ডিসমিসল্যাব

অফিসিয়াল ডেস্ক
রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন শনাক্তে মেটা কতটা কার্যকরী?
This article is more than 11 months old

রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন শনাক্তে মেটা কতটা কার্যকরী?

ডিসমিসল্যাব

অফিসিয়াল ডেস্ক

বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ দিয়ে, মেটার রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত নীতিমালা প্রয়োগ এবং এসব বিজ্ঞাপন শনাক্তের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ত্রুটি ও দূর্বলতার কথা উঠে এসেছে ডিজিটালি রাইটের নতুন একটি গবেষণায়। “হিটস অ্যান্ড মিসেস: এন এক্সামিনেশন অব মেটা’স পলিটিক্যাল অ্যাড পলিসি এনফোর্সমেন্ট ইন বাংলাদেশ” শীর্ষক এই গবেষণায় দেখা গেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন মেটা শনাক্ত করতে পারেনি এবং এগুলো প্রয়োজনীয় ডিসক্লেইমার ছাড়াই ফেসবুকে সচল ছিল।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে: রাজনৈতিক নয়— এমন বিজ্ঞাপন ত্রুটিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক বলে শনাক্ত করা হয়েছে, যা বাণিজ্যিক পেজগুলোর ওপর তুলনামূলক বেশি প্রভাব ফেলেছে। পণ্যের প্রচার, চাকরি বা কর্মসংস্থান সংক্রান্ত সেবা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রচারিত বিজ্ঞাপনকে রাজনৈতিক বলে বিবেচনা করায় প্রশ্ন উঠেছে মেটার বিজ্ঞাপন শনাক্তের অ্যালগরিদমের কার্যকারীতা নিয়ে।

রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে যে ডিসক্লেইমার যুক্ত করতে হয়— সেখানেও অসম্পূর্ণ বা অস্পষ্ট তথ্য প্রদানের দৃষ্টান্ত উঠে এসেছে গবেষণায়। যেটি মেটার স্বচ্ছতা সংক্রান্ত মানদণ্ড এবং তথ্য যাচাই প্রক্রিয়ায় সম্ভাব্য ত্রুটির ইঙ্গিত দেয় এবং ব্যবহারকারীরা বুঝতে পারেন না যে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন পরিচালনার জন্য কারা অর্থের যোগান দিচ্ছে।

মেটা অ্যাড লাইব্রেরিতে রাজনৈতিক বলে শনাক্ত হওয়া এক বছরের বিজ্ঞাপন এবং ডিসক্লেইমার সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই গবেষণায়। এবং শনাক্ত হয়নি এমন রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন চিহ্নিত করার জন্য চালানো হয়েছে কিওয়ার্ড সার্চ।

রাজনৈতিক কিন্তু শনাক্ত হয়নি

রাজনৈতিক বার্তা সম্বলিত বিজ্ঞাপনগুলো যদি সঠিকভাবে শনাক্ত করা না যায়, তাহলে সেটি রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের স্বচ্ছতা সংক্রান্ত পুরো ব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। যার ফলে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই অ্যাড লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত হয়না।

এই গবেষণায় কিওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে এমন ৫০টি বিজ্ঞাপন পাওয়া গেছে, যেগুলোতে স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক বার্তা ছিল এবং এগুলোর প্রায় অর্ধেকই এসেছে রাজনৈতিক হিসেবে ঘোষণা দেওয়া পেজগুলো থেকে। শনাক্ত না হওয়া এসব বিজ্ঞাপনের ৯০ শতাংশের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল বা রাজনীতিবিদের নাম উল্লেখ ছিল এবং ৭২ শতাংশের ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদের ছবি বা রাজনৈতিক দলের লোগো উপস্থিত ছিল। গবেষণা চলাকালে মাত্র চার দিন কিওয়ার্ড সার্চ করে পাওয়া গেছে এই বিজ্ঞাপনগুলো।

গবেষণায় দেখা যায়, হুবহু একই বিজ্ঞাপন কিছু পেজের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে এবং কিছু পেজের ক্ষেত্রে করা হয়নি। রাজনীতি সংশ্লিষ্ট নয়, এমন পেজ থেকে রাজনৈতিক দাবি সম্বলিত বিজ্ঞাপন চালানো হয়েছে এবং সেগুলো শনাক্ত হয়নি— এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে অন্তত ৫টি ক্ষেত্রে। কোনো বিজ্ঞাপন রাজনৈতিক হিসেবে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে বিলম্বের দৃষ্টান্তও উঠে এসেছে গবেষণায়। যেখানে এসব বিজ্ঞাপন দীর্ঘ সময় ধরে সক্রিয় ছিল প্রয়োজনীয় ডিসক্লেইমার ছাড়াই। যেমন, রাজনৈতিক বার্তা সম্বলিত একটি বিজ্ঞাপন অশনাক্ত অবস্থায় ছিল ৩৭২ দিন এবং সেটি পৌঁছেছে ১০ লাখেরও বেশি মানুষের কাছে।

স্বচ্ছতা এড়িয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞাপনদাতারা

অ্যাড লাইব্রেরির ডেটা থেকে পাওয়া ৩১৪টি “পেইড ফর বাই” ডিসক্লেইমার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে নয়টি ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনদাতারা – যাদের মধ্যে একজন মেয়র নির্বাচনের প্রার্থী এবং দুজন রাজনীতিবিদ ছিলেন – প্রয়োজনীয় স্বচ্ছতা সংক্রান্ত তথ্য প্রদান করেননি। তারপরও সেগুলো রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন হিসেবে চালাতে দেওয়া হয়েছে।

মেটার বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত নীতিমালায় বলা হয়েছে, রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন চালানোর ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনদাতাদের ফোন নম্বর, ইমেইল, ওয়েবসাইট ও ঠিকানা প্রদান করতে হবে এবং সেগুলো সব সময় কার্যকর ও সঠিক হতে হবে। যদিও, গবেষণায় দেখা গেছে, ৩১৪টি ডিসক্লেইমারের মধ্যে ৮০ শতাংশের ক্ষেত্রেই অস্পষ্ট বা অপূর্ণাঙ্গ ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। ৪৭ শতাংশ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়েছে শুধু জেলার নাম। পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা দেওয়া হয়েছে মাত্র ১৭ শতাংশ ক্ষেত্রে। এবং ৫৮ শতাংশ ডিসক্লেইমারের ক্ষেত্রে ওয়েবসাইটের জায়গায় দেওয়া হয়েছে ফেসবুক পেজের ইউআরএল।

রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা সংক্রান্ত প্রধান একটি জায়গা “পেইড ফর বাই” ডিসক্লেইমার। এবং ব্যবহারকারীদের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখান থেকে বোঝা যায় যে, কোনো বিজ্ঞাপনের জন্য কারা অর্থের যোগান ও সমর্থন দিচ্ছে। এর মাধ্যমে ভোটাররা বুঝতে পারেন যে, তাদের সামনে আসা কোনো বার্তার পেছনে কারা আছে। গবেষণার ফলাফল থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ডিসক্লেইমারে থাকা তথ্যের কার্যকারীতা ও সঠিকতা যাচাইয়ে মেটার উদ্যোগ যথেষ্ট নয়।

শনাক্ত হয়েছে কিন্তু রাজনৈতিক নয়

গবেষণায় অ্যাড লাইব্রেরিতে থাকা অরাজনৈতিক হিসেবে ঘোষণা করা পেজগুলো (বাণিজ্যিক, সংবাদ, অন্যান্য) থেকে পরিচালিত ১৪২০টি বিজ্ঞাপনের নমুনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২৫ শতাংশ বিজ্ঞাপন ভুলভাবে শনাক্ত করা হয়েছে রাজনৈতিক হিসেবে। সবচেয়ে বেশি, ৪৩ শতাংশ ভুলভাবে শনাক্ত করা হয়েছে ‘বাণিজ্যিক’ শ্রেণির পেজগুলো থেকে আসা বিজ্ঞাপনকে। ভুলভাবে রাজনৈতিক শনাক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে এই শ্রেণির ওপরই তুলনামূলক বেশি প্রভাব পড়েছে। 

রাজনীতিবিদদের মালিকানাধীন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পেজগুলো থেকে আসা বিজ্ঞাপনগুলো ভুলভাবে শনাক্ত হয়েছে রাজনৈতিক হিসেবে। এসব পেজের পণ্যের প্রচার সংক্রান্ত সাধারণ বিজ্ঞাপনও পড়েছে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের তালিকায়।

পাঠ্যবই বা গাইড, উপন্যাস বিক্রি সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন, কর্মসংস্থান, বিদেশে পড়াশোনা, ভিসা আবেদন সংক্রান্ত সেবা দেওয়ার বিজ্ঞাপনও শনাক্ত হয়েছে রাজনৈতিক হিসেবে। সামাজিক ইস্যু হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কারণে এগুলো রাজনৈতিক তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। এই বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য নির্দিষ্টভাবে সামাজিক ইস্যু নির্ধারণ করে দেওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরে।

বাণিজ্যিক শ্রেণির পেজগুলো কিওয়ার্ড সংক্রান্ত ইস্যুর কারণেও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, যেখানে দেখা যায়: ‘মিনিস্টার’ কিওয়ার্ডটির কারণে ইলেকট্রনিক পণ্য বিক্রি বা বিবাহ সেবা সংক্রান্ত পেজের বিজ্ঞাপন  ভুলভাবে রাজনৈতিক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

‘বিজয়ী’-র মতো কিওয়ার্ড এবং নির্দিষ্ট কোনো ইভেন্টের উল্লেখ থাকার কারণেও কিছু বিজ্ঞাপন ভুলভাবে রাজনৈতিক বলে শনাক্ত হয়েছে। 

সুপারিশ

বাংলাদেশে অনলাইন রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের স্বচ্ছতা নিশ্চিতের জন্য দৃষ্টি দেওয়া এবং উন্নয়ন ঘটানো উচিৎ– এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ের দিকে আলোকপাত করেছে এই গবেষণার ফলাফল।

বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি করা কিছু সুপারিশে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনের নীতিমালা তৈরি, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের নিয়মিত কিওয়ার্ড নিরীক্ষা এবং বিভিন্ন অংশীদারদের সমন্বয়ের মাধ্যমে কার্যকরী তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে।

গবেষণা থেকে পাওয়া এমন প্রধান কিছু সুপারিশ:

  • রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন সঠিকভাবে শনাক্ত করার জন্য মেটার মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী নিয়মিত কিওয়ার্ড নিয়ে নিরীক্ষা পরিচালনা করতে হবে এবং এসব নিরীক্ষার কার্যকারীতা মূল্যায়ন এবং গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি পাওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন পর্যবেক্ষক, গবেষক ও সিভিল সোসাইটির সদস্যদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
  • স্বচ্ছতা বাড়ানোর জন্য, নির্বাচন কমিশন বা সরকারকে অবশ্যই সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোকে নির্দেশ দিতে হবে যেন তারা বাংলাদেশ সংক্রান্ত রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের ডেটা উন্মুক্ত করে এবং সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রকাশ করে যে কোন ধরনের তথ্য কীভাবে প্রকাশ করা হবে।
  • বাংলাদেশে অনলাইন বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত বিষয়াবলী স্পষ্ট করার জন্য, নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই একটি নির্দেশনা প্রদান করতে হবে, যেখানে অনলাইনে রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারণা সংক্রান্ত বিষয়গুলো তত্ত্বাবধানের বিধিমালা থাকবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের অফিসিয়াল পেজ চিহ্নিত করে দেওয়ার কথা বলা হবে।
  • মেটার উচিৎ বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক সামাজিক ইস্যুগুলোর বিস্তারিত তালিকা সবার জন্য উন্মুক্ত করা। যেটি তারা করতে পারে স্থানীয় অংশীদারদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করার মাধ্যমে।
  • শুধু রাজনৈতিক নয়, মেটার উচিৎ সব দেশের ক্ষেত্রেই সব ধরনের বিজ্ঞাপন সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা। যেমনটি তারা ডিজিটাল সার্ভিসেস অ্যাক্ট মান্য করার জন্য করে থাকে ইউরোপিয় ইউনিয়নের দেশগুলোর ক্ষেত্রে।
  • রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের কার্যকরী পর্যালোচনা নিশ্চিত করার জন্য মেটাসহ অন্যান্য সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোকে অবশ্যই আরও বেশি মানুষ-নির্ভর পর্যালোচনা বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগ করতে হবে, যাদের স্থানীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ভাষা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান আছে।

পুরো গবেষণা প্রতিবেদনটি পাওয়া যাবে এখানে। 

আরো কিছু লেখা