আহমেদ ইয়াসীর আবরার
ফেসবুকের অ্যাড থেকে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, বিনিয়োগ প্রতারণার ফাঁদ
আহমেদ ইয়াসীর আবরার
ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে ঝকঝকে বিজ্ঞাপন, সেখানে অল্প সময়ে শেয়ারবাজারে বড় মুনাফার প্রতিশ্রুতি। বিজ্ঞাপন থেকে নিয়ে যাওয়া হয় হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে, সেখানে সাজানো প্রশংসা আর তথাকথিত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। এরপর ভুয়া ওয়েবসাইট বা অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপে নিবন্ধন করিয়ে শেষ ধাপে বিকাশ বা নগদে টাকা পাঠাতে বলা হয়। এভাবেই গড়ে উঠেছে এক বহু-প্ল্যাটফর্ম প্রতারণার জাল।
ডিসমিসল্যাবের এক মাসের অনুসন্ধানে এই স্কিমের বিস্তার স্পষ্ট হয়েছে। শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই পাওয়া গেছে অন্তত ১৫টি ফেসবুক পেজ থেকে চালানো শতশত বিজ্ঞাপন, যেগুলোর লক্ষ্য ছিল নতুন নতুন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে মানুষ টেনে নেওয়া। এমন অন্তত ২০টি গ্রুপ শনাক্ত হয়েছে যেখানে সদস্য সংখ্যা সব মিলিয়ে ৩ হাজারের বেশি। গ্রুপগুলো চালানো হচ্ছে দুটি বৈধ ব্রোকারেজ হাউজের নামে: সিটি ব্রোকারেজ লিমিটেড (সিবিএল) এবং ব্র্যাক ইপিএল সিকিউরিটিজ।
ডিসমিসল্যাবের গবেষকেরা গ্রাহক সেজে একাধিক গ্রুপে যোগ দিয়ে গোটা প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছেন। সিবিএল গ্রুপে বিনিয়োগকারীদের পাঠানো হয় একটি ভুয়া অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপে, আর ব্র্যাক গ্রুপে নিয়ে যাওয়া হয় একটি ভুয়া ওয়েবসাইটে। তারপর ব্যাংক এবং বিকাশ ও নগদের মতো মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সেবার মাধ্যমে ব্যক্তিগত একাউন্টে সরাসরি টাকা লেনদেন করা হয়। এই পদ্ধতিকে ব্যবহার করে প্রতারকেরা বৈধ ব্রোকারেজ অ্যাকাউন্ট এড়িয়ে সরাসরি নিজেদের পকেটে টাকা তুলছে।
বিজ্ঞাপনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস ও ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতো বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তির ছবি ও পরিচয় ব্যবহার হচ্ছে।
ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা ডিসমিসল্যাবকে জানিয়েছেন, তারা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, সিআইডিকে লিখিতভাবে এই প্রতারণা সম্পর্কে জানিয়েছেন। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন থেকে এক দফায় সাবধানও করা হয়েছে। কিন্তু এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত বেশিরভাগ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ সক্রিয় ছিল এবং ফেসবুকে প্রতিদিন নতুন নতুন বিজ্ঞাপনও চলছিল।
এর আগে ভারতেও একই ধরণের প্রতারণা দেখা গেছে যেখানে সামাজিক মাধ্যম-মেসেজিং প্লাটফর্ম-ভুয়া ওয়েবসাইট ব্যবহার করে শেয়ারবাজারে উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে সাধারণ গ্রাহকদের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ব্র্যাক ইপিএল ও সিটি ব্রোকারেজের নাম ভাঙ্গিয়ে প্রতারণা
ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই স্কিম মূলত দুটি শাখায় বিভক্ত: একটি শাখা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ চালাচ্ছে সিটি ব্রোকারেজের নাম ভাঙ্গিয়ে এবং অপরটি ব্র্যাক ইপিএলের। এদের মধ্যে সিবিএলের নামে ৭টি এবং ব্র্যাক ইপিলের নামে ১৩টি গ্রুপ এই অনুসন্ধানেই সনাক্ত করা হয়েছে। প্রকৃত গ্রুপের সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে।
সিবিএল পরিচয়ের গ্রুপগুলো বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে সিবিএলপিজি নামের একটি অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপের মাধ্যমে। ব্র্যাক ইপিএলের নামে পরিচালিত স্কিমে টাকা নেওয়া হয় এএনএমব্র্যাকবিএক্সটি ডট কম নামের একটি ওয়েবসাইটের সাহায্যে। এই দুই অংশের মধ্যে মূল পার্থক্য এটাই।
দুই ধরনের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ পরিচালনা করছেন আলাদা ব্যক্তিরা, তাদের ফোন নম্বর আলাদা, কথিত বিশেষজ্ঞদের পরিচয় ভিন্ন, গ্রুপের মধ্যে তারা যে বার্তা দিয়ে থাকেন তার ধরণও আলাদা। তবে প্রতারণার প্রক্রিয়াটি এক।
ডিসমিসল্যাব, ব্র্যাক ইপিএলের নাম ব্যবহার করে চালানো পাঁচটি গ্রুপে প্রবেশ করেছে। প্রতিটিতে ঠিক বেলা ১১টায় একটি টিপস বা পরামর্শ আসে, প্রতিটিতেই “নুসরাত জাহান” নামে একজন নিজেকে ব্র্যাক ইপিএলের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগের কথা বলেন, এবং প্রতিটি গ্রুপেই অ্যাডমিনদের মেসেজ বা বার্তার ভাষা হুবহু একই। সিবিএলের নামসহ একটি গ্রুপে যোগ দিয়ে দেখা গেছে, সেখানে পরামর্শ দিচ্ছেন ব্রোকারেজটির কর্মকর্তা দাবি করা জহিরউদ্দিন শাহ ও অন্বেষা বসু। এই গ্রুপের বার্তা বা ভাষার সঙ্গে ব্র্যাক-ইপিএল নামসহ গ্রুপগুলোর বার্তার মিল নেই।
দুই অংশের মধ্যে সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায় প্রচারণা কৌশলে। অন্তত সাতটি ফেসবুক পেজ পাওয়া গেছে যারা – সিবিএল ও ব্র্যাক ইপিএল – দুই ধরনের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের প্রচারণা চালিয়েছে। দুই অংশের প্রচারণাতেই প্রায় একই গ্রাফিক্স কার্ড ও বার্তা ব্যবহারের আধ ডজন নজির পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঘুরে ফিরে একই ফেসবুক পেজ এই প্রচারণায় অংশ নিচ্ছে এবং প্রতি সপ্তাহে তারা নতুন নতুন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলছে এবং তাতে শত শত ব্যবহারকারী যোগ দিচ্ছেন। বিজ্ঞাপনের ধরন কমবেশী একই, শুধু সপ্তাহে সপ্তাহে বিজ্ঞাপনের সঙ্গে যুক্ত হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটি বদলে যাচ্ছে।

বামের বিজ্ঞাপনটি ৬ সেপ্টেম্বরের; এটি সিবিএল নামসহ একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের প্রচারণা চালায়। ডানের বিজ্ঞাপনটি চলেছে ২৫ সেপ্টেম্বর। গ্রাফিক্স কার্ড ও তথ্য একই, কিন্তু এর অ্যাপ্লাই নাও বাটনে অনুসরণ করে ব্র্যাক নামসহ একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ পাওয়া যায়। দুটো বিজ্ঞাপনই চলেছে কোল্টন কেসি অলিভিয়া নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে।
অনুসন্ধানটি শুরু হয় ৬ সেপ্টেম্বর থেকে। সেই সপ্তাহে যতগুলো বিজ্ঞাপন নথিবদ্ধ করা হয়েছে, প্রতিটিই সিবিএল নামধারী কোনো না কোনো হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে নিয়ে গেছে। পরের সপ্তাহ থেকে এটি পাল্টে যায়। একই মাসের ১৪ তারিখে যতগুলো বিজ্ঞাপন নথিবদ্ধ করা হয়, তার প্রতিটি ব্র্যাক নামসহ কোনো না কোনো হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে নিয়ে যায়। ২০ ও ২৫ সেপ্টেম্বরে ফের যখন একই ধরনের বিজ্ঞাপন নথিবদ্ধ করা হয়, তখন নতুন নতুন গ্রুপের সন্ধান মেলে, প্রতিটি ব্র্যাক বা ব্র্যাক ইপিএলের নাম ও লোগো ব্যবহার করছে।
ডিসমিসল্যাব যখন তথ্য সংগ্রহ করেছে, তখন একেকটি গ্রুপে ৬৫ থেকে ২৫০ জন পর্যন্ত সদস্য পেয়েছে। সব মিলে ২৬টি গ্রুপে সদস্য সংখ্যা তিন হাজারের বেশি ছিল, যারা মুনাফার আশায় গ্রুপগুলোতে যোগ দিয়েছেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, সিবিএলপিজি নামের অ্যাপটি অন্তত ১২শ বার ডাউনলোড হয়েছে। এখান থেকে বোঝা যায়, কত ব্যক্তি এই স্কিমে বিভ্রান্ত হয়েছেন।
ব্র্যাক ইপিএল সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী আহসানুর রহমান ডিসমিসল্যাবকে জানিয়েছেন, এই গ্রুপগুলোর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই; এটি এক ধরনের প্রতারণামূলক স্কিম এবং এর কারণে তাদের অনেক গ্রাহক বিভ্রান্ত হচ্ছেন। এটি তাদের সুনামের ক্ষতি করছে বলেও জানান তিনি। সিটি ব্রোকারেজের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারাও এই প্রতারণা নিয়ে শঙ্কিত এবং বিষয়টি পূঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও পুলিশকে জানিয়েছেন।
হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ও ড. জাহিদ হোসেন

প্রথম স্ক্রিনশটে ড. জাহিদ হোসেনের আগমন বার্তা জানাচ্ছেন নুসরাত জাহান এবং দ্বিতীয় স্ক্রিনশটে কথিত জাহিদ হোসেন এসে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন।
১৫ সেপ্টেম্বর, সকাল ১০টা। গ্রুপে বার্তা এলো, আগামী সপ্তাহেই আসছেন ড. জাহিদ হুসেইন; তিনি এই গ্রুপে সবাইকে ‘লাইভ’ প্রশিক্ষণ দেবেন, যেন শেয়ার বেচাকেনায় লোকসান কমিয়ে, মুনাফা ঘরে তোলা যায়। বার্তাটি দিয়েছেন, নুসরাত জাহান। তিনি বলছেন, ড. জাহিদ তার শিক্ষক, যিনি একটি সম্মেলনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন। তাই শিক্ষকের সহকারী হিসেবে তিনি এত দিন গ্রুপ সদস্যদের দৈনিক আপডেট দিয়ে গেছেন।
ড. জাহিদের আগমনকে বিশ্বাসযোগ্য করতে কিছুক্ষণের মধ্যেই “সাজিদ চৌধুরি” নামের একজন বিনিয়োগকারী আলোচনায় যোগ দেন। তিনি গ্রুপে একটি খবরের লিংক দিয়ে বললেন, “আমিও ড. জাহিদ হোসেন এর লেটেস্ট নিউজ দেখছি, তাই এই গ্রুপে জয়েন করে শিখতেছি।” খবরটির মূল বিষয়বস্তু হলো, ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে একটি “এআই কোয়ান্টিটেটিভ ট্রেডিং প্রমোশন সম্মেলন” হবে , যা ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ আয়োজন করছে, বিএসইসির অনুমোদন নিয়ে। এতে ড. জাহিদ সভাপতিত্ব করবেন।
বলে রাখা ভালো, খবরের লিংকটি ডিজিটাল জার্নাল নামের এক সাইটের, যেখানে টাকা দিয়ে খবর প্রকাশ করা যায় এবং এটি এক মাসে ৭০,০০০ লেখা প্রকাশ করে। একারণে স্প্যামাররা লেখা প্রকাশের জন্য সাইটটিকে ব্যবহার করেন।
এরপর একের পর এক বার্তা আসতে থাকে, “আমি দীর্ঘদিন ধরে ড. জাহিদের ফেরার অপেক্ষায় আছি”, “সো কুল! ড. জাহিদ হুসেইন যখন আমাদের গাইড করছেন, আমরা ট্রেডিংয়ে অনেক বেশি স্টেডি হবো,” ইত্যাদি। এদের কারো নাম সুমাইয়া আক্তার, কারো নাম নওশিন জাহান বা আশিকুর রহমান।
যে গ্রুপটির কথা এতক্ষণ বলা হচ্ছিল, সেটির নাম “H111-BRAC Securities Trading Study Group”। ডিসমিসল্যাব ব্র্যাকের নাম ব্যবহার করা যে চারটি গ্রুপে যোগ দিয়েছে, এটি তার একটি। অন্য তিনটি গ্রুপ হলো: J901 BRAC Investment Research Exchange, S1-BRAC Securities Strategy Group, এবং L215 BRAC Securities Investment Strategy। মজার বিষয় হলো, প্রথমটিতে জাহিদ হোসেনের আগমন ও তার জন্য অপেক্ষার যে মেসেজ বা বার্তাগুলো পোস্ট করা হয়েছে, প্রায় একই সময় হুবহু একই বার্তা, একই ক্রমে, কখনো কখনো একই নামে, অন্য গ্রুপগুলোতেও পোস্ট করা হয়েছে।

ড. জাহিদ হোসেনের ছবি ও নাম ব্যবহার করে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে আগেই প্রতারণার ক্ষেত্র তৈরি করা হয়।
সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখ সকাল সাড়ে দশটায় ড. জাহিদ পরিচয় দিয়ে একজন ব্যক্তি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এলেন এবং লিখলেন: “প্রিয় বন্ধুদের! আমি Zahid Hussain, বর্তমানে BRAC EPL Securities এর chief analyst। প্রতিদিন এখানে আপনাদের সঙ্গে সময় কাটানো আমার জন্য খুবই মূল্যবান।” তিনি আরো জানালেন, বিশ্বব্যাংক থেকে অবসার নেওয়ার পর তিনি বাংলাদেশের পূঁজিবাজারের উন্নয়নে মনোযোগ দিয়েছেন এবং আশা করছেন এই গ্রুপে বিনিয়োগকারীদের “ভবিষ্যতভিত্তিক বাজার বিশ্লেষণ” দিতে পারবেন।
এই ব্যক্তি, ডিসমিসল্যাবের নজরে থাকা চারটি গ্রুপে প্রায় একই সময় এসেছিলেন, এবং প্রত্যেক গ্রুপে তার নাম এক হলেও ফোন নম্বর আলাদা ছিল। ডিসমিসল্যাবের পক্ষ থেকে তার নাম যুক্ত প্রত্যেকটি নম্বরেই সরাসরি কল এবং হোয়াটসঅ্যাপে কল করা হয়, কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি।
প্রকৃত ড. জাহিদ হোসেন একজন বরেণ্য অর্থনীতিবিদ এবং তিনি ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ছিলেন। বর্তমানে তিনি ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ লিমিটেডের পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের স্বাধীন পরিচালক হিসেবে আছেন। ড. জাহিদ ডিসমিসল্যাবকে পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন, এসব গ্রুপ বা বিজ্ঞাপনের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।” তিনি জানান, কথিত সেই সম্মেলনের খবরটি ভুয়া এবং তিনি নিজেও ফেসবুকে এমন বিজ্ঞাপন দেখে অবাক হয়েছেন। ড. জাহিদ সবাইকে এই ধরণের প্রতারণা থেকে সতর্ক থাকতে বলেছেন। তিনি বলেন, “যেকোনো ধরণের বিনিয়োগের আগে অবশ্যই যাচাই বাছাই করা উচিত।”
হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে হরেক রকমের জালিয়াতি
ব্র্যাকের নাম ব্যবহার করা গ্রুপের আরেক চরিত্র, নুসরাত জাহান। প্রতিটি গ্রুপে প্রবেশ করার পর সূচনা বার্তা আসে তার কাছ থেকে। যেমন “H111” গ্রুপে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বার্তা পাঠান, “অফিসিয়াল স্টক স্ট্র্যাটেজি ও বিনিয়োগ আলোচনা গ্রুপে স্বাগতম।” বার্তায় প্রতিদিন সকাল ও দুপুরে নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেডিং পরামর্শ, বাজার প্রবণতা এবং ক্লাসের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, আর শেষে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগের জন্য একটি লিংক শেয়ার করা হয়। অন্য গ্রুপগুলোতেও নুসরাত জাহান নিজেকে ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ লিমিটেডের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে জানান, প্রতিদিন সকাল ১১টায় গ্রুপে সুপারিশ করা স্টক দেখা যাবে এবং ব্যক্তিগত চ্যাটে এসে আরও তথ্য নেওয়া যাবে।

দুটি আলাদা গ্রুপের স্ক্রিনশটে প্রশংসাকারীদের একই পোস্ট, একই নাম বা ছবি আলাদা ফোন নম্বর।
কয়েক মিনিটের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে প্রশংসামূলক প্রতিক্রিয়া আসে। যেমন, “S1-BRAC”-এ দেখা যায়, “জাহিদুল ইসলাম”, “রোকেয়া বেগম”, “নাইম হাসান” ও “জিয়াউল হক” নামে কয়েকটি অ্যাকাউন্ট দ্রুত পরপর লিখেছে যে তারা গ্রুপের পরামর্শে খুশি, প্রতিদিনের রেকর্ড সংরক্ষণ করছেন এবং গ্রুপটিকে শীর্ষে রেখেছেন। একই বার্তা মিনিটের ব্যবধানে হুবহু পুনরাবৃত্তি হয় পর্যবেক্ষণে থাকা অন্য তিনটি গ্রুপেও।
প্রশংসাকারী একাউন্টগুলোর প্রোফাইলেও নির্দিষ্ট ধরণ বা প্যাটার্ন চোখে পড়ে। এক গ্রুপের “রোকেয়া বেগম”-এর ছবি অন্য গ্রুপে “সালমা খান” নামে ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্যদিকে “সাজিদ চৌধুরি” বা “খলিল আহমেদ”-এর মতো নামগুলোও ঘুরেফিরে দেখা যায় একই ধরনের বার্তায়। প্রতিটি গ্রুপে একই নামের অন্তত ৬ জন প্রশংসাকারী পাওয়া গেছে, তবে একেক গ্রুপে তাদের ফোন নম্বর একেকটি।
সিবিএলের নাম ব্যবহার করা গ্রুপে লোকজন আলাদা, তবে স্কিম একই: একজন বিশেষজ্ঞ এবং একজন সহকারী (ব্র্যাক গ্রুপে যেমন নুসরাত ও জাহিদ), এবং তাদের প্রশংসাকারী। “D1826 CBL Official Stock Strategy Community” গ্রুপে প্রথম বার্তাটি আসে “অ্যাসিসটেন্ট অন্বেষা বসু” নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে। সেখানে বলা হয় প্রতিদিন সকাল ১১টায় “উচ্চমানের স্টক রেকমেন্ডেশন এবং এক্সক্লুসিভ ইনসাইড তথ্য” দেওয়া হবে। এই গ্রুপে নিয়মিত বার্তা দেন নিজেকে প্রতিষ্ঠানটির সিআইও পরিচয় দেওয়া “জহিরউদ্দিন শাহ”। তিনি বাজার বিশ্লেষণ করে দিকনির্দেশনা দেন। কিন্তু সিটি ব্রোকারেজ লিমিটেডের পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনা দলে এমন কোনো নাম বা ছবি পাওয়া যায়নি।

প্রথম স্ক্রিনশটে সিবিএল নামধারী গ্রুপের “সহকারী” অন্বেষা বসু এবং দ্বিতীয়টিতে “বিশেষজ্ঞ” জহিরউদ্দিন শাহের পোস্ট।
ডিসমিসল্যাব পর্যবেক্ষণের জন্য সিবিএলের নামধারী মাত্র একটি গ্রুপে প্রবেশ করতে পেরেছে। গ্রুপটিতে ব্র্যাকের মতোই কয়েকজন প্রশংসাকারী রয়েছেন, যারা জহিরউদ্দিন বা অন্বেষার পোস্টের পরপর প্রশংসা বা সমর্থনসূচক পোস্ট দিয়ে থাকেন। এদের মধ্যে বেশ কিছু বিদেশী নামও রয়েছে। যেমন: ১৬ সেপ্টেম্বর রাত ৯টা ৩৯ মিনিটে “র্যামন্ড ডামিনি” (মূল নাম ইংরেজিতে) লেখেন, “আজকের রাতের ক্লাস আমার জন্য খুবই উপকারী হয়েছে…”। ১৮ সেপ্টেম্বরে “মাইকেল মাকগোবা” লেখেন, “CBL টিম সাহসের সাথে দায় নিতে রাজি, তাই আমি ভরসা করি”; এরপর “জেসন বোথা” লেখেন, “এটা হলো আমার দেখা সবচেয়ে দায়িত্বশীল একটা টিম।” (মূল মেসেজ ইংরেজিতে)
গ্রুপের সদস্যদের নামের ভেতরেও বিদেশি ধারার নাম ব্যবহার স্পষ্ট। যেমন, আন্দিলে নদলভু, বাফানা নদলভু, এরিকা থমাস, হেন্ডরিক মিলার ইত্যাদি। কয়েকটি অ্যাকাউন্টের বায়ো বা বৃত্তান্ত হিন্দি ভাষায় লেখা। যেমন, স্টিফেন ডি ভিলার্স নাম ব্যবহার করা হয়েছে এমন একটি অ্যাকাউন্টের বায়োতে লেখা, “आइए हम एक साथ स्वास्थ्य और खुशी की राह पर चलें” (আসুন আমরা একসাথে স্বাস্থ্য এবং সুখের পথে হাঁটি)।

সিবিএলের গ্রুপে বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে দেখা যায় হিন্দি ভাষায় লেখা বায়ো
হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে এমএফএসে
সিটি ব্রোকারেজের নাম ব্যবহার করা গ্রুপটিতে ১৮ সেপ্টেম্বর নতুনভাবে “কাস্টমার রিপ্রেজেন্টেটিভ”-এর ধারণা আনা হয়। সকাল ৯টা ৫৪ মিনিটে “অন্বেষা বসু” ঘোষণা দেন, সিবিএল মেম্বারশিপ সার্ভিসের কাস্টমার রিপ্রেজেন্টেটিভকে স্বাগত জানানো হচ্ছে। কয়েক মিনিট পর, তিনি নিজেকেই সেই কাস্টমার প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দেন এবং একটি লিংক শেয়ার করেন।
লিংকে ক্লিক করলে নতুন একটি চ্যাট উইন্ডো খোলে, যেখানে “কাস্টমার সার্ভিস নং. ০৮৬” নামের একটি অ্যাকাউন্ট আগে থেকেই “হ্যালো, আই উড লাইক টু অ্যাপ্লাই ফর এ মেম্বারশিপ” (মূল ইংরেজিতে) লেখা একটি স্বয়ংক্রিয়-মেসেজ যুক্ত করে রেখেছিল। ডিসমিসল্যাব সেই বার্তা পাঠানোর পর সিবিএল সিকিউরিটিজ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত তথ্য দেওয়া হয় এবং জানানো হয় “১৫ দিনের মধ্যে ৩০% থেকে ৮০% পর্যন্ত রিটার্ন” পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। আগ্রহ দেখালে তিনি গুগলের প্লে স্টোর থেকে “সিবিএলপিজি” নামের একটি অ্যাপ ডাউনলোড করতে বলেন।
অ্যাপ ইনস্টল করার পর নিবন্ধন। এজন্য একটি মোবাইল নাম্বার, ছয় অক্ষরের পাসওয়ার্ড, ক্যাপচা এবং “অফিসিয়াল কোড” পূরণ করতে হয়। কোডটি দেন সেই কাস্টমার প্রতিনিধি। নিবন্ধন শেষে অ্যাপে প্রবেশ করা যায়। অ্যাপটিতে সিটি ব্রোকারেজের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন স্লাইড দেখানো হয়। সেখানে আইপিও, ব্লক ট্রেড, লোন, ডিপোজিট, উইথড্র, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও ওয়ালেটের মতো ফিচার দেখা যায়। টাকা জমা দেওয়ার জন্য বিকল্প দুটি: ব্যাংক ও ওয়ালেট। ন্যুনতম জমার পরিমান হলো ৫০০০ টাকা।
২২ সেপ্টেম্বরের পর ব্র্যাক ইপিএলের নাম ব্যবহার করা গ্রুপগুলোতেও একই ধরন বা প্যাটার্ন দেখা যায়। সেখানে “সাদিয়া” নামের একটি অ্যাকাউন্ট নিজেকে ব্র্যাক ইপিএলের কাস্টমার সার্ভিস স্টাফ পরিচয় দিয়ে জানান, গ্রুপ বা ব্যক্তিগতভাবে যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব তার। একই দিনে এবং একই ভাষায় পাঠানো এই বার্তা ব্র্যাকের নাম যুক্ত চারটি গ্রুপেই পাওয়া যায়।

সিবিএলের নাম ব্যবহার করা অ্যাপ এবং ব্র্যাকের নাম ব্যবহার করা ওয়েবসাইট
সেই বার্তার পর একটি লিংক পাঠানো হয়, যা ক্লিক করলে তার ব্যক্তিগত হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট খোলে। প্রোফাইলেও “সাদিয়া” নাম দেখা যায়। সেখানে যোগাযোগ করলে শুরুতে “১” লিখে পাঠিয়ে বিনিয়োগ পরিষেবা চালু করতে বলা হয়। এরপর তিনি এএনএমব্র্যাকবিএক্সটি ডট কম (anmbracxbt.com) নামের একটি ওয়েবসাইটের লিংক পাঠান। তাতে ব্র্যাক ইপিএলের নাম ও লোগো ব্যবহার করে “হাই নেট ওর্থ ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট” খোলার অপশন আসে এবং নিবন্ধন করতে বলা হয়। এখানেও “অফিসিয়াল কোড” লাগে এবং সেটি আসে সাদিয়ার কাছ থেকে। নিবন্ধন শেষে ব্যাংক ও ওয়ালেটে টাকা জমার অপশন আসে। এই পর্যায়ে ন্যূনতম ১০,০০০ টাকা জমা দিতে হয়। নিবন্ধনের পর কেওয়াইসি (পরিচিতি তথ্য) সংযোজনের ধাপ আসে, যদিও ডিসমিসল্যাব নিরাপত্তাজনিত কারণে সেখানে আর এগোয়নি।
ব্র্যাক ও সিবিএলের নাম করে দুটি স্কিম চললেও তাদের টাকা তোলার ধরন এক। একটিতে অ্যাপ এবং অপরটিতে ওয়েবসাইট ব্যবহার হলেও দৃশ্যত দুটির ডিজাইন এবং গঠন এক। ব্র্যাক ইপিএলের প্রধান নির্বাহী এবং বাজার বিশেষজ্ঞদের অ্যাপ ও ওয়েবসাইটের স্ক্রিনশট ও লিংক পাঠানো হলে, তারা জানান এদের সঙ্গে সিটি ব্রোকারেজ বা ব্র্যাক ইপিএলের কোন সম্পর্ক নেই এবং এগুলো অনুমোদিত নয়।

ভুয়া অ্যাপ এবং ভুয়া ওয়েবসাইটে বিকাশ এবং নগদকে ব্যবহার করে ডিপোজিট গ্রহণ
দুটি স্কিমেই জমার জন্য ব্যাংক এবং নগদ ও বিকাশের মতো এমএফএস চ্যানেল রয়েছে। ব্যাংকের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ “চ্যানেল পাসওয়ার্ড” দিতে হয়, যা কাস্টমার সার্ভিস প্রতিনিধি সরবরাহ করেন। তবে মোবাইল ওয়ালেটের ক্ষেত্রে পাসওয়ার্ডের বাধা নেই। এখানে গ্রাহকদের দুটি নির্দিষ্ট নাম্বার দিয়ে সরাসরি সেন্ড মানি করতে বলা হয়। টাকা পাঠিয়ে রেফারেন্স নম্বর শেয়ার করলেই অ্যাকাউন্ট সক্রিয় হয়ে যায়। অনেকেই সহজ পদ্ধতির কারণে এমএফএস বেছে নেন। এভাবে ব্যক্তিগত নাম্বারকে টার্গেট করে প্রতারকেরা টাকা তুলছে, যা কোনো অনুমোদিত ব্রোকারেজ অ্যাকাউন্টে না গিয়ে সরাসরি তাদের ব্যক্তিগত ওয়ালেটে চলে যাচ্ছে।
সাধারণ গ্রাহকের ক্ষতি কোথায়?
ডিসমিসল্যাব ভুয়া বিজ্ঞাপন দেখে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে প্রবেশ করেছে, সেখান থেকে ওয়েবসাইট ও অ্যাপে গিয়েছে, এমনকি ডিপোজিটের নির্দেশনা পর্যন্ত অনুসরণ করেছে, কিন্তু শেষ ধাপে টাকা পাঠায়নি। সাধারণ বিনিয়োগকারী এ জায়গাতেই প্রতারিত হন। কারণ গ্রুপের ভেতরের সাজানো পরিবেশ, নকল ওয়েবসাইট ও এমএফএসের সহজ লেনদেন কাঠামো একসাথে মিলে তাদেরকে টাকা পাঠাতে প্রলুব্ধ করে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, টাকা জমা হলে প্রতারকেরা আসল মুনাফা তোলে কীভাবে? এর উত্তর মেলে ভারতে, যেখানে হুবহু একই ধরনের একটি প্রতারণা স্কিমের সন্ধান মেলে।
চলতি বছরের ২৯ এপ্রিল ভারতের অন্যতম আর্থিক প্রতিষ্ঠান জেরোদা-র সহ-প্রতিষ্ঠাতা নিথিন কামাথ তার অফিসিয়াল এক্স অ্যাকাউন্টে একটি সতর্কবার্তা দেন। তিনি লেখেন, “সব ধরনের বিনিয়োগ প্রতারণার মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপ ইনভেস্টমেন্ট স্ক্যামে সবচেয়ে বেশি মানুষ প্রতারিত হয়েছেন।” তার বর্ণনায় প্রতারণার ধাপ ছিল চারটি:
১) ভুক্তভোগীদের “জেরোদা এলিট ট্রেডার্স” বা “প্রিমিয়াম ইনভেস্টরস ক্লাব” নামে ভুয়া গ্রুপে যুক্ত করা হয়। লোগো, রঙ ও লাইসেন্স নম্বর এমনভাবে ব্যবহার করা হয় যাতে আসল মনে হয়। অ্যাডমিনরা নিজেদের জেরোদার সহ-প্রতিষ্ঠাতা বা কর্মচারী পরিচয় দেন।
২) কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই চ্যাট ভরে যায় মিথ্যা প্রশংসা, স্ক্রিনশট ও ১০০-২০০% দৈনিক রিটার্নের প্রতিশ্রুতিতে।
৩) গ্রাহকদের বলা হয় “প্রিমিয়াম সিগন্যাল” পেতে একটি নকল অ্যাপ ডাউনলোড করতে। অ্যাপটি জেরোদার কাইট অ্যাপের মতো দেখালেও, সেখানে দেখানো লাভ ছিল কাল্পনিক।
৪) যখন কেউ লাভ বা পূঁজি তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেন, তখন নতুন করে প্রসেসিং ফি, ট্যাক্স বা ভেরিফিকেশন চার্জ দিতে বলা হয়। এসব টাকা নেওয়ার পর প্রতারকেরা উধাও হয়ে যান এবং গ্রাহককে ব্লক করে দেন।
নিথিনের পোস্টে এক ব্যবহারকারী মন্তব্য করেন, তিনি একটি আমন্ত্রণ পেয়ে এমন গ্রুপে ঢুকেছিলেন, কিন্তু জেরোদার লোগোতে অল্প তফাৎ দেখে সন্দেহ হয় এবং বিষয়টি সাইবার নিরাপত্তা দলে রিপোর্ট করেন। তিনি “B1 India Chief Wealth Planner” নামের প্রতারণামূলক একটি গ্রুপের স্ক্রিনশটও শেয়ার করেন। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, গ্রুপটির নামের গঠন, লোগোর ব্যবহার এবং বর্ণনা বাংলাদেশের ভুয়া গ্রুপগুলোর সঙ্গে মিলে যায়। বাংলাদেশেেও অনেক বিনিয়োগকারী এ ধরনের প্রতারক চক্রের প্রলোভনে পড়ে অর্থ খুইয়েছেন বলে জানিয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। ভারতীয় গণমাধ্যম মিন্ট চলতি বছরের ২৭ জুন এ ধরণের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে প্রতারণা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ড. এম. বাতমানাবানে মৌনিসামি নামে অন্ধ্রপ্রদেশের অবসরপ্রাপ্ত এক শিক্ষাবিদ এভাবে প্রায় দুই কোটি রুপি হারিয়েছেন। তিনি পন্ডিচেরির নামী প্রতিষ্ঠান জওহরলাল ইনস্টিটিউট অব পোস্টগ্রাজুয়েট মেডিকেল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (জিপমার)-এর সাবেক পরিচালক ও অধ্যাপক।

ভারতের প্রতারক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সাথে বাংলাদেশের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলোর মধ্যে সাদৃশ্য
ড. মৌনিসামি ১৮ জুন পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন যে, প্রতারকেরা নিজেদের নুভামা নামের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে তাকে প্রতারণা করেছে। প্রথমে তাকে “H-10 Nuvama Health Group” নামের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যোগ করা হয়। গ্রুপে নানা ধরনের বিনিয়োগ পরামর্শ ও ভেতরের তথ্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। যেহেতু তিনি আগে থেকেই নুভামায় বিনিয়োগ করেছিলেন, তাই গ্রুপটিকে সত্যি ভেবে বিশ্বাস করেন। পরে ধাপে ধাপে টাকা দিতে গিয়ে তিনি দুই কোটি রুপি হারান।
এই প্রতারণা তাৎক্ষণিকভাবে নয়, বরং ধাপে ধাপে দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে ওঠে। প্রথমে ছোট অঙ্কের বিনিয়োগে সামান্য লাভ দেখিয়ে ভুক্তভোগীর আস্থা অর্জন করা হয়, এরপর ধীরে ধীরে তাকে বড় অঙ্কের বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করা হয়। ভুয়া প্ল্যাটফর্মে কল্পিত কোটি টাকার ব্যালান্স দেখানো হলেও আসল সমস্যা দেখা দেয় টাকা তুলতে গেলে, যখন প্রসেসিং ফি বা ট্যাক্সের নামে নতুন করে টাকা দাবি করা হয়। অভিযোগ করার সময় আসে তখনই, যখন ভুক্তভোগী বড় অঙ্কের ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
প্রযুক্তি যেভাবে প্রতারণাকে সহজ করেছে
এই স্কিমের প্রতিটি ধাপে আছে প্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রযুক্তি প্লাটফর্মের দায়। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম থেকে নাম সর্বস্ব একাউন্ট দিয়ে শতশত বিজ্ঞাপন চালিয়ে ব্যবহারকারীদের টেনে নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। এই অনুসন্ধান চলাকালে মেটা অ্যাড লাইব্রেরিতে থেকে যে চার দিন তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, তাতে দেখা যায় বিভিন্ন পেজ থেকে শুধু একদিনেই ৫০টিরও বেশি বিজ্ঞাপন চলতে দেখা গেছে। যে ১৫টি পেজ থেকে বিজ্ঞাপনগুলো চালানো হয়েছে, সেগুলো এক বছরের বেশী সময় ধরে সক্রিয়, বিজ্ঞাপন চালানো ছাড়া তাদের প্রোফাইলে আর কোনো কার্যক্রম নেই, অ্যাডমিনদের বেশীরভাগের অবস্থান ভিয়েতনাম বা যুক্তরাষ্ট্রে। দুটিতে বাংলাদেশী অ্যাডমিনও রয়েছে।
এরপর আসে এনক্রিপটেড মেসেজিং প্লাটফর্ম হোয়াটসঅ্যাপ, যেখানে ভুয়া নাম ও পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানের নামে গ্রাহকদের বিনিয়োগে প্রলুদ্ধ করা হচ্ছে। ২০টি গ্রুপ নথিবদ্ধ হয়েছে এই এক অনুসন্ধানেই। এই কাজে গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংকের অসংখ্য মোবাইল নম্বর ব্যবহার হচ্ছে, যার নিবন্ধন কিভাবে কার নামে হলো তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যে ৫টি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপকে ডিসমিসল্যাব পর্যবেক্ষণ করেছে তাদের অ্যাডমিন, বিশেষজ্ঞ ও প্রশংসাকারীদের ২৯টির বেশি ফোন নম্বর শুধু এই অনুসন্ধানেই নথিবদ্ধ করা হয়েছে।
এরপরে রয়েছে এআইয়ের ব্যবহার। শুরু বিজ্ঞাপন থেকে। ফেসবুকে যে বিজ্ঞাপনগুলো (প্রায় ৪০টি) বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তাদের ভাষা যান্ত্রিক, এবং কোথাও কোথাও ছবিগুলো প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে এআই দিয়ে তৈরি বলে মনে হয়েছে। যেমন: “জেসিকা পেগি বোলিন” নামের একটি পেজের বিজ্ঞাপনে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ছবিটি এআই দিয়ে সম্পাদনা করা, এবং বিজ্ঞাপনটির গ্রাফিক্স কার্ডে লেখা, “লক্ষ্য মূল্য: ৳৫৬৯। পরবর্তী মাসে প্রত্যাশিত। এটি বেড়ে ৳১২৬৮ হয়েছে। ৫০টি শেয়ার কিনুন। এখনই কিনুন এবং ৳৬০০০০ পান।” বাক্যগঠন ইংরেজি ভাষার মতো। একই ক্যাপশনে আরেকটি বিজ্ঞাপনে ড. জাহিদ হোসেনের ছবিও যুক্ত থাকতে দেখা যায়।
অন্তত ৪০টি বিজ্ঞাপন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাদের আধেয় যান্ত্রিক (মেশিন জেনারেটেড) এবং বার্তা প্রায় একই রকমের। প্রতিটি গ্রুপের প্রচারণায় একই পেজ থেকে কয়েকটি নির্দিষ্ট থিমে গ্রাফিক্স কার্ড তৈরি হচ্ছে, এবং তাতে বাংলা-জানা কোনো মানব-নজরদারি নেই।

দুটি ভিন্ন পেজ থেকে চলা বিজ্ঞাপনের মধ্যে প্রায়ই একই বার্তা এবং একই গ্রাফিক কার্ড এবং যান্ত্রিক বাংলার ব্যবহার
একই দশা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মেসেজগুলোতেও। ডিসমিসল্যাবের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিশেষজ্ঞ বা অ্যাডমিনেরা যে মেসেজগুলো দিচ্ছেন তা যান্ত্রিক ভাষার এবং প্রায়ই ইংরেজি টেক্সটের আক্ষরিক অনুবাদ। যেমন: একটি গ্রুপে নুসরাত জাহান লিখেছেন, “বন্ধুত্বপূর্ণ স্মরণিকা: গ্রুপটি শীঘ্রই অস্থায়ী নীরব অবস্থায় যাবে। সুস্পষ্ট তথ্য সংক্রমণ নিশ্চিত করা এবং প্রতিটি সদস্যের অ্যাকাউন্ট সুরক্ষিত রাখার উদ্দেশ্যে, গ্রুপটি একটি অস্থায়ী নীরব সময়কাল অতিক্রম করবে।” এখানে “বন্ধুত্বপূর্ণ স্মরণিকা” মানে হলো “ফ্রেন্ডলি রিমাইন্ডার”। এমনকি প্রশংসাকারীদের মেসেজও যান্ত্রিক। গ্রুপে বার্তা প্রেরণের সময়, মেসেজের হুবহু মিল এবং প্রশ্নের উত্তরে ছাঁচেঢালা উত্তরগুলো গ্রুপ পরিচালনায়ও অটোমেশনের ইঙ্গিত বহন করে।
একইভাবে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গুগল তাদের প্লে স্টোরে সিটি ব্রোকারেজের আদলে তৈরি ভুয়া ট্রেডিং অ্যাপকে জায়গা করে দিচ্ছে। বিকাশ ও নগদের মতো পেমেন্ট প্লাটফর্মকে ব্যবহার করে, প্রতারকেরা ব্যক্তিগত একাউন্টে টাকা পাঠানোর সুযোগ পাচ্ছে।
প্রতারণায় এমএফএসের এই ব্যবহার নিয়ে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “এখানে এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর আইনি দায় থাকুক বা না থাকুক, নৈতিক দায় অবশ্যই আছে। কারণ তাদের প্লাটফর্ম ব্যবহার করে প্রতারণা করা হচ্ছে।” তিনি আরো বলেন, “এতে করে তাদের ওপর ব্যবহারকারীরা বিশ্বাস হারাবেন, যা তাদের ভবিষ্যৎ ব্যবসার প্রসারে বাধার কারণ হবে।”
বাংলাদেশের অন্যতম এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশনস অ্যান্ড পিআর শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম ডিসমিসল্যাবকে বলেন, “অনলাইন প্রতারণাসহ সংশ্লিষ্ট সব অবৈধ লেনদেন প্রতিরোধে নিয়মিত তদারকি এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিকাশ-এর যথাযথ প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী নিয়োজিত রয়েছে।” তিনি জানান, বিভিন্ন ধরনের অবৈধ লেনদেন প্রতিরোধে সমন্বিত উদ্যোগের অংশ হিসেবে তারা নিয়ন্ত্রক সংস্থার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা দেন।
প্রতারণার আকার ক্রমেই বড় হচ্ছে
ডিসমিসল্যাবের সব প্রমাণই বলবে, এটি একটি প্রতারণা মূলক স্কিম। এখানে নামকরা প্রতিষ্ঠানের পরিচয় নকল করা হচ্ছে, প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব বা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সেজে মানুষকে শেয়ারবাজারে নির্দিষ্ট শেয়ারে বিনিয়োগের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, অনুমোদিত সাইট বা অ্যাপ তৈরি করে টাকা লেনদেন হচ্ছে। এমন প্রতারণায় যে মানুষ সব হারান তার সাম্প্রতিকতম নজির ভারতেই আছে।
ফেসবুক পেজ, বিজ্ঞাপনের ধরন ও প্রতারণার স্কিম – এর সঙ্গে দেশী-বিদেশী নাগরিকদের সম্পৃক্ততারও ইঙ্গিত দিচ্ছে। ডিসমিসল্যাব, অনুসন্ধানে পাওয়া ২৯টি নম্বরের মধ্যে অ্যাডমিন ও কথিত বিশেষজ্ঞদের ২৩টি নম্বরে সরাসরি এবং ১২টি নাম্বারে হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়েছে। সরাসরি সংযোগে নম্বরগুলো বন্ধ পাওয়া যায়। হোয়াটসঅ্যপেও কেউ কল ধরেনি। একটি গ্রুপ থেকে শুরুতেই ডিসমিসল্যাবের প্রতিনিধিকে বের করে দেয়া হয়।
এ ধরনের প্রতারণা নিয়ে এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন বেরিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “তারা ছোট অঙ্কের লাভ দেখিয়ে বিশ্বাস অর্জন করে, পরবর্তীতে বড় বিনিয়োগের জন্য উৎসাহিত করে এবং টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিনিয়োগকারীর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।” এবং এভাবে বিভিন্ন প্রতারক চক্র সামাজিক মাধ্যমে প্ল্যাটফর্মগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে ক্রমবর্ধমান হারে মানুষকে প্রতারিত করছে।”
বিষয়টি জানতে পারার পর সিটি ব্রোকারেজ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএসইসি ও পুলিশকে জানানো হয়েছে। ব্র্যাক ইপিএল কর্তৃপক্ষ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে। এসইসি থেকে সতর্ক থাকতেও বলা হয়েছে। কিন্তু সমাধান হয়নি।
ব্র্যাক ইপিএলের প্রধান নির্বাহী আহসানুর রহমান বলেন, “তাদের নাম ও লোগো দেখে অনেকে এসব গ্রুপে যোগ দিচ্ছেন এবং বিশ্বাস করছেন। এতে বিনিয়োগকারীরা যেমন ঝুঁকিতে পড়তে পারেন, তেমনি প্রতিষ্ঠানেরও সুনাম ক্ষুন্ন হতে পারে।”
এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিজ্ঞাপনগুলো চলছে এবং প্রতি সপ্তাহেই নতুন নতুন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলা হচ্ছে। শুধু ২৬ তারিখে ৪টি নতুন গ্রুপ খোলা হয়েছে, যা এই গবেষণায় নথিবদ্ধ গ্রুপগুলোর বাইরে। নতুন নতুন সদস্যরা গ্রুপে যোগ দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে সরকারি উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে বিএসইসির মুখপাত্র ও পরিচালক মো: আবুল কালামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়, কিন্তু তিনি সাড়া দেননি।