ফাতেমা তাবাসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব
অ্যাক্টিভিস্ট ও মডেল ফারজানা সিঁথির নামে ভুয়া প্রোফাইল, ছড়ানো হচ্ছে ডিপফেক ভিডিও

অ্যাক্টিভিস্ট ও মডেল ফারজানা সিঁথির নামে ভুয়া প্রোফাইল, ছড়ানো হচ্ছে ডিপফেক ভিডিও

ফাতেমা তাবাসুম

ফেলো, ডিসমিসল্যাব

সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় অ্যাক্টিভিস্ট ও মডেল ফারজানা সিঁথির দুটি ভিডিও (, ) ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। ফেসবুকে তারই নাম ও পরিচয়ে পরিচালিত একটি প্রোফাইল থেকে এই ভিডিওগুলো ছড়িয়ে পড়েছে। ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভিডিওগুলো কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে বানানো ডিপফেক ভিডিও। যাচাইয়ে আরও দেখা যায়, সিঁথির নাম-পরিচয়ে খোলা একটি ভুয়া প্রোফাইল থেকে এগুলো শেয়ার করা হয়েছে, যা ২০২৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে সক্রিয়। “প্রফেশনাল” ক্যাটাগরির এই প্রোফাইলটি নিয়মিতভাবে এধরনের ভিডিও প্রকাশ করে আসছে, যেখানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির চেহারা সম্পাদনা করতে ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। সম্পাদিত ভিডিওগুলো ব্যাপকভাবে শেয়ার হওয়ার পাশাপাশি লাখ লাখ ভিউ পাচ্ছে, যা শুধু একজন নারী অ্যাক্টিভিস্টকে টার্গেট করে সাইবার হয়রানিই নয়, একইসঙ্গে ফেসবুকের নীতিমালারও লঙ্ঘন। 

আলোচনায় আসা ‘ফারজানা সিঁথি’ নামের প্রোফাইল থেকে চলতি বছরের ৬ মার্চ ফেসবুকে দুটি রিল শেয়ার করা হয়। প্রথম রিলে তাকে কালো রঙয়ের পোশাকে নাচতে দেখা যায়। এটি লাখের বেশি ভিউ ও দেড় হাজারের বেশি প্রতিক্রিয়া পায়। আর অন্য রিলে এই মডেলকে কমলা রঙের শাড়িতে দেখা যায়। রিলটি এখন পর্যন্ত এই প্রোফাইলের সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও। প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত রিলটি দেখা হয়েছে ২০ লাখেরও বেশিবার, প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রায় ১৫ হাজার ব্যবহারকারী। এছাড়া রিলটি শেয়ার করেছেন একশোরও বেশি ব্যবহারকারী। দেখা গেছে, দুটো রিলেই মন্তব্যের ঘরে কুরুচিপূর্ণ ও উস্কানিমূলক লেখার ছড়াছড়ি।

রিল দুটির কি-ফ্রেম ধরে রিভার্স ইমেজ সার্চে দেখা যায়, দুটি ভিডিও ক্লিপেরই আসল উৎস আলাদা দুজন ভারতীয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর, ফারজানা সিঁথি নন। প্রথম রিলটি পাওয়া যায় ভারতীয় অভিনেত্রী ও কনটেন্ট ক্রিয়েটর তানিয়া দেসাইয়ের ইন্সটাগ্রাম হ্যান্ডেলে। চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি ভিডিওটি প্রথম তিনিই শেয়ার করেন। অন্যদিকে দুই মিলিয়নের বেশি ভিউ পাওয়া পরের রিলটি ৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম পোস্ট করেছিল আরেক ভারতীয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর ‘পূজা মল্লিক’ তার ইন্সটাগ্রাম হ্যান্ডেলে। এ থেকে স্পষ্ট হয় রিল দুটিতে দেখতে পাওয়া নারী আসলে সিঁথি নন, বরং ভারতীয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর তানিয়া ও পূজা। এআই প্রযুক্তির সহায়তায় তানিয়া ও পূজার চেহারা পরিবর্তন করে ফারজানা সিঁথির চেহারা বসিয়ে বিভ্রান্তিকরভাবে আলোচ্য ফেসবুক প্রোফাইলে শেয়ার করা হয়েছে।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রোফাইলটি মডেল ও অ্যাক্টিভিস্ট ফারজানা সিঁথির নামপরিচয়ে পরিচালিত হচ্ছে। সেখান থেকে নিয়মিতভাবে তার একাধিক রিল (, , , , ) ও ভিডিও (, , ) গত চার মাসের বেশি সময় ধরে শেয়ার করা হচ্ছে। প্রোফাইলে ব্যবহার করা ছবিটি ফারজানা সিঁথির চেহারার আদলে বানানো ডিপফেক ছবি। ২০২৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর, অর্থাৎ পরিচালনা শুরুর সময় প্রোফাইলের ছবিতে ফারজানা সিঁথির ছবি ব্যবহার করে লেখা হয়, তিনি একজন পেশাদার মডেল এবং এই প্রোফাইলটি তার নিজস্ব। যদিও দাবিটি মিথ্যা। এ বিষয়ে ফারজানা সিঁথির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিজেই তার ভেরিফায়েড প্রোফাইলটি শেয়ার করেন।

২০২৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর অর্থাৎ প্রোফাইলটি পরিচালনা শুরুর সময় থেকে ২০২৫ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত মোট ১৫১টি রিল-ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে, যার ১৪৯টিই তৈরি করা হয়েছে ফারজানা সিঁথিকে কেন্দ্র করে।

২০২৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত এই প্রোফাইল থেকে মোট ১৫১টি রিল-ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪৯টিই তৈরি করা হয়েছে সিঁথিকে কেন্দ্র করে। ১৭ মার্চ পর্যন্ত শেয়ার হওয়া শেষ ২০টি রিল যাচাই করলে দেখা যায়, এর মধ্যে ১০টি রিলই এআই দিয়ে তৈরি। ডিপফেক শনাক্তে রিলগুলো ফ্রেম-বাই-ফ্রেম বিশ্লেষণে করা হলে সেখানে অসঙ্গতি ধরা পড়ে। কিছু ফ্রেমে মুখাবয়ব বিকৃত হতে দেখা যায়; কিছুতে গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলাতে গেলে সেখানেও অসামঞ্জস্যতা নজরে আসে। গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর থেকে প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের রিল শেয়ার করছে প্রোফাইলটি। সবচেয়ে বেশি দেখা পাঁচটি ভিডিও (, , , , ) যাচাই করে দেখা গেছে, ভাইরাল এই রিলগুলো সিঁথিকে নিয়ে তৈরি ডিপফেক কনটেন্ট। এখন পর্যন্ত ৪১ লাখেরও বেশিবার দেখা হয়েছে সেগুলো। প্রোফাইল ট্র্যান্সপারেন্সির তথ্য অনুযায়ী, এটি পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে।

আলোচিত প্রোফাইল থেকে সিঁথির চেহারা সম্পাদনা করে তৈরি প্রতিটি ডিপফেক ভিডিও মনিটাইজ করা হয়েছে। এমনকি কিছু কিছু ভিডিও ক্লিপের ওপর নির্মাতা নিজেই  “গিভ মি স্টার” বা “স্টার গিভ মি” লিখে পোস্ট করছেন। আবার সরাসরি স্টার চেয়ে কিছু রিলভিডিও পোস্ট করা হয়েছে, যা থেকে মনিটাইজেশনের বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়।

ফেসবুকের নিজস্ব তথ্য অনুযায়ী, রিলসে “ফেসবুক স্টার” হলো এমন একটি ফিচার, যা কনটেন্ট নির্মাতাদের ভিডিও এবং অডিও কনটেন্ট মনিটাইজ করতে সহায়তা করে। দর্শকরা চাইলে “স্টারস” কিনে তা রিল ভিডিওর মাধ্যমে নির্মাতাকে পাঠিয়ে তাদের সমর্থন জানাতে পারেন। প্রতিটি “স্টার”-এর জন্য ফেসবুক নির্মাতাকে ০.০১ মার্কিন ডলার পরিশোধ করে। র্অথাৎ, কোনো কনটেন্ট ১০,০০০ “স্টার” পেলে এর নির্মাতা ফেসবুক থেকে ১০০ ডলার পাবেন।

এই প্রোফাইল থেকে সিঁথির চেহারা সম্পাদনা করে তৈরি প্রতিটি ডিপফেক ভিডিও মনিটাইজ করা হয়েছে।

ডিপফেক বলতে মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে বানানো ফেক ভিডিওকে বোঝায়, যা বাস্তব ঘটনার ভিডিও বা কথোপকথনকে সম্পাদিত করে বানানো হয়। এ প্রযুক্তির প্রথম প্রকাশ ঘটে ২০১৭ সালে, সামাজিক মাধ্যম রেডিটে। এরপর থেকে এই প্রযুক্তির ব্যবহার প্রতিশোধমূলক পর্ন বা মিথ্যা তথ্য প্রচারের মত অনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা গেছে। বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড্যানিয়েল সিট্রন গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলেন, “ডিপফেক প্রযুক্তি নারীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।”

সিঁথি ঢাকার একটি সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী, যিনি ২০২৪ সালের কোটা আন্দোলন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। সামাজিক মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন কারণে বারবার আলোচনায় এসেছেন তিনি। পড়ালেখার পাশাপাশি করেন মডেলিংও। এ বিষয়ে সিঁথির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডিসমিসল্যাবকে জানান, বাস্তব জীবনে এই ডিপফেক ভিডিও ও ফেক প্রোফাইলগুলো নিয়ে ভয়াবহ সমস্যায় পড়েছেন। সিঁথি বলেন এই ভিডিওগুলোতে তাকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। “এসব ভিডিওর মাধ্যমে আমার চরিত্র হননের চেষ্টা চলছে। আমি বিভিন্ন ধরনের বুলিং ও শেমিংয়ের শিকার হয়েছি। শুধু সামাজিক মাধ্যমেই না, আমার ব্যক্তি জীবনেও এর প্রভাব পড়েছে। আমি বা আমার পরিবারের কেউ বাড়ির বাইরে গেলেই সবাই তাদের এসব নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন করতে থাকে। আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। আমি এখন বিরক্ত।”

সিঁথি জানান ডিপফেক ভিডিও ও ফেক প্রোফাইলগুলোর বন্ধ করতে তিনি নানা পদক্ষেপ নিলেও কার্যত কোনো ফল হয়নি। এমনকি একাধিকবার ফেসবুকে আইডিগুলো বন্ধ করার বিষয়ে অভিযোগ করেও ব্যর্থ হয়েছেন। “আমি থার্ড পার্টি আইটি এক্সপার্টের সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু তারা সবগুলো ফেক আইডি আর ফেক ভিডিওগুলো রিমুভ করার বিনিময়ে আমার কাছে ১০০ থেকে ১৫০ ডলার দাবি করেন, যা আমার সামর্থ্যের বাইরে। তাই আর এগোতে পারিনি,” জানান সিঁথি।

ফেসবুকের নীতিমালা লঙ্ঘন

ফারজানা সিঁথির নাম ও পরিচয় ব্যবহারে তৈরি এই ভুয়া অ্যাকাউন্টটি পরিচালিত হচ্ছে ফেসবুকের নীতিমালা লঙ্ঘন করে। তিনি ডিসমিসল্যাবকে জানান তার ব্যক্তিগত প্রোফাইল একটি, এর বাইরে বাকি কোনটিই তার নয়। ফেসবুকের অনুকরণ সংক্রান্ত নীতিমালায় বলা হয়েছে, “প্রোফাইলে আপনি এমন কারো নাম ও ছবি ব্যবহার করতে পারবেন না, যা দেখে অন্যরা বিশ্বাস করে বিভ্রান্ত হয় যে, সেটি সত্যিই কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির প্রতিনিধিত্ব করে।”

অথচ এই ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা রিলগুলোর মন্তব্য অংশ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় আসলেও অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী রিলগুলো সিঁথির নিজের নাচের ভিডিও ভেবে বিভ্রান্ত হয়েছেন। বেশকিছু ব্যবহারকারীকে কুরুচিপূর্ণ ও উস্কানিমূলক মন্তব্য করতে দেখা গেছে। এক ব্যবহারকারী একটি রিলের নীচে লেখেন— “হায়রে ধর্ষক, তোরা দেখিস না এগুলো, শুধু ৬ বছরের আর ৮ বছরের শিশুগুলোই দেখিস।” আরেক জন লেখেন– “…তোর যে অবস্থা তোকে প্রতিনিয়ত ৫০ টা ছেলেকে দিয়ে ধর্ষণ করানো উচিৎ।” 

সিঁথির নামে পরিচালিত এই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট মেটার ম্যানিপুলেটেড মিডিয়া সংক্রান্ত নীতিমালাও লঙ্ঘন করছে। যেখানে বলা হয়েছে, “এমন ভিডিও পোস্ট করা যাবে না যেটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি, যেখানে বিভিন্ন কন্টেন্ট একসঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় বা কোনো ভিডিওর ওপর অন্য কোনো কন্টেন্ট মিশিয়ে দেওয়া হয়, যা দেখে ভিডিওটি আসল বলে মনে হয়।” আলোচ্য ফেসবুক অ্যাকাউন্টের ভিডিওগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন ভিডিওর মুখ বদলে সেখানে সিঁথির মুখ জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত ১১ মার্চ ধর্ষণের হুমকি পেয়ে খালেদ মাহমুদ হৃদয় খান নামের এক কনটেন্ট ক্রিয়েটরের বিরুদ্ধে ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন সিঁথি। এ ঘটনায় সিঁথি সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, ২৭ ফেব্রুয়ারি হৃদয় ফেসবুক লাইভে এসে তার জীবনযাপন, চলাফেরা, পোশাক-আশাক নিয়ে নোংরাভাবে কথা বলেন এবং ধর্ষণের হুমকি দেন।

এছাড়াও গত নভেম্বরে তীব্র সাইবার হয়রানির মুখে গণমাধ্যমের দ্বারস্থ হয়েছিলেন ফারজানা সিঁথি। সেসময় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারকে তিনি জানিয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিভ্রান্তিকর প্রচার চালানো হচ্ছে, যেখানে তার ভিডিও ক্লিপ কাটছাঁট করে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ফেসবুকে তিনি তার নামে পরিচালিত ১১৭টি ভুয়া অ্যাকাউন্টের ব্যাপারেও জানান, এই প্রোফাইলগুলোতে তার ছবি, তথ্য ও ডিপফেক ভিডিও তৈরি করে ছড়ানোর কারণে তিনি প্রতিনিয়ত সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন, যেখানে আক্রমণের বড় অংশই তার চরিত্র, পোশাক ও অ্যাক্টিভিজম।

আরো কিছু লেখা