তৌহিদুল ইসলাম রাসো
তামারা ইয়াসমীন তমা

বিএনপি কর্মী-সমর্থকদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে সংঘবদ্ধ আক্রমণের অভিযোগ
তামারা ইয়াসমীন তমা
তৌহিদুল ইসলাম রাসো
গতকাল ৩১ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপির নেতা, কর্মী ও দলটির সমর্থক রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিজেবল বা অচল করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। শতাধিক অ্যাকাউন্ট এর শিকার হয়েছে বলে দলটির কর্মীরা বিভিন্ন পোস্টে দাবি করেছেন। আর এই ধরনের ঘটনাকে তারা মত প্রকাশের স্বাধীনতার চরম লঙ্ঘন বলে ডিসমিসল্যাবকে জানিয়েছেন।
গত ৩১ অক্টোবর থেকে অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় হওয়া সংক্রান্ত বেশকিছু ফেসবুক পোস্ট ডিসমিসল্যাবের নজরে আসে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের পোস্ট বাড়তে থাকে। একাধিক ব্যবহারকারী জানান বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী, বিএনপিপন্থী রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মধ্যে অনেকের আইডি ফেসবুকে পাওয়া যাচ্ছে না।
ডিসমিসল্যাব এরকম অন্তত পাঁচজনের আইডি যাচাই করে দেখতে পায় শনিবার (১ নভেম্বর) দুপুর ১২টা পর্যন্ত আইডিগুলো নিষ্ক্রিয় ছিল। যাদের আইডি এসময় নিষ্ক্রিয় পাওয়া গেছে, তারা হলেন- লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট ফাহাম আব্দুস সালাম, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মানসুরা আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবিদুল ইসলাম খান এবং অ্যাক্টিভিস্ট রাসেল হিমাদ্রির।

এর মধ্যে আবিদুল ইসলাম খানের অনুসারীর সংখ্যা আট লাখ ৭৯ হাজার, ফাহাম আব্দুস সালামের ফেসবুকে অনুসারীর সংখ্যা চার লাখ ৭১ হাজার, মাহদী আমিনের অনুসারীর সংখ্যা এক লাখ ৪৪ হাজার, মানসুরা আলমের অনুসারীর সংখ্যা ৭৩ হাজার এবং রাসেল হিমাদ্রীরের অনুসারী সংখ্যা ৩০ হাজার।
দুপুরের পরে একে একে অ্যাকাউন্টগুলো সচল হতে শুরু করে।
ফাহাম আব্দুস সালামের সহধর্মিনী ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কন্যা ড. শামারুহ্ মির্জা তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে অভিযোগ করেন- “গত পনেরো বছরেও যাদের আইডি ডিসএবেল করা যায় নি, গত কদিনে তাদের আইডি ডিসাবেল করা হয়েছে! এরা বেশির ভাগই হাসিনার বিরুদ্ধে লিখেছে তবু ডিসএবেল হয়নি! তাইলে গত কদিনে কারা করলো? আজকাল এই আইডি গুলোর লেখা কাদের ভাল লাগছে না? নতুন ফ্যানাটিসি[জ]ম এলো বটে !”

বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক শাফকাত রাব্বী অনিক তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে অভিযোগ করেন, “একাধিক পপুলার বিএনপি পন্থী লোকজনের ফেসবুক আইডি ডিজাবেল করা হয়েছে। ফাহাম ভাই, মাহদী আমিন সহ আরো অনেকে। এনারা এই মুহূর্তে ফেসবুকে নাই। এদের দুই জনেরই ভেরিফায়েড আইডি ছিল। কালকে রাত্রে ঢাকার অনেক গুলো আইএসপি সাইবার আক্রমণের শিকার হয়েছে। ডিডিওএস (DDOS) এটাক খেয়েছে। এর বাইরে অনেক হ্যাকার একটিভ হয়েছে। এআই দিয়ে নানা ধরনের ফেইক ভিডিও এবং ভোটারদেরকে আগামী ভোটের ব্যাপারে হতাশ করার মিশন শুরু হয়েছে।”

জাতীয়তাবাদী দলের আরেক সমর্থক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেন- “অলরেডি ২০০+ বিএনপি পন্থী এক্টিভিস্টদের আইডি ডিজেবল লাস্ট কয়েক ঘন্টায়।”
এদিকে রেড জুলাই-সাইবার ফোর্স নামের একটি পেজ থেকে সাইবার আক্রমণের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একাধিক সমর্থক ও অ্যাক্টিভিস্টদের আইডি নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার দাবি করা হয়। পেজটি সদ্য ৩১ অক্টোবর খোলা হয়। পেজটি থেকে আরও দাবি করা হয়, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশকৃত গণভোটে বিএনপির ”না”-সূচক ক্যাম্পেইন বা প্রচারণার জন্যই এই সাইবার আক্রমণ চালানো হয়েছে। পেজটিতে গণভোটে বিএনপি নেতাকর্মীদের হ্যাঁ ভোট দেওয়ার পক্ষে প্রচারণা চালানোর আল্টিমেটামও দেওয়া হয়, অন্যথায় নেতাকর্মী ও অ্যাটিভিস্টদের আইডি পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। তবে এর পেছনে কারা রয়েছেন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মানসুরা আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডিসমিসল্যাবকে বলেন, “আমার আইডি এ নিয়ে চারবার ডিজেবল হয়েছে। দুইবার পার্মানেন্টলি ডিজেবল হয়েছিল, তখন আন্তর্জাতিক একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একজন রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে ফেরত এনেছি। আর দুবার হয়েছে কিছু সময়ের জন্য। এবার আমার আইডিতে সমস্যা শুরু হয় ৩০ অক্টোবর দিবাগত রাত দুইটা থেকে আড়াইটার মধ্যে।”
তিনি আরও বলেন, “মেটা থেকে জানানো হয়েছে কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ না করার জন্য আইডি ডিজেবল হয়েছে। আমি আপিল করেছি, যে তথ্য চেয়েছিল সেটা দিয়েছি। আমাকে মেটা ২৪ ঘন্টা অপেক্ষা করতে বলেছে”।
কোনো ধরনের সাইবার হুমকির শিকার হয়েছেন কি না জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান, তেমন কোনো হুমকি পাননি। তবে, তিনি বলেন, “পরিচিত কয়েকজন জানিয়েছে যে আমাদের কিছু আইডি একটা গ্রুপে অ্যাড করা হয়েছে, এরপর সেখান থেকে আইডি ডিজেবল হয়ে যাচ্ছে। এরপর স্প্যাম ফোল্ডারে চেক করে দেখি একটা অপরিচিত গ্রুপে আমাকে অ্যাড করা হয়েছে। “
অনলাইনে সমন্বিতভাবে প্রতিপক্ষের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়ার কৌশল সাধারণ মেটার ইনঅথেনটিক বিহেভিয়ার নীতিমালার অধীনে পড়ে। মেটার কোয়ার্টারলি অ্যাডভার্সারিয়াল থ্রেট রিপোর্ট অনুসারে, এক্ষেত্রে আক্রমণকারীদের মূল লক্ষ্য থাকে, প্ল্যাটফর্মের নীতিমালা লঙ্ঘন না করেও, কোনো নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্ট বা কনটেন্টকে ভুলভাবে বা অন্যায়ভাবে নিষ্ক্রিয় করা। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো টার্গেট করা ব্যবহারকারীকে নীরব করে দেওয়া বা তার কণ্ঠ রোধ করা। এ ধরনের আক্রমণে সিস্টেম প্রায়ই মানুষের পর্যালোচনা ছাড়াই নীতিমালা ভঙ্গের অভিযোগে অ্যাকাউন্টগুলো নিষ্ক্রিয় করে দেয়, যা অনেকসময় গণতন্ত্রকে প্রভাবিত করার একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
মানসুরা আরও বলেন, “আমি অনেকদিন ধরে রাজনীতি করি, এবং মত প্রকাশের জন্যে অনেক সমস্যা হয়েছে কিন্তু এই ধরনের ঘটনা একেবারে নতুন। ফ্যাসিস্ট সময়েও মত প্রকাশের সময় আমার আইডিতে এরকম সমস্যা হয়নি। এটা মত প্রকাশের স্বাধীনতার চরম লঙ্ঘন।”
“আগে নিজের মত প্রকাশ করতে গেলে শারীরিক ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হতো, এখন হয়তো সেটা কেউ করতে পারছে না। এখন মত প্রকাশ করতে গেলে আইডিতে আক্রমণ করা হচ্ছে, আমার চিন্তা চেতনা রুদ্ধ করা হচ্ছে। নৈতিকভাবে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে”, জানান মানসুরা।