তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
ফেসবুক বিজ্ঞাপন ও ভুয়া সংবাদের মাধ্যমে প্রতারণাপূর্ণ বিনিয়োগের ফাঁদ

ফেসবুক বিজ্ঞাপন ও ভুয়া সংবাদের মাধ্যমে প্রতারণাপূর্ণ বিনিয়োগের ফাঁদ

তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

দেশের নামকরা একটি গণমাধ্যমের ওয়েবসাইটে নিজের নামে একটি প্রতিবেদন দেখে হতভম্ব হয়ে যান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অনলাইন বিনিয়োগ স্কিম’ প্রচারের অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংক তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তার বিস্ময়ের মাত্রা আরও বেড়ে যায়, যখন দেখেন, খবরটির সঙ্গে পুলিশের হাতে তার “গ্রেপ্তারের” ছবিও রয়েছে। ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে ছড়ানো এই সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ কয়েক দিন ধরে ঘুরছিল। কিন্তু বাস্তবে খবরটি পুরোপুরি ভুয়া। এমনকি যে ওয়েবসাইট থেকে সেটি প্রকাশিত হয়েছে, সেটিও ছিল নকল।

এ ঘটনাকে দেশের ভেতরে ও বাইরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা হিসেবে দেখছেন সালেহউদ্দিন আহমেদ। তবে ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই ধরনের প্রতিবেদন শুধু প্রোপাগান্ডা বা ভাবমূর্তি নষ্ট করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়নি। বরং এটি ছিল আরও বড় একটি বৈশ্বিক প্রতারণার অংশ। ডিসমিসল্যাব ৩৭টি সংবাদ ও ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন, ১৫টি অনলাইন রিভিউসহ একই ধরনের প্রতারণামূলক নিবন্ধগুলো বিশ্লেষণ করে দেখেছে অন্তত ৩৬টি দেশে এ ধরনের প্রতারণামূলক প্রচারণা চালানো হয়েছে। বিবিসি, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, ভ্যানগার্ড, রিপাবলিকা, খালিজ টাইমের মতো প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমসহ অন্তত ৩৯টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ওয়েবসাইট নকল করে চলেছে এই প্রতারণা।

বিশ্বজুড়ে মূলধারার সংবাদমাধ্যম নকল করে প্রকাশিত ভুয়া প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট

গত মার্চে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ফেসবুকে অন্তত পাঁচজন সুপরিচিত বাংলাদেশিকে নিয়ে এক ডজনেরও বেশি ভুয়া বিজ্ঞাপন খুঁজে পেয়েছে ডিসমিসল্যাব। এই তালিকায় রয়েছে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, এমনকি একজন অভিনেত্রীর নাম। প্রতিটি বিজ্ঞাপন ব্যবহারকারীদের নিয়ে যায় একটি ভুয়া সংবাদ সাইটে, যেখানে সংবাদটির শিরোনাম হুবহু একই থাকলেও—শুধু ব্যক্তির নাম পাল্টে যাচ্ছে: “বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মামলা করেছে —এর বিরুদ্ধে”। অভিযোগ হিসেবে বলা হয়েছে, টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের সময় বেফাঁস মন্তব্য করায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ভুয়া সংবাদগুলোর ভাষ্য অনুযায়ী, ওই ব্যক্তিরা টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে একটি নির্দিষ্ট অনলাইন বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্মে নিজেদের বিনিয়োগের কথা বলেন, যেখানে অল্প সময়েই পেয়েছেন প্রচুর মুনাফা। এমনকি পাঠকদেরও ‘দ্রুত ধনী হতে চাইলে’ সেই প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ করতে বলা হয়।

তবে শুধু ভুয়া সংবাদেই কাহিনী শেষ হয়নি। ডিসমিসল্যাব দেখেছে, গোটা প্রতারণাটি চার ধাপে সম্পন্ন হচ্ছে। প্রথমে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের বিজ্ঞাপন ব্যবহারকারীদের ভুয়া সংবাদ ওয়েবসাইটে নিয়ে যায়। এরপর ওই ওয়েবসাইট থেকে তাদের সরাসরি কিছু ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মে পাঠানো হয়। সেখানে ব্যবহারকারীরা ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে নিবন্ধন করলেই প্রতারকচক্র তাদের বিনিয়োগের জন্য উৎসাহিত করে। কিন্তু একবার টাকা জমা দেওয়ার পরে সেই টাকা ফেরত নেওয়া সম্ভব হয় না। শেষ পর্যন্ত বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হন। ব্যবসায়িক পর্যালোচনা সাইট ট্রাস্টপাইলটে ব্যবহারকারীরা এমন অভিজ্ঞতার কথাই তুলে ধরেছেন।

মেটার বিজ্ঞাপন নীতিমালা অনুযায়ী অন্য প্রতিষ্ঠানের ডোমেইন নকল করা, স্প্যাম প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কিন্তু এত কড়াকড়ির পরেও এই ভুয়া বিজ্ঞাপনগুলো ফেসবুকে চলতে দেখা যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপনে ভুয়া খবর, বিভ্রান্তিকর তথ্য

ডিসমিসল্যাব এ ধরনের প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন প্রথম দেখতে পায় গত ২১ ফেব্রুয়ারি। বিজ্ঞাপনটিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদের নাম ব্যবহার করে দাবি করা হয়েছে, টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের সময় দেওয়া বক্তব্যের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিজ্ঞাপনে ক্লিক করলেই ব্যবহারকারীদের নিয়ে যাওয়া হয় বিডিনিউজ২৪ ডট কমের নামে বানানো একটি ভুয়া ওয়েবসাইটে।

বিডিনিউজ২৪-এর নকল করে তৈরি ভুয়া প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট

ওই ভুয়া প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল, “টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারে দেওয়া বক্তব্যের কারণে সালেহউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা করলো বাংলাদেশ ব্যাংক”। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, “সরাসরি সম্প্রচারের সময় অসাবধানতাবশত সালেহউদ্দিন আহমেদ নিজের গোপন তথ্য ফাঁস করে ফেলেন”। পরে নাকি অনুষ্ঠান চলাকালেই বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ফোন করে বাধা দেন। প্রতিবেদনে সাবেক গভর্নরের উদ্ধৃতি হিসেবে বলা হয়, “আমাকে ৩০ হাজার ৫০০ টাকা দিন, আমি ‘নিয়ারেস্ট এজ’ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে (সঙ্গে ছিল প্ল্যাটফর্মের একটি প্রচারণামূলক লিংক) মাত্র ১২ থেকে ১৫ সপ্তাহের মধ্যে সেটা ১০ লাখ টাকা বানিয়ে দেব!” ভুয়া প্রতিবেদনের নিচের অংশে কীভাবে প্ল্যাটফর্মে নিবন্ধন করতে হবে, সেই নির্দেশনার সঙ্গে ছিল নিবন্ধন ফর্মের লিংক।

প্রতিবেদনে ব্যবহৃত টকশোর স্ক্রিনশটটি নেওয়া হয়েছিল চ্যানেল ২৪-এর একটি অনুষ্ঠান থেকে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক ছিলেন ‘পীযূষ বানসা’ এবং অনুষ্ঠান চলাকালেই সালেহউদ্দিন আহমেদ তাঁকে ওই বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্মে নিবন্ধন করাতে সাহায্য করেন, “যার মুনাফা মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যেই দেখা যায়”।

রিভার্স ইমেজ সার্চ করে ডিসমিসল্যাব প্রকৃত টকশোটি শনাক্ত করেছে। মূল অনুষ্ঠানের উপস্থাপক পীযূষ নয়, ছিলেন জান্নাতুন নাঈম। পুরো ৫০ মিনিটের পর্বটিতে কোথাও সালেহউদ্দিন আহমেদ কোনো বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কিছু বলেননি, যা প্রমাণ করে, ওই দাবি সম্পূর্ণ ভুয়া।

একই ধরনের ভুয়া বিজ্ঞাপন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ও ছাত্রনেতা নাহিদ ইসলাম, ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আজিজ খান এবং অভিনেত্রী সাদিয়া আয়মানের নামেও ছড়ানো হয়। অনলাইন বিনিয়োগ–সম্পর্কিত মন্তব্যের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই মামলা করেছে বলে দাবি করা হয়।

ফেসবুকে প্রচারিত বিজ্ঞাপনের স্ক্রিনশট

এসব ভুয়া বিজ্ঞাপন ছড়ানো হয়েছে লিথুয়ানিয়া ও ইউক্রেন থেকে পরিচালিত একাধিক ফেসবুক পেজ (, , , ) ব্যবহার করে। ২০২২ সালের জুন মাসে তৈরি হওয়া এসব পেজের প্রোফাইল ও কাভার ছবিও ছিল প্রায় একই রকম। এসব পেজের কোনো উল্লেখযোগ্য ফলোয়ার ছিল না। সবগুলোকে ফেসবুকের ‘কমিউনিটি পেজ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। প্রতিটি পেজে যোগাযোগের জন্য দেওয়া নম্বরও ছিল একই।

পেজগুলোর বৈশিষ্ট্য ‘বার্নার অ্যাকাউন্ট’-এর মতো, যেগুলো মূলত প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন দিতে ব্যবহৃত হয়। পেজগুলোতে স্বাভাবিক কোনো পোস্ট নেই, নেই প্রকৃত দর্শক বা পাঠকের সঙ্গে সম্পৃক্ততা।

কীভাবে চলছে প্রতারণা?

এসব ভুয়া বিজ্ঞাপন ব্যবহারকারীদের পাঠিয়ে দেয় “ইমিডিয়েট লুমিনারি”, “নেথারেক্স প্রো” কিংবা “নিয়ারেস্ট এজ”-নামের বিভিন্ন সন্দেহজনক বিনিয়োগ সাইটে। সালেহউদ্দিন আহমেদের নাম ব্যবহার করে প্রচারিত ভুয়া টিভি অনুষ্ঠানে যে প্ল্যাটফর্মটির নাম এসেছিল, সেটি ছিল নিয়ারেস্ট এজ। প্রতিটি প্ল্যাটফর্ম থেকেই ব্যবহারকারীদের বলা হচ্ছিল, নিবন্ধনের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই একজন এজেন্ট ফোন করবেন।

কীভাবে এই প্রতারণার জাল বিছানো হচ্ছে, তা বুঝতে এই প্রতিবেদক নিয়ারেস্ট এজ প্ল্যাটফর্মে নিবন্ধন করেন। মাত্র আধঘণ্টার মধ্যেই সাইপ্রাসের একটি নম্বর থেকে ফোন আসে। অপরিচিত একটি ভাষায় একজন এজেন্ট কথা বলেন। তবে প্রতিবেদক ইংরেজিতে জবাব দেওয়ামাত্রই ফোন কেটে দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর আরেকজন ফোন করে জানান, তাঁদের পাঠানো ই-মেইলে ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মের লগইন তথ্য দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু ই-মেইলটি নিয়ারেস্ট এজ-এর  প্ল্যাটফর্মের জন্য পাঠানো হয়নি। সেটি এসেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার একটি বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্ম ইজেড ইনভেস্ট-এর পক্ষ থেকে। পাঠানো লগইন তথ্য ব্যবহার করে ইজেড ইনভেস্ট-এর ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখা যায়, সেখানে বিভিন্ন ট্রেডিংয়ের রিয়েল-টাইম দর এবং ট্রেন্ড গ্রাফ দেখানো হচ্ছে।

এরপর এজেন্ট এই প্রতিবেদককে অন্তত ২০০ ডলার (বা বাংলাদেশি টাকায় সমপরিমাণ অর্থ) জমা দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। তিনি বলেন, ক্রেডিট কার্ড কিংবা ব্যাংক ট্রান্সফার—যেকোনো মাধ্যমেই অর্থ জমা দেওয়া যাবে। টাকা জমা দিলেই নাকি বিনিয়োগ থেকে লাভ করতে প্রয়োজনীয় সাহায্য পাবেন। প্রতিবেদক প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করলেও পরে বারবার সাইপ্রাস এবং যুক্তরাজ্যের নম্বর থেকে ফোন আসতে থাকে। প্রতিবারই তাদের প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হচ্ছিল।

ইজেড ইনভেস্ট তাদের ওয়েবসাইটে দাবি করেছে, তারা দক্ষিণ আফ্রিকার ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর কন্ডাক্ট অথরিটি (এফএসসিএ) কর্তৃক অনুমোদিত এবং নিয়ন্ত্রিত। তাদের ঠিকানাও প্রকাশ্যে দেওয়া আছে, এবং প্রাথমিক অনুসন্ধানে নিবন্ধনের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। কিন্তু বিখ্যাত ব্যবসায়িক রিভিউ প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রাস্টপাইলটে’ অনেক ব্যবহারকারীই ইজেড ইনভেস্ট-এর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ করেছেন।

শ্রীলঙ্কার নাগরিক চন্দনা ফারনান্দো ট্রাস্টপাইলটে তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। ফেসবুকে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের নাম ব্যবহার করে একটি বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্মের প্রচারণা দেখার পর তিনি আগ্রহী হন। যুক্তরাজ্য ও সাইপ্রাসের নম্বর থেকে ফোন পেয়ে তিনি নির্দেশনা মেনে ২০১ ডলার বিনিয়োগ করেন। কিন্তু পরে টাকা তুলতে চাইলে তাঁর কাছে ‘কমপ্লায়েন্স ডিপার্টমেন্ট’-এর নাম ব্যবহার করে ব্যক্তিগত তথ্য চেয়ে বারবার ই-মেইল আসতে থাকে। এসব ই-মেইলে তাঁকে হুমকি দেওয়া হয়, এক মাসের মধ্যে এসব তথ্য না দিলে তাঁর অর্থ স্থগিত করা হবে।

একই ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন ভারতের নাগরিক প্রবীণকুমার গোখেও। তিনিও ট্রাস্টপাইলটে লিখেছেন, ইজেড ইনভেস্টের একজন এজেন্ট দৈনিক লাভের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁকে প্রাথমিকভাবে ২০০ ডলার বিনিয়োগে রাজি করান। পরে ‘পোর্টফোলিও ম্যানেজার’ তাঁকে চাপ দিয়ে ৪ হাজার ৩৮০ ডলার বিনিয়োগ করান। প্রথম দিকে সামান্য লাভ দেখালেও পরে সেই ম্যানেজার তাঁকে লাভজনক ট্রেড বন্ধ করে লোকসানের দিকে ঠেলে দেন। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আরও অর্থ জমা দিতে চাপ দিতে থাকেন। প্রবীণ এখন বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরত চাইছেন এবং অন্যদের সতর্ক করছেন যেন কেউ এই প্রতারণায় না পড়েন।

বাংলাদেশে ছড়ানো প্রতারণাগুলোর ক্ষেত্রেও হুবহু একই কৌশল দেখা যায়। 

প্রতারণার বিস্তার: ৩৬ দেশ, ৬৪ জন বিখ্যাত ব্যক্তি

ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, একই ধরনের ভুয়া সংবাদ ও বিজ্ঞাপন দিয়ে অন্তত ৩৬টি দেশে প্রতারণা চলছে। এই প্রতারণার কৌশল প্রায় একই: ভুয়া সংবাদে দাবি করা হয়, দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক একজন বিখ্যাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ভাষা বদলালেও বক্তব্য এক, যেখানে বলা হয় ওই ব্যক্তি একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগে জনগণকে প্রলুব্ধ করছেন।

ফ্যাক্টচেক রিপোর্ট, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একই ধরনের বিজ্ঞাপন ছড়িয়েছে এশিয়ার ভারত, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর হংকংসহ বিভিন্ন দেশে। আফ্রিকায় নাইজেরিয়া, ঘানা, জিম্বাবুয়েউগান্ডাতেও এই প্রতারণার শিকার হয়েছেন ব্যবহারকারীরা।

ইউরোপে এই ধরনের প্রতারণার প্রাথমিক নজির পাওয়া যায় ২০২৩ সালের শেষ দিকে। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়েছে এই প্রতারণা। আমেরিকা অঞ্চলে চিলি, কলম্বিয়া, জ্যামাইকাকানাডায় এবং মধ্যপ্রাচ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতারওমানে প্রতারণাটি দেখা গেছে। এমনকি ওশেনিয়া অঞ্চলের অস্ট্রেলিয়ানিউজিল্যান্ডেও এমন ঘটনা ঘটেছে।

ডিসমিসল্যাব আরও চিহ্নিত করেছে, বিশ্বজুড়ে অন্তত ৩৯টি গণমাধ্যমের ওয়েবসাইট নকল করে প্রতারকেরা এই বিজ্ঞাপন ছড়িয়েছে। এর মধ্যে বিবিসি, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, সিএনবিসি, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, সিবিসির মতো বিশ্বখ্যাত সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে ইতালির লা রিপাবলিকা, নাইজেরিয়ার ভ্যানগার্ড, ভারতের নিউজ ১৮, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা পোস্ট, নিউজিল্যান্ডের নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড, আরব আমিরাতের খালিজ টাইমস ও স্পেনের এল মুন্দোর মতো গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক গণমাধ্যমও রয়েছে।

২০২৪ সালের জুলাইয়ে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে একই ধরনের প্রতারণায় বিখ্যাত সাংবাদিকদের নাম ব্যবহার করে প্রতারণার বিষয়টি উঠে আসে। মার্চের শুরুতে ওসিসিআরপি ও এসভিটি-র স্ক্যাম এমপায়ার নামের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ইসরায়েল, পূর্ব ইউরোপ ও জর্জিয়া থেকে পরিচালিত বড় কল সেন্টারের মাধ্যমে সেলিব্রেটিদের নাম ভাঙিয়ে ৩২ হাজার মানুষ থেকে অন্তত ২৭৫ মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেওয়া হয়।

ওসিসিআরপির আরেক প্রতিবেদন অনুসারে, ইলন মাস্ক, সান্দ্রা ওহ, এমবাপে, রায়ান রেনল্ডস, জেরেমি ক্লার্কসন, ফার্নান্দো আলোনসোর মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের ডিপফেক ভিডিও ও ছবি ব্যবহার করেও প্রতারকেরা এই জাল বিছিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার একজন ব্যবহারকারী শুধু ইলন মাস্কের ডিপফেক ভিডিওতে ক্লিক করেই হারিয়েছেন ৮০ হাজার ডলার।

সন্দেহজনক ওয়েবসাইট, ভুয়া ডোমেইন

বাংলাদেশে সালেহউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে ভুয়া প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়া বিডিনিউজ ২৪ ডট কমের নকল ওয়েবসাইটট ডেনফার-রুফিং ডট কম নামের একটি ডোমেইনে হোস্ট করা। সরাসরি লিংক ব্যবহার না করলে এই ওয়েবসাইটে ঢোকা যায় না। নির্দিষ্ট সময়েই কেবল সচল থাকে ভুয়া প্রতিবেদন। অন্য সময় একই ডোমেইন থেকে ব্যবহারকারীদের ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের পুরোনো সংবাদের নকল পেজে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই কৌশলে প্রতারণার সংবাদ আর্কাইভে সংরক্ষিত হওয়া ঠেকানো হয়।

এই অনুসন্ধানে ডিসমিসল্যাব বাংলাদেশসহ ১৯টি দেশে এমন অন্তত ২৩টি ভুয়া ডোমেইন পেয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে একই ডোমেইন একাধিক দেশে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, বাংলাদেশে ব্যবহৃত স্যাভিওয়েলথপ্ল্যান ডট কম এবং এক্সপার্টাফিল ডট কম ডোমেইনগুলো নাইজেরিয়া ও মালয়েশিয়ায় ব্যবহৃত হয়েছে।

মেটা কেন ধরতে পারছে না?

মেটার নীতিমালা অনুযায়ী প্রতারণা, স্প্যাম ও বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ। বিশেষ করে ‘কম বিনিয়োগে দ্রুত ধনী হওয়া’ ধরনের প্রচারণাও নিষেধ। কিন্তু ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধানে উঠে আসা বিজ্ঞাপনগুলো এসব নীতিমালা লঙ্ঘন করেই প্রকাশিত হচ্ছে।

প্রতারকেরা মেটার স্বয়ংক্রিয় বিজ্ঞাপন পর্যালোচনা ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে। বিশেষ করে ইংরেজি ছাড়া অন্যান্য ভাষা এবং কম নজরদারির অঞ্চলগুলোকে লক্ষ্য করে এ ধরনের প্রতারণা সহজে চালানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে ‘ক্লোকিং’ পদ্ধতি ব্যবহার করে মেটার পর্যালোচনাকে ফাঁকি দিয়ে পরে প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। তারা স্বল্প মেয়াদে তৈরি ডোমেইন ও বার্নার অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে দ্রুত বিজ্ঞাপন বদল করে, ফলে এটি নজরে আসা কঠিন হয়।

এর আগে চেকফার্স্টের একটি অনুসন্ধানে ‘ফেসবুক হাসলস’ নামের প্রতারণা এবং রিসেটের অনুসন্ধানে ২ লাখ ৪২ হাজার ভুয়া ফেসবুক পেজের মাধ্যমে প্রো-ক্রেমলিন আর্থিক প্রতারণার বিষয়টি উঠে এসেছিল। এবারের এই প্রতারণার কৌশলও ছিল প্রায় একই ধরনের।

অনুসন্ধানের পদ্ধতি

আমাদের এই অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে প্রকাশিত বিডিনিউজ ২৪ ডট কমের নামে একটি ভুয়া প্রতিবেদন থেকে। ফেসবুকে এই বিজ্ঞাপনটি দেখার পর, অ্যালগরিদমের কারণে একই ধরনের আরও কিছু বিজ্ঞাপন আমাদের ফিডে আসতে থাকে। বিষয়টি গভীরভাবে বুঝতে আমরা ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক মামলা করেছে…টিভি বক্তব্যের জন্য’—এমন একটি কিওয়ার্ড দিয়ে খোঁজ চালাই। এতে আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে একই ধরনের প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন নিয়ে করা পোস্ট, রিপোর্ট এবং ফ্যাক্টচেক দেখতে পাই। এরপর আমরা প্রতিটি রিপোর্ট, ফ্যাক্টচেক ও অনলাইন রিভিউ বিশ্লেষণ করি। পাশাপাশি ভুয়া ওয়েবসাইটের স্ক্রিনশট এবং প্রতারণায় ব্যবহৃত ভুয়া সংবাদ ওয়েবসাইট ও ডোমেইনগুলো পর্যালোচনা করি।

আরো কিছু লেখা