পার্থ প্রতীম দাস

এনগেজমেন্ট এডিটর, ডিসমিসল্যাব
অনলাইনে আয়ের প্রলোভন: ফেসবুক বিজ্ঞাপন থেকে প্রতারণাপূর্ণ ওয়েবসাইটে
This article is more than 2 months old

অনলাইনে আয়ের প্রলোভন: ফেসবুক বিজ্ঞাপন থেকে প্রতারণাপূর্ণ ওয়েবসাইটে

পার্থ প্রতীম দাস

এনগেজমেন্ট এডিটর, ডিসমিসল্যাব

নারায়নগঞ্জে একটি গণপরিবহনের কাউন্টারে কাজ করেন আব্দুল মান্নান। অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেখে বাড়তি অর্থ উপার্জনের জন্য নিবন্ধন করেছিলেন একটি ওয়েবসাইটে। তাকে বলা হয়েছিল, সাইটটিতে ১০০০ টাকা জমা করে শুধু বিজ্ঞাপন দেখে প্রতিদিন আয় করতে পারবেন ৬০০ টাকা। অর্থ জমা করার পর নির্দেশনা অনুযায়ী সব কাজও করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সেখান থেকে আর কোনো অর্থ উত্তোলন করতে পারেননি। তার জমা করা ১০০০ টাকা চলে গেছে প্রতারকদের পকেটে।

মান্নান একাই নন। অনলাইন থেকে সহজে অর্থ উপার্জনের আশায় এ ধরনের বেশ কিছু ওয়েবসাইটে অর্থ জমা করে প্রতারণার শিকার হয়েছেন আরও অনেকে। ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে চালানো হচ্ছে এসব প্রতারণামূলক ওয়েবসাইটের প্রচারণা। ওয়েবসাইটগুলোতে ব্যবহারকারীদের নিবন্ধন এবং অর্থ জমা করে “সিলভার” বা “প্ল্যাটিনাম” নামের বিভিন্ন প্যাকেজ কিনতে বলা হয়। দেওয়া হয় প্রতিদিন অর্থ উপার্জনের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু বাস্তবে এখান থেকে কোনো অর্থ উপার্জন করা যায় না।

মেটা অ্যাড লাইব্রেরিতে দুই দিন “অ্যাড দেখে ইনকাম করুন” এবং “ইনকাম ওয়েবসাইট”– এই দুই কিওয়ার্ড সার্চ করে অন্তত ৩১টি পেজ থেকে এধরনের বিজ্ঞাপন চলতে দেখেছে ডিসমিসল্যাব। অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, এ ধরনের কিছু ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইট কিছুদিন পর নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। কিন্তু দ্রুতই সেই জায়গায় তৈরি করা হয় নতুন নতুন পেজ। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেখান থেকে শুরু হয় এ ধরনের প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন চালানো।

ফেসবুক বিজ্ঞাপন থেকে প্রতারণাপূর্ণ ওয়েবসাইট: এটি কীভাবে কাজ করে

৬ ও ১২ মে, মেটা অ্যাড লাইব্রেরিতে সার্চ করে ৩১টি ফেসবুক পেজ থেকে প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন চলতে দেখা গেছে, যেগুলো ব্যবহারকারীদের নিয়ে যায় ২৫টি ভিন্ন ভিন্ন ওয়েবসাইটে। কিছু ক্ষেত্রে, একই ওয়েবসাইটের প্রচারণা চলেছে একাধিক পেজ থেকে। একটি ওয়েবসাইটের প্রচারণা চালানো হয়েছে অন্তত তিনটি পেজ থেকে।

২৪ জুন, ওয়েবসাইটগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ২৫টির মধ্যে সক্রিয় আছে মাত্র ৭টি। কিন্তু এ ধরনের প্রতারণামূলক নতুন কিছু ওয়েবসাইটের (, , , ) প্রচারণা চালানো হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ফেসবুক পেজ (, , , , ) থেকে। একই দিনে, আরও অন্তত ৩১টি পেজ থেকে চলতে দেখা গেছে এ ধরনের বিজ্ঞাপন। 

অনলাইন থেকে সহজে অর্থ উপার্জন সংক্রান্ত এসব ওয়েবসাইটের বিজ্ঞাপন চালানো হয়েছে ৫-৬ মিনিটের কিছু ভিডিওর মাধ্যমে। এসব ভিডিওর শুরুর ৩০ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট সময় পর্যন্ত দেখা যায় দুইটি জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেল, সোহাগ খন্দকারএএফআর টেকনোলজি-র উপস্থাপকদের। দুইটি চ্যানেলেই আছে ৪০ লাখের বেশি সাবস্ক্রাইবার। এই অংশে তাদের বলতে শোনা যায়, কীভাবে ফেসবুকে ভিডিও দেখে ব্যবহারকারীরা অর্থ উপার্জন করতে পারেন। তাদের চ্যানেলের মূল যে ভিডিওগুলো (, ) থেকে এই বিজ্ঞাপনের শুরুর অংশটি নেওয়া হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে ফেসবুকে রিয়্যাকশন ভিডিও বানানোর মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের কৌশল। সেখানে কোনো ওয়েবসাইটে নিবন্ধন বা অর্থ জমা করা প্রসঙ্গে কোনো কথা বলা হয়নি। 

বিজ্ঞাপনগুলোতে জনপ্রিয় ইউটিউবারদের এসব ভিডিওর শুরুর অংশটুকু দেখানোর পর মোবাইলের স্ক্রিন রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে দেখানো হয় ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করে অর্থ জমা করার মাধ্যমে কীভাবে কাজ পাওয়া যায় এবং অর্থ উপার্জন করা যায়। বিজ্ঞাপনে ক্লিক করলে সেটি ব্যবহারকারীদের নিয়ে যায় ওয়েবসাইটে। 

এসব ওয়েবসাইটে দেখা যায় একই ধরনের কাঠামো। শুরুতে সেখানে ব্যবহারকারীদের নিবন্ধন করে কাজ পাওয়ার জন্য বিভিন্ন অর্থমূল্যের প্যাকেজ কিনতে বলা হয়। যেমন ৫০০ টাকার প্যাকেজ কিনলে প্রতিদিন তিনটি বিজ্ঞাপন দেখে ৩০০ টাকা আয় করা যাবে। এই প্যাকেজের মেয়াদ থাকবে ২০০ দিন। ১০০০ টাকার প্যাকেজ কিনলে প্রতিদিন ছয়টি বিজ্ঞাপন দেখে আয় করা যাবে ৬০০ টাকা। এভাবে ২০০০, ৫০০০ করে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকার প্যাকেজ আছে। প্যাকেজ কেনার জন্য অর্থ পাঠাতে বলা হয় মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস বিকাশ বা নগদের মাধ্যমে। 

অনলাইনে আয়ের প্রলোভন: ফেসবুক বিজ্ঞাপন থেকে প্রতারণাপূর্ণ ওয়েবসাইটে - ডিসমিসল্যাবের গবেষণা
ওয়েবসাইটে নিবন্ধনকারীদের প্রলুব্ধ করা হয় বিভিন্ন অঙ্কের টাকার প্যাকেজ কেনার জন্য। যত বেশির টাকার প্যাকেজ, তত বেশি আয়ের প্রতিশ্রুতি।

বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখার জন্য ডিসমিসল্যাব এমন দুইটি ওয়েবসাইটে (goldbd7.com, green75.com) নিবন্ধন করেছে এবং ৫০০ টাকার প্যাকেজ কিনেছে। দুইটি ওয়েবসাইটেই বলা হয়েছিল যে, তিন থেকে ছয়টি বিজ্ঞাপন দেখার মাধ্যমে প্রতিদিন ৩০০ টাকা আয় করা যাবে।

নির্দেশনা অনুসরণ করে দুই দিন ওয়েবসাইটগুলোতে বিজ্ঞাপন দেখেছে ডিসমিসল্যাবের গবেষকেরা। একটি ওয়েবসাইটে দেখানো হয়েছিল বাংলালিংকের বিজ্ঞাপন। আরেকটি ওয়েবসাইটে ছিল হোস্টিংগার অ্যাকাডেমির একটি ভিডিও। প্রতিটি ওয়েবসাইটে প্রতিদিন তিনটি করে বিজ্ঞাপন দেখার পর একেকটি ওয়েবসাইট থেকে ৬০০ টাকা আয় করা হয়েছে। নির্দেশনা মেনে সব কাজ করার পরও ওয়েবসাইটগুলো থেকে কোনো টাকা উত্তোলন করা যায়নি। যে নম্বরে বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠানো হয়েছিল, সেই নম্বরগুলোতে যোগাযোগ করে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। 

নারায়নগঞ্জে গণপরিবহনের কাউন্টারে কাজ করা মান্নানও জানিয়েছেন একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা। তিনি ডিসমিসল্যাবকে বলেছেন, “আমি মানি ডট লাইভ (https://maney.live) ওয়েবসাইটে ১০০০ টাকা ডিপোজিট করেছিলাম। বলা হয়েছিল, এর মাধ্যমে আমি প্রতিদিন ৬০০ টাকা করে ইনকাম করতে পারব ২ মাস পর্যন্ত। আমি সেভাবে কাজও করেছিলাম। কিন্তু পরে আর সেখান থেকে টাকা তুলতে পারিনি।” 

ডোমেইন ও ওয়েবসাইট হোস্টিংয়ের সাদৃশ্য

ভিন্ন ভিন্ন নামে খোলা হলেও এই অনুসন্ধানের জন্য বিশ্লেষণ করা ওয়েবসাইটগুলোর মধ্যে বিভিন্ন সাদৃশ্য দেখা যায়। প্রতিটি ওয়েবসাইটই অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেখার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের প্রতিশ্রুতি দেয়। সবগুলো ওয়েবসাইটের মূল লগইন পেজে দেখা যায় একটি বৃত্তাকার আইকন, যেখানে সাইটটির লোগো বসানো থাকে। নিচে দেখা যায় মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস নগদ, বিকাশ ও রকেটের লোগো।

অনলাইনে আয়ের প্রলোভন: ফেসবুক বিজ্ঞাপন থেকে প্রতারণাপূর্ণ ওয়েবসাইটে - ডিসমিসল্যাবের গবেষণা
দুইটি ওয়েবসাইটের ল্যান্ডিং পেজের স্ক্রিনশট

যে ২৪টি ওয়েবসাইট বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তার ২৩টিতেই ছিল একই ধরনের আইকন: “ডিপোজিট”, “উইথড্র”, “টাস্ক”, “প্ল্যান”, “রেফার”, “ট্রানজ্যাকশন”, “প্রোফাইল” ও “হেল্পলাইন”। প্রায় সব ওয়েবসাইটেই এসব আইকন দেখা যায় একই ধরনের গ্রিড ফরম্যাটে। 

লেআউট ছাড়াও অন্যান্য দৃশ্যগত মিল পাওয়া যায় এসব ওয়েবসাইটে। যেমন, bdcash24.com, goldbd24.com, ও surecash24.com-এ দেখা যায় একই সবুজ হেডার এবং মাঝখানে বড় একটি গোলাপী রঙের উইথড্র আইকন। এছাড়াও চারটি ভিন্ন ওয়েবসাইটে ব্যবহার করা হয়েছে একই নামের একটি ইমেজ ফাইল: “photo_2024-08-26_16-51-15.jpg”।

অন্য কিছু ওয়েবসাইটে (যেমন, bdincome.site ও clickbd69.com) ব্যবহার করা হয়েছে লাল রঙের থিম। এগুলোতে দেখা যায় সারিবদ্ধ কিছু আইকন বক্স এবং “কীভাবে কাজ করতে হবে”– এমন একটি নির্দেশনামূলক ভিডিও গাইড।

ডোমেইন তথ্য বিশ্লেষণের টুল হুইজ থেকে দেখা যায়, বেশিরভাগ ডোমেইনই নিবন্ধন করা হয়েছে ২০২৫ সালের এপ্রিল ও মে মাসে। অনেকেই ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একই রেজিস্টার ও হোস্টিং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এগুলো পরিচালিত হচ্ছে। যেমন, ৫টি ওয়েবসাইট নিবন্ধন করা হয়েছে পিডিআর লিমিটেডের মাধ্যমে। এবং সেগুলো হোস্ট করা হয়েছে একই আইপি অ্যাড্রেসে (১৫৭.১৭৩.২১৮.২০১)। 

ভুয়া, ইতিবাচক মন্তব্য

প্রতারণাপূর্ণ এসব ওয়েবসাইটের বিজ্ঞাপন ফেসবুকে ব্যাপকভাবে প্রচার সত্ত্বেও কিছু ব্যবহারকারী অন্যদের এ বিষয়ে সাবধান করার চেষ্টা করেছেন। যেসব পেজ থেকে এসব বিজ্ঞাপন চালানো হয়েছে, সেসব পেজের কিছু পোস্টে একশরও বেশি ব্যবহারকারী বিষয়টিকে প্রতারণা বলে বর্ণনা করেছেন। অন্তত ৩০ জন বলেছেন তারা এসব ওয়েবসাইটে অর্থ জমা করেছেন এবং বিনিময়ে কিছুই পাননি। 

একজন লিখেছেন, “১৫০০০/- উত্তোলন দেয়া। তিন মাস থেকে ১ টাকাও পাই নাই”। আরেকজন লিখেছেন, “আমার ১০০০ টাকা মেরে দিয়েছে”। আরেক ব্যবহারকারী মন্তব্য করেছেন, “এদের বিশ্বাস করবেন না। আমি টাকা হারিয়েছি। এরা প্রতারক।”

কিন্তু এই ধরনের কমেন্টগুলো হারিয়ে যায় বিপুল সংখ্যক ইতিবাচক মন্তব্যের মাঝে, যেগুলোর বেশিরভাগই ভুয়া মন্তব্য। স্টুডেন্ট ওয়ালেট নামের পেজ থেকে করা একটি পোস্টে একজন মন্তব্য করেছেন, “অনেক ভালো ওয়েবসাইট বহুদিন ধরে কাজ করছি, বিশ্বস্ত”। আরেকজন লিখেছেন, “১০০০ টাকা একাউন্ট দিয়ে টোটাল ৩৫০০ টাকা উইথড্র করলাম”। 

এ ধরনের ইতিবাচক মন্তব্য আছে– এমন ১০টি পোস্টের নিচে থাকা ৪৮০৯টি মন্তব্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, একই ধরনের মন্তব্য বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে বারবার করা হয়েছে। ১০ বারের বেশি করা হয়েছে ১২৮টি স্বতন্ত্র মন্তব্য। এসব মন্তব্যই ঘুরেফিরে বারবার করা এসেছে মোট মন্তব্যের ৭৯% ক্ষেত্রে, ৩৭৮২ বার। সবচেয়ে বেশি, ১১১ বার করা হয়েছে এই মন্তব্যটি– “আমি ৫০০০ টাকা মেম্বারশিপ ৩ দিন আগে অ্যাকটিভ করলাম। এখন পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছি”। এই একই মন্তব্য করা হয়েছে ৮৬টি প্রোফাইল থেকে। 

সবচেয়ে বেশিবার করা ৫টি মন্তব্য
মন্তব্যসংখ্যা
Ami 5,000 Taka membership 3 Din aga Active korlam Akhon pojonto kaj kora jacci১১১
ভাই ১০০০ টাকা প্যাকেজটা নিতে চাই আমি কিভাবে নিবো৮১
৫০০০ টাকার প্যাকেজ নিয়ে এখন পর্যন্ত ১১০০০ টাকা পাইছি৭৭
আমি ১০০০ টাকার প্যাকেজ নিয়েছি।৭৩
আমি ২০০০ টাকার মেম্বার একটিভ করলাম এই ওয়েবসাইটে থেকে🥰৭০

প্রতারণামূলক এসব ওয়েবসাইটের প্রচারণায় ২০টির বেশি ইতিবাচক মন্তব্য করেছে– এমন ৬৪টি প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এগুলো ভুয়া অ্যাকাউন্ট। সবগুলো প্রোফাইলেই দেখা যায়, সেখানে নিয়মিত পোস্ট করা হয় না। তাদের ফ্রেন্ড সংখ্যা ৫০-এর কম। এবং তাদের অ্যাবাউট সেকশনে কোনো তথ্য নেই। প্রতারণামূলক ওয়েবসাইটগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য এসব ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে বিভিন্ন ইতিবাচক পোস্ট করা হয়। ডিসমিসল্যাবের পক্ষ থেকে এমন ৫টি অ্যাকাউন্টে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য ইনফ্লুয়েন্সারদের ভিডিও ব্যবহার

ভিডিওর মাধ্যমে চালানো বিজ্ঞাপনগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ইউটিউবের জনপ্রিয় দুইটি চ্যানেল, সোহাগ খন্দকার ও এএফআর টেকনোলজির অন্য বিষয় নিয়ে করা ভিডিওর খণ্ডাংশ। দুইটি চ্যানেলেই আছে চার মিলিয়নের বেশি সাবস্ক্রাইবার। জনপ্রিয় এই ইউটিউবারদের ভিডিওগুলো ব্যবহার করা হয়েছে তাদের অনুমতি ছাড়াই। মূল ভিডিওগুলোতে তারা কথা বলেছেন কীভাবে ফেসবুকে রিয়্যাকশন ভিডিও বানানোর মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা যায়। সেখানে কোনো ওয়েবসাইটে নিবন্ধন বা অর্থ জমা করা প্রসঙ্গে কোনো কথা বলা হয়নি। 

বিজ্ঞাপনগুলোতে জনপ্রিয় ইউটিউবারদের এসব ভিডিওর শুরুর অংশটুকু দেখানোর পর মোবাইলের স্ক্রিন রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে দেখানো হয় ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করে অর্থ জমা করার মাধ্যমে কীভাবে কাজ পাওয়া যায় এবং অর্থ উপার্জন করা যায়। বিজ্ঞাপনের শুরুতে জনপ্রিয় এসব ইউটিউবারদের চ্যানেল থেকে নেওয়া ভিডিওর খণ্ডাংশ উপস্থাপনের মাধ্যমে সেগুলো বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার প্রচেষ্টা দেখা যায়। প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন চালানো কিছু পেজের নামও দেওয়া হয়েছে এই দুই ইউটিউবারের চ্যানেলের নামের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে। যেমন, এএফআর টেকনোলজি, এএফআর টেকনোলজি ০.০, এএফআর টেকনোলজি ০৭, সোহাগ খন্দকার, এসকে সোহাগ খন্দকার, সোহাগ খন্দকার ০২

এই পেজগুলো তৈরি করার পরপরই সেখান থেকে বিজ্ঞাপন চালানো শুরু করে। যেমন, অনলাইন ইনকাম টিপস নামের একটি পেজ তৈরি করা হয়েছে ৪ মে। এবং সেদিনই সেখান থেকে একটি প্রতারণামূলক ওয়েবসাইটের বিজ্ঞাপন চালানো শুরু করেছে। এএফআর টেকনোলজি ০৭ নামের একটি পেজ ১১ মে তৈরি করার পর সেদিনই বিজ্ঞাপন চালানো শুরু করেছে।

অনলাইনে আয়ের প্রলোভন: ফেসবুক বিজ্ঞাপন থেকে প্রতারণাপূর্ণ ওয়েবসাইটে
একটি ফেসবুক পেজের ট্রান্সপারেন্সি সেকশন (বামে) এবং সেই পেজ থেকে চালানো বিজ্ঞাপনের (ডানে) স্ক্রিনশট

এধরনের বেশিরভাগ পেজ সক্রিয় থাকে খুব অল্প সময়ের জন্য। বিজ্ঞাপন চালানোর কিছুদিন পর সেগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে দেখা যায়। আবার কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে একই নামে নতুন পেজ খোলা হয়েছে। যেমন, ১১ মে ইনকাম টিপস নামের পেজ থেকে বিজ্ঞাপন চালানোর পর সেটি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তবে দুই সপ্তাহ পরে একই নামের আরেকটি পেজ খোলা হয় এবং সেখান থেকে বিজ্ঞাপন চালানো শুরু হয়। পেজ দুইটি একই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে কিনা– তা ডিসমিসল্যাব যাচাই করতে পারেনি।

অনলাইনে আয়ের প্রলোভন: ফেসবুক বিজ্ঞাপন থেকে প্রতারণাপূর্ণ ওয়েবসাইটে - ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধান
ইনকাম টিপস নামের একটি পেজ থেকে বিজ্ঞাপন চালানো হয়েছিল ১১ মে (বামে)। পরবর্তীতে এই পেজটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু একই নামের আরেকটি পেজ (ডানে) থেকে বিজ্ঞাপন চালানো শুরু হয় ২৫ মে থেকে।

যে জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেলগুলোর ভিডিওর খণ্ডাংশ এসব বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়েছে, তেমন একটি চ্যানেলের মালিক সোহাগ খন্দকার ডিসমিসল্যাবকে বলেছেন যে, তিনি প্রতিনিয়তই এ ধরনের ভিডিও দেখেন। “আমি প্রায়ই এগুলো রিপোর্ট করি। কিন্তু একই ধরনের ভিডিও নতুন নতুন পেজ থেকে পোস্ট করা হতে থাকে,” বলেছেন তিনি।

প্রতারণাপূর্ণ বিজ্ঞাপন ভাঙছে মেটার নীতিমালা

ফেসবুকে এই ধরনের প্রতারণামূলক প্রচারণার মাধ্যমে মেটার অন্তত দুই ধরনের নীতিমালা ভঙ্গ করা হয়েছে। প্রথমত, জনপ্রিয় ইউটিউবারদের ভিডিওর খণ্ডাংশ ব্যবহারের মাধ্যমে ভাঙা হয়েছে “অথেনটিক আইডেন্টিটি রিপ্রেজেন্টেশন” নীতিমালা। যেখানে বলা হয়েছে, ফেসবুক এমন কোনো পোস্ট করতে দেয় না, “যেখানে প্রতারণার উদ্দেশ্যে অন্য কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের ছবি, নাম বা সাদৃশ্য ব্যবহার করা হয়”।

দ্বিতীয়ত, এই ধরনের প্রতারণামূলক প্রচারণা ভঙ্গ করেছে মেটার ফ্রড, স্ক্যামস অ্যান্ড ডিসেপটিভ প্র্যাকটিসেস নীতিমালা। এখানে চাকরি সংক্রান্ত প্রতারণার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, এমন কোনো কন্টেন্ট পোস্ট করা যাবে না, যেখানে চাকরি বা কাজ পাওয়ার জন্য আগে অর্থ জমা দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু অনলাইন থেকে অর্থ উপার্জন সংক্রান্ত এসব প্রতারণামূলক পোস্টগুলোতে আগে অর্থ জমা করার নির্দেশনাই দেওয়া হচ্ছে। 

মেটার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন চালিয়ে এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা নতুন নয়। বাংলাদেশে এর আগেও দেখা গেছে, কীভাবে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন প্রতারণামূলক বিনিয়োগ সংক্রান্ত ওয়েবসাইটে নিয়ে যাওয়া হয়। বাংলাদেশে অ্যালকোহল ও বিভিন্ন মাদক সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন প্রচার নিষিদ্ধ হলেও এর আগে দেখা গেছে, এ ধরনের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রতারণা করা হয়েছে। বারবার এ ধরনের প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন চালানো হলেও এগুলো শনাক্তে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারছে না মেটা।

এমন দৃশ্য শুধু বাংলাদেশেরই নয়। এর আগে ভারতে দেখা গেছে এ ধরনের প্রতারণার চিত্র। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দেখে সহজে অনলাইন থেকে অর্থ আয়ের প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে ১৭ লাখ রুপি হারিয়েছিলেন ভারতের এক নাগরিক। বিখ্যাত ব্যক্তিদের ডিপফেক ভিডিও ব্যবহার করে মেটার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন দিয়ে কীভাবে অস্ট্রেলিয়ায় প্রতারণার ফাঁদ পাতা হয়েছিল– তা নিয়ে গত বছর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল দ্য এজ-এ। সেখানে বলা হয়েছিল, মেটাকে এ ধরনের প্রতারণার বিষয়গুলো জানানোর পরও তারা কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। মেটার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সহজেই এসব বিজ্ঞাপন চালানো যাচ্ছে বলেই প্রতারকেরা সক্রিয়ভাবে কাজ করে যেতে পারছে। 

সাইবার অপরাধ অনুসন্ধানের প্রতিষ্ঠান আইএফডব্লিউ গ্লোবালের অভিজ্ঞ অনুসন্ধানকারী কেন গ্যাম্বল দ্য এজ-কে বলেছেন, “প্রতারকেরা একটি হানিপট পদ্ধতি ব্যবহার করছে, যেটি হলো ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়া। সেখানে যখন একজন ব্যক্তি ক্লিক করছেন, নিবন্ধন করছেন, তখনই প্রতারকদের যাত্রাটা শুরু হয়ে যাচ্ছে।”

অস্ট্রেলিয়ায় এ ধরনের প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন চালানো প্রসঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস মিনিস্টার স্টিভেন জোনস বলেছেন, আমরা তাদের বিজ্ঞাপনদাতাদের যাচাই করে নিতে বলছি। আমরা চাই যেন দ্রুত এসব ভুয়া বিজ্ঞাপন সরিয়ে নেওয়া হয়। এবং তাদের পক্ষ থেকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তারা এটি জানে। কাজটি তারা আজকেই করতে পারে। কিন্তু তারা সেটি করে না। 

গবেষণা পদ্ধতি

ডিসমিসল্যাবের এই অনুসন্ধানটি পরিচালিত হয়েছে ৬ থেকে ১৮ মে তারিখের মধ্যে। মেটার অ্যাড লাইব্রেরিতে “অ্যাড দেখে ইনকাম করুন” ও “ইনকাম ওয়েবসাইট”– এই দুই কিওয়ার্ড সার্চ করে প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপনগুলো শনাক্ত করা হয়েছে।

৬ ও ১২ মে কিওয়ার্ড সার্চ করে গবেষকেরা এমন ৩১টি ফেসবুক পেজ শনাক্ত করেছেন, যেগুলো থেকে প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন চালানো হয়েছে। দেখা হয়েছে, বিজ্ঞাপনগুলো কতদিন ধরে চালানো হয়েছে, প্রতিটি বিজ্ঞাপনে কোন ওয়েবসাইটের প্রচারণা চালানো হয়েছে এবং পেজগুলো কবে তৈরি করা হয়েছে। 

বিজ্ঞাপনগুলোতে যে ২৫টি ওয়েবসাইটের প্রচারণা চালানো হয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। নথিভুক্ত করা হয়েছে টাকা পাঠানোর জন্য দেওয়া মোবাইল নম্বর। বিশ্লেষণ করা হয়েছে সাইটগুলোর সোর্স কোড। ওয়েবসাইটের দাবি সত্য কিনা– তা যাচাইয়ের জন্য ডিসমিসল্যাব দুইটি ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করেছে এবং ৫০০ টাকার প্যাকেজ কিনেছে।

প্রতারণামূলক ১০টি ফেসবুক পোস্টের ৪,৮০৯টি কমেন্ট সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দেখা হয়েছে কোন কমেন্টগুলো সবচেয়ে বেশিবার করা হয়েছে এবং সেগুলো কোন প্রোফাইল থেকে করা হয়েছে। বারবার একই ধরনের ইতিবাচক কমেন্ট করেছে– এমন ৬৪টি প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে যে সেগুলোতে নিয়মিত পোস্ট করা হয় কিনা, তাদের বন্ধু সংখ্যা কত এবং প্রোফাইল পিকচার অন্য জায়গা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে কিনা।

বিজ্ঞাপনগুলোতে যে ইউটিউব ভিডিওগুলো ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো কোন চ্যানেল থেকে নেওয়া হয়েছে– তা দেখা হয়েছে। এতে দেখা গেছে সেগুলো বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে পাওয়া ফলাফলগুলো মেটার সংশ্লিষ্ট নীতিমালার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়েছে।

আরো কিছু লেখা