ফাতেমা তাবাসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্র উদ্ধারের দাবিতে ছয় মাস পুরোনো ভিডিও প্রচার

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্র উদ্ধারের দাবিতে ছয় মাস পুরোনো ভিডিও প্রচার

ফাতেমা তাবাসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে সারিবদ্ধভাবে সাজানো বিপুল পরিমাণ অস্ত্র। ভিডিওটি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দাবি উঠতে দেখা গেছে—কেউ এটিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে ছাত্রশিবিরের সভাপতির কক্ষ থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের দৃশ্য দাবি করছে, আবার কেউ বলছে এগুলো ছাত্রদলের সভাপতির কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তবে যাচাইয়ে দেখা যায়, দাবিগুলো ভিত্তিহীন। ভিডিওটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল বা ছাত্রশিবিরের কোনো সদস্যের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধারের নয়, বরং এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ঘটনার দৃশ্য। ভিডিওটি ছয় মাস আগের। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী থানায় লুট হওয়া অস্ত্র সেনাবাহিনীর মাধ্যমে পুলিশের কাছে হস্তান্তরের দৃশ্য এটি।

সম্প্রতি একাধিক ফেসবুক ব্যবহারকারীকে (, , ) একটি ভিডিও শেয়ার করতে দেখা গেছে, যেখানে সারিবদ্ধভাবে সাজানো বিপুল পরিমাণ অস্ত্র প্রদর্শন করা হচ্ছে। কয়েকজন ব্যবহারকারী (, , ) দাবি করেছেন, এটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব আবদুল লতিফ হলের শিবিরের সভাপতির রুম থেকে সেনাবাহিনী কর্তৃক উদ্ধারকৃত পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র। এক ব্যবহারকারী একই দাবি করে অভিযোগ করেন, এই ধরনের ঘটনাগুলো দেশের মধ্যে লুটপাট, ডাকাতি ও মব জাস্টিসের বৃদ্ধি ঘটিয়েছে, এবং দাবি করেন যে ছাত্রশিবির এইভাবে বাংলাদেশের মধ্যে জঙ্গিবাদের উত্থান করতে চাচ্ছে। অন্যদিকে, আরেক ব্যবহারকারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে “শিবিরের দুর্গ” হিসেবে আখ্যায়িত করে লিখেছেন, “শিবিরের মদদদাতা হিসেবে ইন্টেরিমেরও বিশাল হাত আছে।”

এছাড়া, “আমার দেশ” নামের একটি ফেসবুক প্রোফাইল থেকেও একই ভিডিওটি “আবদুল লতিফ হলের ছাত্রদলের সভাপতির রুম থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্র” দাবিতে প্রচার করা হয়।

এছাড়া, একটি দৈনিক পত্রিকার নাম নকল করে আমার দেশ (Amar Desh) নামে পরিচালিত একটি ফেসবুক প্রোফাইল থেকেও একই ভিডিও “আবদুল লতিফ হলের ছাত্রদলের সভাপতির রুম থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্র” দাবিতে প্রচার করা হয়।

এক মিনিট তিন সেকেন্ডের ভিডিও বিশ্লেষণে দেখা যায়, একটি সাদা কাপড় বিছানো টেবিলের ওপর বিপুল সংখ্যক রাইফেল এবং শটগান সারিবদ্ধভাবে রাখা রয়েছে। ভিডিওটির ১১ সেকেন্ড পর থেকে দেখা যায়, সবুজ কাপড় বিছানো আরও একটি টেবিলের ওপর পিস্তল, হ্যান্ডকাফ, ওয়াকিটকি এবং একটি সাদা আয়তাকার বাক্স রাখা। টেবিলগুলো ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং সাধারণ পোশাকে একাধিক ব্যক্তি। ভিডিওতে শোনা যায়, সবাইকে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে অস্ত্রগুলো স্পর্শ না করতে।

ডিসমিসল্যাব ভিডিওটির কী-ফ্রেম ধরে রিভার্স ইমেজ অনুসন্ধান চালানোর পর, ছয় মাস আগের একই ভিডিও ইন্টারনেটে খুঁজে পায়। গত বছরের ১৮ আগস্ট, ‘টপ নিউজ’ নামে একটি ফেসবুক প্রোফাইল থেকে ‘টপ নিউজ’ লোগো ব্যবহার করে ভিডিওটি শেয়ার করা হয়েছিল। পোস্টের ক্যাপশনে লেখা ছিল, “মুন্সিগঞ্জ টঙ্গীবাড়ী থানার লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত হস্তান্তর” (বানান অপরিবর্তিত)। এই তথ্যই প্রমাণ করে, ভিডিওটি সাম্প্রতিক কোনো ঘটনার নয়, বরং ছয় মাসের বেশি পুরোনো একটি ঘটনার, যা বর্তমান সময়ে এসে ভিন্ন প্রসঙ্গে উপস্থাপন করা হচ্ছে।

ঘটনার বিবরণ ধরে কি-ওয়ার্ড সার্চে ‘নিউজ৭১টিভি মুন্সীগঞ্জ’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ২৩ আগস্ট প্রকাশিত একই ঘটনার একটি ভিডিও প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। ভিডিওটির সাত সেকেন্ডের পর থেকে ভাইরাল ভিডিওতে দৃশ্যমান সাদা ও সবুজ কাপড়ের টেবিল এবং টেবিলে রাখা অস্ত্র, হ্যান্ডকাফ, ও সাদা আয়তাকার বাক্সসহ ওয়াকিটকি– স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। ভিডিওর শিরোনাম ও বিবরণিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী থানা থেকে সেদিনের পূর্বে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তা আনুষ্ঠানিকভাবে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছিল। এটি ছিল মূলত সেই ঘটনার একটি ভিডিও।

এছাড়াও গুগলে কিওয়ার্ড সার্চে এই ঘটনা নিয়ে কালের কণ্ঠ, ডেইলি পোস্ট, ও চ্যানেল ২৪ সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সাবেক সরকার প্রধান শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ও দেশ ত্যাগের পর, ৫ আগস্ট মুন্সীগঞ্জ সদর থানা, পুলিশ ফাঁড়ি ও টঙ্গিবাড়ী থানা লুট করে দুর্বৃত্তরা। সেনাবাহিনীর অভিযানে লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা সম্ভব হয়। বিশেষ করে মুন্সীগঞ্জ সদর ও টঙ্গিবাড়ী থানার অস্ত্রের বড় অংশ উদ্ধার করে সেনাবাহিনী, যা পরবর্তীতে পুলিশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়। ১৮ আগস্ট মুন্সীগঞ্জ সার্কিট হাউসে সদর আর্মি ক্যাম্পে নির্বাহী সকলের উপস্থিতিতে এই লুণ্ঠিত অস্ত্র হস্তান্তর করা হয়।

এছাড়াও ‘দৈনিক আমার দেশ’ তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে শেয়ার করা স্ক্রিনশটে জানিয়েছে যে, আমার দেশ (Amar Desh) নামক প্রোফাইল ও তাদের শেয়ারকৃত ভাইরাল ভিডিওটির সাথে পত্রিকাটির কোনো সম্পর্ক নেই।

আরো কিছু লেখা