত্রীর ভুয়া ছবি ব্যবহার করে ও-ক্যাপ নামক ঔষধটির প্রচারণা করা হয়। 

ডায়াস্টাইন (,,), ডায়াবেটিন (,) এবং ফ্লেক্সিও (,) এর নামে বেশ কিছু ফেসবুক পেজ রয়েছে। দৃষ্টিশক্তির পুনরুদ্ধারের পণ্য ও-ক্যাপস (,,) এর রয়েছে একাধিক ফেসবুক পেজ, চলছে বিজ্ঞাপনও ()। এসব পেইজে গিয়ে বার্তা পাঠিয়ে পণ্যগুলো কেনার জন্য বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়।

গত দু বছরে বাংলাদেশে বেশ কিছু পোষ্টে এই অপ্টিম্যাক্স বিক্রির তথ্য পোষ্ট করা হয়েছে। এসব পোষ্টের কমেন্টে দেখা যায়, অনেকে পণ্যটি পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন এবং পেজগুলো থেকে এর জবাবে ফোন নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। অনেক ক্রেতা বিভিন্ন পোস্টে পণ্যটি নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। গত তিন জুলাই একটি পোস্টে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য একটি দুঃসংবাদ নিয়ে আসছে Optimax নামক একটি চোখ নষ্ট করার ক্যাপসুল। যা কিনবেন তো ঠকছেন। আমি কিনেছি ঠকেছি।”

আরো কিছু লেখা