আহমেদ ইয়াসীর আবরার
বাংলাদেশ নিয়ে ভুতুড়ে লেখকদের বয়ান যেভাবে ছড়ালো
আহমেদ ইয়াসীর আবরার
“মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। সুদহার চড়েছে ১২ শতাংশের ওপর। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে থাকা বাংলাদেশিরা সামনে একটা কঠিন প্রশ্ন তুলতে পারেন—কীভাবে টানাপোড়েনে থাকা একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের মেয়ে বিলাসী জীবনযাপন করছেন। আর সবার যখন পকেট কাটা পড়ছে, তখন আহসান মনসুর নিজেই বা কীভাবে তিনতলা কাঁচ ও স্টিলের ‘ফার্মহাউসে’ নিশ্চিন্তে থাকেন?”
কথাগুলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনলাইন ম্যাগাজিন ইন্টারন্যাশনাল পলিসি ডাইজেস্টে (আইপিডি) গত ৩১ জানুয়ারি প্রকাশিত একটি নিবন্ধের। লেখকের নাম, টিম লারকিন। লেখার সারবস্তু হল, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের সম্পদ খতিয়ে দেখছে ঠিকই, কিন্তু এই তদন্ত পরিচালনাকারী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে সেই ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি করা হচ্ছে না। কিন্তু সমস্যা হল, বাস্তবে টিম লারকিন নামের এই লেখকেরই অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না।
ডিসমিসল্যাবের গত এক মাসের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অনলাইন এই সাময়িকী গত আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশ নিয়ে যে ১০টি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে, তার প্রতিটিই লিখেছে টিম লারকিনের মতো ভুতুড়ে লেখকেরা। অনলাইনে যাদের সম্পর্কে কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রোফাইল ছবি নেওয়া হয়েছে শাটারস্টক-এর মতো স্টক ছবির সাইট থেকে, এবং তাদের যোগাযোগের ঠিকানাও নেই।
এই ভুতুড়ে লেখকদের অন্তত দুটি লেখা বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম যাচাই ছাড়াই প্রকাশ করছে। নিবন্ধগুলো সামাজিক মাধ্যমেও (১, ২) ছড়িয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং আওয়ামী লীগের বিভিন্ন দলীয় পেজ সেগুলো শেয়ার করেছে, যা নিবন্ধগুলোর ভাষ্য আরও বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে দিয়েছে।
কিন্তু অখ্যাত একটি ওয়েবসাইটে ভুতুড়ে লেখকদের লেখা প্রকাশ করে লাভটা কি? এই প্রশ্নের উত্তর হয়ত পরিস্কার হত না, যদি না যুক্তরাজ্যভিত্তিক গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদনে বিষয়টি সামনে আসতো। গত ২৪ মার্চ গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়, আইপিডিতে প্রকাশিত দুটি নিবন্ধ যুক্তরাজ্যের কর ও দুর্নীতি নিয়ে কাজ করা সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির (এপিপিজি) সদস্যদের কাছে ইমেইলে পাঠানো হয়, যেখানে ড. মনসুরের মেয়ের সম্পদ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।
যাদের কাছে ইমেইলটি পাঠানো হয়, সেই সংসদ সদস্যদের সঙ্গেই গভর্নর ড. আহসান মনসুরের বৈঠক করার কথা ছিল। তাঁর লন্ডন সফরের উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাজ্য সরকারের সহায়তা চাওয়া। এই সফরের ঠিক আগে আগে তাকে লক্ষ্য করে পরপর তিনটি নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়, যার প্রতিটিই ভুতুড়ে লেখকদের লেখা। এসব নিবন্ধে তাকে ব্যক্তিগতভাবেও আক্রমণ করা হয়।

ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধানে আইপিডি-এর সম্পাদকীয় নীতিমালার বড় ধরনের দুর্বলতা উন্মোচিত হয়। ডিসমিসল্যাব নিজেই দুটি ভুয়া নিবন্ধ আইপিডিতে জমা দেয়। এদের একটির ভাষ্য ছিল, আওয়ামী লীগের পক্ষে এবং জুলাই আন্দোলন নিয়ে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং প্রতিবেদনে “সম্ভাব্য পক্ষপাত” নিয়ে; অপরটি ছিল শিক্ষার্থীদের নতুন দল, জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রশংসা করে। দুটি নিবন্ধই লেখা হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা টুলের সহায়তায়, ভুয়া তথ্য ও ছবি দিয়ে এবং এজন্য ভুয়া দুইজন লেখকের প্রোফাইলও তৈরি করা হয়। সাময়িকীটি প্রথম লেখাটি প্রকাশ করেছে, কিন্তু দ্বিতীয়টি প্রকাশ করে নি।
ভুতুড়ে লেখক
ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইন্টারন্যাশনাল পলিসি ডাইজেস্টের যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায়। তারা সমসাময়িক বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে লেখা প্রকাশ করে। ডিসমিসল্যাব, তাদের ওয়েবসাইটে ২০২৪ সালের আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ নিয়ে প্রকাশিত ১০টি নিবন্ধের সন্ধান পায়। লিখেছেন মোট আট জন লেখক। এদের মধ্যে দুইজন লিখেছেন, দুটি করে। যাচাই করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে, আইপিডি ছাড়া এদের কারোই অনলাইন অস্তিত্ত্ব নেই।
এই আট ভুতুড়ে লেখকের একজন হলেন টিম লারকিন। তিনি বাংলাদেশ নিয়ে সম্প্রতি দুটি লেখা লেখেন: একটির বিষয় বাংলাদেশের বিপ্লব যেভাবে “পথ হারালো” এবং অন্যটি ড. মনসুর ও তার মেয়ের প্রতি আক্রমণ। আরো আছেন ক্রিস্টোফার ও’ব্রায়ান, যিনি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের দুর্দশা নিয়ে লিখেছেন। আগস্টের আগে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সমালোচনা করে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। অন্যান্য লেখকরা হলেন: উইলিয়াম ফ্রাই, অ্যান্ড্রু হ্যাকনি, গুস্তাভ এলিসন. থমাস ইব্রাহিম, থমাস অ্যান্ডারসন এবং টম প্রাইস।
ডিসমিসল্যাব এসব লেখকের পরিচয় যাচাই করতে গিয়ে অনলাইনে চারটি বিষয় খোঁজ করে: সামাজিক মাধ্যমে উপস্থিতি, ছবি, পরিচিতি তথ্য এবং যোগাযোগের ঠিকানা (ইমেইল বা ওয়েবসাইট) আছে কিনা। এই আট লেখকের সবার বেলায়ই, ফলাফল শূণ্য। না আছে সামাজিক মাধ্যমে কোনো প্রোফাইল, না পেশাগত ইতিহাস। এমনকি আইপিডির সাইটে ব্যবহার করা ছবিগুলোও শাটারস্টক বা ফ্রিপিকের মতো সাইট থেকে নেওয়া। এসব স্টক সাইটে ছবি কেনা বেচা হয় এবং কিছু ছবি বিনা পয়সায়ও পাওয়া যায়।
আইপিডিতে প্রকাশিত নিবন্ধগুলি লেখা হয়েছে ভুয়া পরিচয় দিয়ে, প্রোফাইল ছবিগুলো নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন স্টক ছবির ওয়েবসাইট থেকে
ডিসমিসল্যাবের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে চাইলে, আইপিডির সম্পাদক জন লাইম্যান ইমেইলে জানান, তাদের প্ল্যাটফর্ম লেখকদের সঙ্গে “বিশ্বাসের ভিত্তিতে” কাজ করে থাকে, এবং স্বীকার করেন যে “কিছু ভুয়া লেখকের লেখা হয়তো ছাপা হয়ে গেছে,” কারণ তাদের প্রায় ৩,০০০ কনট্রিবিউটর রয়েছেন।
তিনি আরও জানান, কিছু লেখক মাঝেমধ্যে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করলে তাঁরা সেটাও করেন। কিন্তু লেখা প্রকাশের আগে লেখকদের পরিচয় খতিয়ে দেখেন কি না, সেটি তিনি স্পষ্ট করেননি।
আইপিডি শুধু ভুয়া লেখকদের লেখাই প্রকাশ করে তেমন নয়। সাইটটি নিয়মিতভাবে যাচাইযোগ্য প্রোফাইলের লেখকদের নিবন্ধও প্রকাশ করে। যেমন, জুলাই আন্দোলনের আগে বাংলাদেশ নিয়ে অন্তত পাঁচটি নিবন্ধ তারা প্রকাশ করেছে, যেগুলোর লেখকদের পরিচয় যাচাই করার মতো তথ্য ছিল। লেখাগুলোয় বাংলাদেশের ইতিহাস, আঞ্চলিক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল।
তবে এই অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আইপিডির সম্পাদকীয় ও যাচাই প্রক্রিয়া এতটাই দুর্বল যে, যে কেউ এটি পাশ কাটিয়ে সেখানে অপপ্রচারমূলক নিবন্ধও ছাপাতে পারে।
ভুয়া লেখকদের যত লেখা
আগস্টের পর আইপিডিতে প্রকাশিত বাংলাদেশ সম্পর্কিত প্রথম নিবন্ধে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে মিশরের বিপর্যয় এবং তিউনিসিয়ার গণতন্ত্রের পতনের সঙ্গে তুলনা করা হয়। তবে পরে এই লেখকদের মনোযোগ ধীরে ধীরে আর্থিক খাত এবং বিশেষ করে গভর্নর ড. মনসুরের দিকে সরে যায়।
এই বিষয় নিয়ে চারটি লেখা প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ম্যাগাজিনটি। প্রথমটির শিরোনাম ছিল “আস্থার অভাব: বাংলাদেশের ব্যাংকিং দুর্দশা, স্থিতিশীলতাকে হুমকিতে ফেলছে যেভাবে” (নভেম্বর ১৩, ২০২৪)। এখানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সমস্যার উৎস হিসেবে দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও তদারকিকে দায়ী করা হয়।

পরের তিনটি নিবন্ধই ছিল সরাসরি গভর্নরকে আক্রমণ করে। “কাঁচের ঘর: বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিচারিতা” (জানুয়ারি ৩১, ২০২৫) শিরোনামের নিবন্ধটির বিষয় ছিল মনসুরের মেয়ের “বিলাসবহুল জীবন ও তাঁর নিজের সততা”।
এরপরে আসে “অনির্বাচিত ব্যাংকার: বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে আহসান মনসুরের জুয়া খেলা” (ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৫) । গুস্তাভ এলিসনের এই লেখায় সরাসরি ড. মনসুরের নিয়োগ, যোগ্যতা ও সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।
সবশেষে প্রকাশ পায়, “বাংলাদেশের আর্থিক খাতের লড়াইয়ে স্বচ্ছতার অভাব” (মার্চ ১৩, ২০২৫) শিরোনামের নিবন্ধটি, যেখানে ভুতুড়ে লেখক উইলিয়াম ফ্রাই অন্তর্বর্তী সরকারের আর্থিক কৌশল যথেষ্ট স্বচ্ছ নয় বলে অভিযোগ করেন।
এই নিবন্ধে ড. মনসুরের যুক্তরাজ্য সফরের বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়। বলা হয়: “১৭ মার্চ আহসান মনসুর যুক্তরাজ্যের সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপের সামনে বক্তব্য দেবেন, যেখানে তিনি বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে যুক্তরাজ্যের সহযোগিতা চাইবেন। যদি বাংলাদেশের দুর্নীতির প্রশ্ন সত্যিই সমাধান করতে হয়, তবে হয়তো সংসদ সদস্যগন তার পরিবারের সম্পদের উৎস নিয়েও প্রশ্ন তুলবেন।”
ডিসমিসল্যাবের এই অনুসন্ধানের শেষপর্যায়ে, ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান এ বিষয়ে তাদের নিজস্ব প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয় ব্রিটিশ সংসদ সদস্যরা বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্যের প্রচারণার শিকার হতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, “এমপিরা ধারণা করছেন, বাংলাদেশকে সহায়তা দিতে যুক্তরাজ্যের যে প্রচেষ্টা, সেটিকে একটি সুপরিকল্পিত অপপ্রচার বিঘ্নিত করতে পারে,” এবং ড. মনসুরকে নিয়ে ভুয়া সাংবাদিকদের লেখা এইসব নিবন্ধ তারই অংশ।

দ্য গার্ডিয়ান আরও জানায়, ড. মনসুরের সঙ্গে গত মার্চে পূর্বনির্ধারিত বৈঠকের আগে এই সংসদ সদস্যরা কয়েকটি ইমেইল পান। তাতে আইপিডির নিবন্ধের লিংক যুক্ত ছিল। এসব মেইল একজন তথাকথিত সাংবাদিক এবং যুক্তরাজ্যের একটি জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছিল। গার্ডিয়ান কথিত সেই সাংবাদিকের খোঁজ পায়নি। জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানটি কার হয়ে এই ইমেইল পাঠিয়েছে তা জানাতে অস্বীকার করে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ. আল মামুন বলেন, “এটি একটি সুসংগঠিত, পরিকল্পিত প্রোপাগান্ডা প্রচারণা, যা আওয়ামী লীগের পক্ষে পরিচালিত হচ্ছে।” ২০২৩ সালে এএফপি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, যেখানে দেখানো হয় কিভাবে ভুয়া বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন দেশি ও আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইটে নিবন্ধ প্রকাশ করে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ায়। অধ্যাপক মামুন বলেন, “তখন এই প্রচারণার একটি ধরন ছিল। এখন সেখানে একটি ভিন্ন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। তবে আমার বিশ্বাস, এর উৎস সেই একই জায়গা।”
যেভাবে আরো ছড়ালো
টিম লারকিনের “কাঁচের ঘর” শিরোনামের নিবন্ধটি প্রকাশের কয়েক দিনের মধ্যে বাংলাদেশের একাধিক সংবাদমাধ্যমে তা প্রকাশিত হয়। পহেলা ফেব্রুয়ারি, প্রথম এটি বাংলায় অনুবাদ করে বিডি ডাইজেস্ট। পরদিন, খবরের কাগজ নামের একটি গণমাধ্যমে এই লেখার সূত্র ধরে গভর্নরের মেয়ের বিলাসবহুল জীবন ও তার সম্পদের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। খবরের কাগজ, একটি ভিডিও-ও প্রকাশ করে। এরপর বাংলাদেশ ফার্স্ট এবং বার্তা২৪-এ একই ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ২ ফেব্রুয়ারি এটি প্রকাশিত হয় জনকণ্ঠ ও এসএ টিভিতে।

লারকিনের নিবন্ধটি শেয়ার করা হয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, তার এক্স (সাবেক টুইটার) ও ফেসবুক একাউন্টে শেয়ার করার পরে এটি আরো ছড়ায়। এরপর এটি আরও অনেকে পোস্ট করেন এক্স (১, ২, ৩) ও ফেসবুকে (১, ২, ৩, ৪)। গুস্তাভ এলিসনের লেখা নিবন্ধটিও ছাত্রলীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে শেয়ার করা হয়।

অধ্যাপক মামুন বলেন, “বিদেশি পত্রিকার কোনো লেখা বা সূত্র ব্যবহার করার সময় আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলোর উচিত সংশ্লিষ্ট পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ করে উৎস যাচাই করা। একই সঙ্গে সেখানে কোনো ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য আছে কিনা তা-ও নিশ্চিত করা উচিত।”
ভুয়া লেখা যেভাবে প্রকাশিত হয়
আইপিডির সম্পাদকীয় প্রক্রিয়া ও বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করতে ডিসমিসল্যাব, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি, ‘সারাহ সুনেহরা জামান’ নামে একজন ভুয়া লেখকের নামে একটি নিবন্ধ পাঠায়। এই সারাহ চরিত্রটি তৈরি করা হয় একটি এআই-জেনারেটেড ছবি দিয়ে এবং ভুয়া বৃত্তান্ত ব্যবহার করে। বলা হয়, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়েছেন এবং সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের ফেলো ছিলেন।
নিবন্ধটি লেখা হয় চ্যাটজিপিটির সহায়তায়। এতে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে করা প্রতিবেদনে জাতিসংঘ পক্ষপাত দেখিয়েছে এমন অভিযোগ তোলা হয়। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং রিপোর্টে বলা হয়েছিল, “সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থী ও বিক্ষোভকারীদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।” এই বক্তব্যকে সামনে এনে জাতিসংঘের নিরপেক্ষতাকে নিবন্ধটিতে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়।

এই লেখায় ইচ্ছাকৃতভাবে তিনটি ভুয়া তথ্য রাখা হয়:
১. দ্য টাইমসের-এর বরাত দিয়ে বলা হয়, “৫ আগস্টের পর ৩,০০০ মানুষ নিহত হয়েছেন”, যা বুম বাংলাদেশ নামে একটি ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান গত অক্টোবরে যাচাই করে এর কোনো সত্যতা পায় নি।
২. সিরাজগঞ্জে গর্ভবতী এক নারী পুলিশ কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে আরেকটি দাবি নিবন্ধে ছিল, যা খণ্ডন করে আজকের পত্রিকা জানিয়েছিল যে সেদিন নিহত ১৩ জন পুলিশ সদস্যের মধ্যে কোনো নারী ছিলেন না।
৩. ওয়াশিংটন পোস্টের বরাতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের আদেশ অমান্য করায় কয়েকজন সেনা অফিসার বরখাস্ত হয়েছেন এবং এই দাবিও ডিসমিসল্যাব নিজেই ২০২৪ সালের অক্টোবরে খণ্ডন করেছে।
নিবন্ধটি জমা দেওয়া হয় “জাতিসংঘ এবং সংঘাত রিপোর্টিংয়ের রাজনীতি” শিরোনামে। তবে, আইপিডির সম্পাদকেরা সেটি পরিবর্তন করে “জাতিসংঘের কি পক্ষপাতের সমস্যা আছে?” শিরোনাম দেন। তারা তথ্য বা লেখকের কোনো সত্যতা যাচাই না করেই ২৪ ফেব্রুয়ারি এটি প্রকাশও করেন। প্রকাশ প্রক্রিয়া ছিল খুবই সহজ— একটি গুগল ফর্ম পূরণ এবং ইমেইলে লেখা পাঠানো।
ডিসমিসল্যাবের পক্ষ থেকে, গত ২৪ মার্চ, নিবন্ধে অপতথ্য থাকার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে, সম্পাদক লাইম্যান বলেন, “যেকোনো সংবাদ ওয়েবসাইটেই মাঝে মাঝে ভুল তথ্য চলে আসে। দুর্ভাগ্যজনক, তবে সেগুলো সহজেই ঠিক করে নেওয়া যায়।”
তবে ভিন্ন ঘটনা ঘটে আরেকটি নিবন্ধ নিয়ে, যা ডিসমিসল্যাব জমা দিয়েছিল ৬ মার্চ। এর লেখক ছিলেন আরেক ভুয়া ব্যক্তি—নাজিব খান, যার ছবি নেওয়া হয়েছিল ফ্রিপিক থেকে এবং পরিচয় ছিল বানোয়াট। এই লেখায় শিক্ষার্থীদের নতুন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) সম্পর্কে ইতিবাচক বর্ণনা দেওয়া হয়। আইপিডি এই নিবন্ধ এখনো প্রকাশ করেনি।
ডিসমিসল্যাব যখন ভুয়া লেখক নাজিব খানের ইমেইল থেকে লেখাটি প্রকাশ না হওয়ার কারণ জানতে চায়, তখন আইপিডির সম্পাদক ইমেইলে দুঃখ প্রকাশ করে জানান যে তার পরিবারের একজন সদস্য “হামলার শিকার হয়ে চিকিৎসাধীন থাকায়” তিনি ব্যস্ত ছিলেন। তিনি লেখেন, “আমি প্রতিটি লেখা নিজে পড়ি ও সম্পাদনা করি। এ ব্যাপারে আমি পুঙ্খানুপুঙ্খ থাকার চেষ্টা করি।”