সুদেষ্ণা মহাজন অর্পা

ইন্টার্ন, ডিসমিসল্যাব

নোশিন তাবাসসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

মো. তৌহিদুল ইসলাম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

তাসনিম তাবাস্সুম মুনমুন

ফেলো, ডিসমিসল্যাব
অক্টোবর ১৭, ২০২৫
২০:৪০:১৩
ডাকসু নির্বাচনে নারী প্রার্থীরা যেভাবে সাইবার হয়রানির শিকার হলেন

ডাকসু নির্বাচনে নারী প্রার্থীরা যেভাবে সাইবার হয়রানির শিকার হলেন

অক্টোবর ১৭, ২০২৫
২০:৪০:১৩

সুদেষ্ণা মহাজন অর্পা

ইন্টার্ন, ডিসমিসল্যাব

নোশিন তাবাসসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

মো. তৌহিদুল ইসলাম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

তাসনিম তাবাস্সুম মুনমুন

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনকে অনেকেই জাতীয় রাজনীতির প্রতিচ্ছবি মনে করেন। এখান থেকেই দেশের অনেক রাজনৈতিক নেতৃত্বের শুরু, আর এর ফল প্রায়ই জাতীয় রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এই গবেষণায় দেখা হয়েছে, ডাকসু নির্বাচনে নারী প্রার্থীরা অনলাইনে কীভাবে গালাগালি, বিদ্বেষ ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এই অভিজ্ঞতা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে নারী প্রার্থীদের জন্যও এক ধরনের সতর্ক সংকেত হতে পারে।

এই লেখায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীদের উদ্দেশ করে ব্যবহৃত কিছু গালি ও অবমাননাকর শব্দ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এটি করা হয়েছে গবেষণার প্রেক্ষিতে অনলাইন সহিংসতার ভাষা ও প্রকৃতি সঠিকভাবে উপস্থাপন করার জন্য, যাতে প্রেক্ষিত ও অর্থ বিকৃত না হয়।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রচারণায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লৈঙ্গিক বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, ব্যক্তিগত আক্রমণ, চরিত্রহনন বা যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্যের শিকার হচ্ছেন বলে জানিয়েছিলেন একাধিক নারী প্রার্থী। কাউকে বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের কারণে, আবার কাউকে জাতিগত পরিচয়ের কারণে হতে হয়েছে বিদ্রুপ ও অবমাননাকর মন্তব্যের শিকার। কারও ডিপফেক ভিডিও ছড়ানো হয়েছে, আবার কেউ পেয়েছেন যৌন সহিংসতার হুমকি। ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে নারী প্রার্থীরা অনলাইনে কী ধরনের হয়রানির মুখে পড়েছেন—তা খতিয়ে দেখতে ডিসমিসল্যাবের এই গবেষণা। 

এই গবেষণায় বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যম ও নিজের সামাজিক মাধ্যমে সাইবার হয়রানির কথা জানানো আলোচিত ৫ নারী প্রার্থীকে নির্বাচন করা হয়েছে। তারা হলেন ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা, বামপন্থী ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী শেখ তাসনিম আফরোজ (ইমি), ইসলামী ছাত্রশিবির–সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক পদপ্রার্থী ফাতিমা তাসনিম জুমা, বামপন্থী ‘অপরাজেয় ৭১ ও অদম্য ২৪’ জোটের প্রার্থী বি এম ফাহমিদা আলম এবং ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ প্যানেলের সদস্য পদপ্রার্থী হেমা চাকমা।

এই নারী প্রার্থীদের নিয়ে অনলাইনে কী ধরনের হয়রানিমূলক বক্তব্য এসেছে— তা দেখার জন্য ডাকসু নির্বাচনের ৪ দিন আগে, গত ৪ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে প্রত্যেকের নাম সার্চ করে প্রথম ১০০টি পোস্ট সংগ্রহ করে ডিসমিসল্যাব। এসব পোস্টের বিষয়বস্তু ছিল বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন, নির্বাচনী প্রচারণা, জরিপ বা বিভিন্ন প্যানেল ও প্রার্থীদের পক্ষে-বিপক্ষে ব্যক্তিগত মন্তব্য-বিশ্লেষণ। ডিসমিসল্যাব এরপর এসব পোস্ট এবং এর নিচে থাকা মন্তব্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে যে সেখানে কোনো বিদ্বেষমূলক উপাদান ছিল কিনা। কোনো পোস্টের নিচে একটি মন্তব্যেও এমন উপাদান পাওয়া গেলে সেই পোস্টকে বিবেচনা করা হয়েছে সমস্যাজনক পোস্ট হিসেবে। এরপর এসব পোস্টের নিচে থাকা সব মন্তব্য সংগ্রহ করে সেগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দেখা হয়েছে কোন প্রার্থীর ক্ষেত্রে কত শতাংশ মন্তব্য বিদ্বেষমূলক ছিল এবং এসব মন্তব্যে আক্রমণের ধরন কেমন। (বিস্তারিত দেখুন: গবেষণা পদ্ধতিতে)

সামগ্রিক বিশ্লেষণ

ডিসমিসল্যাবের এই বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৫ প্রার্থীর জন্য সংগৃহীত মোট ৫০০টি পোস্টের মধ্যে ২২ শতাংশ পোস্টেরই (১১০টি) বিবরণে বা মন্তব্যের ঘরে বিদ্বেষ ও হয়রানিমূলক উপাদান ছিল। আর এই ২২ শতাংশ পোস্টের নিচে থাকা মোট মন্তব্যের (১৩,৬৭৪টি) ২৪ শতাংশই ছিল বিদ্বেষ ও হয়রানিমূলক।

১১০টি পোস্টের মধ্যে সমস্যাজনক পোস্ট ছিল ১৬.৪ শতাংশ, শুধু সমস্যাজনক কমেন্ট ছিল ৮০.৯ শতাংশ পোস্টে এবং পোস্ট ও কমেন্ট- দুই ক্ষেত্রেই সমস্যাজনক উপাদান পাওয়া গেছে- এমন পোস্ট ছিল ২.৭ শতাংশ।

সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হয়েছেন ফাহমিদা আলম ও তাসনিম আফরোজ ইমি। ‘অপরাজেয় ৭১ ও অদম্য ২৪’ প্যানেলের প্রার্থী ফাহমিদার পোস্টগুলোর নিচে পাওয়া মোট ৩৯৮৩টি মন্তব্যের ৩৯ শতাংশই ছিল বিদ্বেষমূলক। আর ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ইমির ক্ষেত্রে ৩৮ শতাংশ মন্তব্য ছিল বিদ্বেষমূলক। সবচেয়ে কম বিদ্বেষমূলক মন্তব্য পাওয়া গেছে ছাত্রশিবির–সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের প্রার্থী ফাতিমা তাসনিম জুমার ক্ষেত্রে, ৪ শতাংশ।

বিদ্বেষমূলক বক্তব্যগুলোকে তাদের ধরন অনুযায়ী ছয়টি বিভাগে ভাগ করেছে ডিসমিসল্যাব।

  • লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ভিত্তিক গালি ও অপমান
  • শারীরিক বৈশিষ্ট্য বা পোশাক নিয়ে অপমান
  • সাধারণ গালি ও অপমান
  • মতাদর্শিক কারণে অবমাননা ও হেয় করা
  • স্টেরিওটাইপ ও সমষ্টিগত কারণে অপমান
  • হুমকি ও সহিংসতায় প্ররোচনা

দেখা গেছে, একেক প্রার্থীকে একেক ধরনের বৈশিষ্ট্যের কারণে বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তবে সামষ্টিকভাবে সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা গেছে, ‘স্টেরিওটাইপিং মন্তব্য’—অর্থাৎ, কোনো বস্তু বা বিশেষ গোষ্ঠীর মানুষের (যেমন: জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ ইত্যাদি) আচরণ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বহুপ্রচলিত একটি অতিসরলীকৃত ও স্থায়ী ধারণা, অনেক ক্ষেত্রে যা ভুল বা নেতিবাচক, এমন কিছু বলে অপমান করা। উদাহরণস্বরূপ, বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত প্রার্থীদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, তারা নিয়মিত গোসল করে না, তাদের গায়ে দুর্গন্ধ, কিংবা তারা মাদকাসক্ত — যা বাম রাজনীতিকে নিয়ে প্রচলিত নেতিবাচক ধারণার পুনরাবৃত্তি। এই ধরনের স্টেরিওটাইপিং মন্তব্য মোট বিদ্বেষসূচক মন্তব্যের প্রায় ৩২ শতাংশ।

এরপরের অবস্থানে আছে ‘লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ভিত্তিক গালি ও অপমান’, যা প্রায় ৩১ শতাংশ। যেমন, পতিতা বা বেশ্যা ইত্যাদি জেন্ডারভিত্তিক গালি, যার মূল উদ্দেশ্য নারীর চরিত্রহনন ও তাকে হেয় প্রতিপন্ন করা। এছাড়া কখনো কখনো তাদের লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে সন্দেহ পোষণ করা কিংবা তৃতীয় লিঙ্গের দাবি করা ইত্যাদিও এই তালিকায় রয়েছে।

তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রায় ১৮ শতাংশ মন্তব্যে দেখা গেছে ‘সাধারণ গালাগালি ও অপমানসূচক বক্তব্য’। এর মধ্যে রয়েছে মানুষ ব্যতীত অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে তুলনা করা, অশালীন শব্দ ব্যবহার, বা বিভিন্ন নেতিবাচক বিশেষণে অপমান করা। অন্যদিকে, প্রায় ১৫ শতাংশ বিদ্বেষমূলক মন্তব্য ছিল নারীর বাহ্যিক ও শারীরিক বৈশিষ্ট্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, চুল, সাজসজ্জা বা বয়স নিয়ে কটূক্তি বা বিদ্রূপ—অর্থাৎ, ‘বডি শেমিং’। এতে প্রার্থীদের শরীর, চেহারা বা পোশাকের ভিত্তিতে হেয় করা হয়েছে।

বাকি দুটি ক্যাটাগরিতে মতাদর্শভিত্তিক অবমাননা ও হেয় করা এবং হুমকি ও সহিংসতায় প্ররোচনা মন্তব্যের হার তুলনামূলকভাবে কম—যথাক্রমে ২.৩% ও ২%। ‘মতাদর্শভিত্তিক অবমাননা ও হেয় করা’- এই শ্রেণিতে আছে সে শব্দগুলো যা সাধারণভাবে গালি নয়, কিন্তু কোনো ব্যক্তি, মতাদর্শ বা কারও অবস্থাকে নেতিবাচক দেখিয়ে আক্রমণ করা হয়েছে। হুমকি ও সহিংসতায় প্ররোচনা- এই শ্রেণির মন্তব্যগুলো সরাসরি সহিংসতা বা যৌন সহিংসতার ভয় দেখায় বা উসকানি দেয় — যেমন “ধর্ষণ করব”, “জুতা মারব”, “মারব” ইত্যাদি। এসব কেবল ঘৃণাসূচক বক্তব্য নয়, বাস্তব সহিংসতার সম্ভাবনাও বাড়ায় এবং হেনস্তার লক্ষ্যবস্তুর নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করে।

শারিরীক বৈশিষ্ট্যের কারণে বিদ্রুপের শিকার উমামা ফাতেমা

ডাকসু নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) পদে ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন উমামা ফাতেমা। জুলাই আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখাসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে আলোচিত হলেও গত জুনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হল সংসদে নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর নতুন করে সাইবার হয়রানির মুখে পড়েন উমামা। তার নাম সার্চ করে পাওয়া প্রথম ১০০টি পোস্টের মধ্যে ৪০টি পোস্টেই দেখা গেছে হয় পোস্টের বিবরণে অথবা পোস্টের নিচে থাকা কমেন্টগুলোর মধ্যে অন্তত ১টিতে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য আছে। এই ৪০টি পোস্টের নিচে থাকা সব কমেন্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এসব কমেন্টের ১৯ শতাংশ ক্ষেত্রে ছিল বিভিন্ন বিদ্বেষমূলক ও যৌন হয়রানিমূলক বক্তব্য।

বিদ্বেষমূলক মন্তব্য ছাড়াও সেখানে আপত্তিকর ফটো–কমেন্ট, গালিগালাজ এবং লিঙ্গভিত্তিক হয়রানির উদাহরণ মিলেছে। উমামার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে শারীরিক বৈশিষ্ট্য বা পোশাক নিয়ে অপমানসূচক মন্তব্য (৪৭%)। যেমন, বলা হয়েছে, “দাঁতনি রে দেখলে ঘৃণা লাগে😐”, বা “দাঁতের কি একটা অবস্থা।” বা “তোর দাঁত গুলা ঠিক করস না কেন”।

এরপরেই বেশি দেখা গেছে বিভিন্ন লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ভিত্তিক গালি ও অপমান (২৬%)। এছাড়াও সাধারণভাবে প্রচলিত গালি বা বিভিন্ন অপমানসূচক মন্তব্য দেখা গেছে ১৬ শতাংশ ক্ষেত্রে।

উমামার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে নির্বাচনে দোয়া চেয়ে দেওয়া পোস্টের নিচেও যৌন সহিংসতার ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য এসেছে। এমনকি ফেসবুকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের নিচে করা মন্তব্যেও অন্যান্য দলীয় নেতাদের সঙ্গে জড়িয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তা দেওয়া হয়েছে। তার নিজের পোস্টেই একজন মন্তব্য করেন, “তুমি আবার ভিপি হতে চাও? তুমি হাসনাত সারজিসের রাতের খাবার।”

ডিসমিসল্যাবকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উমামা বলেছেন, নির্বাচন ঘিরে এই আক্রমণকে ব্যক্তিগত নয় বরং সামগ্রিকভাবেই নারী প্রার্থীদের জন্য একটি অভিন্ন সমস্যা হিসেবে দেখছেন। উমামার ভাষ্য, নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণার পর প্রথমে বট আইডি দিয়ে আক্রমণ করে তার ব্যক্তিগত আইডির রিচ কমিয়ে দেওয়া হয়। নির্বাচনে প্রার্থী থাকায় তিনি কমেন্ট বক্স খোলা রেখেছিলেন। সেখানে নিয়মিতই অবমাননাকর মন্তব্য করা হতো। তিনি বলেন, “আমার ফেশিয়াল এক্সপ্রেশন, জেসচার এবং শারীরিক অবয়ব- প্রতিটি বিষয় নিয়ে অবমাননাকর কথা বলা হতো।”

শিবিরের দুই নারী প্রার্থী এবং জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নারী প্রার্থীদেরও একই ধরনের হয়রানির শিকার হওয়ার কথা উল্লেখ করে উমামা বলেছেন, এসব আক্রমণ বিচ্ছিন্ন নয়, বরং সমন্বিত। দাবি করেছেন, ফেসবুক আইডির রিচ কমাতে এমনকি বিদেশি বট আইডি থেকেও পরিকল্পিত আক্রমণ হয়েছে।

এই হয়রানির প্রতিকার পেতে বিশ্ববিদ্যালয়, প্রশাসন বা ফেসবুক- কোনো পক্ষ থেকেই উল্লেখযোগ্য সহায়তা পাননি বলেও জানান উমামা। তার ভাষ্য, “বেশিরভাগ সময়েই এটা আমলে নেওয়া হয় না।”

আমার ফেশিয়াল এক্সপ্রেশন, জেসচার এবং শারীরিক অবয়ব - প্রতিটি বিষয় নিয়ে অবমাননাকর কথা বলা হতো - বলেন উমামা ফাতেমা

সবচেয়ে বেশি বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের শিকার ফাহমিদা

“অপরাজেয় ৭১ ও অদম্য ২৪” প্যানেলের মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক পদপ্রার্থী বি এম ফাহমিদা আলম সবচেয়ে বেশি বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের শিকার হয়েছেন। ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী এস এম ফরহাদের মনোনয়নকে আইনগতভাবে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন বামজোট সমর্থিত এই প্রার্থী। এর প্রতিক্রিয়ায় তাকে চরম যৌন সহিংসতাপূর্ণ আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে, যার মধ্যে ছিল ‘গণধর্ষণের’ হুমকিও।

ফাহমিদা আলমের রিট আবেদনের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে কেন্দ্র করে বিদ্বেষমূলক প্রচার শুরু হয়। এই বিদ্বেষ এতটাই ভয়াবহ রূপ নেয় যে, আলী হোসেন নামের এক শিক্ষার্থী ফেসবুকে ফাহমিদার বিরুদ্ধে “গণধর্ষণ মিছিল” করার ডাক দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরে আলী হোসেনকে ছয় মাসের জন্য বহিষ্কার করে।

ডিসমিসল্যাবের এই বিশ্লেষণে দেখা যায়, ফাহমিদা আলমকে নিয়ে করা পোস্টগুলোর ১৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই হয় পোস্টের বিবরণে অথবা কমেন্টে বিদ্বেষসূচক বক্তব্য এসেছে। এসব পোস্টের নিচে থাকা কমেন্টগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৩৯ শতাংশ কমেন্টই ছিল বিদ্বেষমূলক।

ফাহমিদাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ভিত্তিক অপমানসূচক বক্তব্য এবং অন্যান্য গালি। ছোট চুলের দিকে ইঙ্গিত করে তার লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে কটাক্ষ করা হয়েছে। যেমন, বলা হয়েছে, “তুর চুল কই? তুমি ছেলে নাকি মেয়ে?”, বা “এ কি মহিলা, না পুরুষ?” বা “এটা বেটা না বেটি?”

দৈনিক সমকালের একটি ভিডিও প্রতিবেদনে এস এম ফরহাদের বিরুদ্ধে রিট করার কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন ফাহমিদা। ফেসবুকে সেই প্রতিবেদনে অশ্রাব্য ভাষায় মন্তব্য করা হয়েছে। একটি মন্তব্যে লেখা হয়েছে, “*** উত্তরা আবাসিক হোটেলের”। ছোট চুলের জন্য লিঙ্গভিত্তিক হয়রানিরও শিকার হন ফাহমিদা। কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন তিনি ছেলে নাকি তৃতীয় লিঙ্গের তা বোঝা যায় না। বাংলা নিউজ ২৪-এ ফাহমিদার আরেকটি সাক্ষাৎকারের নিচে করা মন্তব্যগুলোও একইরকম বিদ্বেষপূর্ণ। সেখানে একজন লিখেছেন, “সে দেখতে তো এক জন পুরুষের মতো।” আরেকটি মন্তব্যে লেখা, “সাবান লাগলে সাবান নে শাহবাগিদের গোসল দে।”

সাইবার হয়রানি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ফাহমিদা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “রিট আবেদনের সময় বিষয়টি শুধু সাইবার হামলায় সীমাবদ্ধ ছিল না। শুধু একজন নারী বলেই আমাকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল এবং বিভিন্ন ধরনের অমানবিক আচরণ সহ্য করতে বাধ্য করা হয়েছিল।” বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি আরও বলেন, “যদি এই রিট আবেদন কোনো পুরুষ প্রার্থী করতেন? নারীদের ক্ষেত্রে এমন হামলা তুলনামূলক বেশি সংগঠিত ও নিরবচ্ছিন্ন হয়ে ওঠে। ওই ঘটনার পর থেকে ভয়ে আছি, এসব হুমকি আর শুধু অনলাইনে সীমাবদ্ধ নেই। এখন বাস্তবেই সত্যিকারের শারীরিক লাঞ্ছনার আশঙ্কা করছি।”

“অপরাজেয় ৭১ ও অদম্য ২৪” প্যানেলের মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক পদপ্রার্থী বি এম ফাহমিদা আলম

চরিত্রহনন ডিপফেকের শিকার ফাতিমা তাসনিম জুমা

ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল থেকে লড়ে বিজয়ী হয়েছেন ফাতিমা তাসনিম জুমা। প্রচারণার সময় রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে তিনি শুধু সাইবার হয়রানির শিকারই হননি, পেয়েছেন গণধর্ষণের হুমকি। চরিত্রহননের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে তার এআই-জেনারেটেড ছবিও। 

ডিসমিসল্যাবের বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুমাকে নিয়ে করা ১০০টি পোস্টের মধ্যে ১৫টি পোস্টেই বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক কমেন্ট। তবে জুমা সংশ্লিষ্ট এসব পোস্টের সব কমেন্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেখানে বিদ্বেষ বা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কমেন্ট ছিল অন্য প্রার্থীদের তুলনায় সবচেয়ে কম। মাত্র ৪ শতাংশ।

এই আক্রমণগুলো শুধু তার রাজনৈতিক বক্তব্য বা দর্শনকে কেন্দ্র করে ছিল না, সরাসরি তার নারী পরিচয়কেও লক্ষ্য বানিয়ে করা হয়েছে। তাকে নিয়ে লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ভিত্তিক অপমান ছিল সবচেয়ে বেশি, ৬৬ শতাংশ। ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের একটি পোস্টের মন্তব্যে তাঁকে “পতিতালয়ের নর্তকী সাদিক কায়েম ফরহাদের রাতের ডিনার” বলে আক্রমণ করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের নিচে “শিবিরের রাতের খাবার”, “শিবিরের দাসী”, “জাশির যৌ ন দাসী” এবং “মিয়া খলিফার (পর্নোগ্রাফিক তারকা) শিবির ভার্সন” ইত্যাদি অবমাননাকর মন্তব্য করা হয়েছে।

অনলাইন হয়রানি জুমার ব্যক্তিগত জীবনেও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডিসমিসল্যাবকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমাকে ভার্চুয়ালি কেউ যদি গণধর্ষণের হুমকি দেয় কিংবা আমার ফ্যামিলিকে হুমকি দেয়, সেটা তো অবশ্যই আমার ব্যক্তিগত প্রভাব ফেলে। আমি অনিরাপদ বোধ করি।” এই হুমকির ভয়াবহতা এতটাই যে, ডাকসু নির্বাচনের আগে তার বাবা-মা গ্রাম থেকে ঢাকায় চলে আসতেও বাধ্য হয়েছিলেন বলে জানান জুমা।

আক্রমণের মাত্রা নতুন রূপ নেয় যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে তার সম্পাদিত ছবি ছড়ানো হয়। ডিসমিসল্যাবের বিশ্লেষণ করা কমেন্টগুলোতেও দেখা গেছে এমন কিছু সম্পাদিত ছবি। জুমা বলেন, “আমার ডিপফেক বানানো হয়েছে। আমার সহকর্মীদের সঙ্গে মিলিয়েও আমার অশ্লীল ভিডিও বানানো হয়েছে। যারা এআই সম্পর্কে জানে না, তাদের কিন্তু আমার বোঝানোর ক্ষমতা নাই।”

জুমা মনে করেন, এই আক্রমণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি “সম্মিলিত আক্রমণ”। তার ভাষায়, “সবার রাজনৈতিক প্যানেল আলাদা আলাদা, কিন্তু তারা যখন আমাকে আক্রমণ করছে তখন তারা একেবারে একসাথে ঐক্যবদ্ধ। কে কোনটা নিয়ে বলবে, এটা ঠিকঠাক করেই করছে।”

তবে এই হয়রানির বিরুদ্ধে তিনি কোনো প্রশাসনিক বা আইনি সুরক্ষা পাননি বলেও জানান। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখতিয়ারের বাইরে বলে দায় এড়িয়েছে বলে উল্লেখ করেন জুমা। এছাড়া থানায় করা সাধারণ ডায়েরির (জিডি) কোনো অগ্রগতি জানানো হয়নি তাকে। ফেসবুক বা মেটার কাছে রিপোর্ট করেও বিকৃত ছবিগুলো সরানো সম্ভব হয়নি জানান এই নারী প্রার্থী।

জুমা অভিযোগ করেন, সব রাজনৈতিক প্যানেলকে একত্রিত হয়ে সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েও সাড়া পাননি। তিনি বলেন, “এই গালি খাওয়াটা আসলে অনেকের রাজনীতি (রাজনৈতিক অবস্থান) দাঁড় করিয়ে দেয়। আমাদের জন্য এটা হচ্ছে ট্রমাটাইজিং ব্যাপার। কিন্তু বাকিরা আগ্রহী না, কারণ এটা না করলে তাদের ওই রাজনৈতিক ফায়দাটা আসে না।”

চরিত্রহনন ও ডিপফেকের শিকার ফাতিমা তাসনিম জুমা

জাতিগত পরিচয়ের কারণে আক্রমণের শিকার হেমা চাকমা

এবারের ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে বামপন্থী সাতটি ছাত্রসংগঠন মিলে গঠন করেছিল প্রতিরোধ পর্ষদ। প্রতিরোধ পর্ষদ প্যানেলের হেমা চাকমা কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য পদে নির্বাচিত হয়েছেন।

নারী প্রার্থী হওয়া, জাতিগত পরিচয়, পূর্বে ছাত্রলীগের উপ-সাংস্কৃতিক পদে থাকা এবং বামপন্থী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা – বেশ কয়েকটি কারণে অনলাইনে তাকে বিশেষভাবে লক্ষ্য বানানো হয়েছে বলে ডিসমিসল্যাবের বিশ্লেষণে ধরা পড়ে। এছাড়া ডাকসুতে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট প্যানেলের মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক ফাতিমা তাসনিম জুমাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্কিত পোস্ট করাতেও হেমা চাকমা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনায় আসেন।

হেমাকে নিয়ে ডিসমিসল্যাবের বিশ্লেষণ করা ১০০টি পোস্টের মধ্যে ২১ শতাংশ পোস্টেই পাওয়া গেছে বিভিন্ন বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য। এই ২১ শতাংশ পোস্টের নিচে পাওয়া সব কমেন্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেখানে ১৭ শতাংশ কমেন্ট ছিল বিদ্বেষমূলক।

অন্য প্রার্থীদের মতো হেমাকে নিয়েও দেখা গেছে বিভিন্ন যৌন হয়রানি এবং লিঙ্গভিত্তিক বিদ্বেষমূলক মন্তব্য। এটিএন বাংলা নিউজের একটি ভিডিও প্রতিবেদনে একজন মন্তব্যকারী লিখেছেন, “এত গলা ফাঠিয়ে লাব কি দিন শেষে বাঙালিদের রাতের খাবার তুমি”।

হেমা চাকমা নিজেও অনলাইন আক্রমণ নিয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়েছেন। তার ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে দেওয়া এক পোস্টে তিনি উল্লেখ করেন, নির্বাচনে প্রার্থিতা ঘোষণা করার পর থেকে ইনবক্সে গালি, অশালীন বার্তা এবং কটূক্তি পাচ্ছেন। ডিসমিসল্যাবকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “মেয়েদের উদ্দেশে যেসব গালি সাধারণত দেওয়া হয়, সেগুলোই আমার দিকে ছোড়া হচ্ছে। মিমও বানানো হচ্ছে।”

অনলাইন নিরাপত্তাহীনতার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে বলেছেন, “অনলাইনে নিজেকে অনিরাপদ মনে করি। মন্তব্যের প্রাইভেসি আগে পাবলিক ছিল, এখন ফ্রেন্ডস করেছি। ‘যেখানেই পাই, অবস্থা খারাপ করে দেব’- এ ধরনের জীবননাশের হুমকিও পেয়েছি। আমি তো সবসময় কাউকে সঙ্গে রাখতে পারি না, অনেক সময় একাই চলাফেরা করতে হয়। এটাই সবচেয়ে উদ্বেগের।”

হেমার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে জাতিগত পরিচয়ের কারণে বিভিন্ন আক্রমণাত্মক মন্তব্য করতে দেখা গেছে। যেমন, এক জায়গায় বলা হয়েছে, “এই মেয়ে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের সমর্থক , বাঙালি ও আর্মি বিদ্বেষী ।” বা “ওরা হলো দেশ বিদ্রোহী”। বা “এই উপজাতিরা দেশদ্রোহী এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সরকারকে খেসারত দিতে হবে”। 

হেমা মনে করেন, তার জাতিগত পরিচয় এই আক্রমণ বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। তার ভাষায়, “যেহেতু আমি পাহাড়ের মেয়ে, এই হয়রানিটা আরও বেশি গুরুতর। আমি যখন কোনো একটা আন্দোলন করি, তখন কিন্তু আমি রাষ্ট্রদ্রোহী, দেশদ্রোহী হয়ে যাই।” তার কাছে সবচেয়ে হতাশাজনক ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে সরাসরি জাতিগত ও যৌন নিপীড়নমূলক হুমকি পাওয়া।

জাতিগত পরিচয়ের কারণে আক্রমণের শিকার হেমা চাকমা

আইনি প্রতিকার না চাওয়ার ব্যাখ্যায় হেমা বলেন, “আমি জানি এই দেশে বিচার চাওয়া মানে একটা প্রথা ভাঙা। কয়বার যাব আমি?” দলের সহকর্মীরা মানসিকভাবে পাশে থাকলেও প্রশাসনিক সহায়তা মেলেনি। প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিকার না চাওয়ার প্রসঙ্গে হেমার মন্তব্য, “প্রতিকার চাইতে যাইনি, কারণ এখানে বিচার চাইতে গেলে বারবার ধাক্কা খেতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাইবার বুলিং না করার কড়া নির্দেশনা ছিল, তবু হচ্ছে। এখন অভিযোগ করতে গেলে বিচার হবে না, উল্টো আমার প্রচারণাই ব্যাহত হবে। প্রশাসন থেকেও কোনো সহায়তা পাইনি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ধরনের আক্রমণগুলো আমাদের ভাগ্য হয়ে গেছে।”

বাম সংশ্লিষ্টতার কারণে আক্রমণের শিকার শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি

এবারের ডাকসু নির্বাচনে প্রতিরোধ পর্ষদ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ছিলেন শেখ তাসনিম আফরোজ (ইমি) । ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনেও শামসুন নাহার হল সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন ইমি। গত ১২ আগস্ট, ২০২৫ নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে পোস্ট দিয়ে এবারের ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ঘোষণা দেন। এরপর থেকেই নারী প্রার্থী হওয়ায় এবং বামপন্থী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততার কারণে সাইবার হয়রানির শিকার হন।

ডিসমিসল্যাবের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ইমিকে নিয়ে করা পোস্টগুলোর ১৫ শতাংশেই ছিল বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য। এসব পোস্টের সব মন্তব্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মোট মন্তব্যের ৩৮ শতাংশই ছিল বিদ্বেষপূর্ণ।

ইমির ক্ষেত্রে এসব নেতিবাচক মন্তব্যের অধিকাংশই এসেছে তার বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে। বামপন্থীরা গোসল করা না, মাদক গ্রহণ করে– এই ধরনের স্টেরিওটাইপ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন দেখা গেছে ইমিকে কেন্দ্র করে আসা নেতিবাচক মন্তব্যগুলোতে। যেমন, বলা হয়েছে “গাঁজাখোরের দল” বা “গাঞ্জার প্রভাবে এক একটার যা অবস্থা 🙄” ইত্যাদি।

ইমির বয়স বেশি এমন ইঙ্গিত দিয়েও করা হয়েছে বিভিন্ন নেতিবাচক মন্তব্য। অনেক জায়গায় তাকে ডাকা হয়েছে, “নানী”, “খালাম্মা”, “শিক্ষার্থীদের মা” ইত্যাদি বলে। পাওয়া গেছে বিভিন্ন যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্যও। যেমন রাজশাহী ইউনিভার্সিটি নিউজ২৪ নামের একটি পেজে ইমিকে নিয়ে করা পোস্টে একজন মন্তব্য করেন, “ছাত্রলীগের খাবার ছিল এটা”। আরেকজন লিখেছেন, “ফিউজ হয়ে গেছে। লাগাইতে লাগাইতে”। প্রথম আলোর একটি ফেসবুক পোস্টের নিচে বেশ কয়েকজন যৌন হয়রানিমূলক কটূক্তি করেছেন। একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “চন্দ্রিমা উদ্যানের খদ্দের খোঁজা মহিলা”। একই পোস্টে আরেকজন মন্তব্য করেছেন, “ইনি কি কোন হোটেল থেকে পালিয়ে আসছে নাকি দৌলতিয়া পল্লী থেকে আসছে”।

সাইবার আক্রমণ নিয়ে শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি প্রথম আলোকে বলেছেন, “অনলাইনে প্রচুর হ্যারাসমেন্টের (হয়রানির) শিকার হচ্ছি। আজেবাজে গালাগালি করা হচ্ছে। বিশেষ করে ডানপন্থী কিছু সংগঠন খুব বাজেভাবে আক্রমণ করে, শাহবাগি ট্যাগ (অভিহিত করা) দেয়। সবকিছু মিলিয়ে আমি বলব, আসলে কোনো সংগঠনের নারী প্রার্থীদের জন্যই ভালো পরিবেশ নেই।”

ইমি জানিয়েছিলেন, এই আক্রমণ বিচ্ছিন্নভাবে শুধু তাকেই করা হচ্ছে না। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথোপকথনে বলেছেন, “আমাদের প্যানেলের প্রায় ১১ জন নারীই হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এদের মধ্যে যারা আদিবাসী, তাদের নিজ জাতিগত পরিচয়ের কারণে আক্রমণ করা হচ্ছে, আবার নারী হওয়ার কারণেও লক্ষ্য বানানো হচ্ছে।”

বাম সংশ্লিষ্টতার কারণে আক্রমণের শিকার শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি

গবেষণা পদ্ধতি

এই গবেষণায় ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী পাঁচ নারী প্রার্থী, যারা বিভিন্ন সময় গণমাধ্যম ও ফেসবুকে সাইবার হয়রানির শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন তাদের নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আক্রমণের ধরন বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গত ৪ সেপ্টেম্বর, ফেসবুকে পাঁচ প্রার্থীর নাম সার্চ করে ২৯ জুলাই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে সেদিন পর্যন্ত দেওয়া প্রথম ১০০টি করে মোট ৫০০টি পাবলিক পোস্ট সংগ্রহ করা হয়।

এরমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রার্থীদের নামে প্রচারিত সংবাদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পাবলিক পেজ ও প্রোফাইল থেকে পাওয়া পোস্টও ছিল। প্রতিটি পোস্টের কমেন্ট পর্যালোচনা করে যেসব পোস্টে অন্তত একটি হলেও হয়রানিমূলক বা বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য পাওয়া যায় সেগুলোকে ‘সমস্যামূলক পোস্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই পোস্টগুলো থেকে ১৩ হাজার কমেন্ট সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি কমেন্ট বিশ্লেষণ করে প্রত্যেক প্রার্থীর বিপরীতে কত শতাংশ মন্তব্য বিদ্বেষমূলক তা বিশ্লেষণ করা হয়।

হয়রানি হিসেবে ধরা হয়েছে লিঙ্গ–বিদ্বেষী ভাষ্য, যৌন ইঙ্গিত বা সহিংসতার হুমকি, শারীরিক অবয়ব বা বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিদ্রূপ, জাতিগত–ধর্মীয় অবমাননা, অপমানজনক বা অবমাননাকর লেবেলিং। শুধু পাবলিক হিসেবে দৃশ্যমান কনটেন্ট বিবেচনায় এসেছে এবং পোস্টগুলোর স্ক্রিনশট ও লিংক আর্কাইভ সংরক্ষণ করা হয়েছে।

আরো কিছু লেখা