তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চার, ডিসমিসল্যাব
ভারতের ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ধর্মীয় অপতথ্য

ভারতের ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ধর্মীয় অপতথ্য

তামারা ইয়াসমীন তমা

রিসার্চার, ডিসমিসল্যাব

ভারতের লোকসভা নির্বাচন ঘিরে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমজুড়ে ছড়াতে দেখা গেছে বিভিন্ন ধর্মীয় অপতথ্য, যার একটি বড় অংশজুড়ে ছিল মুসলিম-বিদ্বেষ এবং দেশটির সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার। ভারতের ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান বুম, ফ্যাক্টলি, নিউজচেকার, দ্য কুইন্টঅল্ট নিউজে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় নিয়ে প্রকাশিত ২০২টি ইউনিক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পায় ডিসমিসল্যাব।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬২ শতাংশ ধর্মীয় অপতথ্যেই মুসলিম সম্প্রদায় ও ইসলাম ধর্মকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা ছড়িয়েছে। রাজনৈতিক বিভিন্ন আন্দোলন ও দ্বন্দ্ব কেন্দ্র করে শিখ ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের নিয়েও ছিল নেতিবাচক প্রচার। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অপতথ্য ছিল ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ সনাতন ধর্মাবলম্বী ও হিন্দু ধর্মকেন্দ্রিক, যার ৮০ শতাংশই ছিল ইতিবাচক বা নিরপেক্ষ।

৩৯ শতাংশ ক্ষেত্রে ধর্মীয় অপতথ্যে সরাসরি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের উল্লেখ ছিল। এর প্রায় অর্ধেকই ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচার। ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-কে ঘিরেও ছড়িয়েছে অপতথ্য, তবে এগুলোর একটি বড় অংশেই সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং অযোধ্যার রাম মন্দির ঘিরে ইতিবাচক প্রচারণা চলেছে।

অপতথ্য ন্যারেটিভের একটি বড় জায়গা ছিল মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের হেনস্তা করার মিথ্যা অপপ্রচার, যেখানে মুসলিমদের হামলাকারী, খুনি, ধর্ষক, অপহরণে জড়িত হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে। মুসলিমরা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেস ও বিজেপি বিরোধী অন্যান্য দলের গঠিত সরকার ব্যবস্থায় বিশেষ সংরক্ষণ সুবিধা ভোগ করায় এসব রাজ্যে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বঞ্চিত হচ্ছে– এমন ভাষ্য ছড়ানোর চেষ্টাও লক্ষ্য করা গেছে। পাশাপাশি রাম মন্দির উদ্বোধন, কৃষক আন্দোলন, পশ্চিমবঙ্গের সন্দেশখালির যৌন নির্যাতন, মুম্বাইয়ের মীরা রোডে দাঙ্গা, উত্তরাখণ্ডের হলদওয়ানিতে মসজিদ-মাদ্রাসা ভাঙচুর, ওবিসি সংরক্ষণ, মুসলিমদের মাঝে সম্পদ বন্টনের ভুয়া খবর ইত্যাদি সাম্প্রতিক ইস্যুকে ধর্মীয় অপতথ্যের বিষয় হিসেবে আসতে দেখা গেছে। 

সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যম লোকসভা নির্বাচন ঘিরে ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণাধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডানপন্থী পপুলিস্ট বা জনতোষামদী দলগুলো কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের মধ্যে বিশ্বায়নের নেতিবাচক প্রভাব, অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা ও সংস্কৃতিক স্বতন্ত্রতা ক্ষুন্ন হওয়ার ভয় ছড়িয়ে দিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।

বেড়েছে ইসলাম বিরোধী অপতথ্য এবং সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ

ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনগুলো থেকে ভারতে ধর্মীয় অপতথ্যের প্রবণতা আরও গভীরভাবে বোঝা যায়। বিশ্লেষণ করা ২০২টি দাবির মধ্যে ৬২ শতাংশ মুসলিম, ৩২ শতাংশ হিন্দু এবং বাকিগুলো ছিল শিখ ও খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের টার্গেট করে। ধর্মীয় অপতথ্যের বেশিরভাগই বিদ্বেষপূর্ণ, ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রেই যেগুলো ছিল অন্তত একটি ধর্ম ও সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ। ১৭ শতাংশ ছিল বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায় নিয়ে ইতিবাচক, যেখানে ধর্মীয় মাহাত্ম্য ও প্রসার নিয়ে ভুয়া তথ্য ছড়িয়েছে এবং বাকিগুলো ছিল নিরপেক্ষ।

ডেটাসেট বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মুসলিম সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে অপতথ্য ছড়ানো বাড়তে থাকে, এপ্রিলে যা ছিল সর্বোচ্চ। জানুয়ারিতে হিন্দু ধর্ম ও সম্প্রদায় ঘিরে সবচেয়ে বেশি অপতথ্য ছড়ালেও পরবর্তীতে তা কমে আসে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, জানুয়ারিতে উত্তর প্রদেশে অযোধ্যা রামমন্দির উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে এসব অপতথ্য বেড়ে গিয়েছিল। 

মুসলিম সম্প্রদায় ও ইসলাম ধর্ম নিয়ে ছড়ানো অপতথ্যগুলোর ৯৬ শতাংশই ছিল সম্প্রদায়টির প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ ও নেতিবাচক। অন্যদিকে, হিন্দুধর্ম ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঘিরে ছড়ানো অপতথ্যের ৮০ শতাংশই ছিল ধর্মটি নিয়ে ইতিবাচক ও নিরপেক্ষ।

হিন্দুধর্ম নিয়ে ছড়ানো প্রায় অর্ধেক ভুয়া তথ্যেই ধর্মটিকে ইতিবাচকভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, রাম মন্দিরের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের আগমন, বা বিভিন্ন ধর্মীয় মাহাত্ম্য বর্ণনা এবং মন্দির সম্পর্কিত অলৌকিক কাহিনী।

অপতথ্যের ন্যারেটিভ

মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নেতিবাচক হিসেবে প্রচারিত অপতথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এসব প্রচারণায় তাদের উগ্র, হামলাকারী, নিপীড়ক, খুনি বা ধর্ষক হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে। যেমন, কর্ণাটক কলকাতায় মুসলিমরা হিন্দু মেয়েদের অপহরণ করছে, হিন্দুদের উপর মুসলিমদের হামলা (, , ), হত্যাচেষ্টা (, , ), ধর্ষণ ইত্যাদি অভিযোগে বিভিন্ন অপতথ্য ছড়াতে দেখা গেছে। 

মুসলিম ব্যবসায়ীদের নামেও বিভিন্ন নেতিবাচক ভুয়া দাবি প্রচারিত হয়েছে। যেমন, মুসলিম রেস্তোরাগুলোতে যৌনভাবে অক্ষম করে দেওয়ার ওষুধ মেশানো, মুসলিম আইসক্রিম বিক্রেতার হস্তমৈথুন, তরমুজ বিক্রেতার ইনজেকশন ব্যবহার ইত্যাদি। এমনকি মুসলিম মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত হামদর্দ ইউনানি, হিমালয়া, মালাবার গোল্ড অ্যান্ড ডায়মন্ডস ইত্যাদি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নিয়েও অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে।

এ ধরনের অপতথ্য বিস্তারের লক্ষ্য বুঝতে ‘ইসলামোফোবিয়া’র একটি সংজ্ঞা উদ্ধৃত করা যায়, যা জাতিসংঘ নির্ধারণ করেছে। বৈশ্বিক এ সংস্থাটির মতে “ইসলামোফোবিয়া হলো মুসলিমদের ভয় পাওয়া, মুসলিমদের নিয়ে বিভিন্ন কুসংস্কারে বিশ্বাস ও বিদ্বেষ পোষণ করা, যা থেকে মানুষের মাঝে উত্তেজনা, বৈরি মনোভাব, ও অসহিষ্ণুতার সঞ্চার ঘটে এবং তারা অনলাইন বা অফলাইনে মুসলিম এমনকি অমুসলিমদের হুমকি প্রদান, হয়রানি, শোষণ, প্ররোচিতকরণ ও ভয় দেখাতে উদ্যত হয়”।

ঐতিহাসিক বিরোধ থাকা সত্ত্বেও ভারতের মুসলমানরা পাকিস্তানকে সমর্থন করে– এমন ভাষ্যও প্রচারিত হয়েছে বিভিন্ন অপতথ্যে। যেমন ভারতের হায়দরাবাদে পাকিস্তানি পতাকা হাতে মুসলিমরা র‍্যালি করছে– এমন দাবিতে ছড়ানো ভিডিরও সঙ্গে ক্যাপশনে বলা হয়, “যারা আমাদের দেশকে বাঁচাবে, আমাদের ধর্মকে বাঁচাবে, সেই দলকে ভোট দিন।” যাচাইয়ে দেখা যায় পতাকাটি পাকিস্তানের নয়, বরং ধর্মীয় পতাকা হাতে ঈদে-মিলাদুন্নবীর আয়োজনে মিছিলটি বেরিয়েছিল। 

অন্যদিকে, হিন্দু সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে প্রচারিত হয়েছে ১২টি নেতিবাচক অপতথ্য। যার মধ্যে ছিল হিন্দুদের হাতে উত্তর প্রদেশে মুসলিম খ্রিষ্টান নির্যাতন, গুজরাটে দলিত সম্প্রদায়ের কিশোরী ধর্ষণ, দিল্লিতে হিজাব পড়ায় শিক্ষার্থী হেনস্তার শিকার ইত্যাদি।

ভারতে কৃষক আন্দোলন চলার সময় মধ্যে নেতিবাচক অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে শিখ ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে। খালিস্তানি সমর্থক শিখরা হিন্দু মন্দিরে আক্রমণ করছে– এমন একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে যাচাইয়ে দেখা যায় ভিডিওটি পুরোনো। নেতিবাচক অপতথ্য বিস্তারের উদাহরণ হিসেবে কৃষক আন্দোলন চলাকালে পুলিশের উপর তলোয়ার নিয়ে শিখদের হামলা চালানোর মতো দাবিরও উল্লেখ করা যায়।

খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের ঘিরেও দেখা গেছে নেতিবাচক প্রচার। যেমন, কেরালায় খ্রিষ্টানরা জোর করে হিন্দুদের কাছ থেকে বড়দিনের চাঁদা আদায় করছে এমন ভুয়া দাবি। অন্যদিকে, ভারতে স্প্যানিশ ভ্লগার ধর্ষণে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃতরা খ্রিষ্টান মিশনারির হয়ে কাজ করে বলে ভুয়া দাবি করেন একজন বিজেপি নেতা, তিনি খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের ‘চালের বস্তার জন্য ধর্মান্তরিত’ বলেও আখ্যায়িত করেন। 

ধর্মীয় অপতথ্যের লক্ষ্য যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল

এই গবেষণার জন্য বিশ্লেষণ করা ২০২টি ধর্মীয় অপতথ্যের মধ্যে ৭৮টিতে অর্থাৎ, ৩৯ শতাংশ ক্ষেত্রে ভারতের কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতার নাম পাওয়া গেছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং এর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। বিশ্লেষণে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক অপতথ্য ছড়াতে দেখা গেছে রাহুল গান্ধী, নরেন্দ্র মোদি, মমতা ব্যানার্জি, আসাদউদ্দিন ওয়াইসি ও সিদ্ধারামাইয়াকে ঘিরে।

অনেক ক্ষেত্রে এসব অপতথ্যের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক লক্ষ্যে ভোটারদের ধর্মীয় আবেগ কাজে লাগানো। যেমন, রাহুল গান্ধিমমতা ব্যানার্জি ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান নিয়ে আপত্তি জানাচ্ছেন– এমন অপতথ্যগুলোর মূল টার্গেট ধর্মীয় সম্প্রদায় নয় বরং রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেস। এখানে রাহুল ও মমতার ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ই ছিল মুখ্য।

রাজনৈতিক নেতিবাচক প্রচারণার ৯৭ শতাংশই ছিল কংগ্রেস ও এর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে । এছাড়া ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে প্রভাব বিস্তারকারী বিজেপি বিরোধী বিভিন্ন বামপন্থী ও ইসলামিক রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে ছড়ানো অপতথ্যগুলোর শতভাগই ছিল নেতিবাচক। এই দলগুলোর মধ্যে আছে- তৃণমূল কংগ্রেস, অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমীন (এআইএমআইএম), শিব সেনা, আম আদমি পার্টি, ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ (আইইউএমএল), লেফট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এলডিএফ), পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া (পিএফআই), দ্রাবিড় প্রগতিশীল ফেডারেশন (ডিএমকে), সমাজবাদী পার্টি ইত্যাদি।

ধর্মীয় স্পিন ঘিরে এই অপতথ্যগুলোর একটি সাধারণ ভাষ্য হলো বিজেপি বিরোধী বিভিন্ন রাজ্যর সরকার বিভিন্নভাবে মুসলিমদের সমর্থন করলেও হিন্দুদের ধর্মীয় আচার পালনে বাধা তৈরি করছে। যেমন, তামিল নাড়ুতে মন্দিরকে মসজিদে রূপান্তর ও স্থানীয় সরকারের মন্দির গুড়িয়ে ফেলা, কিংবা কেরালায় কংগ্রেসের সহায়তায় মুসলিমরা মন্দির দখল করে মাংসের দোকান স্থাপন হয়েছে দাবিতে প্রচারণাগুলো ছিল নেতিবাচক।

যেসব রাজ্যে কংগ্রেস, তৃণমূল, এলডিএফ ইত্যাদি বিজেপি বিরোধী দল সরকার গঠন করেছে সেখানে মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে বলেও দাবি করা হয়। যেমন: “কর্ণাটকের মুসলিমদের মাঝে সম্পদ বিতরণ করা হবে”- কংগ্রেস নেতার এমন একটি ভুয়া বক্তব্য প্রচারিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সাব-ইন্সপেক্টর নিয়োগ পরীক্ষায় শুধুমাত্র মুসলিমদের নিয়োগ প্রদান করা হচ্ছে এমন একটি গুজবও ছড়ায়। 

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য থেকেও ছড়িয়েছে অপতথ্য। গত ২১ এপ্রিল রাজস্থানের বাঁশওয়ারায় এক জনসভায় মোদি বলেন, “মনমোহন সিংয়ের সরকার বলেছিল দেশের সম্পদে প্রথম অধিকার হবে মুসলিমদের।” যাচাইয়ে দেখা যায়, মনমোহন সিংয়ের উদ্বৃতি বিকৃত করে বিজেপি প্রধান এই বক্তব্য রাখেন। 

একই বক্তৃতায় তিনি মুসলিমদের উল্লেখ করে আরও বলেন, “তারা সমস্ত সম্পদ একত্র করে কার মধ্যে বণ্টন করবে? যাদের সন্তান বেশি। তারা তা অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে বিতরণ করবে। আপনার কষ্টার্জিত সম্পদ কি অনুপ্রবেশকারীদের দেওয়া উচিত? আপনার কি এটা মেনে নেওয়া উচিত?” পরবর্তীতে বিতর্কের মুখে মোদি মুসলিমদের ‘বেশি সন্তান জন্মদানকারী’ ও ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে মন্তব্য করেননি বলে দাবি করলেও ফ্যাক্টচেকে সেটি ভুল প্রমাণিত হয়।

বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ নিয়েও ছড়িয়েছে অপতথ্য। যেমন রামকে নিয়ে কটুক্তির অভিযোগে মহারাষ্ট্রের কংগ্রেস নেতা জিতেন্দ্র আওহাদের উপর হামলার মিথ্যা দাবি ছড়ায়। আওহাদের ধর্মাবমাননা ও হামলা, দুটি খবরই ছিল বিভ্রান্তিকর। কংগ্রেস কর্মীরা হিন্দু দেবদেবীর হোর্ডিং ছিঁড়ে ফেলছেন এমন একটি ভিডিও-ও ছড়াতে দেখা গেছে, যেটি আসলে ছিল বিজেপি কর্মীদের প্রতিবাদ সমাবেশ। ধর্মাবমাননা ছাড়াও বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীরা আদর্শ হিন্দু নন, এমন চিত্রও তুলে ধরার চেষ্টা চলে বিভিন্ন অপতথ্যে। রাহুল গান্ধীর দেবমূর্তি গ্রহণে অস্বীকৃতি, কর্ণাটকের সিএম সিদ্ধারামাইয়ার মুসলিম হিসেবে পুনর্জন্ম নেওয়ার ইচ্ছা– এ জাতীয় অপতথ্য হিন্দু ভোটারদের সামনে দলটির নেতাদের ‘হিন্দুত্ব’ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে। 

কংগ্রেসের একাধিক ভুয়া নির্বাচনী ইশতেহারও ছড়াতে দেখা গেছে। এরকমই একটি ভুয়া ইশতেহারে লাভ জিহাদ সমর্থন, গোমাংস বৈধকরণ, বোরকার পক্ষে কংগ্রেসের সমর্থন থাকবে এসব ভুয়া দাবি তুলে ধরা হয়। এছাড়াও দাবি করা হয় যে, ক্ষমতায় এলে কংগ্রেস সমলিঙ্গের বিবাহ বৈধ ঘোষণা করবে।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিভিন্ন অপতথ্যে বিজেপিকে নিয়ে ইতিবাচক প্রচারণার মাধ্যমে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। যেমন তামিল নাড়ুতে মন্দিরকে মসজিদে রূপান্তরের গুজবের সঙ্গে ‘ভবিষ্যত প্রজন্মকে’ বাঁচাতে বিজেপিকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। দলটিকে ঘিরে কিছু নেতিবাচক প্রচারও দেখা গেছে। যেমন, বিজেপি নেতার খ্রিষ্টান পাদ্রিকে নিপীড়ন, নেতানেত্রীদের দ্বিমুখী আচরণ, নবরাত্রির সময় আমিষ কেনাবেচা নিষিদ্ধ করা হলেও বিজেপি নেত্রী স্মৃতি ইরানির মাছ নিয়ে ছবি তোলা, কিংবা বিজেপি নেতার মন্দির পরিষ্কারের অভিনয় করা ইত্যাদি ভুয়া ছবি ও ভিডিও প্রচার এই শ্রেণিতে পড়ে।

দেশের সীমানা ছাড়িয়ে

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশি দেশগুলোর বিভিন্ন ঘটনাও অনেক সময় ভারতের দাবি করে ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছে। যেমন, বাংলাদেশের একজন ধর্মীয় নেতার ভিডিও ভারতের বলে প্রচারিত হয়। ভিডিওটির ক্যাপশনে দাবি করা হয়, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে হিন্দুদের ঘরে ঘরে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া হবে। একইভাবে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে ধর্ষণের শিকার কিশোরীর ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হয় যে, সেটি ছিল গুজরাটে দলিত সম্প্রদায়ের কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনা।

যাচাই হওয়া অপতথ্যগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ছড়িয়েছে এমন আটটি দাবি (, , , , , , , ) পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সাতটিই ছড়িয়েছে ভিডিও ফরম্যাটে। এগুলোর মধ্যে মুসলিমদের হাতে বাংলাদেশি হিন্দুদের নির্যাতন, বোরকা না পরায় লাঞ্ছিত করা, লাভ জিহাদ ও ধর্মান্তরিতকরণ ইত্যাদি বিষয় উঠে এসেছে, যা ভারতেও সাড়া ফেলেছে। 

হিন্দু ভোটারদের মধ্যে ‘আতঙ্ক’ তৈরি

পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা যায়, ভারতে সংখ্যালঘু দলগুলোর মধ্যে একমাত্র জৈনরাই বিজেপিকে একনিষ্ঠভাবে সমর্থন করে। অন্যদিকে, বুদ্ধ (২৯%), মুসলিম (১৯%), শিখ (১৯%) ও খ্রীষ্টানদের (১০%) খুব সামান্য অংশই ২০১৯ সালের সংসদ নির্বাচনে বিজেপিকে ভোট দেওয়ার কথা জানায়।

সাংবাদিক অনুরাগ ভার্মার মতে, বিজেপির ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারণায় অবিভক্ত হিন্দু ভোট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে পিউ রিসার্চের গবেষণাটি বলছে, ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে ভাষা, খাদ্যাভাস ও আচারের পার্থক্য ধর্মীয়-রাজনীতির ক্ষেত্রে তাদের পছন্দের ভিন্নতা তৈরি করে।

বুমের গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০২১ সাল থেকে ভারতে প্রচারিত অপতথ্যের মূল টার্গেট মুসলিমরা। বুমের সর্বশেষ একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এপ্রিলে বিজেপি বিরোধী দলগুলোকে টার্গেট করে মেটা প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপনে প্রায় সোয়া চার কোটি রুপির বেশি ব্যয় করা হয়। বুমের মতে, অনেক বিজ্ঞাপনেই তফসিলি জাতি ও উপজাতির মধ্যে কংগ্রেস কেবল মুসলিমদের প্রাধান্য দিয়ে থাকে এমন দাবি তুলে ধরা হয়।

ডানপন্থী পপুলিস্ট (জনতোষামদী) রাজনীতিতে ভোটারদের মধ্যে ‘উদ্বেগ সৃষ্টিকে’ একটি বড় কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয় বলে মনে করেন গবেষক অ্যান ম্যাটেন ও মাইকেল বেয়ারলিন। তাদের মতে, ডানপন্থী দলগুলো আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা ও সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্রতা ক্ষুন্ন হওয়ার ভয় ঢুকিয়ে মানুষকে সঙ্গে রাখার চেষ্টা করে। একইসঙ্গে, ভোটারদের মধ্যে অস্তিত্বগত সংকটের সঙ্গে ডানপন্থী দলগুলোর ভোটলাভের সম্ভাবনা সমানুপাতিক।


গবেষণা পদ্ধতি

ভারতে এক ডজনেরও বেশি ফ্যাক্টচেকিং সাইট রয়েছে যারা নিয়মিতভাবে মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর দাবি নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। এই গবেষণায় ভারতের পাঁচটি প্রধান ফ্যাক্ট-চেকিং সাইট থেকে নমুনা নেওয়া হয়েছে, যারা ইংরেজি ভাষায় ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ডেটা সংগ্রহের জন্য সাইটগুলোতে গত পাঁচ মাসে (জানুয়ারি-মে ২০২৪) ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত প্রতিটি ফ্যাক্ট-চেক প্রতিবেদন পড়ে বিভিন্ন ধর্মের উল্লেখিত রেফারেন্সসহ কনটেন্টগুলো নথিভুক্ত করা হয়েছে।

নমুনা প্রতিবেদনের ভুয়া দাবিগুলোকে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান এবং শিখ এই চারটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সাপক্ষে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে, এর বাইরে অন্যান্য সম্প্রদায় সম্পর্কিত তথ্য মিলেনি। প্রতিটি ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত শব্দ বা শব্দগুচ্ছ যেমন, ‘ধর্মীয় প্রতীক’, ‘উপাসনালয়’, ‘চর্চা’ ইত্যাদির উল্লেখ থেকে দাবিটি কোন ধর্মকে ইঙ্গিত করছে তা নির্ধারণ করা হয়েছে।

একাধিক ধর্ম বা সম্প্রদায়ের উল্লেখ থাকলে সাবজেক্ট বা কর্তা অর্থাৎ, যারা ঘটনাটি ঘটাচ্ছে তাদের নির্বাচন করা হয়েছে। যেমন বাংলাদেশে মুসলিমদের হাতে হিন্দু পরিবারের তিন সদস্য হত্যা; এখানে মুসলিমদের দ্বারা হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি সংঘটিত হওয়ার দাবি করায় একে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচার হিসেবে ধরা হয়েছে।

অপতথ্যটি ‘ইতিবাচক’, না ‘নেতিবাচক’ নাকি ‘নিরপেক্ষ’ কোন ধরনের মনোভাব ইঙ্গিত করছে (ইন্ডিকেটর অব সেন্টিমেন্ট) তা নির্দেশকের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন: ইতিবাচক সেন্টিমেন্টের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্ম, এর অনুসারী বা এর বিশ্বাসের প্রতি প্রশংসা, শ্রদ্ধা বা সমর্থনের অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয়েছে। নেগেটিভ সেন্টিমেন্টের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ধর্ম ও এর চর্চাকারীদের নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য বা বিদ্বেষ প্রকাশ করা হয়েছে। অন্যদিকে শুধু তথ্য/ফ্যাক্ট তুলে ধরছে এমন বিষয়গুলো নিরপেক্ষ শ্রেণিতে ফেলা হয়েছে। 

এই শ্রেণিগুলো নির্ধারণে প্রতিটি ঘটনার প্রেক্ষাপট, যেসব জায়গা থেকে ছড়িয়েছে সেসব সূত্র এবং ভাষার ব্যবহার বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিটি গুজবের সাম্প্রদায়িক স্পিন, টার্গেটেড ধর্মীয় সম্প্রদায় ও তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী বিবেচনা করা হয়েছে।

রাজনৈতিক বিভিন্ন দল এবং তাদের নেতাদের সরাসরি উল্লেখ থাকা কনটেন্টগুলোর মনোভাব বিশ্লেষণে প্রচারণাগুলো তাদের কীভাবে চিত্রায়িত করছে, এর ভিত্তিতে তাদের ইতিবাচক, নেতিবাচক বা নিরপেক্ষ হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে।

আরো কিছু লেখা