আহমেদ ইয়াসীর আবরার
ইউটিউবে সস্তা মিথ্যার জমজমাট ব্যবসা
আহমেদ ইয়াসীর আবরার
প্রথম দেখাতেই আপনার মনে হবে ভিডিওগুলো ভুয়া এবং এর যে বার্তা ও উপস্থাপনা তা একেবারেই সস্তা। কোনো ভিডিওতে দাবি করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা ছেড়েছেন, কোনোটিতে বলা হচ্ছে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিয়েছে বা সচিবালয় দখল হয়ে গেছে; থাম্বনেইল বা ভিডিওর প্রচ্ছদ ও শিরোনামের সঙ্গেও ভেতরের বিষয়বস্তুর মিল নেই। সম্ভবত একবার দেখার পর একজন সচেতন দর্শক হিসেবে আপনি এই ইউটিউব চ্যানেলটিকে এড়িয়েও যাবেন।
কিন্তু ইউটিউবে এ ধরনের সস্তা মিথ্যার (চিপ ফেক) একটি বাজার গড়ে উঠেছে, সেই বাজারে ভিউ বা সাবস্ক্রাইবার ফুলে ফেঁপে উঠছে। এসব চিপ ফেকের চ্যানেলে বিজ্ঞাপন চলছে, সন্দেহ নেই যে সেই বিজ্ঞাপন থেকে প্লাটফর্ম হিসেবে ইউটিউব ব্যবসাও করছে। আর ভিউবাণিজ্যের এই বাজারে টাকার বিনিময়ে বদল হচ্ছে চ্যানেলের মালিকানা; কখনো শিক্ষামূলক, কখনো বা ধর্মীয় কনটেন্ট দিয়ে শুরু করে পরে সেগুলো রাজনৈতিক অপতথ্যের চ্যানেলে পরিণত হয়েছে।
সস্তা মিথ্যা বা চিপ ফেক হলো সস্তা মাধ্যম ব্যবহার করে অডিও-ভিডিও কারসাজির (ফটোশপ, ভিডিওর প্লেব্যাক স্পিড বৃদ্ধি বা হ্রাস, ভুল কনটেক্সট ব্যবহার ইত্যাদি) মাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়ানো। ডিসমিসল্যাব এমন কয়েকটি ইউটিউব চ্যানেল খুঁজে পেয়েছে যেখানে ইউটিউবের কনটেন্ট মডারেশন প্রক্রিয়াকে ফাঁকি দিয়ে এ ধরনের ভিডিও পোস্ট করা হয়।
সবাই শিখি, তাজা নিউজ ও মিডিয়া সেল ২৪ এমনই তিনটি চ্যানেল যারা ইউটিউবে রাজনৈতিক ভুয়া তথ্য প্রচার করার মাধ্যমে আয় করছে। ডিসমিসল্যাব এই তিনটি চ্যানেলের গভীর বিশ্লেষণ করেছে যে কীভাবে তারা এমন ভুল তথ্য প্রচারের চ্যানেলে পরিণত হলো। চ্যানেলগুলো জন্মের পর থেকে যত ভিডিও পোস্ট করেছে তার উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তারা যে সময় থেকে ভুল বা অপতথ্যভিত্তিক আধেয় পোস্ট করা শুরু করেছে, তখন থেকে তাদের ভিউ এবং সাবস্ক্রাইবার সংখ্যাও বাড়তে শুরু করেছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিগুণ বা তিনগুনের বেশি বেড়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই তিনটি চ্যানেলের ভিডিওতে বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়েছে, যেখান থেকে নিশ্চিতভাবে প্লাটফর্ম হিসেবে ইউটিউবও মুনাফা করেছে।
যত মিথ্যা, তত সাবস্ক্রাইবার
সবাই শিখি: নাম দেখেই মনে হবে এটি একটি শিক্ষামূলক চ্যানেল এবং চ্যানেলটির বিবরণেও এমনটাই বলা আছে। একটা সময় চ্যানেলটিতে স্কুল পর্যায়ের বিভিন্ন পরীক্ষা বা চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি সংক্রান্ত ভিডিও প্রকাশ করা হতো। কিন্তু ২০২৩ সালের মার্চ থেকে হঠাৎ করে চ্যানেলটি রাজনৈতিক অপতথ্য প্রচার করতে থাকে। এই চ্যানেল থেকে প্রচারিত এ ধরনের অন্তত ৫০টি ভিডিও নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
চ্যানেলটি ইউটিউবে যাত্রা শুরু করেছিল ২০২১ সালের মার্চে। শুরুর দিকের ভিডিওগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চ্যানেলটি শুরু হয়েছিল বিভিন্ন ধরনের শিক্ষামূলক ভিডিও প্রকাশ করার মাধ্যমে। ২০২৩ সালের ৮ মার্চ পর্যন্ত সেখানে নিয়মিতভাবে চাকরির বিজ্ঞপ্তি, চাকরি পরীক্ষার প্রশ্নের সমাধান, সাধারণ জ্ঞানসহ শিক্ষা সংক্রান্ত ৯০০টিরও বেশি ভিডিও প্রকাশ হয়েছে।
যাত্রা শুরুর দুই বছর পর থেকে, চ্যানেলটিতে আপলোড করা ভিডিওর ধরন বদলে যায় এবং তারা রাজনীতি বিষয়ক ভুল বা অপতথ্য প্রকাশ করতে থাকে। এবং দেখা যায়: রাজনৈতিক অপতথ্য ছড়ানো ভিডিওগুলোর তুলনামূলক ভিউ ছিল অনেক বেশি। ২০২১ সালের মার্চ থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত, দুই বছরে যে ৯৫৯টি শিক্ষামূলক ও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি সংক্রান্ত ভিডিও আপলোড করা হয়েছিল, সেগুলোর গড় ভিউ ছিল ২৮৭২। অন্যদিকে ২০২৩ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যে ২৫৬টি রাজনৈতিক অপতথ্যমূলক ভিডিও আপলোড করা হয়েছে, সেগুলোর গড় ভিউ ছিল ১,২১,৮২৮।
সোশ্যাল ব্লেডের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়: ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত চ্যানেলটিতে ছিল ৬৫ হাজার সাবস্ক্রাইবার। সেখানে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে চ্যানেলটিতে দেখা যায় ২ লাখ ৫ হাজার সাবস্ক্রাইবার। অর্থাৎ, ভুয়া খবর প্রচার শুরুর পর গত ১০ মাসে চ্যানেলটির সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে।
তাজা নিউজ: চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি সংক্রান্ত পোস্ট দিয়ে যাত্রা শুরু করে পরবর্তীতে রাজনৈতিক অপতথ্য ছড়ানো শুরু হয়েছে— এমন আরেকটি চ্যানেল তাজা নিউজ (Taza News)। চ্যানেলটিতে আছে ৫ লাখেরও বেশি সাবস্ক্রাইবার। ইউটিউবে চ্যানেলটি খোলা হয়েছিল ২০২১ সালের অক্টোবরে। এবং সেখানে চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি সংক্রান্ত ভিডিও দেওয়া হয়েছে প্রায় দেড় বছর ধরে। সেসময়ের এমন কিছু ভিডিওতে চ্যানেলটিকে “জব নিউজ” বলে উল্লেখ করতে শোনা যায়। এই সময়পর্বে আপলোড করা ১৮৯টি ভিডিও-র গড় ভিউ ছিল ৯ হাজার।
চাকরি সংক্রান্ত শেষ ভিডিওটি প্রকাশ করা হয় ২০২৩ সালের ১৪ এপ্রিলে। এরপর এক মাসের একটি বিরতির পর ২০২৩ সালের মে মাস থেকে চ্যানেলটিতে প্রকাশ করা হতে থাকে রাজনীতি বিষয়ক ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য সম্বলিত ভিডিও। গত ৮ মাসে এই চ্যানেলে এমন ভিডিও আপলোড করা হয়েছে ২১৮টি। এই সময়পর্বে চ্যানেলটির ভিডিওগুলোর গড় ভিউ ছিল ১৩,৩৭১।
সোশ্যাল ব্লেডের বিশ্লেষণে দেখা যায় নিয়মিতভাবেই এই চ্যানেলটির সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে চ্যানেলটির ভিউ অনেক বেশি হারে কমে যায়। ভিউ কমে যাওয়ার কারণ হতে পারে মাঝে এক মাস কোনো ভিডিও আপলোড না করা। সাবস্ক্রাইবার ও ভিউতে এই ধসের পর আবার একটি উত্থান লক্ষ্য করা যায় ২৯ মে থেকে ৫ জুন সময়কালের মধ্যে। এই সময়ে চ্যানেলে নতুন ১০ হাজার সাবস্ক্রাইবার যুক্ত হয়। অর্থাৎ, অপতথ্য ছড়ানো শুরুর সময়েই চ্যানেলটিতে আবার দর্শক সম্পৃক্ততা তৈরি হয় এবং তারপর থেকে সাবস্ক্রাইবার নিয়মিতভাবে বেড়েছে।
মিডিয়া সেল ২৪: এই চ্যানেলটি ভেরিফায়েড। চ্যানেলটির বিবরণে লেখা আছে: “প্রিয় দর্শক আমি জান্নাতি আমার ভিডিও পেতে চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে সাথে থাকুন।” ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে চালু হওয়া এই চ্যানেলে শুরুর দিকে আপলোড করা হয়েছে ছোট একটি মেয়ের বলা ছড়া, কবিতা বা ইসলামী গান। পরবর্তীতে আপলোড করা হয় পিরোজপুর জেলার একটি মাদ্রাসার প্রচার-প্রচারণামূলক কিছু ভিডিও। এভাবে চ্যানেলটি চলেছিল ১৩ মাস।
কিন্তু ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর থেকে এখানে রাজনীতি বিষয়ক ভুল তথ্যের ভিডিও আপলোড করা হতে থাকে। প্রথম ১৩ মাসে যেখানে চ্যানেলটিতে ২১৬টি ভিডিও আপলোড করা হয়েছিল, সেখানে গত ৩ মাসেই এখানে আপলোড করা হয়েছে ১৬৯টি ভিডিও। এবং চ্যানেলটির ভিউ ও রিয়্যাকশন ২২২ শতাংশ বেড়েছে। আগের ২১৬টি ভিডিও-র গড় ভিউ ছিল ৩৭,০৯৮। অন্যদিকে অপতথ্যমূলক ১৬৯টি ভিডিওর গড় ভিউ ছিল ১,১৯,৪৭০। অর্থাৎ, রাজনৈতিক চিপ ফেক প্রচার শুরুর পর থেকে চ্যানেলটির ভিডিওর গড় ভিউ প্রায় তিনগুণ বেড়েছে।
সোশ্যাল ব্লেডের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়: ২০২৩ সালের নভেম্বরে চ্যানেলটির সাবস্ক্রাইবার ছিল ৩৩,৯০০। রাজনৈতিক অপতথ্যমূলক ভিডিও আপলোড শুরুর পর গত তিন মাসেই চ্যানেলটিতে সাবস্ক্রাইবার বেড়েছে এক লাখেরও বেশি। এখন চ্যানেলটিতে আছে ১ লাখ ৪০ হাজার সাবস্ক্রাইবার। অর্থ্যাৎ, তিন মাসে তাদের সাবস্ক্রাইবার বেড়েছে চারগুণ।
চ্যানেলটি থেকে পিরোজপুরের যে মাদ্রাসাটির প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়েছিল, সেই মাদ্রাসাটির পরিচালক নাজমুল হুদা গাজীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান যে, চ্যানেলটি তিনিই খুলেছিলেন। তিনিই সেখানে ভিডিও আপলোড করতেন। কিন্তু একটা সময় তিনি চ্যানেলটি অন্য আরেক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেন। এই চ্যানেল থেকে রাজনৈতিক অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে জেনে তিনি দুঃখও প্রকাশ করেন।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে ফেসবুক পেজ, গ্রুপ বা ইউটিউব চ্যানেলের মালিকানা বদলের চর্চা দেখা যায়। যেখানে অর্থের বিনিময়ে কোনো ইউটিউব চ্যানেল বা ফেসবুক পেজের ইমেইল বা আইডি ও পাসওয়ার্ড হস্তান্তর করা হয়। এ রকম কেনাবেচার বেশ কিছু ফেসবুক গ্রুপও (১, ২, ৩, ৪, ৫) খুঁজে পাওয়া যায়।
ভিডিওগুলোতে কী থাকে
তিনটি চ্যানেলেই রাজনৈতিক অপতথ্য সম্বলিত ভিডিও আপলোড করা শুরু হয়েছে ২০২৩ সালে, অর্থাৎ বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের বছর থেকে। প্রতিটি চ্যানেলে ভিডিও-র একটি প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল নির্বাচন। ২০২৩ সালজুড়ে বাংলাদেশের কয়েকটি বিরোধী রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে আন্দোলন করেছিল। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারও ছিল এসব চ্যানেলের ভিডিওগুলোর অন্যতম প্রধান বিষয়।
প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন বা মন্ত্রীসভার সদস্যদের পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন, সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, বিরোধীদল রাজপথ বা সচিবালয় দখল করে নিয়েছে– এ ধরনের মিথ্যা তথ্য দেখতে পাওয়া যায় ভিডিওগুলোর শিরোনাম ও থাম্বনেইলে।
যেমন, তাজা নিউজ নামের চ্যানেলটি থেকে আপলোড হওয়া “সংসদে ওবায়দুল কাদেরকে পি*টা*লো জিএম কাদের, সংসদ অবৈধ ঘোষণা করলো জাতীয় পার্টি | BD politics news” শিরোনামের একটি ভিডিওর থাম্বনেইলে দাবি করা হচ্ছে একজন সরকার দলীয় সংসদ সদস্যকে পিটিয়েছেন একজন বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদ বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভিডিওর শুরুতেই বলা হচ্ছে সংসদের ভেতরে ক্ষমতাসীন জোট ও বিরোধীদলীয় নেতারা মারামারি করেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রচারিত সংবাদের খণ্ডাংশকে এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যেন শুনে মনে হবে সংসদে মারামারির ঘটনাটি বাংলাদেশের। কিন্তু মূল সংবাদটি হলো মালদ্বীপের সংসদে মারামারির ঘটনা নিয়ে। এরপর সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ওয়াক আউট করা সংক্রান্ত একটি সংবাদের খণ্ডাংশ দেখা যায়। কিন্তু এই ক্ষেত্রেও মূল সংবাদটি হলো সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ ইস্যুতে জাতীয় পার্টির সাংসদদের ওয়াক আউট করার হুমকি সংক্রান্ত পুরানো খবরের, যার সাথে মূল শিরোনামের কোনো সম্পর্ক নেই। এরপর অন্য আরেকটি বিরোধী দল বিএনপির নেত্রী পাপিয়ার একটি রাজনৈতিক বক্তৃতার খণ্ডাংশ দিয়ে ২ মিনিট ২০ সেকেন্ডের ভিডিওটি শেষ হয়। পুরো ভিডিওর কোথাও সরকারদলীয় নেতা ওবায়দুল কাদের বা বিরোধী দলীয় নেতা জি. এম. কাদেরকে দেখাও যায়নি বা তাদের মধ্যে কোনো প্রকার মারামারির সংবাদও দেয়া হয়নি। অথচ এই ভিডিওটি এখন পর্যন্ত তাজা নিউজের সবচেয়ে বেশি ভিউ হওয়া ভিডিও।
একইভাবে অন্যান্য ভিডিওতে দেখানো হয় পুরোনো অনেক সংবাদ ও ঘটনার ফুটেজ। এমন অনেক ফুটেজ একসঙ্গে যুক্ত করে তৈরি করা এসব ভিডিওর সঙ্গে শিরোনাম বা থাম্বনেইলের কোনো সংযোগ থাকে না। অর্থাৎ, থাম্বনেইলে বা শিরোনামে যা বলা হয়, তেমন কোনো তথ্য ভিডিওতে দেওয়া হয় না।
ইউটিউবের কমিউনিটি গাইডলাইনের থাম্বনেইল পলিসিতে বলা হয়েছে, ভিডিওর থাম্বনেইলে এমন কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। থাম্বনেইলে যে বিষয়টির কথা বলা আছে, সেটি দেখে দর্শক যদি ভিডিওতে ক্লিক করেন এবং সেই সংক্রান্ত তথ্য আর দেখতে না পান—তাহলে সেটি ইউটিউবের নীতিমালা ভঙ্গ করবে।
কিন্তু দেখা যায়, রাজনৈতিক অপতথ্য ছড়ানো তিনটি চ্যানেলই তাদের ভিডিওতে বিভ্রান্তিকর থাম্বনেইল ব্যবহার করছে। সেখানে এমন তথ্যের উল্লেখ আছে, যা সত্য নয় এবং ভিডিওতে তেমন কোনো তথ্য উপস্থাপনও করা হচ্ছে না। তারপরও সেসব ভিডিও ইউটিউবে টিকে আছে এবং মনিটাইজেশনের মাধ্যমে মুনাফা করছে, যেগুলো থেকে প্রশ্ন উঠছে ইউটিউবের কনটেন্ট মডারেশনের মান নিয়েও।
চ্যানেলের আয় সংক্রান্ত তথ্যে অস্বচ্ছতা
কোন চ্যানেলগুলো ইউটিউবে আয় করছে আর কোনগুলো করছে না– সেই তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রেও অস্বচ্ছ ইউটিউব। ২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বরের আগে চ্যানেলের মনিটাইজেশন সংক্রান্ত তথ্য সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। চ্যানেলটির সোর্স কোর্ডে গিয়ে দেখা যেত যে, “is_monetization_enabled” কোডটির পাশে True লেখা আছে নাকি False। এর মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে জানা যেত যে চ্যানেলটি মনিটাইজেশনের মাধ্যমে আয় করছে কিনা। কিন্তু ২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বরের পর থেকে ইউটিউব এই তথ্যটি আর উন্মুক্ত করে না।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া ম্যাটার্স ফর আমেরিকার মুখপাত্র এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “শুধু মিডিয়া ম্যাটার্সের জন্য নয়, এভাবে স্বচ্ছতা কমিয়ে ফেলা সামগ্রিকভাবে মনিটাইজেশন সংক্রান্ত গবেষণার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এটা হতাশাজনক যে আমাদের নতুন নতুন পদ্ধতির খোঁজ করতে হচ্ছে।” এমনই এক বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা চ্যানেলগুলোর মনিটাইজেশন সংক্রান্ত তথ্য জানার জন্য। চ্যানেলগুলোর ভিডিওতে বিজ্ঞাপন দেখানো হয় কিনা– তা যাচাই করা হয়েছে ওয়াইটিলার্জ ইউটিউব মনিটাইজেশন চেকার টুল দিয়ে। টুলটি ভিডিও-র সোর্স কোডে খোঁজ করে “yt_ad”, “value”: “1” আছে কিনা। এটি থাকার অর্থ, ভিডিওটিতে বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। এই টুলটি তিনটি চ্যানেলকেই মনিটাইজড হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ইউটিউব পার্টনারশিপ প্রোগ্রামের আওতায় চ্যানেলটি আয় করে নাকি শুধু ইউটিউব একাই আয় করে– তা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই।
ডিসমিসল্যাব আলাদাভাবে প্রতিটি চ্যানেলের রাজনৈতিক ভুলতথ্য ছড়ানো এবং সর্বোচ্চ ভিউ পাওয়া তিনটি করে ভিডিওর পেজ সোর্সে অনুসন্ধান করে দেখেছে যে সেখানে “yt_ad”, “value”: “1” এর অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। অর্থাৎ চ্যানেলগুলোর মালিক এবং ইউটিউব, উভয়েই অথবা ইউটিউব একাই এই ভিডিওগুলোর মাধ্যমে আয় করছে।
সবাই শিখি চ্যানেলের চিপ ফেক ভিডিওগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ভিউ পাওয়া তিনটি মূলত রাজনৈতিক, যেগুলোর শিরোনাম হলো “পদত্যাগের ঘোষণায়, রাতেই জরুরী ভিওিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুমতি দিলো রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন চুপ্পু”, “তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল অনুমোদন দিলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, ক্ষিপ্ত আ.লীগ | তত্ত্বাবধায়ক সরকার” এবং “বিএনপির পক্ষ নিলো সেনাবাহিনী, মুহূর্তেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার জারি, ভয়ে শেখ হাসিনা Caretaker Government”। এই ভিডিওগুলোর প্রত্যেকটির ভিউ সংখ্যা ৯ লক্ষেরও বেশি ছিল।
তাজা নিউজের সর্বোচ্চ ভিউ পাওয়া তিনটি ভিডিও শিরোনাম হলো “সংসদে ওবায়দুল কাদেরকে পি*টা*লো জিএম কাদের, সংসদ অবৈধ ঘোষণা করলো জাতীয় পার্টি | BD politics news”, “তুরস্ক থেকে ফিরেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ঘোষণা দিলো নতুন রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন চুপ্পু | BD Politics” এবং “৭ দিনের মধ্যে পদত্যাগের নির্দেশ দিলো জাতিসংঘের প্রধান অ্যান্তোনিও গুতেরেস | Caretaker Government”। এই ভিডিওগুলোর প্রত্যেকটির ভিউ সংখ্যা ৭ লক্ষেরও বেশি।
মিডিয়া সেল ২৪-এর তিনটি সর্বোচ্চ ভিউ কাউন্ট হয়েছে এমন রাজনৈতিক অপতথ্যমূলক ভিডিওর শিরোনামগুলো হলো “সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হচ্ছে সিইসি দেশে আসছে তারেক জিয়া নিরাপত্তা দিবে সেনাবাহিনী। bd news”, “মুক্তি পাচ্ছে মির্জা ফখরুল আজ থেকে সারাদেশে সেনাবাহিনী মোতায়ন তফসিল বাতিল।” এবং “নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিতে যোগ দিল জাতীয় পার্টি গ্রেফতার চুন্নু ও জিএম কাদেরI”। অন্যান্য সস্তা অপতথ্যমূলক ভিডিওগুলোর ক্ষেত্রেও একই ধরনের শিরোনাম দেখা যায়।
মনিটাইজেশনের বিষয়টি আরো নিশ্চিত হতে ইজ দিজ চ্যানেল মনিটাইজড নামের আরেকটি ইউটিউব রেভিনিউ বিশ্লেষণ সাইটের মাধ্যমে চ্যানেলগুলোকে পরীক্ষা করে দেখা হয়। এই সাইটটিও দেখায় যে কেস স্টাডির তিনটি ইউটিউব চ্যানেলই সম্ভবত মনিটাইজেশনের আওতায় পড়ে, কারণ প্রত্যেক চ্যানেলেরই অন্তত তিনটি ভিডিও পাওয়া যায় যেগুলোতে বিজ্ঞাপন চলেছে।
গবেষণা পদ্ধতি
এই কেস স্টাডির জন্য বাংলাদেশের ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থাগুলোর ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের আওতায় আসা সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে এমন তিনটি চ্যানেলকে বেছে নেওয়া হয়েছে। এই তিনটি চ্যানেল নির্ধারণের ক্ষেত্রে আরেকটি বিবেচ্য বিষয় ছিল চ্যানেলের কনটেন্টের ধরন পরিবর্তন। অর্থাৎ, চ্যানেলগুলোর শুরু এক ধরনের কনটেন্ট দিয়ে হলেও, পরবর্তীতে তারা রাজনৈতিক অপতথ্যমূলক ভিডিও আপলোড করেছে।
রাজনৈতিক অপতথ্যমূলক ভিডিও আপলোডের আগে ও পরে চ্যানেলের সামগ্রিক পরিবর্তন বিশ্লেষণ করার জন্য এমডব্লিউ মেটাডাটার মাধ্যমে চ্যানেলগুলোর সব ভিডিওর শিরোনাম, আপলোডের তারিখ, লাইক, কমেন্ট, ভিউ ও ট্যাগ সংক্রান্ত ডেটা সংগ্রহ করা হয়েছে এবং সেগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ইউটিউব চ্যানেলগুলোর ভিডিও থেকে চ্যানেল আয় করছে কিনা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ব্যবহার করা হয়েছে দুইটি টুল: ওয়াইটিলার্জ এবং ইজ দিজ চ্যানেল মনিটাইজড। দুটি টুলই চ্যানেলের ভিডিও পেজের সোর্স কোডে গিয়ে “yt_ad”, “value”: “1” আছে কিনা চেক করে। তাদের মতে, যদি সোর্স কোডটির অস্তিত্ব থাকে, তবে চ্যানেলের ভিডিওতে বিজ্ঞাপন চালানো হয়েছে।