পার্থ প্রতীম দাস

এনগেজমেন্ট অ্যান্ড আউটরিচ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

তৌহিদুল ইসলাম রাসো

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব
ডিসেম্বর ২, ২০২৫
১৭:০৮:৫৪
আওয়ামী লীগের সমালোচনা করলে ফেসবুকে হামলে পড়ছে সংঘবদ্ধ নেটওয়ার্ক

আওয়ামী লীগপন্থী নেটওয়ার্কের রিভিউ বম্বিং

আওয়ামী লীগের সমালোচনা করলে ফেসবুকে হামলে পড়ছে সংঘবদ্ধ নেটওয়ার্ক

ডিসেম্বর ২, ২০২৫
১৭:০৮:৫৪

পার্থ প্রতীম দাস

এনগেজমেন্ট অ্যান্ড আউটরিচ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

তৌহিদুল ইসলাম রাসো

রিসার্চ অফিসার, ডিসমিসল্যাব

সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে হাজারেরও বেশি অ্যাকাউন্টের একটি সংঘবদ্ধ নেটওয়ার্কের সন্ধান পাওয়া গেছে। সাংবাদিক, সংবাদমাধ্যম, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে সমন্বিত রিভিউ আক্রমণ চালানো হচ্ছে এই নেটওয়ার্ক থেকে। ফেসবুকের “রিভিউ” টুল ব্যবহার করে সমালোচকদের সুনামহানি কিংবা সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন প্রশ্নবিদ্ধ করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে তারা। আওয়ামী লীগ বিরোধী বা দলটির কার্যক্রমের সমালোচনা করে—এমন পেজগুলোতে এসব অ্যাকাউন্ট থেকে একই ভাষায় নেতিবাচক রিভিউ দিয়ে পেজের ফেসবুক রেটিং কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ডিসমিসল্যাব ফেসবুকের ১,১১৮টি পেজে দেওয়া ৬২,৫২৯টি রিভিউ বিশ্লেষণ করে দেখেছে এই নেটওয়ার্ক কীভাবে কাজ করে, কারা ওদের লক্ষ্যবস্তু এবং কীভাবে একই ধরনের ভাষ্য দিয়ে খুব অল্প সময়ে পেজগুলোতে আক্রমণ চালায়।

২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই নেটওয়ার্ক অন্তত ৭২১টি পেজকে লক্ষ্য করে রিভিউ আক্রমণ চালায়, যেসবের মধ্যে ছিল সংবাদমাধ্যম, অধিকার কর্মী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের পেজ। এসব পেজের বিরুদ্ধে “ভুয়া তথ্য”, “সন্ত্রাসবাদ” বা “সামাজিক ক্ষতি” ছড়ানোর অভিযোগ তোলে তারা। একই অ্যাকাউন্টগুলো আবার বেশ কিছু আওয়ামী লীগের সমর্থক পেজে ইতিবাচক রিভিউ দিয়েছে। এছাড়া ভারতের কয়েকটি গণমাধ্যমের পেজ এবং ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) এক নেতার ফেসবুক প্রোফাইলেও ইতিবাচক রিভিউ দিয়েছে। অর্থাৎ, সংঘবদ্ধ এই রিভিউয়ের মাধ্যমে তারা এক পক্ষের যেমন প্রশংসা করেছে, তেমনি অন্য পক্ষের অবমূল্যায়ন করেছে।

রিভিউ বম্বিংয়ের মূল লক্ষ্য ছিল সমালোচনামূলক কণ্ঠকে দমন করা। যেমন, সংবাদমাধ্যম “ঢাকা স্ট্রিম” ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নেতিবাচক রিভিউ আক্রমণের শিকার হয়। স্বাধীন মিডিয়া সংস্থা “দৃক”-ও আক্রমণের মুখে পড়ে। জুলাই–আগস্টের গণঅভ্যুত্থান নিয়ে আয়োজিত প্রদর্শনীর ছবি পোস্ট করার পরপর প্রতিষ্ঠানটির পেজে নেতিবাচক মন্তব্য আসতে থাকে।

ডিসমিসল্যাবও একইভাবে লক্ষ্যবস্তু হয়। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেত্রী ড. তাসনিম জারার বিরুদ্ধে অনলাইন হয়রানি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই এই আক্রমণের শিকার হয় ডিসমিসল্যাব। আক্রমণের ধরনও ছিল একই: দুই থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে একই ভাষ্যের মন্তব্যের বিস্ফোরণ, এবং একাধিক পেজে হুবহু একই লেখায় রিভিউ দেওয়া।

এমন নেতিবাচক রিভিউয়ের ঘটনাকে “অনলাইন মব” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন গণমাধ্যম বিশ্লেষকেরা। তাদের মতে, এগুলো কোনো পেজ সম্পর্কে জনমতকে প্রভাবিত করতে পারে। কারণ এখন অনলাইনে ব্যবহারকারীরা সঠিক তথ্যের চেয়ে গুরুত্ব দেয় প্রথমে দেখা তথ্যকে, তাই এমন নেতিবাচক রিভিউ কোনো একটি পেজ নিয়ে ব্যবহারকারীদের মধ্যে অবিশ্বাসের জায়গা তৈরি করতে পারে।

ডিসমিসল্যাবের পেজে রিভিউ বম্বিং

ফেসবুকে রিভিউ বম্বিং বলতে সাধারণত কোনো পেজের রেকমেন্ডেশন বা রিভিউ অংশে একযোগে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নেতিবাচক মন্তব্য বা রেটিং দেওয়াকে বোঝায়, যার উদ্দেশ্যই থাকে সেই পেজ বা প্রতিষ্ঠানের সুনামকে ক্ষতিগ্রস্ত করা। স্বাভাবিকভাবে ব্যক্তিগত সমালোচনা নতুন কিছু নয়। কেউ কোনো প্রতিবেদন অপছন্দ করতে পারে, কেউ আবার কোনো প্রকাশকের সঙ্গে দ্বিমতও পোষণ করতে পারে। তবে যখন খুব অল্প সময়ের মধ্যে অনেক নেতিবাচক রিভিউ আসতে থাকে এবং বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে একই ধরনের রিভিউ মন্তব্য দেখা যায়, তখন বোঝা যায় বিষয়টি সাধারণ কোনো ঘটনা নয়; বরং এর পেছনে রয়েছে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা।

ডিসমিসল্যাবের ফেসবুক পেজে রিভিউ বম্বিং শুরু হয় চলতি বছরের ২ অক্টোবর থেকে। তার ঠিক আগেই জাতীয় নাগরিক পার্টির নেত্রী তাসনিম জারা কীভাবে অনলাইনে হয়রানির শিকার হচ্ছেন– সে সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ডিসমিসল্যাব। প্রথম নেতিবাচক রিভিউটি আসে চক্রপতি অরপিতা নামের একটি প্রোফাইল থেকে (পরে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় “Orpita Chakroborthy”)। সেখানে লেখা, “গুজব ও তথ্যস-ন্ত্রা-সের পক্ষে  কাজ করা বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠান “ডিসমিস ল্যাব”কে এই দায়িত্বশীল ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ জানাই না।”

কয়েক মিনিটের মধ্যেই অন্য ব্যবহারকারীরা প্রায় একই লেখা দিয়ে রিভিউ করতে শুরু করেন। পরের দিন, ৩ অক্টোবর সকাল ৭টা থেকে ৯টার মধ্যে এই সংঘবদ্ধ রিভিউয়ের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। মাত্র দুই ঘণ্টায় ৪৮টি নেতিবাচক রিভিউ করতে দেখা যায়; কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে বেশকিছু রিভিউ করা হয়। কিছু রিভিউতে আবার #স্টপপ্রোপাগান্ডা (#StopPropaganda) বা #প্রোটেক্টহিস্ট্রি (#ProtectHistory) এর মতো হ্যাশট্যাগ দেখা যায়, যা পুরো ঘটনাটিকে আরও সংঘবদ্ধ আক্রমণের দিকে ইঙ্গিত করে।

তিন দিনের মধ্যে মোট ৬০টি প্রোফাইল থেকে ডিসমিসল্যাবের পেজে নেতিবাচক রিভিউ দেওয়া হয়; যার সঙ্গে ছিল একটি করে মন্তব্য। তবে বিশ্লেষণে দেখা যায়, নেতিবাচক রিভিউয়ে লেখা মন্তব্যে ছিল মূলত ২৩টি বার্তা, যেগুলো বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে বারবার ব্যবহার করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশিবার লেখা বার্তাটি ছিল ইংরেজিতে যার হুবহু বাংলা করলে অর্থ দাড়ায়, “শুধু কথা নয়—তারা ক্ষতির উসকানি দেয়: ভুয়া খবর, ভাঙচুরের বর্ণনা আর সামাজিক ক্ষতি।” মোট ১১টি প্রোফাইল থেকে এই একই লেখাযুক্ত মন্তব্য পোস্ট করতে দেখা যায়। পরবর্তীতে এই ৬০টি প্রোফাইল যত রিভিউ দিয়েছে, তা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডিসমিসল্যাবের পেজে করা ২৩টি বার্তা আরও ৩১৫টি পেজের নেতিবাচক রিভিউয়ে ব্যবহার করা হয়েছে, মোট ১,৪৭৩ বার।

আক্রমণটি কারা পরিচালনা করেছে তা শনাক্ত করতে ডিসমিসল্যাব রিভিউগুলোর পেছনে থাকা ৬০টি অ্যাকাউন্ট পর্যালোচনা করে। অ্যাকাউন্টগুলোর নাম ছিল বিভিন্ন ধাঁচের। কিছু প্রোফাইল দেখা গেছে ব্যক্তিগত পরিচয়ে—যেমন শেখ রাসেল (Sheikh Rasel), অসীম সূত্রধর, নীল (Neel), নিরা নিরা (Nira Nira), ঈমাদ বিন রোহান বা হায়দার আহমদ (Haidar Ahmad)। কোনোগুলোতে আবার সরাসরি রাজনৈতিক দলের নাম ব্যবহার করতে দেখা গেছে—যেমন, বিএনপি মানে বিনোদন (BNP মানে বিনোদন), এনসিপি = ন্যাশন্যাল চান্দাবাজ পার্টি (NCP = National Chandabaz Party), ১৯৭১ to ২০২৪: রাজাকার–লালবাদার, বা শেখ রাসেল ৭১/৭৫ (Sheikh Rasel 71/75)।

অন্তত ১৯টি অ্যাকাউন্টের নাম ছিল বিভিন্ন খাবার বা মসলাজাত পণ্যের নামে: রুটি বার্গার (Roti Burger), ট্রপিক মেয়োনেজ (Tropic Mayonnaise), সসেজ (Sosej), সস সালাদ (Sos Salad), মাশরুম স্যুপ (Mushrooms Soup), চিকেন স্লাইস (Chicken Slice), হট অ্যান্ড স্পাইসি (Hot & Spicy), মেয়ো বেস্ট (Mayo Best), ব্ল্যাক পেপার (Black Pepar), সুইস বেয়ার চিজ (Swiss Bear Cheese) ইত্যাদি। এদের মধ্যে ১৩টি পেজ তৈরি হয়েছে মাত্র দুই দিনে—চলতি বছরের ৩১ মে ও ১ জুন। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে একসঙ্গে বিভিন্ন পেজে ৩ হাজারেরও বেশি রিভিউ পোস্ট করা হয়েছে, যার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে একই ধরনের লেখার পুনরাবৃত্তি।

আওয়ামী লীগপন্থী নেটওয়ার্কের রিভিউ বম্বিং: আওয়ামী লীগের সমালোচনা করলে ফেসবুকে হামলে পড়ছে সংঘবদ্ধ নেটওয়ার্ক
ডিসমিসল্যাবের ফেসবুক পেজে বিভিন্ন খাবার ও মশলার নামযুক্ত অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া নেতিবাচক রিভিউয়ের স্ক্রিনশট।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ডিসমিসল্যাবে আক্রমণ চালানো ৬০টি অ্যাকাউন্টের মধ্যে ৩৬টি অ্যাকাউন্ট রগ পরিচর্যা কেন্দ্র নামের একটি ফেসবুক পেজে ইতিবাচক রিভিউও দিয়েছে। ব্যঙ্গ বা প্যারোডি পেজ হিসেবে পরিচয় দিলেও, বিশ্লেষণে দেখা গেছে এই পেজ থেকে করা পোস্টগুলো নিয়মিতভাবে আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছে এবং প্রতিপক্ষ দলগুলোকে ব্যঙ্গ করেছে। এক বর্ষপূর্তি পোস্টে বলা হয়, কীভাবে পেজটির উদ্দেশ্য বদলে গেছে: শুরুতে যা ছিল ব্যঙ্গাত্মক পেজ, তা ৫ আগস্ট ২০২৪ এর পর থেকে অনুসারীদের “মিম দিয়ে কীভাবে অনলাইনে লড়াই করতে হবে” তা শেখানোর দিকে ঝুঁকে পড়ে। পোস্টটির ভাষ্য ইঙ্গিত দেয়, হাসিও এক ধরনের প্রতিরোধের অস্ত্র।

৬০টি প্রোফাইল থেকে এক হাজারেরও বেশি আক্রমণকারীর নেটওয়ার্কে

যা দেখা হয়েছেনির্ধারিত সীমাফলাফল (অ্যাকাউন্ট)ব্যাখ্যা
পেজে রিভিউ দেওয়ার ধরন২৩টি স্বতন্ত্র রিভিউ মন্তব্য২৭৮প্রধান রিভিউয়ার
কমেন্ট করার হার১০টির বেশি কমেন্ট~৬০০বেশি সক্রিয় অ্যাকাউন্ট
কমেন্ট করার হারছয়টির বেশি কমেন্ট~১,১৫০ মাঝারি সক্রিয় গ্রুপ
একই মন্তব্য বারবার করা হয়েছেএকই রিভিউ মন্তব্য ১০ বারের বেশি১,০১৯সমন্বিতভাবে একই মন্তব্য করা হয়

গবেষকেরা যখন ডিসমিসল্যাবের পেজে আক্রমণের ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন তখন প্রাথমিকভাবে এই নেটওয়ার্কের আকার ছিল ছোট। একই ধরনের ২৩টি রিভিউ বার্তার ক্লাস্টার থেকে ২৭৮টি অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করা হয়। সংখ্যাগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এটি এর মূল পরিসর বা গভীরতা বোঝার মতো বড় নয়। গবেষকদের এই পর্যবেক্ষণই আরও বিস্তৃত বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা তৈরি করে।

৬০টি মূল অ্যাকাউন্টের সূত্র ধরে ১,১১৮টি পেজ থেকে সংগৃহীত মোট ৬২,৫২৯টি মন্তব্যের পূর্ণ ডেটাসেট ব্যবহার করে গবেষক দল ভাষাগত ধরন বিশ্লেষণ থেকে আচরণগত সাদৃশ্যের দিকে নজর দেয়। প্রথমে রিভিউ করা অ্যাকাউন্টগুলো সক্রিয়তা অনুসারে সাজানো হয়, এবং যারা দশটির কম রিভিউ দিয়েছে তাদের বাদ দেওয়া হয়। এই কঠোর মানদণ্ডে প্রায় ৬০০টি অ্যাকাউন্ট পাওয়া যায়, যেগুলো থেকে নিয়মিত রিভিউ করতে দেখা যায়। যখন মানদণ্ড শিথিল করে পাঁচটির বেশি রিভিউ দেওয়া অ্যাকাউন্টগুলোকেও নেওয়া হয়, তখন নেটওয়ার্কের সম্ভাব্য পরিসর বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ১,১৫০ অ্যাকাউন্টে দাঁড়ায়—যা মধ্যমমাত্রার সক্রিয় অংশগ্রহণকারীদের দ্বিতীয় স্তর নির্দেশ করে।

সংঘবদ্ধ নেটওয়ার্ক কাজ করছে কি না তা অনুসন্ধানে ডেটাসেটটি পরে এমনভাবে ফিল্টার করা হয়, যাতে কেবল সেই লেখাগুলো রাখা হয় যেগুলো অন্তত দশবার বা তার বেশি দেখা গেছে। দশের চেয়ে কম রিভিউয়ে থাকা মন্তব্যগুলো এরপর বাদ দেওয়া হয়। এতে মোট ১,০১৯টি অ্যাকাউন্টের একটি তালিকা পাওয়া যায়, যারা হুবহু একই বার্তা কপি–পেস্ট করেছে। এটি কোনো সাধারণ বা কাকতালীয় বিষয় হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম।

এই ১,০১৯ অ্যাকাউন্ট থেকে ১৩ হাজারেরও বেশি রিভিউ পোস্ট করা হয়েছে। এর প্রায় ৯৪ শতাংশই ছিল আওয়ামী লীগপন্থী বার্তা। আবার মোট মন্তব্যের পাঁচটির মধ্যে চারটি ছিল সাংবাদিক, গণমাধ্যম, অধিকার কর্মী, নাগরিক সমাজের গ্রুপ ও রাজনৈতিক বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক আক্রমণের। প্রায় ১৬ শতাংশ মন্তব্যে প্রশংসা করা হয়েছে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ পেজ বা দলটির কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করে এমন পেজকে।

দেখা গেছে, এ বছরের মার্চ থেকে অক্টোবরের মধ্যে একই বার্তাযুক্ত রিভিউ করেছেন ২১৫ জন ব্যবহারকারী; মোট ৯৩০ বার। ইংরেজিতে লেখা সেই বার্তাটি ছিল, “এই পেজটি মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে এবং সন্ত্রাসবাদকে উৎসাহ দিচ্ছে। মেটার এটি সরিয়ে দেওয়া উচিত।” অন্য মন্তব্যগুলোতে বিভিন্ন পেজকে ঘৃণাবিদ্বেষ কিংবা প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানো, মিথ্যা তথ্য দেওয়া বা “দেশদ্রোহীদের গৌরবান্বিত করা”র অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব মন্তব্যের অনেকগুলোতেই পেজটি মেটা থেকে পুরোপুরি সরিয়ে দেওয়ার আহ্বান ছিল।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, আওয়ামী লীগপন্থী অ্যাকাউন্টগুলোর রিভিউ বম্বিং কার্যক্রম শুরু হয় ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে। সেসময় বিভিন্ন পেজে প্রায় ৩৫৮টি নেতিবাচক রিভিউ করেছিল তারা। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বছরজুড়ে এই আক্রমণের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। সেপ্টেম্বর নাগাদ মাসিক মন্তব্যের সংখ্যা প্রায় সাত গুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২,৪৬৫টিতে। এই প্রবণতা অক্টোবরেও অব্যাহত ছিল। গবেষণা চলাকালে ডেটাসেটে থাকা বেশ কিছু অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যায় বা ফেসবুক থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে ধারনা করা হয়।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ২৪ জন ব্যবহারকারী বিভিন্ন পেজে আওয়ামী লীগ বিরোধী রিভিউ পোস্ট করেছে। আর অন্য পেজগুলোতে ৬১২টি টি রিভিউ মন্তব্য খুঁজে পাওয়া গেছে যেগুলো নিরপেক্ষ বলে প্রতীয়মান হয়েছে এবং সংঘবদ্ধ চক্রের কোনো সম্পর্ক দেখা যায়নি।

নেটওয়ার্কের লক্ষ্য কারা?

  • আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গেলে ফেসবুকে রিভিউ হামলা করা হচ্ছে
  • আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গেলে ফেসবুকে রিভিউ হামলা করা হচ্ছে

সংঘবদ্ধ নেটওয়ার্কের এই চক্রটি কীভাবে কাজ করে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় সংবাদমাধ্যম ঢাকা স্ট্রিমের ফেসবুক পেজে রিভিউয়ের ঘটনাটি। প্রতিষ্ঠানটি গত ১৭ সেপ্টেম্বর ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা একটি হিন্দু পরিবারের কাছ থেকে জোরপূর্বক জমি কিনেছেন অভিযোগে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনটি শেয়ার করার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই তাদের ফেসবুক পেজে সন্ধ্যা ৫:৫৫ থেকে ৬:৩৬ মিনিটের মধ্যে ৩০টি নেতিবাচক রিভিউ করা হয়। সবগুলো রিভিউয়ের ভাষ্য ও শব্দচয়ন ছিল অভিন্ন। পরবর্তীতে আউটলেটটি তাদের রিভিউ সেকশনটি বন্ধ করে দেয়।

কারণ জানতে চাইলে সংবাদমাধ্যমটির সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ের ডেপুটি ম্যানেজার উচ্ছাস খান জানান, শেখ হাসিনার জোরপূর্বক জমি কেনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই তাদের পেজে নেতিবাচক রিভিউয়ের ঢল নামে। ঘটনাটিকে অনলাইন হয়রানির একটি রূপ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, “শুধু যে আমাদের পেজকে ভুয়া খবর বা প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর অভিযোগে ভরিয়ে দেওয়া হয়েছে তা নয়, আমাদের সহকর্মীদের ব্যক্তিগত ছবি ও পরিবারের তথ্যও নেতিবাচক রিভিউয়ের সঙ্গে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের আক্রমণ ঠেকাতে আমরা রিভিউ ফিচারটি বন্ধ করে দিই।”

আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গেলে ফেসবুকে রিভিউ হামলা করা হচ্ছে
শেখ হাসিনার জোরপূর্বক জমি কেনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই ঢাকা স্ট্রিমের ফেসবুক পেজে আসা নেতিবাচক রিভিউয়ের স্ক্রিনশট।

আরেক মিডিয়া প্রতিষ্ঠান “দৃক”–ও একই ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে। পুরস্কারপ্রাপ্ত এই প্রতিষ্ঠানটি দুই ধাপে সংঘবদ্ধ রিভিউ বম্বিংয়ের শিকার হয়। প্রথম দফায় গত ১৯–২০ এপ্রিলে; প্রেস ফটো কনটেস্ট প্রদর্শনীতে জুলাই–আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের ছবি প্রকাশের পর। আর দ্বিতীয় দফায় গত ৯–১০ অক্টোবর, প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল আলমের গাজা ফ্রিডম ফ্লোটিলায় অংশ নেওয়া ও আটক হওয়া পোস্ট করার পর। দুই ক্ষেত্রেই রিভিউগুলো আসে গুচ্ছ আকারে, এবং প্রায় একই ভাষা ব্যবহার করা হয়। প্রসঙ্গত, শহিদুল আলম দীর্ঘদিন ধরেই শেখ হাসিনার সমালোচক এবং তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা জুলাই–আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ২০১৮ সালেও হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে “প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানোর” অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাঁকে।

যমুনা টিভি, দৈনিক আমার দেশ, স্টার নিউজ ও এসএ টিভি নিউজসহ আরও কয়েকটি সংবাদমাধ্যমও একই ধরনের আক্রমণের শিকার হয়েছে। যমুনা টিভির পেজে করা এক রিভিউতে চ্যানেলটিকে “জঙ্গিবাদে উৎসাহ দেওয়া” এবং “৩ হাজারের বেশি পুলিশ হত্যায় জড়িত” থাকার অভিযোগ তোলা হয়। একই মন্তব্য ৩ ফেব্রুয়ারি রাত ২টা ৪৪ মিনিট থেকে ৩টা ৩০ মিনিটের মধ্যে ৩০ বার পোস্ট করা হয়।

সংবাদমাধ্যম প্রথম আলোর লাইফস্টাইল পেজ “হাল ফ্যাশন”ও রিভিউ আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছে। ২ অক্টোবর রাত ৯টা ১৮ থেকে ১১টা ২০ এর মধ্যে পেজটিতে হুবহু একই ভাষার ২৪টি বাংলা রিভিউ আসে, যেখানে পত্রিকার সম্পাদককে ব্যঙ্গ করা হয় এবং বয়কটের আহ্বান জানানো হয়। এর আগেও জুলাইয়ের শেষ ভাগ ও আগস্টের শেষ দিকে এসএ টিভি ও স্টার টিভির পেজেও একই ধরনের রিভিউ আক্রমণ দেখা গেছে।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সংশ্লিষ্ট পেজও একটি বড় লক্ষ্যবস্তু হিসেবে পরিণত হয়েছে। বিএনপি মিডিয়া সেল গত ৭ জানুয়ারি ৪১টি এবং ৫ আগস্ট আরও ২৫টি নেতিবাচক রিভিউয়ের শিকার হয়। জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির–সম্পৃক্ত পেজগুলোও আক্রমণের মুখে পড়ে। এর পাশাপাশি রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ও তাদের প্রকাশনা সংস্থা রাষ্ট্রচিন্তা প্রকাশনীর সঙ্গে যুক্ত ছয়টি পেজে ৩১ আগস্ট সংঘবদ্ধ নেতিবাচক রিভিউ পোস্ট করা হয়।

রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ববি হাজ্জাজ (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট), ইমরান ইমন (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদের রাশেদ খান ও ফারুক হাসান, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, রাজনৈতিক বিশ্লেষক সলিমুল্লাহ খান, মোস্তফা ফিরোজ, জাহেদ উর রহমান এবং সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন ব্যক্তির পেজে নেতিবাচক রিভিউ দেওয়া হয়েছে। এদের অনেকেই কোনো না কোনো সময় আওয়ামী লীগকে সমালোচনা করেছেন বা দলটির বিভিন্ন ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন।

আওয়ামী লীগপন্থী নেটওয়ার্কের রিভিউ বম্বিং, আওয়ামী লীগের সমালোচনা করলে ফেসবুকে হামলে পড়ছে সংঘবদ্ধ নেটওয়ার্ক
বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিশ্লেষক ও সাংবাদিকদের ফেসবুক পেজে আসা নেতিবাচক রিভিউয়ের স্ক্রিনশট।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও এ ধরনের আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি), বাংলাদেশ পুলিশ এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও সমন্বিত নেতিবাচক রিভিউয়ের লক্ষ্য হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ফাউন্ডেশন, গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সংগঠন “মায়ের ডাক”–এর পেজেও একই ধরনের আক্রমণ চালানো হয়েছে।

প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও অনলাইন বইয়ের দোকান—ঐতিহ্য, আহসান পাবলিকেশন, রকমারি, বুক ক্যাফে ও বিদ্যানবিডি—সবগুলোতেই একই ধরনের গুচ্ছ আকারে নেতিবাচক রিভিউ দেখা গেছে। পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটসহ বেশ কিছু সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের নামও ডেটাসেটে উঠে এসেছে। অনলাইনে বই বিক্রির ওয়েবসাইট রকমারির রাজনৈতিক ও ইতিহাস–বিষয়ক বইয়ের পেজে একই মন্তব্যসহ ৩০টি রিভিউ পাওয়া গেছে, যেখানে লেখা: “ বইগুলোর বাহ্যিক রূপ দেখে কিনবেন না। বইগুলো খুব বাজে লেখা আর খারাপভাবে ছাপা।”

ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ এবং পাকিস্তান হাইকমিশন বাংলাদেশের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজেও একই নেটওয়ার্ক থেকে নেতিবাচক রিভিউ করতে দেখা গেছে। এসব রিভিউতে অশালীন ভাষা ব্যবহার করে দূতাবাসগুলোকে “সন্ত্রাসবাদে উৎসাহ দেওয়ার” অভিযোগ তোলা হয়েছে।

গবেষকেরা ১,০১৯টি অ্যাকাউন্টের প্রত্যেকটির পোস্টিং আচরণ পর্যালোচনা করেছেন। ব্যবহারকারীদের প্রোফাইলে শেয়ার করা পোস্ট ও তাদের সম্পৃক্ততার ধরন বিশ্লেষণ করে আওয়ামী লীগ সমর্থনের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়।

একই নেটওয়ার্ক আবার প্রশংসাসূচক পোস্টও করে থাকে

যে প্রোফাইলগুলো থেকে গণমাধ্যম ও সমালোচকদের আক্রমণ করতে দেখা গেছে, তারাই আবার পছন্দের পেজগুলোতে ইতিবাচক রিভিউ পোস্ট করেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একই ধরনের ভাষা কপি-পেস্ট করে। মোট ১৬৫টি পেজে ৯৭টি স্বতন্ত্র ইতিবাচক রিভিউ মন্তব্য ২,০৮৬ বার দেখা গেছে।

এসব রিভিউ–মন্তব্যের বেশির ভাগই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে প্রশংসা করেছে বা তাদের রাজনৈতিক বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেছে। বেশকিছুতে দলীয় নেতাদের প্রশংসা করা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার বা বিরোধী দলগুলোকে সমালোচনা করা হয়েছে, এবং “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু” এর মতো পরিচিত স্লোগান ব্যবহার করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এসব পেজকে “দেশপ্রেমিক”, “বাংলাদেশের রক্ষক” বা “ন্যায়বিচারের আন্দোলনের অংশ” বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সমালোচনা করলে ফেসবুকে হামলে পড়ছে সংঘবদ্ধ নেটওয়ার্ক
একই ব্যবহারকারীদের দুই ধরনের রিভিউয়ের স্ক্রিনশট: ভারতীয় গণমাধ্যমের পেজে ইতিবাচক, আর বাংলাদেশের গণমাধ্যম পেজে নেতিবাচক মন্তব্য।

একই অ্যাকাউন্টগুলো কাউকে প্রশংসিত করতে বা কারও সুনামহানি করতে— কখনো ইতিবাচক বা কখনো নেতিবাচক রিভিউ দিয়েছে। ‘চক্রপতি অর্পিতা’ নামের একটি প্রোফাইল, যা পরে নাম বদলে হয় ‘অর্পিতা চক্রবর্তী’, ঢাকার কয়েকটি গণমাধ্যম পেজে সমালোচনামূলক রিভিউ দিলেও কলকাতাভিত্তিক এবিপি আনন্দ ও রিপাবলিক বাংলা–তে দিয়েছে ইতিবাচক রিভিউ। এবিপি আনন্দের পেজে অর্পিতা লিখেছে: “এটি একটি নিরপেক্ষ পেজ, যারা সব সময় সঠিক খবর দেয়। তিনি লড়াকু সাংবাদিক—অনেক বাধা পেরিয়ে সত্য খবর তুলে আনেন, আমাদের খুব উপকার করে।”

ভারতভিত্তিক আরেক গণমাধ্যম জি ২৪ ঘণ্টার পেজে ১৭ জুলাই ছয়টি প্রোফাইল হুবহু একই রিভিউ পোস্ট করে। প্রোফাইলের মধ্যে ছিল– শেখ রাসেল (Sheikh Rasel, সসেজ (Sosej) ও শ্রেয়া ইসলাম (Sreya Islam)। রিভিউতে লেখা ছিল: “সব খবর ও সত্যের জন্য শক্তিশালী একটি পেজ — Zee 24 Ghanta।” এই প্রোফাইলগুলো থেকে আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম পেজে নেতিবাচক রিভিউ দেওয়া হয়েছে।

এই অ্যাকাউন্টগুলোর কয়েকটি পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি নেতা রজত মুখার্জির ফেসবুক পেজেও ইতিবাচক রিভিউ পোস্ট করেছে। সেখানে বারবার ব্যবহৃত এক মন্তব্যে তাকে “বাংলাদেশের সত্যিকারের বন্ধু” বলে উল্লেখ করা হয় এবং “রাষ্ট্রবিরোধী প্রোপাগাণ্ডা” এর বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানকে প্রশংসা করা হয়।

আছে একটি ছোট আওয়ামী লীগ-বিরোধী নেটওয়ার্কও

পরিসর ছোট হলেও বিভিন্ন পেজে প্রায় একই কায়দায় ইতিবাচক ও নেতিবাচক রিভিউ দেওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে আওয়ামী লীগের বিরোধীপক্ষের দিক থেকেও। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগবিরোধী এমন ২৪টি প্রোফাইল ৩৩টি পেজে মোট ২৫০ বার সাত ধরনের নেতিবাচক রিভিউ–মন্তব্য পোস্ট করেছে, যেগুলোর প্রতিটি ১০ বারের বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। কিছু মন্তব্যে আওয়ামী লীগকে “গুজব লীগ” বা “নাস্তিক লীগ” এমন তকমা দেওয়া হয়েছে।

এই প্রোফাইলগুলো আবার নির্দিষ্ট কিছু পেজে ইতিবাচক রিভিউও দিয়েছে এবং সেখানে তথাকথিত “বট লীগ” এর রিভিউ বম্বিং সম্পর্কে সতর্ক করেছে। “আবু সাঈদ, মুগ্ধ। শেষ হয়নি যুদ্ধ” এবং “ইনকিলাব জিন্দাবাদ – Inquilab Jindabad” এর মতো পেজে ইতিবাচক রিভিউতে বার্তা ছিল: “চমৎকার পেজ, তবে রিভিউ অপশন বন্ধ করুন না হলে বট লীগ ভুয়া রিভিউ দিয়ে নষ্ট করবে” বা “রিভিউ অপশন বন্ধ করে দিন—না হলে কান্নাকাটি করা বট বাহিনী পেজের রিচ নষ্ট করে দেবে।”

আওয়ামী লীগের সমালোচনা করলে ফেসবুকে হামলে পড়ছে সংঘবদ্ধ নেটওয়ার্ক
আওয়ামী লীগ বিরোধী পেজ-প্রোফাইল থেকেও একই ধরনের সংঘবদ্ধ রিভিউ বম্বিং দেখা গেছে।

এ ক্ষেত্রেও কাছাকাছি সময়ে রিভিউ করার প্রবণতা স্পষ্ট ছিল। ১৭ জুলাই, আওয়ামী লীগের সমর্থক ২১টি ফেসবুক পেজে একই দিনে ৯৯টি নেতিবাচক রিভিউ পোস্ট করা হয়। ২০ জুন একই কৌশল ব্যবহার করে ৬০টি নেতিবাচক রিভিউ দেওয়া হয়। ‘বেঙ্গল এম্পায়ার ৭১’ পেজে সেদিন বিকেল ৩টা ০৫ থেকে ৪টা ৫৫–এর মধ্যে ১৪টি নেতিবাচক রিভিউ আসে। অন্যদিকে সাতটি পেজে দুই ঘণ্টার মধ্যে ৪৯টি রিভিউ পোস্ট করা হয়। ১৭ জুলাই আবারও ১২টি পেজে ৬৮টি নেতিবাচক রিভিউ দেখা যায় দুই ধাপে: প্রথম ধাপ বিকেল ৩টা ০৯ থেকে ৩টা ৩৫ পর্যন্ত, আর দ্বিতীয় ধাপ সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত।

এই ‘মিরর নেটওয়ার্কটি’ আকারে ছোট এবং তুলনামূলকভাবে কম সংঘবদ্ধ বলে মনে হলেও, এর প্রকৃত বিস্তার জানতে আরও গবেষণা প্রয়োজন—কারণ বর্তমান ডেটাসেটটি মূলত ডিসমিসল্যাবের বিরুদ্ধে পরিচালিত আক্রমণ অনুসরণ করেই নির্মিত।

রিভিউ বম্বিংয়ের প্রভাব

সাধারণ ব্যবহারকারীরা একটি ফেসবুক পেজকে কীভাবে দেখা হবে তার ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে সংঘবদ্ধ রিভিউ আক্রমণের ঘটনা। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ডজন–ডজন একই ধরনের রিভিউ এলে ফেসবুকের ইন্টারফেস সেগুলোকে প্রকৃত জনমত হিসেবে উপস্থাপন করে। আক্রমণের শিকার পেজগুলোর “রেকমেন্ডেড” রেটিং হঠাৎ কমে যায়, ফলে নতুন ব্যবহারকারীদের কাছে সেগুলো কম বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়। এই ডেটাসেটে দেখা কয়েকটি পেজ আক্রমণের পর রিভিউ ফিচার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে, যা সাধারণত কোনো প্রতিষ্ঠানের আস্থা গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়।

বাংলাদেশের আরেক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান ফ্যাক্টওয়াচও একই ধরনের সংঘবদ্ধ রিভিউ আক্রমণের শিকার হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এবং ইউল্যাবের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. সুমন রহমান ডিসমিসল্যাবকে জানান, হঠাৎ করে একরকমের বিপুল নেতিবাচক রিভিউ আসা “এক ধরনের অনলাইন মব” তৈরি করে, যা সাধারণ ব্যবহারকারীদের পেজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে নিরুৎসাহিত করে।

তিনি বলেন, এসব রিভিউয়ের উদ্দেশ্য স্পষ্ট: “মূল লক্ষ্যই হলো অবিশ্বাস তৈরি করা। প্রথমে দেখা কোনো তথ্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আর অনেকে তথ্য যাচাই না করেই কোনো পেজ নিয়ে প্রথম দেখাতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।” ড. রহমান আরও বলেন, “এর প্রভাব অনেকটাই নির্ভর করে মিডিয়া সাক্ষরতার ওপর: যাদের মিডিয়া লিটারেসি বেশি, তারা উপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু বড় একটি ব্যবহারকারী গোষ্ঠী তা পারে না; তারা নেতিবাচক রিভিউ দেখেই ধারণা তৈরি করে ফেলে।”

মেটার কমিউনিটি ফিডব্যাক পলিসি অনুযায়ী, রিভিউ অবশ্যই বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে হতে হবে এবং রেটিং বা রেকমেন্ডেশনকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা নিষিদ্ধ। ভুল তথ্য, আক্রমণাত্মক ভাষা, হয়রানি বা কৃত্রিমভাবে স্কোর কমিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে করা রিভিউও নীতিমালা লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হয়।

মেটার কোঅর্ডিনেটেড ইনঅথেন্টিক বিহেভিয়ার (সিআইবি) কাঠামোর অধীনে, অনেকগুলো অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে পরিচিতি, উদ্দেশ্য বা কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ব্যবহারকারীদের বিভ্রান্ত করা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। তবে গবেষণায় বিশ্লেষণ করা বেশ কয়েকটি পেজে দেখা গেছে, মিনিটের ব্যবধানে, একই ভাষায় পোস্ট হওয়া নেতিবাচক রিভিউগুলো দৃশ্যমানই রয়ে গেছে। মেটা এগুলোকে নীতিমালা লঙ্ঘন হিসেবে দেখবে কি না, তা নির্ভর করে উদ্দেশ্য, সংঘবদ্ধ আক্রমণের প্রমাণ এবং রিপোর্টের পরিমাণের ওপর।

গবেষণা পদ্ধতি

ডিসমিসল্যাব অক্টোবর মাসে নিজেদের ফেসবুক পেজে পোস্ট করা সমস্ত রিভিউ সংগ্রহ করে। ৬০টি প্রোফাইল পাওয়া যায়, যাদের প্রত্যেকে ১টি করে মোট ৬০টি নেতিবাচক রিভিউ পোস্ট করেছে। এরপর গবেষকরা এই ৬০টি প্রোফাইলের “রিভিউস গিভেন” অপশন দেখে, তারা আর কোথায় রিভিউ করেছে তা সংগ্রহ করেছে। এই তথ্য থেকে একটি ডেটাসেট তৈরি হয়, যেখানে প্রতিটি পেজ, প্রতিটি প্রোফাইলের পোস্ট করা রিভিউ, ব্যবহৃত ভাষা এবং সেই ভাষার পুনরাবৃত্তির হার অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই তালিকা থেকে, যেসব পেজে রিভিউ পোস্ট করা হয়েছে, তা লিপিবদ্ধ করা হয় এবং এই অ্যাকাউন্টগুলোর মোট রিভিউ মন্তব্যের সংখ্যা গণনা করা হয়।

দ্বিতীয় পর্যায়ে, ডিসমিসল্যাব সেসব পেজ থেকে রিভিউ সংগ্রহ করে একটি বড় নেটওয়ার্কের নমুনা তৈরি করে। শুধুমাত্র সেসব পেজের ডেটা নেওয়া হয়, যেখানে রিভিউ ফিচারটি ওপেন ছিল। এসব পেজ থেকে সমস্ত রিভিউ মন্তব্য সংগ্রহ করে, সেগুলোকে ভাষার ধরন, পুনরাবৃত্তির হার এবং পোস্টিং অ্যাকাউন্টের ভিত্তিতে সূচিবদ্ধ করা হয়। এরপর মন্তব্যগুলো একত্রিত করা হয় তার স্বতন্ত্রতা অনুযায়ী – প্রথমে আলাদা রিভিউ স্ক্রিপ্ট গণনা করা হয়, তারপর সেগুলোর মধ্যে যেগুলো ১০ বার বা তার বেশি পোস্ট হয়েছে, সেগুলো আলাদা করা হয়। সাধারণ অভিবাদন ও অর্থহীন পুনরাবৃত্তি বাদ দেওয়া হয়, যাতে ডেটাসেটটি শুধুমাত্র প্রকৃত রিভিউ বিষয়বস্তু প্রতিফলিত করে। শেষে, চূড়ান্ত ডেটাসেট ব্যবহার করে পুনরাবৃত্তি, অ্যাকাউন্টগুলোর মধ্যে ওভারল্যাপ এবং ফেসবুকে একরকম রিভিউ লেখার বিস্তার পরিমাপ করা হয়।

এই বিশ্লেষণটি শুধুমাত্র যেসব মন্তব্য দেখতে পাওয়া গেছে তার ওপর ভিত্তি করে এবং নেটওয়ার্কের কার্যকলাপের শুধু দৃশ্যমান অংশটুকু প্রতিফলিত করে, অর্থাৎ নীরব দর্শক, ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং মুছে ফেলা রিভিউগুলো গবেষণা ডেটার বাইরে রয়ে গেছে। নেটওয়ার্ক আকারের অনুমানগুলো বিভিন্ন ধরনের মানদণ্ডের ওপর নির্ভরশীল — যেমন ≥৫ অথবা ≥১০ মন্তব্য প্রতি অ্যাকাউন্ট, এবং ১০ বা তার বেশি মন্তব্য–টেক্সট পুনরাবৃত্তি। বিভিন্ন ধরনের কাট-অফ নির্বাচন করলে ভিন্ন ভিন্ন আকার পাওয়া যায়। কপি-পেস্ট সনাক্তকরণে হুবহু টেক্সট ম্যাচের ওপর নির্ভর করা হয়েছে, তাই একই বার্তার পরিপ্রেক্ষিতে প্যারাফ্রেজ করা বা সামান্য পরিবর্তনের লক্ষণ কম থাকতে পারে। অতিমাত্রায় অংশগ্রহণ এবং পুনরাবৃত্ত মন্তব্য ব্যবহারকারীর আচরণের ধরণ দেখায়, কিন্তু অতিরিক্ত সময়ভিত্তিক বা ক্রস-প্ল্যাটফর্ম প্রমাণ ছাড়া এগুলো স্বাধীনভাবে সংঘবদ্ধ, উদ্দেশ্য বা সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত করতে পারে না।

আরো কিছু লেখা