ডিসমিসল্যাব

অফিসিয়াল ডেস্ক
ভুল তথ্যের ভিডিওতে বিজ্ঞাপন চালাচ্ছে ইউটিউব
This article is more than 2 months old

ভুল তথ্যের ভিডিওতে বিজ্ঞাপন চালাচ্ছে ইউটিউব

ডিসমিসল্যাব

অফিসিয়াল ডেস্ক

ইউটিউব বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম। ২০২৪ সালের এপ্রিলের হিসেবে, প্রতি মাসে বাংলাদেশে তিন কোটি ৬০ লাখ মানুষ ইউটিউব দেখে থাকেন। ব্যবহারকারী বেশি বলে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো তাদের বিজ্ঞাপন দেখানোর জন্য বেছে নিচ্ছে প্ল্যাটফর্মটিকে। কিন্তু ভিডিওতে ভুল বা অপতথ্য থাকার পরও এগুলোতে বিজ্ঞাপন চলতে দেখা যায়। ডিসমিসল্যাব “মিসইনফরমেশন অন ইউটিউব: হাই প্রফিট, লো মডারেশন” শীর্ষক নতুন গবেষণায় ভুল তথ্য ছড়ানো ৭০০টি ভিডিও বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পেয়েছে ।

গবেষণায় বলা হয়, ভুল তথ্য ছড়ানো ভিডিওর মধ্যে ৫৫৮টি প্রচলিত কাঠামোর, বাকিগুলো শর্ট বা ক্ষুদ্র ভিডিও। ৫৫৮টি ভিডিওর ৩০ শতাংশের ভেতরে বিজ্ঞাপন চলতে দেখা যায়, যার মধ্যে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বড় কিছু কোম্পানির বিজ্ঞাপনও ছিল। বিজ্ঞাপনের মধ্যে ছিল বেটিং বা জুয়া সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনও, যা ইউটিউবের নীতিমালা অনুযায়ী বাংলাদেশে চলার কথা নয়। 

এই গবেষণার জন্য সাক্ষাৎকার দেওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুল তথ্য ছড়ানো ভিডিওতে বিজ্ঞাপন চললে ব্র্যান্ড বা কোম্পানির যেমন সুনামহানি হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় সঠিক তথ্য প্রদানকারী সংবাদমাধ্যম। তারা এ ধরনের ভিডিওতে বিজ্ঞাপন দেখানো উচিৎ নয় বলে অভিমত দেন। এই গবেষণায় অন্তর্ভূক্ত সবগুলো ভিডিওর ব্যাপারে রিপোর্ট করেছিলেন ডিসমিসল্যাবের গবেষকেরা। কিন্তু হাতেগোণা কয়েকটি ভিডিওর ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয় প্ল্যাটফর্মটি।

এ গবেষণার আওতায় বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট সাতটি ফ্যাক্টচেকিং সাইটে ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিত ২০৪২টি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করা হয়। এর মধ্যে ৭০০ ভিডিওতে ভুল বা অপতথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ ছিল প্রচলিত আকারের ভিডিও এবং ২০ শতাংশ শর্টস ভিডিও। এই ভিডিওগুলোর বিষয়ে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে ইউটিউবকে রিপোর্ট আকারে জানায় ডিসমিসল্যাব। এছাড়া ভিডিওগুলোতে বিজ্ঞাপন চালানো হচ্ছে কিনা– তা বোঝার জন্য গবেষকেরা প্রতিটি ভিডিও দুইবার করে দেখেন ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে। 

ভুয়া তথ্যের ভিডিওতে বিজ্ঞাপন

গবেষণায় দেখা যায়, প্রচলিত কাঠামোর ভিডিওগুলোর মধ্যে ১৬৫ তথা ৩০ শতাংশ ভিডিওতেই বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়েছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ভিডিওগুলো দেখা হয়েছে ৩ কোটি ৭০ লাখ বার। গড়ে প্রতিটি ভিডিও ২ লাখ ২৪ হাজার বার দেখা হয়। এসব ভিডিওতে ৮৩টি ভিন্ন ভিন্ন ব্র্যান্ডের ১৮৯টি বিজ্ঞাপন চলতে দেখা গেছে। এর মধ্যে অনলাইন গেম, টেলিকমিউনিকেশন, ই-কমার্স ও অন্যান্য ভোক্তা পণ্যের বিজ্ঞাপন নথিভুক্ত করেন গবেষকেরা। হিরো ওয়ার্স নামের একটি গেমিং অ্যাপের বিজ্ঞাপন দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি। এরপরেই ছিল বাংলাদেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর রবি এক্সিয়েটা লিমিটেড। এছাড়াও ছিল স্টিং নামের একটি এনার্জি ড্রিংকের বিজ্ঞাপন, যেটি পেপসিকোর একটি পণ্য। ভুল তথ্য ছড়ানো ভিডিওগুলোতে আলাদাভাবে ১৬ বার করে দেখা গেছে এই দুই কোম্পানির বিজ্ঞাপন।

ইউটিউবের নীতিমালা অনুযায়ী, বাংলাদেশে বেটিং বা জুয়া সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন চলার সুযোগ নেই। কিন্তু ২২বেট নামের একটি বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন চলতে দেখা গেছে দুইটি ভিডিওতে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, বা তাঁর পুত্র যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তার হয়েছেন– এ ধরনের মিথ্য রাজনৈতিক অপতথ্য ছড়ানো ভিডিওতে চলতে দেখা গেছে হিরো ওয়ার্স, ফ্লাইট এক্সপার্ট ও রবির বিজ্ঞাপন। 

ইন্টারেক্টিভ অ্যাডভার্টাইজিং ব্যুরোর ২০২০ সালের এক সমীক্ষার বরাত দিয়ে ডিসমিসল্যাবের গবেষণায় বলা হয়, ভুল বা অপতথ্য রয়েছে এমন ভিডিওতে বিজ্ঞাপন চালানো হলে ব্র্যান্ডগুলোর সুনামহানির আশঙ্কা থাকে। ইন্টারেক্টিভ অ্যাডভার্টাইজিং ব্যুরোর সমীক্ষা মতে, “যখন একটি ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন নিম্ন-মানের কন্টেন্টের পাশে প্রদর্শিত হয় তখন অধিকাংশ মার্কিন গ্রাহক (৮১%) এটিকে বিরক্তিকর বলে মনে করে। এছাড়াবিজ্ঞাপনদাতা ব্র্যান্ডগুলোর প্রতিও ৫২% মার্কিন নাগরিক প্রতিকূল মনোভাব দেখায়। একইভাবে ৬২% গ্রাহক একটি ব্র্যান্ড সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করা বন্ধ করে দেবে যদি তাদের বিজ্ঞাপন নিম্নমানের কন্টেন্টের সঙ্গে দেখানো হয়।”

ডিসমিসল্যাবের এই গবেষণার প্রয়োজনে বিজ্ঞাপনদাতা ব্র্যান্ড, ডিজিটাল বিজ্ঞাপনী সংস্থা এবং ইস্যু বিশেষজ্ঞদের প্রতিনিধিত্বকারী ছয়জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। যার উদ্দেশ্য ছিল ইউটিউবে ভুল তথ্যের ভিডিও থেকেও যে অর্থ আয় হয়, সেটার প্রয়োজনীয়তা বা চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে ভালোভাবে বোঝা। সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের একটি বড় ফাইন্যান্সিয়াল টেকনোলজি কোম্পানির প্রতিনিধি বলেন, “কোন কোন ভিডিওতে আপনার বিজ্ঞাপন চলছে– এটি সুনির্দিষ্টভাবে দেখা সম্ভব না। আপনি দেখতে পারবেন না যে, কোনো একটি চ্যানেলের কোন ভিডিওগুলোতে আপনার বিজ্ঞাপন দেখানো হবে।” সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের একটি প্রধান ভোক্তা পণ্য ব্র্যান্ডের একজন প্রতিনিধি বলেন, “ভুল তথ্য ছড়ানো ভিডিওতে যদি কোনো বিজ্ঞাপন চলে, তাহলে এমনটা মনে হতেই পারে যে সেই কন্টেন্টকে সমর্থন করা হচ্ছে। আমি মনে করি, নানাবিধ বৈশ্বিক পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য ইউটিউব তার নীতিমালা পরিবর্তন করছে। কিন্তু আমি এটিও মনে করি যে, ইউটিউবের শুধু নির্ভুল তথ্য সম্বলিত ভিডিওগুলোতেই বিজ্ঞাপন দেখানো উচিৎ।”

ইউটিউবের স্বত্তাধিকারী গুগল তাদের ভিডিও অ্যাড সেফটি প্রমিসে দাবি করে থাকে যে তারা অশ্লীলতা, নগ্নতা, সন্ত্রাসবাদ এবং অন্যান্য সংবেদনশীল বিষয়ের ভিডিওতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হওয়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিরোধ করে থাকে। তবে কনটেন্টে যদি ভুল বা অপতথ্য থাকে তাহলে বিজ্ঞাপন নীতি কী হবে গুগলের এই নিরাপত্তা অঙ্গীকারে তা নির্দিষ্টভাবে বলা নেই। আবার ভুল বা অপতথ্য থাকলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন বন্ধ থাকবে- সেটিংসে এমন কিছু বাছাই করারও সুযোগ বিজ্ঞাপনদাতাদের জন্য রাখা হয়নি।

বিজ্ঞাপনদাতা এবং ডিজিটাল বিপণন বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্র্যান্ডগুলো বিজ্ঞাপনের জন্য ইউটিউব ভিডিও বা চ্যানেল নিজেদের মতো নির্বাচন করতে পারে। কিন্তু ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণের কাজটি তাদের জন্য কঠিন। এর কিছু কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে উচ্চ প্রতিযোগিতা ব্যয় এবং ইউটিউব কন্টেন্টসমূহের নানাবিধ প্রকৃতি। বেশি দর্শকের কাছে পৌঁছানোর জন্য বিজ্ঞাপনদাতারা ‘অডিয়েন্স টার্গেটিং’ এর মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে এবং বিজ্ঞাপন কোথায় প্রদর্শিত হবে তা ছেড়ে দেয় অ্যালগরিদমের ওপর। এ কাজটি বিজ্ঞাপনদাতাদের ওপর ছেড়ে দেওয়ার বিপক্ষে মত দিয়েছেন এই গবেষণার জন্য সাক্ষাৎকার দেওয়া একজন বিশেষজ্ঞ মত দেন। তিনি বলেন, আসলে “ইউটিউবের এআইকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন যেন এটি নিজে নিজে মিসইনফরমেশন বা ভুয়া ভিডিও সনাক্ত করতে পারে… [এবং] এটি আরও কার্যকরী হয়ে উঠতে পারে।”

প্রযুক্তি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে কাজ করে থাকেন এমন একজন আইনজীবী সাক্ষাতকারে বলেন, “এই গবেষণাটি দেখায় যে, ইউটিউব তাদের বিজ্ঞাপনী ক্লায়েন্টদের ত্রুটিপূর্ণ বিজ্ঞাপন প্লেসমেন্টের জন্য চার্জ করতে পারে – যা বিজ্ঞাপন দেওয়ার কাঙ্ক্ষিত মান পূরণ করে না এবং কোম্পানির সুনাম ক্ষুন্ন করে।”

ডিসমিসল্যাবের এই গবেষনায় বলা হয়েছে, “মিসইনফরমেশনের তুলনায় মনিটাইজেশন বা আয়ের সুযোগের প্রভাবটি বহুমুখী। এটি কেবল ব্র্যান্ড নিরাপত্তার জন্যই ঝুঁকি তৈরি করে না; যারা ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে তাদের তহবিল সংগ্রহে সহায়তা করছে, পাশাপাশি ক্ষতি করছে সঠিক তথ্য প্রদানকারী ও স্বাধীন গণমাধ্যমের।

“যেখানে মূলধারার গণমাধ্যম সঠিক কন্টেন্ট তৈরি করতে ঘন্টার পর ঘন্টা ফ্যাক্টচেকিং করে, সেখানে একটি ভুল তথ্যের ভিডিও ততক্ষনে লক্ষ লক্ষ ভিউ পেতে পারে এবং সেই সময়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারে,” বলেন এক বিশেষজ্ঞ, যিনি বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রে ডিজিটাল অপারেশন পরিচালনা করেন৷ “দুঃখজনকভাবে, দর্শকদের একটি বড় অংশ এই ভিডিওগুলোকে সত্য বলে বিশ্বাস করে। ফলে তারা আর মূলধারার মিডিয়ার ইউটিউব চ্যানেলগুলোতে যায় না, ‌এতে করে মূলধারার আউটলেটগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়,” তিনি যোগ করেন।

ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে এমন ভিডিওর বিষয়টি নজরে আনা হলে জবাবে ইউটিউব কোনো ব্যবস্থা নেয় কিনা– তা দেখার জন্য ৪ মাস অপেক্ষা করেন গবেষকেরা। দেখা যায়, ৬৬৮টি ভিডিওর তথ্য রিপোর্টিং তালিকায় রয়েছে। এর মধ্যে ইউটিউব ব্যবস্থা নিয়েছে মাত্র ২৫টির ক্ষেত্রে, ২২টি সরিয়ে ফেলেছে এবং তিনটিতে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ব্যবহারকারীর বয়সের শর্ত। ৩২টি ভিডিওর রিপোর্ট করার তথ্য পাওয়া যায়নি। এর কারণ হতে পারে একাধিক ব্যবহারকারী সেসব ভিডিও আগেই রিপোর্ট করেছন, বা সেগুলো আগে থেকেই ইউটিউবের রিভিউয়ের আওতায় ছিল। 

গবেষণায় বলা হয়েছে, রিপোর্ট পাওয়ার পর কোনো ভিডিও যদি ইউটিউব না মুছে ফেলে রেখেও দেয় – ভিডিওটি সম্পর্কে ব্যবহারকারীদের সতর্ক করা উচিৎ। ফেসবুক ও টুইটারের ক্ষেত্রে এমনটি করা হয়ে থার্ড পার্টি ফ্যাক্টচেকিং সংগঠন বা ব্যবহারকারীদের রিপোর্টের ভিত্তিতে। কিন্তু ইউটিউবে এমনটি দেখা যায় না। ভুল তথ্য ছড়ানো ভিডিওতে স্পষ্টভাবে সতর্কীকরণ বার্তা থাকা উচিৎ- ২০২২ সালে ইউটিউবের কাছে ৮০টি ফ্যাক্টচেকিং সংগঠনের পাঠানো চিঠিতে এমন দাবি জানানো হয়েছিল।

আরো কিছু লেখা