ডিসমিসল্যাব
ভুয়া তথ্য ও গুজব মোকাবেলায় নাগরিক সমাজের ভূমিকা
ডিসমিসল্যাব
ভুয়া তথ্য বিরোধী বৈশ্বিক যুদ্ধে সাংবাদিকদের ভূমিকা কেমন হবে– তা নিয়ে গবেষণা কম হয়নি। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষিত করে তোলার উদ্যোগও অনেক। কিন্তু সমাজের আরেকটি প্রভাবশালী অংশ, সিভিল সোসাইটির ভূমিকা কেমন হতে পারে– তা নিয়ে আলোচনা কমই হয়েছে। ভুয়া খবরের মোকাবেলায় সিভিল সোসাইটির করণীয় কী হতে পারে– সেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন ড.জোয়ান ডোনোভান (Dr. Joan Donovan) ও তার গবেষক দল।
২০২০ সালের অক্টোবর মাসে এ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট পেশ করেন তারা। ‘HOW CIVIL SOCIETY CAN COMBAT MISINFORMATION AND HATE SPEECH WITHOUT MAKING IT WORSE’ শিরোনামের রিপোর্টিতে গবেষক দলটি ভুয়া খবর এবং হেইট স্পিচ রোধে সমাজের সুশীল সমাজের করনীয় নিয়ে আলোকপাত করেন।
হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের শোরেন্সটাইন সেন্টার অন মিডিয়া, পলিটিক্স এন্ড পাবলিক পলিসির রিসার্চ ডিরেক্টর ড. জোয়ান ডোনোভান ২০২০ সালের টেকনোলজি এন্ড সোশ্যাল চেঞ্জ (সংক্ষেপে TaSC) গবেষণা প্রজেক্টের পরিপ্রেক্ষিতে এই পরামর্শপত্রটি প্রদান করেন। তার গবেষকদল ‘মিডিয়া ম্যানিপুলেশন লাইফ সাইকেল” পদ্ধতি অনুসরণ করে ভুয়া খবর ছড়ানোর বিবর্তন ও তার প্রভাবের প্রমাণ সংগ্রহ করেন।
ভুল তথ্য ও হেইট স্পিচের বিরুদ্ধে যেকোনো লড়াইয়ের পুরো প্রক্রিয়াটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই এই কষ্টসাধ্য কাজটিকে আরো সহজলভ্য করার উদ্দেশ্যেই তুলে ধরা হয়েছে এই সুপারিশগুলো। এখানে তিনি নাগরিক সমাজের জন্যে যে ছয়টি পরামর্শ দিয়েছেন– সেগুলো হলো:
পারস্পরিকভাবে সুসংবদ্ধ জনগোষ্ঠী তৈরি
এই রিপোর্টিতে যেকোনো সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের নিছক ‘ব্যবহারকারী’ হিসেবে নয় বরং ভার্চুয়াল দুনিয়ায় পরস্পরের সাথে গভীরভাবে যুক্ত সমাজের অংশ হিসেবে দেখার কথা বলা হয়েছে। তাই সামাজিক মাধ্যমগুলোর যেকোন গ্রুপ বা ফোরামে কেউ মিসইনফরমেশন(ভুয়া খবর) ছড়ালে নির্ভরযোগ্য প্রমাণসহ মন্তব্য করে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করা উচিত। কোনোভাবেই ভুয়া খবর ছড়ানো ব্যক্তিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা উচিত না। এরপরেও তিনি ভুল তথ্য ছড়াতে থাকলে গ্রুপের অ্যাডমিন বা ফোরামের মডারেটরকে জানিয়ে পোস্টটি সরানোর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। প্রয়োজনবোধে সেই ব্যবহারকারীকে ফোরাম ত্যাগ করতে বাধ্য করা যেতে পারে।
সঠিক তথ্য প্রচারে স্যান্ডুইচ মডেল অনুসরণ
ভুয়া তথ্যগুলো সাধারণত হাস্যরসের ছলে ছড়ানো হয়, যেমন মিম আকারে। বা বিভিন্ন স্লোগানের আদলেও ভাইরাল হয়। তাই যেকোনো ভুয়া তথ্য প্রচারিত হলে তার বিপরীতে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ ও ছড়ানোর কৌশলকে ‘স্যান্ডুইচ’ এর মতো ধাপে ধাপে চিহ্নিত করে সঠিক তথ্য প্রচারে কাজ করতে হবে।
যাচাই এর আগে যাচাই
ভুয়া খবর বা গুজব ছড়ানোর নির্দিষ্ট কিছু প্যাটার্ন ও উদ্দেশ্য আছে। রাজনৈতিক বিতর্ক, নির্বাচন বা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ইস্যুতে প্রায়ই নির্দিষ্ট ধরনের কিছু ভুল তথ্য প্রচারিত হতে দেখা যায়। ফলে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু বিষয়ে প্রথম দেখাতেই কিছু অনুমানভিত্তিক পর্যবেক্ষণ দেওয়া যায়। এজন্যে ড. ডোনোভান ৫টি ধাপের একটি প্রক্রিয়া অনুসরণের কথা রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে আছে প্রতিনিয়ত দেশীয় ফ্যাক্টচেকিং সাইটগুলো অনুসরণ করে ভুয়া খবরের চলমান ধারা সম্পর্কে আগে থেকেই একটি ধারণা নিয়ে রাখা এবং এ ধরনের মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে সেগুলো প্রচার করা।
সর্বদা সম্মিলিতভাবে যাচাইয়ের কাজ চালিয়ে যাওয়া
অনেক সময় কোনো ভুল তথ্য যাচাই করতে গিয়েও সেটিকে আরও বেশি করে ছড়িয়ে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে শুধু ভুল তথ্যের প্রতিক্রিয়া জানানোই যথেষ্ট হয় না। প্রয়োজন হয়ে পড়ে সেটির বিস্তার রোধে সমন্বিত উদ্যোগের। এক্ষেত্রে সঠিক তথ্য জানানোর জন্য সিভিল সোসাইটি পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগ নিতে পারে।
স্থানীয় প্রেক্ষাপটের সাথে সম্পর্ক
ভুয়া খবরের প্রভাব বর্ণনার ক্ষেত্রে নিজস্ব পারিপার্শ্বিক ঘটনা বা প্রেক্ষিত যুক্ত করলে সেটির প্রভাব হয় দীর্ঘমেয়াদী। নির্ভরযোগ্য প্রমানের সাথে এভাবে প্রেক্ষাপট যুক্ত করে ব্যাখ্যা করলে ইতিবাচক প্রভাব পাওয়া যায়।
ভুল তথ্য মোকাবিলায় হাস্যরসের ব্যবহার
ভুল তথ্য ছড়ানোর মনস্তত্ব বেশ জটিল। প্রায়ই এগুলো ছড়ায় আবেগীয় প্রতিক্রিয়া বা বদ্ধমূল ধারণাগুলোর প্রভাবে। বিশেষভাবে ক্ষোভ ও ভীতি তৈরি করার মতো পরিস্থিতিতে এগুলো বেশি ছড়ায়। কর্তৃপক্ষ বা মূলধারার সংবাদমাধ্যম কোনো খবর চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে– এমন সন্দেহ থেকেও জন্ম হতে পারে অনেক অপতথ্য। এ জাতীয় পরিস্থিতি মোকাবিলার একটি উপায় হতে পারে হাস্যরসের ব্যবহার। কীভাবে এই পদ্ধতি অনুসরণ করে তাইওয়ানে করোনা সংক্রান্ত নানা ভুয়া তথ্য মোকাবিলা করা হয়েছিল– তার উল্লেখ আছে এই গবেষণায়।
সর্বোপরি ভুল তথ্য ও অপতথ্যের বিরুদ্ধে ভার্চুয়াল সামাজিক মাধ্যমসহ টেক প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু অপতথ্যের ছড়িয়ে পড়ার গতির বিপরীতে এই পদক্ষেপগুলো অপ্রতুল। তাই তাদের উদ্যোগের জন্যে অপেক্ষা না করে সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের এই প্রয়াসকে আরো সহজলভ্য করাই এই সুপারিশগুলোর মূল উদ্দেশ্য বলে জানান ড. জোয়ান ডোনোভানের গবেষক দল।